তুমি আমার চেনা হয়েও অচেনা পর্ব-০৩

0
347

#তুমি_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা
#আফরোজা_আহমেদ_কুহু
#পর্ব_০৩

এরপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। এসএসসির রেজাল্ট। ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। রেজাল্ট কি আসবে?ভালো হবে না খারাপ। আমার অস্থিরতা দেখে মা কিছুক্ষণ পর পরই এসে আমাকে বলছিল,

–“যা হওয়ার হবে এত টেনশন করিস না। আল্লাহ যা রেখেছে তা তো হবেই। ”

মায়েরও যে টেনশন হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। বাবাও কিছুক্ষণ পর পর ফোন করছিল অফিস হতে। অবশেষে রেজাল্ট দিলো। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে আমার রোল নাম্বারটা তুললাম। এরপর চোখ বন্ধ করে ক্লিক করতেই রেজাল্ট সামনে এলো মনে হয়। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে আছি। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। যদি ভালো না হয় তখন কি হবে? কিভাবে বলবো মা-বাবাকে?মা আমার পাশে ছিলো। সে আমাকে ধরে কান্না করে দিলো। আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। এরপর রেজাল্টের দিকে তাকিয়ে দেখি জিপিএ-৫ এসেছে। তখন বুঝলাম এটা কষ্টে কান্না নয় এটা খুশির কান্না।

এরপর আমি ভর্তি হই কলেজে। আমাদের বাসা হতে ২০মিনিটের দূরত্ব ছিল।প্রথমদিন অনেক এক্সাইটেড ছিলাম।কি হবে, কেমন মানুষ থাকবে সেখানে?কিন্তু ক্লাসে যেতেই মনে হলো অবশেষে হয়তো আমি আহিরকে সরাতে পারবো আমার মন থেকে। কেননা আহিরের সাথে তো আর দেখা হবে না৷ দূরে থাকলে সে আমার থাকবে, আমার কল্পনায়। যেখানে আমি নিজের মতো সব সাজাতে পারবো। কিন্তু আহির সামনে এলেই যে আমার কল্পনাগুলোকে পাল্টে দেয়। কিন্তু ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলাই না চলছিল তখন।
আহির তখন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে সেইখানেই। আমি হাজার বার যাকে ভুলতে চাইছি। সে বার বার আমার সামনে আসছে। কিন্তু সে আমার হয়ে নয় বরং অন্য কারোর হয়ে। ভাগ্য যেভাবে সব জায়গায়ই আমাদের এক করে দিচ্ছে। চাইলেই কি সে আমার হতে পারে না?এক অদ্ভুত জাদু কি হতে পারে না জীবনে, যেখানে সে শুধু আমার হবে। কলেজ জীবনের কিছুদিনের মধ্যেই জানলাম আহিরের প্রেয়সীও এখানেই ভর্তি হয়েছে। সে যখন তার প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষা করতো। আমি দূর হতে তা দেখতাম। বার বার চোখ ফিরিয়ে নিলেও বেহায়া চোখ শুধু তার পানেই তাকিয়ে থাকতো। সে কি একটি বারও আমার দিকে তাকাতে পারে না।সে হয়তো কোনোদিনই জানতে পারবে না এই কথা। কলেজের ফাঁকে ফাঁকে যে তাকে কেউ আড়াল থেকে দেখে, সে তা কখনোই বুঝতে পারবে না যার মনে সে ভালো লাগার একটি ছোট গাছ লাগিয়েছিল। সেই গাছ ভালোবাসার রুপ নিয়েছে। সে কখনোই শুনতে পাবে না আমার অভিযোগ গুলো।কেন ভাগ্য আমাকে সেই থার্ড পার্সনই বানালো। আমি তো হতে চাই নি। আমি সারাদিন তার আগের কথা গুলো ভাবি। তার বলা প্রথম ভালোবাসি কথাটা এখনো আমার কানে বাজে। সে যদিও নাম নেয় নি। আমার প্রতি তার হয়তো ভালো লাগাই ছিলো। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে বরাবরই আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সে তার প্রেয়সীর দিকে যখন মুগ্ধ নয়নে তাকাতো তখন আমার মধ্যে ঝড় বয়ে যেতো। কে বলেছিল আমার সাথে এমন আচরণ করতে? কিন্তু উত্তর পাই নি কখনোই। না কোনোদিন পাবো। ক্লাসে আমার নতুন একজন ফ্রেন্ড হয়। নাম আরাবি। সে ছিলো অনেক মিশুক একটা মেয়ে। কিছুদিনের মধ্যেই সে আমার প্রিয় মানুষদের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছিল। আহিরকে লুকিয়ে দেখা নিয়ে সে একদিন আমাকে প্রশ্ন করেছিল। আমি বলেছিলাম তাকে আমার সেই একপাক্ষিক অনুভূতির কথা। সে আমার দিকে তখন অবাক নয়নে তাকিয়ে ছিলো। হয়তো এসব কথাভাবে নি। এরপর আমি চলে যেতে নিলেই সে আমাকে জরিয়ে ধরেছিল। দিয়েছিল একরাশ সান্ত্বনা। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম তখন। প্রথম কারোর কাছে নিজের মধ্যে জমিয়ে রাখা অনুভূতিকে প্রকাশ করায় কেমন জানি লাগছিল।

এরপর কেঁটে যায় আরো ১মাস, তখন জানুয়ারী মাস।ঠান্ডা প্রকোপ বেড়েছে আবারও। আমি বাসা হতে বের হয়ে সেইস্থানে দাঁড়ালাম। যেখানে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। চারপাশে তাকালাম। ঠান্ডায় এখনো কথা বললে মুখ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই কয়েকবছরে রাস্তার ঘাটের পরিবর্তন তেমন একটা হয় নি। রাস্তার পাশে থাকা দোকানগুলোও রয়েছে নিজ জায়গায়। সব কিছুই সেই আগের মতোই রয়েছে। আজকের আর সেইদিনের মধ্যে পার্থক্য এইটুকুই সেইদিন এই স্থানে সে দাঁড়িয়ে ছিল। আমরা তখন একে অপরকে চিনি না। আমি মাথা নিচু করে তার পাশ কাটিয়ে চলে গেলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। সেই সময় তার চোখে আমাকে দেখার ব্যাকুলতা দেখতে পেতাম। কিন্তু আজ যখন আমি তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি। আজ সে মানুষটাই নেই।সেদিন তো আমি তার চোখে ভাষা বুঝেছিলাম। তবে সে কেন বুঝলো না আমাকে। আমার চোখের ব্যাকুলতা কি সে দেখতে পায় নি। পেয়েছিল হয়তো পাত্তা দেয় নি।

হঠাৎ মনে হলো কেউ দেখছে আমায়। আমি পিছনে ঘুরে দেখলাম অপরিচিত মুখ। আমি ঘুরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। গন্তব্য জানি না। শুধু এই ব্যস্ত নগরীতে একটু একা হাঁটতে চাই। নিজের মতো করে উদ্দেশ্যহীনভাবে। কিছুক্ষণ যেতেই লক্ষ্য করলাম লোকটি আমার পিছু নিয়েছে। সে কি ফলো করছে আমায়? করুক আমি আর ফিরে তাকাবো না। আর কারোর চোখের ভাষাও আমি বুঝতে চাই না। আমি আর মাথা ঘামালাম না। আমি চাই না এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হোক। কারোর জীবনে আর থার্ড পার্সনের ভূমিকা আমি রাখতে চাই না। নিঃসঙ্গতাই বরং থাকুক। অন্তত সে আমায় ছেড়ে যাবে না। আহির, সে তো আমার চেনা হয়েও অচেনা মানুষ হয়ে গেছে। এখন নাহয় নিঃসঙ্গতাই থাক। আমার হয়ে আমার মতো করে।

এরপর আমিও তাকে এভয়েড করার চেষ্টা করতাম। লাভ বিশেষ হতো না। তাও তার সামনে বেহায়ার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকতাম না। আড়ালে দেখতাম।একদিন আমি কলেজের মাঠে বসেছিলাম। আমার নতুন বান্ধবী আরাবি গেছে লাইব্রেরীতে। মিরাও মাঝে মাঝেই ফোন করে আমাকে। আমি ধরি না। সে আমার অনুভূতি গুলো না জানলেও আহিরের তখনকার আমার প্রতি আচরণগুলো জানতো। তবুও সে কথার মাঝে রিবা আর আহিরকে তুলতো। এতে যে আমার হ্রদয়ে রক্ত ক্ষরণ হয় যে হয়তো বুঝতো। তবে তবুও হয়তো সে আমাকে এসব বলে মানসিক শান্তি পেতো। তাই আমিও যোগাযোগ রাখি না। নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করে অন্যের মানসিক শান্তির কারণ, আমি হতে চাই না।

তখন আমি বসে ফোন স্ক্রোল করছিলাম। এমন সময় একজন ছেলে এসে বসলো আমার পাশে। দেখতে এককথায় সুদর্শন। সেইদিন ওনিই আমার পিছু নিয়েছিল।সিনিয়র ছিল আমার। আমাদের ভার্সিটির না হলেও কলেজে তিনি এখানেই পড়তেন। তাছাড়া ভালো ছাত্র হওয়ায় সামনের বছর লেকচারার হিসেবে এখানে জয়েন দিবে বলে শুনেছিলাম।তার নাম শ্রাবণ৷আমি তাকে দেখে দ্রুত উঠতে নিলেই সে হাত ধরলো আমার। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও ছাড়লো না। উল্টো বললো,

–“ভালোবাসি মিহিতা।”

আমি স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম। ভার্সিটির অনেক ভাইয়া আপুরাও তখন উপস্থিত ছিল। এত লোকের সামনে এভাবে কেউ প্রপোজ করাতে আমি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। আমার অস্থিরতা দেখে সে আমার হাত আরোও শক্ত করে চেপে ধরে বললো,

–“জীবনটাকে কি আরেকটা সুযোগ দেওয়া যায় না? ”

আমি অবাক হলাম। সে কি আমার সম্পর্কে জানে? কিন্তু কিভাবে?

ততক্ষণে আরাবি চলে এসেছে। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। তবে কি আরাবিই বলেছে? সে কিভাবে পারলো এটা করতে?আমার অনুভূতির কথাগুলো তো সে ব্যতিত আর কেউ জানে না!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে