#তুমি_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা
#আফরোজা_আহমেদ_কুহু
#পর্ব_০৫
হঠাৎ কারোর কথায় নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে মিহিতা। উক্ত বলা কথাটির মালিককের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল শ্রাবণকে। সে মিহিতাকে জরিয়ে ধরলো।চিন্তিত কন্ঠে শ্রাবণ মিহিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“বাচ্চাটা ঠিক আছে?”
–“হ্যাঁ, স্যালাইন চলছে। ”
আসলে মিহিতা তার পুরনো সব বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল আজ। এত বছর পর তার স্কুল লাইফ থেকে শুরু করে মোটামুটি সব বন্ধুরা আজ এক জায়গায় হয়েছে। ওদের সাথে গল্প আড্ডা দিয়ে রিকশা করে ফেরার সময়। হঠাৎ একটা বাচ্চা কোথা থেকে যেন দৌড়ে আসে তার রিকশার সামনে। রিকশাওয়ালা মামা বাচ্চাটিকে বাঁচাতে গিয়ে দ্রুত রিকশা সাইড করে, যার ফলে অসাবধানতাবশত রিকশার চাকা ঢুকে যায় রাস্তায় থাকা একটা গর্তে মধ্যে। যার কারণে হঠাৎ ঝাঁকুনিতে মিহিতা রিকশা হতে পড়ে হাত-পা সহ মাথায় ব্যাথা। অন্যদিকে বাচ্চাটি হঠাৎ রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ায় সে দ্রুত বাচ্চাটিকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ সাথে শ্রাবণকেও ফোন করে। শ্রাবণের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কিছুদিন পরই বিয়ে। সেই শহর ছেড়ে আসার পর। শ্রাবণ আমাদের পাশের কলেজেই লেকচারার হিসেবে জয়েন করে৷তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সে ঠিকানা কোথায় পেল?
সে তখন হাত দিয়ে তার মাথার চুল গুলোকে পিছনে ঠেলে বলেছিল,
–“যে পুরো আমিটাকেই নিয়ে গেছে। তার ঠিকানা খুঁজতে কি বেশি সময় লাগবে? ”
এই সাত বছর সে আমার পাশে ছায়া হয়েই থেকেছে। প্রথমে সম্পূর্ণভাবে ইগনোর করলেও সে পিছু ছাড়ে নি৷ মাঝে মাঝে রাগ হতো৷ বিরক্তি নিয়ে চলে যেতে চাইলেও সে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকতো৷ এরপর ভালোবাসার দাবি না মানলেও বন্ধুত্বটাকে টিকিয়ে রেখেছিলাম। তখন একের পর এক বিয়ে ভাঙ্গার কারণে আমি হয়ে উঠলাম বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার মূল। তারা প্রকাশ না করলেও বুঝতাম। শ্রাবণের সাথে আমার বন্ধুত্বটার কথা বাবা-মা জানতো৷ ভার্সিটি লাইফে সকল জটিলতা কাটিয়ে উঠতে শ্রাবণই সাহায্য করে গেছে। তাই শ্রাবণ যখন পুনরায় বিয়ে প্রস্তাব পাঠালো। তখন রাজি হয়ে গেলাম। এতেই হয়তো সবার ভালো হবে।
যেদিন শ্রাবণ তার পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়ি এসেছিল। আমি তখন দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিলাম৷ এরপর যখন আমাদের একা কথা বলার সময় দেওয়া হলো৷ তখন শ্রাবণ আমার দু’হাত তার মুঠোয় নিয়ে বলেছিল।
–“তোমাকে আমায় ভালোবাসাতে হবে না মিহি। শুধু সারাজীবন পাশে থেকো তাতেই হবে। বিশ্বাস কর, কখনো কোনো কষ্ট পেতে দিবো না৷ ”
তার এত আবেদনীয় কন্ঠে বলা কথাগুলোর কারণে তখন আর আমি না করতে পারি নি। সেই মানুষটার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার হওয়ার তো আর কোনো পথ নেই। তার সাথে তো কথাও হয় নি আমার। আমার অনুভূতিগুলো একান্তই আমার। তা নাহয় শুধু আমারই থাক।
বাচ্চাটিকে নিয়ে হসপিটালে ভর্তি করালাম। আমার প্রচন্ড ভয় কাজ করছিল। বাচ্চাটার কিছু হয়ে যাবে না তো। কিন্তু আল্লাহর রহমতে বাচ্চাটির জ্ঞান ফিরলো। ডাক্তার জানালো ভয়ের কারণে এমনটা হয়েছে৷ তাছাড়া শরীর দুর্বল। আমি বাচ্চাটির কাছে গেলাম। এরপর একটা টুল টেনে বসলাম তার পাশে। বাচ্চাটির বয়স চার-পাঁচ বছর। এতটুকু বাচ্চাকে রাস্তায় কেউ কিভাবে একে ছাড়তে পারে। আমি বাচ্চাটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করলাম। বাচ্চাটি অস্পষ্ট কন্ঠে বললো তার নাম আফরা৷ আমি বাচ্চাটিকে তার বাবা-মার সম্পর্কে জানতে চাইলাম। মেয়েটি আমাকে তার বাবার নাম আহির ও মায়ের নাম মালিহা বললো। “আহির” নামটা শুনতেই আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো। এরপর নিজেকে বোঝালাম পৃথিবীতে অনেকের নামই তো আহির থাকতে পারে। বাচ্চাটিকে তার বাবা অথবা মায়ের ফোন নাম্বার সম্পর্কে জানতে চাইলে সে বললো৷ মেয়েটা বেশ বুদ্ধিমতী আর চুপচাপ স্বভাবের বলেই আমার মনে হলো।প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ছাড়া এর বাহিরে আর একটাও কথাও বলছে না।আমি তাকে পুনরায় প্রশ্ন করলাম,
–“তুমি রাস্তায় ওভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন? তোমার বাবা-মা কোথায় ছিল?”
মেয়েটি ভীত কন্ঠে জানালো তারা মেলায় ঘুরতে এসেছিল। তবে অনেক ভীড়ের মধ্যে সে হারিয়ে যায়। তখন সে তার বাবা-মাকে খুঁজতে খুঁজতে মেলা থেকে বের হয়ে একটা নিরব রাস্তায় চলে আসে। রাস্তাটা অন্ধকার হওয়ায় সে ভয়ে দৌড় দিয়েছিল। এরপর আমি আফরার বলা নাম্বারে কল করলাম। কল করতে অপরপাশ হতে একটি মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এলো। ফোনের এপাশ হতেই বুঝতে পারলাম তিনি অস্থির হয়ে আছেন। আমি তাকে হসপিটালের নাম বলে এখানে আসতে বললাম। তিনি দ্বিগুণ অস্থিরতা জড়িত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মেয়ে ঠিক আছে কি না ” আমি তাকে ভরসা দিয়ে ফোন রাখলাম। মেয়েটির হাতে স্যালাইন লাগানো। আমি তার পাশে বসে টুকটাক কথা বললাম।
মিনিট দশেকের মধ্যেই পুনরায় আমার ফোনে একটা কল এলো। অপরিচিত নাম্বার। রিসিভ করে কানে দিতেই ভেসে এলো একটি পুরুষনালীয় কন্ঠ।আমি থমকে গেলাম। এ কন্ঠ তো আমার চেনা। সেই সাত বছর ধরে যার সাথে আমার যোগাযোগ নেই। যার থেকে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। ব্যক্তিটি আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“আফরা কত তলায় আছে?”
–“তিনতলায়। ”
বলেই ফোন রেখে। আমি বের হয়ে এলাম। তবে কি পুনরায় সেই ব্যক্তিটির সাথে আমার দেখা হবে? এত বছর পর আবারও কি তার সামনে দাঁড়াতে হবে আমায়?আমি এসব ভাবতে ভাবতেই আমার সামনে উপস্থিত হলো এক দম্পতি। আমি থমকে গেলাম। সাত বছর পর আবারও তার দেখা। আগের থেকে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। গালে চাপ দাড়ি। মুখে চিন্তার ভাঁজ। দুজনই আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটি আমাকে অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
–“আফরা, কোথায়? ও আমার মেয়ে! ”
সামনে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে,আমার কথা বলার শক্তিটুকু হচ্ছিল না। “আহির” এত বছর পর, আবার, আবার কেন আমার সামনে আসতে হলো?আমি সব কিছুকে পিছনে ঠেলে তো চলে এসেছিলাম। তবে কেন আবার ভাগ্য আমায় একই জায়গায় এনে দাঁড় করালো। আমাকে কথা বলতে না দেখে এবার আহির আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“কি হলো?বলছেন না কেন? আপনিই কি আফরাকে নিয়ে এসেছেন? সে আমাদের মেয়ে?সে কোথায় আছে?”
#চলবে