#তুমি_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা
#আফরোজা_আহমেদ_কুহু
#অন্তিম_পর্ব
আমাকে কথা বলতে না দেখে এবার আহির আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি হলো?বলছেন না কেন? আপনিই কি আফরাকে নিয়ে এসেছেন? সে আমাদের মেয়ে?কোথায় সে?
আমি শুধু হাত দিয়ে ইশারা করে আফরার কক্ষটি দেখিয়ে দিলাম। তারা দ্রুত রুমে প্রবেশ করলো।আমি আমার থেকে কিছুটা দূরে থাকা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। “আহির” সে আমায় চিনতে পারে নি। আমার শ্বাস কেমন যেন আঁটকে আঁটকে আসছিল। অস্থির অস্থির লাগছিল। অতীতটা আবারও সামনে এসে দাঁড়িয়ে। শেষে কি না আহিরের মেয়ের মাধ্যমে আবার দেখা হলো।কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলাম সেই পুরোনো স্মৃতির পাতায়। এরপর শ্রাবণের ডাকে আমি আমার ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসি।
শ্রাবণ আমার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললো,
–“কি হয়েছে মিহি?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ করছে? ”
আমি মাথা নেড়ে না বললাম। “আমি ঠিক আছি শ্রাবণ”।
–” তো এখনো ওষুধ কেন লাগাও নি? হসপিটালে আছো তাও একবার ডাক্তার দেখাবে না।কপালের রক্ত শুকিয়ে গেছে অলরেডি।” (কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে বললো)
আমি আমার কপালে হাত ছোঁয়ালাম। সত্যিই শুকিয়ে গেছে। এত কিছুর মাঝে ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমারও ব্যাথা লেগেছে। হঠাৎ আহির বেরিয়ে এলো সেই কক্ষ হতে। শ্রাবণ আহিরকে দেখে একবার আমার দিকে তো একবার আহিরের দিকে তাকাচ্ছে। আহির আমার সামনে এসে বললো,
–“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে মিহিতা। প্লিজ একটু এদিকে আসবে?শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য প্লিজ। ”
আমি আহিরের দিকে তাকালাম। তার মানে সে আমাকে চিনতে পেরেছে। তাহলে তখন বউ থাকায় নাটক করলো। আমি শ্রাবণের দিকে তাকালাম। সেও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে আমার উত্তর শোনার জন্য। আমি শ্রাবণকে আস্তে আস্তে বললাম,
–“যাবো?
–“যাও।”
শ্রাবণের বলা কথাটায় কেমন যেন রাগ ছিলো। সে উঠে চলে গেল। আমিও তার পিছু যেতে নিলেই আহির আটকালো।এরপর বললো,
–“আ’ম সরি মিহিতা। ”
–“কেন?”
–“আসলে আমি তখন বুঝতে পারি নি। তুমি আমাকে এতটা ভালোবেসে ফেলবে। বিশ্বাস কর, আমি বুঝতে পারি নি। ”
আমি হাসলাম। সব সংকোচবোধ একপাশে সরিয়ে আমি নিজেকে তার সামনে একজন শক্ত মানুষ হিসেবে তুলে ধরতে চাইলাম। এই সাত বছরে নিজেকে আমি তার থেকে অনেক দূরে নিয়ে এসেছি। আর চেষ্টা করলেও তা ফিরে আসবে না। আমার অনূভুতি গুলোকে আমি আমার মনের মধ্যে থাকা ডায়েরীটায় বন্দী করে ফেলেছি। দিন যাবে, এই ডায়রীতে ধুলো পড়বে। হয়তো একদিন খুলে দেখবো ডায়রীর পাতা গুলো হঠাৎ করেই। আবার সেই পুরোনো কথা গুলো মনে করে কষ্ট হবে কিছুক্ষণ। কিন্তু সময়ের সাথে পুনরায় এই ডায়েরী বন্ধ হয়ে যাবে। আবার হারিয়ে যাবে সময়ের স্রোতে। নতুন স্মৃতির ডায়রী গুলোর নিচে পড়ে যাবে তা।
–” মিহিতা, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি পরে সব আরাবির কাছ থেকে জেনেছিলাম। তুমি ওই শহর ছেড়ে আসার পর। হ্যাঁ, আমি মানছি আমি ভুল করেছিলাম। আমি ভাবতে পারি নি আমার এই ভালোলাগাটুকুর জন্য তুমি এতদিন অপেক্ষা করবে। তুমি প্লিজ নতুন করে তোমার জীবনটা শুরু করো মিহি।”
–“আমার নাম মিহি নয় মিহিতা। মিহি শুধু তারাই ডাকতে পারে যারা আমার আপন। তাছাড়া আপনাকে কে বললো মি.আহির আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হ্যাঁ,কিছু তিক্ত অনুভূতি তৈরি হয়েছিল আমার।কিন্তু সেই অনুভূতি গুলো শুধুই আমার। একান্তই আমার। আর তাছাড়া নতুন জীবন তো আমি কবেই শুরু করেছি। এই যে দেখছেন, রাগ করে চলে গেল। সে আমার হবু বর। কিছুদিন পরই বিয়ে। আপনার দাওয়াত রইলো। সবাই আসবেন কিন্তু। ”
কেন জানি না। আহিরের কথাগুলোতে মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এতকিছুর পরও সে এসেছে আবার কথা বলতে। সে কি একদমই কিছুই বোঝে নি। আচ্ছা বুঝলাম না হয় কিছুই বোঝে নি। তবে কেন রিলেশনে যাওয়ার পর ওই জন্মদিনের দিন এসেছিল কথা বলতে। কিছু মানুষ সত্যি হঠাৎ এসে সুন্দর সাজানো জীবনটাকে তছনছ করে দিয়ে বলে সে কিছুই জানতো না। মজা নিতে এসব করেছে শুধু।
হঠাৎ আফরার কন্ঠ শুনতে পেলাম। সে দৌড়ে এসে বললো,
–“পাপা আমরা বাড়ি যাবো কখন?”
–“এই তো এখনি যাবো। ”
মালিহা আমার কাছে এসে বললো,
–“আপু, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে তো আমরা জানতেও পারতাম না। আফরা কোথায় আছে।
আমি হেঁসে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। এখন কেন জানি না অনেকটাই শান্তি লাগছে। আজকে প্রথম ও শেষবারের মতো আহিরের সাথে আমি কথা বলেছি। আশা করি আর যেন দেখা না হয়। অবশ্য দেখা হলে তার প্রতি কোনো অনুভূতি আমার প্রকাশ হবে না।আজকে সত্যিই আমি সফল। সম্পূর্ণরুপে আহিরকে আমি নিজের জীবন থেকে দূরে করতে পেরেছি। নিচ তলায় এসে দেখলাম। শ্রাবণ দাঁড়িয়ে আছে উল্টো দিকে ঘুরে। সাদা শার্ট ইন করা আর কালো প্যান্ট। ফর্মাল গেট আপই আছে। আমি হেঁসে তাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলাম। শ্রাবণ চমকে গেল মনে হয়। আমার হাত ধরে সামনে নিয়ে এসে বললো,
–“তুমি আমাকে জরিয়ে ধরলে মিহি?”
–“কেন ধরতে পারি না। ”
–“তো আহির এখানে কি করছে মিহি?আর তুমি কি আমাদের বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাইছো কোনোভাবে?”
সে আশাহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আবারও হাসলাম। শ্রাবণ জানে না যে আহিরের বিয়ে হয়েছে। আমিই জানাই নি।আমি তো আর জানতাম না যে এভাবে আবার দেখা হবে। জানলে বলে দিতাম। আমি শ্রাবণকে বললাম,
–“মি.শ্রাবণ হাওলাদার। আহির এখানে তার মেয়ের জন্য এসেছে। আর বিয়ে ভাঙ্গার জন্য আপনাকে জরিয়ে ধরেছি নাকি? ”
শ্রাবণ ভ্রুর- কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললো,
–“আহিরের মেয়ে মানে?সে বিয়ে করেছে? ”
–“জ্বী মিস্টার। সবাই কি আর আপনার মতো নাকি যে আমার আশায় থাকবে?”
শ্রাবণ হেঁসে নিজের ঠোঁটের এক কণা কামড়ে ধরে বললো,
–“তুমি কি কাউকে আশায় থাকতে বলছো নাকি?আমি কিন্তু এসব কিচ্ছু এলাউ করবো না, মিসেস শ্রাবণ। ”
এমন সময় আহিররা নিচে নামলো। মালিহা আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“আপু তবে এবার আসি আমরা। ”
–“আচ্ছা। ”
আমরা একসাথে বের হলেও দুই রাস্তায় চলে গেলাম। সারাজীবনের মতো। সত্যিই কষ্টের পরই সুখ থাকে। আমি যদি আহিরকে না হারাতাম তবে তো আর শ্রাবণকে পেতাম না। শ্রাবণ আমাকে এক হাত দিয়ে জরিয়ে ধরলো। আমি ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলাম। রাত এগারোটা বাজে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস বইছে। আমি শ্রাবণকে বললাম,
–“নদীর দিকটায় যাবেন শ্রাবণ? ”
শ্রাবণ হাঁটা থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
–“এখন? এত রাতের বেলা? তুমি না অন্ধকার ভয় পাও?”
–“আর কিছুতে ভয় পেতে চাইছি না। চলুন না কিছুক্ষণ থাকবো। তাছাড়া চাঁদের আলো আছে তো। অন্ধকার কোথায়?”
শ্রাবণ আমার দিকে তাকিয়ে আমার কপালে আলতো করে চুমু খেল। এরপর আমরা চললাম নদীর ধারে। নতুনভাবে নতুন করে পথ চলা শুরু হবে।
অবশেষে তুমি আমার স্মৃতির পাতায় রয়ে যাবে আর অন্য কারোর ভাগ্যে। তোমাকে না চিনে, না জেনেই যেমন ভালোবেসেছিলাম। অত:পর তুমি আমার চেনা হয়েও অচেনা সে ডায়রীর পাতায় রয়ে যাবে সারাজীবন।
সমাপ্ত