তুমি আমার চেনা হয়েও অচেনা পর্ব-০৪

0
361

#তুমি_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা
#আফরোজা_আহমেদ_কুহু
#পর্ব_০৪

ততক্ষণে আরাবি চলে এসেছে। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে কি আরাবিই বলেছে? সে কিভাবে পারলো এটা করতে?আমার অনুভূতির কথাগুলো তো সে ব্যতিত আর কেউ জানে না! আমি জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। এরপর কলেজ গেট হতে বেরতেই আরাবী দৌড়ে এলো আমার কাছে। ওকে দেখে তখন আমার প্রচুর রাগের সাথে সাথে কষ্ট হচ্ছিল। আরাবি এসে আমার পথ আটকিয়ে বলে,
–“মিহি, বিশ্বাস কর। ভাইয়া অনেক ভালো একটা ছেলে।”

আমি কোনো কথা না বলে চলে যেতে নিলে সে পুনরায় আটকায়।
–“মিহি, তুই আমার উপর যতোই রাগ করিস না কেন। কিন্তু আমি তো তোর ফ্রেন্ড তাছাড়া আমি তোকে আমার ফ্রেন্ডের থেকে বেশি বোন ভাবি। আমি সত্যিই তোর খারাপ চাই না। শ্রাবণ ভাইয়া তোকে সত্যি ভালোবাসে। কতদিন আর এভাবে চলবে বল?”

–“প্লিজ আর ভাবিস না আমায় নিয়ে। আমাকে প্লিজ একা থাকতে দে। আমি আমার মতো করে তো ভালো আছি। আমি চাই না পুনরায় কেউ আর আমাকে ভেঙ্গে দিক। ”
কথাটা বলেই চলে এসেছিলাম। প্রচন্ড কান্না আসছিল। কিন্তু রাস্তায় তো আর কান্না করা যায় না। বার বার চোখ পানিতে পূর্ণ হয়ে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো। হঠাৎ আহিরকে দেখলাম। তার এক বাহু জরিয়ে রিবা হেঁসে হেঁসে কথা বলছে। কত সুন্দর লাগছে তাদের!এতক্ষণ ধরে আটকিয়ে রাখা কান্নাটা যেন এভার বাঁধ ভেঙ্গে বেরিয়ে এলো। আর পারছিলাম না নিজেকে সামলাতে। দ্রুত একটা ফাঁকা গলিতে ঢুকে পড়ি। সেই পথ ধরেই কান্না করতে করতে দৌড়ে যেতে থাকি। গলিতে থাকা কিছু মানুষ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো। আমি সব কিছু উপেক্ষা করে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। আর সহ্য করতে পারছি না এই অবহেলা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল।হঠাৎ বৃষ্টি হতে শুরু করলো। রাস্তার মানুষ সব বৃষ্টি হতে বাঁচার জন্য ছোটাছুটি করছে। আমি থামলাম সেই মুহুর্তেই। আমার অবাধ্য হয়ে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো লোনাজল। যা বৃষ্টির পানির সাথে মিশে যাচ্ছে।আমি চোখ বন্ধ করে অনুভব করতে লাগলাম বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা। আজ আমার মতো আকাশের মনেও কালো মেঘ এসে জমেছে। যা একমাত্র এইভাবেই দূর হবে। এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব হলো। আশেপাশের থেকে কয়েকটা মানুষ চিৎকার করে কিছু একটা বলছে যেন৷ কি বলছে আমি শুনলাম না। আজকে আমি সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিতের বাহিরে চলে গেছি। হঠাৎ কেউ হাত ধরে টেনে খুব শক্ত করে জরিয়ে ধরলো আমায়। সে জরিয়ে ধরেই বলছে,

–“আ’ম সরি, মিহিতা। আমার তোমাকে ওভাবে সবার সামনে বলা ঠিক হয় নি। আ’ম রিয়েলি সরি। ”

বলে পুনরায় আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। আমি মাথা উঠিয়ে দেখলাম এটা শ্রাবণ। আমি ভ্রুর- কুঁচকে তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরত্বে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে পুনরায় কিছুটা এগিয়ে এসে বললো,

–“এভাবে প্লিজ নিজেকে শেষ করে দিও না, মিহি প্লিজ।”
–“আচ্ছা”
বলেই আমি চলে এলাম সেখান থেকে। দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তা পেরিয়ে রেললাইনের দিকে চলে এসেছিলাম আমি৷ মানুষ হয়তো ট্রেন আসা নিয়েই ডাকছিল আমায়।
বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ যাবত কান্না করি। মা এসে অনেকবার ডেকে গিয়েছিল। মাথা ব্যাথা করছে বলে আর দরজা খুলি নি।
এরপর নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বেরিয়ে এলাম। বাবা জানালো তার হঠাৎ আবার বদলি হয়েছে। এ শহর থেকে দূরে। যেহেতু কিছুদিন পরই আমার ফাস্ট ইয়ার শেষ হয়ে যাবে। তাই এইচএসসিটা খালামণির বাসায় থেকেই করতে বললো। কিন্তু আমি মানা করলাম। বাবাকে কলেজে গিয়ে টিসির বিষয়ে কথা বলতে বললাম। বাবা প্রথমে রাজি না হলেও পরে ঠিকই রাজি হলো। এরপর ফাস্ট ইয়ারটা ওখানে শেষ করে চলে আসার সময় আরাবি আমাকে ধরে প্রচন্ড কাঁদলো। তার ভাষ্য মতে তার জন্যই আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তো তার জন্য যাচ্ছি না। আমি পালাতে চাচ্ছি আহিরের থেকে। এই শহর থেকে। সময় ঘনিয়ে এলো আমাদের যাওয়ার। আরাবি এলো আমাকে বিদায় দিতে। দূর হতে শ্রাবণ ভাইয়াকেও দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। আশাহত চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আমি চোখ সরিয়ে নিলাম আর কাউকে প্রয়োজন নেই আমার৷ আমি শেষবারের জন্য একবার গিয়ে দাঁড়ালাম সেই স্থানে। যেখান হতে এসবের শুরু। আজ আবার সেখানেই এসবে শেষ করে দিয়ে আমি চলে যাচ্ছি। চলে যাচ্ছি বললে ভুল হবে পালিয়ে যাচ্ছি। এ শহরে আর আসা হবে না। আর কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা হবে না। কাউকে দেখে কষ্ট হবে না। কারোর জন্য ব্যাকুলতা থাকবে না। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। শেষবারের জন্য একবার আহিরকে দেখার ইচ্ছে হলো। কিন্তু ইচ্ছে পূরণ হলো না। তার সাথে আমার আর কোনো কথা হলো না কখনোই। আর হবেও না। এই শহরটা ছেড়ে যেতে প্রচন্ড খারাপ লাগছে। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মায়ের কাঁধে কিছুক্ষণ মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে রইলাম কিছুক্ষণ।আমার এই চেনা শহরের মতো #তুমিও_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা হয়ে গেলে। এবার আর ভাগ্য আমাদের এক সাথে করতে পারবে না। না আমাকে আর সেই দহনে পুরতে হবে।

—————————————
এরপর কেটে যায় সাতটি বছর। সাত বছরের মাঝে আমি শুধু একবার ফিরে গিয়েছিলাম সেই শহরে। সেখানে আহিরের একজন বন্ধুর কাছে জানতে পারলাম। আহির বিয়ে করেছে। কিন্তু রিবাকে নয়। অন্য আরেকটি মেয়েকে।পারিবারিকভাবেই নাকি বিয়েটা হয়েছে। রিবা নাকি আহিরকে চিট করেছে। কথাটা শুনে আমি হাসলাম। কেন হাসলাম জানি না। সেই ভাইয়াটা আমাকে হাসতে দেখে বললো,

–“আপু হাসছো তুমি?জানো তোমার প্রতি আহিরের এত ডেস্পারেট ভাব দেখে আমরা সবাই ভেবে নিয়েছিলাম সে তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু এরপর হঠাৎই রিবা কোথা থেকে এলো,সম্পূর্ণ আহিরটাকেই পাল্টে দিলো। আমাদের সাথেও সে যোগাযোগ আস্তে আস্তে বন্ধ করে দিলো। তোমার কথা আমাদের বন্ধু মহলে আলোচনা হতো। তখন আহির বলেছিল তার নাকি তোমাকে শুধুই ভালো লেগেছিল। এরপর রিবার সাথে সম্পর্ক জরিয়ে পড়ে। এরপর থেকেই তোমাকে ইগনোর করে। ”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। আমি যা শোনার ছিলো শুনে নিয়েছি।

–“সরি,মিহি এতক্ষণ ওয়েট করানোর জন্য।তুমি ঠিক আছো? হাতে তো ব্যাথা পেয়েছো, মাথাও ফাটিয়েছো।এক্সিডেন্টটা হলো কিভাবে? ”

হঠাৎ কারোর কথায় নিজের ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে মিহিতা। উক্ত বলা কথাটির মালিককের দিকে তাকাতেই সে দেখতে পেল শ্রাবণকে। সে মিহিতাকে জরিয়ে ধরলো।চিন্তিত কন্ঠে শ্রাবণ মিহিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
–“বাচ্চাটা ঠিক আছে?”
–“হ্যাঁ, স্যালাইন চলছে। ”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে