তুমি আমার চেনা হয়েও অচেনা পর্ব-০২

0
186

#তুমি_আমার_চেনা_হয়েও_অচেনা
#আফরোজা_আহমেদ_কুহু
#পর্ব_০২

কিন্তু হঠাৎ একদিন আমার বান্ধবী মিরার কাছে জানতে পারি আহির অন্য আরেকটি মেয়ের সাথে রিলেশনে গেছে কিছুদিন আগে। ওইদিন বাসায় এসে কেন জানি না অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছিল মনে। প্রচুর কেঁদেছিলাম, ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদা সময় অন্য ঘর থেকে যখন মা ডাক দিয়েছিল। তখন ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে গিয়েছিলাম। মা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে বলেছিল,”এভাবে ঘুরছিস কেন?” এরপর দ্রুত ঘরে চলে এসেছিলাম। তখন বুঝতে পারি নি কেন এমন হচ্ছিল। ভাবলাম হয়তো সে আমার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল তাই খারাপ লাগছে।আমি সেই কথার সত্যি মিথ্যা যাচাই করি নি যাচাই করতে ইচ্ছে করে নি। তাছাড়া যাচাই করারও উপায় ছিলো না। আমি তো আর তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না। এরপরের দিন গুলো স্বাভাবিকভাবেই যেতো। কিন্তু সে যখন সামনে পরতো আবার তখন আমি এলোমেলো হয়ে যেতাম। কষ্ট হতো মনে। এখন ক্লাস নাইন হতে টেইনে উঠে গেলাম। পড়াশোনার চাপ বাড়লো দ্বিগুণভাবে। তাও প্রতিদিন নিয়ম করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। তার দেখা পাওয়ার আশায়। মাঝে মাঝে পেতামও তার দর্শন।আমাদের স্কুল ছিল আটতলা ভবনের। উপরের তিনটা তলা ছিল কলেজের ভাইয়া আপুদের জন্য। আমি ছিলাম পঞ্চমতলায়।তখন রোজার মধ্যেও স্কুলে কোচিং ছিল। ৯টা থেকে কোচিং শুরু হলেও আমরা ফ্রেন্ডরা আসতাম আধঘন্টা আগে। পুরো স্কুল রাউন্ড দিতাম। তখন শুধু পুরো স্কুলে আমরাই ছিলাম। ক্লাস রুম সব খালি। ষষ্ঠতলায় আমরা প্রতিদিনই যেতাম। কেননা ওখানের একপাশে কলেজের ভাইয়াদের ক্লাস হলেও। আরেকপাশ ছিলো পুরো ফাঁকা। তাই ক্লাস রুমগুলো অনেকটা ভূতুড়েই মনে হতো আমাদের। তখন কলেজের ভাইয়াদের ক্লাস ছিলো না। তাই আমরা প্রতিদিন সেখানে গিয়ে এখানে কেমন ভূতের মুভি বানানো যায় তাই নিয়ে কতক্ষণ আলোচনা করতাম।একদিন আমি আর ঈষিকা আগে চলে এসেছিলাম। তখন মাত্র স্কুল খুলেছে। আন্টিরা বেঞ্জগুলো পরিষ্কার করছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও যখন আর কারোর দেখা মিললো না। আমরা দুজন তখন হাঁটা দিলাম সেই ভুতুড়ে তলায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমরা যেই না সামনে এগিয়েছি। তখনই দেখলাম একটা কালো রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত একটা ছেলে গিটার হাতে বসে আছে একটা টুলের উপর। এই অসময়ে আমরা দুজন ব্যতিত অন্য কোনো স্টুডেন্ট তো এখানে ছিল না। তার উপর গিটার হাতে পাঞ্জাবি পড়া।যার কারণে ঈষিকা ভূত বলে চিৎকার করে আমাকে রেখেই দৌড় দিলো। আমি তখনও স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। ঈশিকার চিৎকার শুনে ছেলেটি আমার দিকে ঘুরলো। আমি অবাক হলাম। কেননা এটা আহির ছিল। তখনই আরেকটা ভাইয়া সিড়ি দিয়ে উপর থেকে নিচে নামার সময় আমাকে দিলো ঝাড়ি। ঝাড়ি খেয়ে আর এক মুহুত দাড়ালাম না। দৌড়ে নিচে নেমে এলাম। পরে অবশ্য জেনেছিলাম ওরা একটা প্রোগ্রামের জন্য স্কুলে এসেছে।
এরপর একদিন পড়তে যাওয়ার সময় লক্ষ্য করলাম। রাস্তার পাশে থাকা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আহির ও তার প্রেয়সীকে ঝগড়া করতে। আমার পাও তখন সেখানে জমে যায়। তখন সে আমাকে দেখে খুব জোড়ে মেইন গেইটের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিল৷ আমিও সেইদিন চলে এসেছিল, সাথে জমেছিল তার প্রতি সুপ্ত অভিমান। সময় প্রবাহিত হতে শুরু করলো। এসএসসি পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল, এখন তিন মাস বাড়িতে বসা। সে এখন আর তার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয় না। তার বন্ধুদের মাঠে খেলতে দেখলেও তাকে দেখি না। মনটা প্রতিনিয়তই বিষন্নতার অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগলো। মাঝে মাঝে যখন বাসা থেকে নিচে কিছু আনার জন্য যেতাম রাস্তায় দেখলেও আমার দিকে তাকতো না সে। কিন্তু আমি তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম। চাইতাম শুধু একটি বার আমার দিকে তাকিয়ে দেখুক। আমি ভালো নেই। যদিও চাওয়াটা ছিল অন্যায়। কিন্তু মন মানতে চাইতো না।

আমি যখন প্রায় বিষন্নতার অন্ধকারে ডুবে গেছি ঠিক তখনই আমার এক কাজিনের বার্থডে পড়লো।পাশাপাশি বিল্ডিংই থাকতাম আমরা। তো আঙ্কেল এসে আমাকে নিয়ে গেল যদিও আমি তখন যেতে চাইছিলাম না। কেননা আম্মুর পায়ের ব্যাথা ছিল। ছাঁদে কাপড় দেওয়ার সময় স্লিপ কেটে পড়ে গিয়েছিল। পায়ের অবস্থা নাজেহাল।তাই আব্বু আমাকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে থাকলো আম্মু কাছে। আমি সেইখানে গিয়ে বসে রইলাম। কাজিনও ছিল ছোট। মাত্র ছয় বছর। তাও কতক্ষণ ওর সাথে গল্প করলাম। ও আবার আমার কাছে সবসময়ই গল্প শুনতে চাইতো। তখন খালামণি এসে বলে,

–“মিহিতা, তুই এখনো রেডি হস নি। ”

এরপর আমি সাজতে না চাইলেও খালামণি হালকা সাজিয়ে দিলো। চোখে কাজল,লিপস্টিক আর হালকা পাউডার। খালামণি চুল বেঁধে দিয়েছিল। এরপর গেস্টরা সবাই আসতে শুরু করলো। আমি আরোও একা হয়ে যেতে লাগলাম। কেননা আমি তেমন কাউকেই চিনতাম না। এরপর আমার মামাতো বোন আসতেই আমার বোরিং ফিল হওয়াটা একটু কমলো। ও আর আমি গেলাম ছাঁদে। সেখানেই সবকিছুর আয়োজন হচ্ছিল। কিন্তু ছাঁদে যেতেই দেখতে পেলাম সেই অপ্রতাশিত ব্যক্তিকে। আহির, সে আকাশী কালারের একটা শার্ট পড়া। হাতা দু’টো ফ্লোড করে কোমড়ে এক হাত দিয়ে, আরেক হাতে কপালে পড়ে থাকা চুলগুলোকে পিছনের দিকে ঠেলে দিলো। কপালে ঘামের বিন্দু বিন্দু কণা এসে জমা হয়েছে। হঠাৎ তার আর আমার চোখাচোখি হতেই আমি চোখ নামিয়ে ফেলি। এরপর তার পুরো বন্ধুমহলের সাথেই দেখা হয়। যদিও আমি কথা বলি নি। আমি আর মিঠি গিয়ে ছাঁদের একপাশে চেয়ারে গিয়ে বসি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না আহির এখানে কেন,এরপর আমার সেই কাজিনকে অর্থাৎ সাফিনকে নিয়ে আসা হলো কেক কাটাতে। খালামণি আমাকে বললো তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতে। এরপর কিছুক্ষণ ছবি তুলে অবশেষে কেক কাটা হলো।কিন্তু সাফিন সবাইকে সুন্দরভাবে কেক খাওয়ালেও আমাকে খাওয়ালো তো ঠিকই কিন্তু আমার গালে মাখিয়ে দিয়ে বললো,

–“আজকে স্টোরিটা তুমি পুরোটা আমাকে বলো নি মিহিপু।এটা তোমার শাস্তি। ”

উপস্থিত সবাই তখন হেঁসে দিয়েছিল। আমি পড়েছিলাম লজ্জায়। এরপর গালে লেগে থাকা কেকটুকু টিস্যু দিয়ে মোছার সময় একটা ছেলে এসে দাঁড়ালো আমার থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে” কথাটা শুনতেই আহিরের দিকে আমার চোখ গেল। সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। তাকে দেখার ইচ্ছে আমার নেই, শুধু শুধু কেন আমি তাকিয়ে থাকবো। আমাকে নিজেকে সামলাতে হবে। এভাবে তো চলতে পারে না।সে তো অন্য কারোর সাথে রিলেশনে আছে। আমি কেন বেহায়া হবো?এরপর খাওয়া দাওয়ার পর্ব আসে। আমি সোফায় বসে খাচ্ছিলাম আর টিভিতে কার্টুন দেখছিলাম। আমার ফেভারিট কার্টুন রুদ্রা। আমার সাথে অবশ্য সাফিনও ছিলো। তাকেও আমিই খাইয়ে দিচ্ছিলাম। খালামণি আর আঙ্কেল বাকি গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। ঘরোয়াভাবে তারা অনুষ্ঠানের কথা বললেও আমার কাছে মোটেও এটা ঘরোয়া মনে হয় নি। আঙ্কেলের অফিসের লোক, আরোও অনেকেই ছিলো। হঠাৎ কোথা থেকে আহির এসে বসলো একই সোফায়। কিন্তু বেশ খানিকটা দূরেই। বসেই বললো,

–“কি বাচ্চাদের কার্টুন দেখো! অন্যকিছু দাও।

আমি কিছু না বলে টিভির রিমোটটা বাড়িয়ে দেই তার কাছে। আমি চুপচাপ স্বভাবেরই মেয়ে। কারোর সাথে হঠাৎ করে মিশে যেতে বা কথা বলতে আমি পারি না। সেটা কোনো মেয়ে হলেও না তার সাথে হঠাৎ দেখায় আমি মিশতে পারি না। পরিচিত হলেও কিছুটা সময় লাগে। অবশ্য এটা বেস্টফ্রেন্ডের জন্য আলাদা।

এরপর আবার কেটে যায় কিছুদিন। পরীক্ষার রেজাল্টের সময়ও ঘনিয়ে আসতে থাকে। এর মধ্যে মিরা ফোন করে, কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পরই ও শুরু করে। জানো আহির রিবাকে এটা দিয়েছে ওটা দিয়েছে। মিরা ও রিবার বাড়ি ছিলো পাশাপাশি। তারা ফ্রেন্ডও ছিল হয়তো। মিরার এই কথা শুনে আমি বিরক্ত হলাম। কে কাকে কি দিয়েছে তা জেনে আমি কি করবো? কিন্তু প্রকাশ করলাম না। শুধু শুনে গেলাম। কষ্ট হলো ঠিকই তবে সেটা আর কারোর কাছে প্রকাশ করা হলো না। নিজের মধ্যেই মাটি চাপা দিতে হলো।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে