#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ০৪
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা
শান সোহাকে দেখতে দেখতে বলে
” তুমি শাড়ি পেরেছো ?? আমি তো ভাবলাম গায়ে সাপ পেচিয়ে রেখেছো।” বলে হেসে দেয়। সোহার হাসি মুখ চুপসে যায়। সোহা মন খারাপ করে বসে পরে। শান সোহাকে দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। শান হাসতে হাসতে সোফা থেকে পরে গেলো। সেইসময় দরজায় কড়া নড়ে উঠে। দরজার বাইরে থেকে শাহানাজ বেগমের গলা শোনা যায়। শান হাসি বন্ধ করে সোহার দিকে তাকায় । শাহানাজ বেগম আবারও দরজা বাড়ি দিয়ে বলে উঠে
” শান দরজা খোল তোর হাসি পুরো বাড়িতে শোনা যাচ্ছে। এতো সকালে এতো হাসির কি দেখলি তুই ??” শান তাড়াহুড়ো করে সোফা থেকে উঠে ব্ল্যাংকেট টা আলমারির ভেতর ঢুকিয়ে রাতের ভেজা বিছানার চাদরটা ওয়াসরুমে রেখে আসে। সোহা শাড়ি পরে হাটতে পারছে না তাই শাড়ি ধরে কয়েকটা লাফ দিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলেই সোহা শাহানাজ বেগমের পাশে নিলা, সিমি আর সালমা কে দেখতে পেলো। শাহানাজ বেগম সোহাকে দেখে অবাক হয়ে বলে
” একি রে এটা কি পরেছিস তুই ??” সিমি সোহার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হেসে দিলো। সেই সাথে পেছম থেকে শানের উচ্চস্বরে হাসির শব্দও শোনা গেলো। সোহা সিমির দিকে রেগে তাকালো। সিমি বড় বোন হয়ে এভাবে হাসছে এর চেয়ে বড় অপমান আর কি হতে পারে। সোহা কাঁদোকাঁদো চেহারায় শাহানাজ বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে
” দেখেছো মামনি তোমার মেজো বউ আর শান ভাইয়া আমাকে দেখে হাসছে।” সোহা বলতে বলতে কেঁদে দিতে নিলেই নিলা সোহার পাশে এসে বলে
” থাক থাক বাবু কাঁদে না। এসো তোমাকে আমরা শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছি।” সোহা নাক টেনে আবার লাফ দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকে দাঁড়ায়।শাহানাজ বেগম রুমের ভেতরে ঢুকে শানকে হাসতে দেখে ধমক দিয়ে বলে
” চুপ যা বাইরে যা। এমন ভাবে দাঁত কেলানোর কোনো দরকার নেই শাড়ি পরতে অনেকেই জানে না।” শান ধমক খেয়ে চুপ করে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে
” মা ওকে জিজ্ঞেস করোতো আজকে সাপ পেচিয়ে রেখেছে কেনো ?? সেইদিন ক্যাফে তো সুন্দর করেই শাড়ি পরেছিলো।” সোহা মুখ ফুলিয়ে বলে
” এটা আমি করেছি নাকি ?? আম্মু শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিলো।” শান শাহানাজ বেগমের দিকে তাকাতেই শাহানাজ বেগমকে চোখ পাকিয়ে তাকাতে দেখে শান ওয়াসরুম থেকে ব্রাশ নিয়ে সামিরের রুমে ছুট লাগায়। শাহানাজ বেগম দরজা লাগিয়ে সোহার কাছে আসতেই সোহা বলে
” আচ্ছা আমার টমি কোথায় ?? কালকে রাত থেকে আমার কাছে আসেনি।” নিলা মুচকি হেসে বলে
” টমি রাতে নাইসার সাথে ছিলো সকালে উঠেই তোমাকে খুজেছিলো তাই নাইসা ওকে নিয়ে খেলছে।” সোহা ঠোঁট চোখা করে বলে।
” ওওও” শাহানাজ বেগম আর নিলা সোহাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে থাকে। সিমি সোহার জামাকাপড় বের করতে থাকে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে আছে সবাই। সোহারা এখনও আসেনি তাই সবাই বসে বসে অপেক্ষা করছে। শানদের বাড়িতে এখন বেশি গেস্ট নেই বললেই চলে শুধুমাত্র কয়েকজন কাজিন আর খালা, চাচা, চাচিরা রয়েছে যারা আজকে রিসেপশনের পর চলে যাবে। তারা সবাই ব্রেকফাস্ট করে বাইরে ঘুরছে এখন শুধু ফ্যামিলি মেমবারদের ব্রেকফাস্ট বাকি। অপেক্ষা করতে করতে সোহাদের দেখা মিললো। সোহাকে শাড়িতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। শান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। এই মায়াময় চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে যতো ঘৃণা আছে সেই সব মুছে যাবে যেড়া শান চায় না। শাহানাজ বেগম সোহাকে শানের পাশে বসিয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলে
” নাও সবাই খাওয়া শুরু করো।” শান নিশ্বাস ফেলে খাওয়া শুরু করে। মুখে খাবার তুলতে নিলেই শাহানাজ বেগম শানকে ধমকস্বরে বলে উঠে
” শান !!” শান মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে
” কি মা ??” শাহানাজ বেগম বিরক্তকর কন্ঠে বলে
” তোমাকে আর কি কি সেখাতে হবে বলবে আমাকে একটু প্লিজ ?? নাহ বলতে হবে একটা লিস্ট করে আমাকে জমা দিও। তুমি আমাদের বাড়ির নিয়ম জানো না ?? বিয়ের পরেরদিন প্রথম খাবার স্বামীর হাতে খায় এতোবার দেখেও তুমি শিখনি এখনও ?? কোথায় সামিরকে তো আমার শিখিয়ে দেওয়া লাগেনি সামির নিজেই সিমিকে খাইয়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলো। তোমাকে কেনো শিখিয়ে দিতে হচ্ছে ??” শাহানাজ বেগমের কথায় সামির থতমত খেয়ে মাথা নিচু করে নেয়। নিলা মুখ টিপে হেসে পাশ থেকে সিমির দিকে তাকাতেই সিমি লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়। শানের মুখ দেখে সোহা মিটিমিটি করে হাসছে।
সোহা আসার পর থেকে সে অনবরত মায়ের কাছ থেকে ধমক খেয়ে যাচ্ছে ভেবে শানের সোহার উপর খুব রাগ হলো। শান বিরক্তিমুখ করে বলে
” মা সোহা নিজের হাতে খেতে পারে।এতোদিন বাড়িতেও খেয়েছে। এটা তো শাড়ি না যে সাপের মতো পেচিয়ে রাখবে।” শাহানাজ বেগম কিছু বলার আগেই পাশ থেকে ইশান ব্রেডে জ্যাম লাগাতে লাগাতে বলে উঠে
” ছোট বেলায় তুই মায়ের শাড়ি নিয়ে ঘুরতি শাড়ি পড়ার জন্য। পড়তে পারতি না তাই সাপের মতো পেচিয়ে রাখতি পরে মা সেটা ঠিক করে পড়িয়ে দিয়ে তোকে মেয়ে সাজিয়ে নিজের মেয়ের হওয়ার ইচ্ছে পূরণ করতো। ছবিও আছে সেটার।” পুরো লিভিং রুম চুপচাপ হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। শানের চেহারার কথা না বলাই ভালো দেখার মতো একটা চেহারা হয়েছে। সোহা ফিকফিক করে হেসে দিতেই মুসফিক চৌধুরিসহ
সবাই উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। সোহাকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে দেখে শান অসহায় গলায় ইশানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে
” ভাইয়া আজকেই এসব বলার ছিলো তোমার ??” ইশান ইনোসেন্ট ফেস করে বলে
” কি করবো বল তোর কথা শুনে আর নিজেকে থামাতে পারলাম মা। সরি !!”
শান সোহার দিকে তাকালো সোহা পেটে হাত দিয়ে হেসে চলছে। কিছুক্ষণ মুখ লটকিয়ে বসিয়ে থেকে শান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে
” এবার থামবে তোমরা ?? খিদে পেয়েছি আমার।” সবাই অনেক কষ্টে হাসি থামায়। শাহানাজ বেগম হাসি থামিয়ে বলে
” শান এবার খাইয়ে দাও সোহাকে।” শান গম্ভীর চেহারায় সোহাকে কোনো রকম একটু খাইয়ে দিয়ে নিজে খেতে থাকে। পরে শাহানাজ বেগম সোহাকে নিজের হাতে সুন্দর করে খাইয়ে দেয়। খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই নাইসা এসে উপস্থিত হয় টমিকে নিয়ে। টমি সোহাকে দেখেই তার ছোট গলায় ঘেউঘেউ করে নাইসার কোল থেকে লাফ দিয়ে সোহার কাছে চলে যায়। সোহা হেসে টমিকে কোলে তুলে নেয়। নাইসা এসে সোহার কাছে দাঁড়িয়ে তার মিষ্টি স্বরে বলে
” আচ্ছা সোহু আন্টি তোমাকে কি এখন থেকে আমি চাচি বলে ডাকবো ?? কিন্তু আমি তো চাচ্চু কে শান বলে ডাকি।”
সোহা মুচকি হেসে নাইসার গালে চুমু দিয়ে বলে
” না নাইসা বেবি আমরা তো ফ্রেন্ড। so, তুমি আমাকে সোহু মনি বা মিষ্টি মনি বলে ডাকতে পারো।” নাইসা খুশি হয়ে সোহার দুই গাল ধরে সোহার মুখটা এগিয়ে সোহার গালে চুমু দিয়ে বলে
” তুমি অনেক ভালো মিষ্টি মনি।” সোহা হেসে বলে
” আমি জানি তো। আমার নাইসাও অনেক ভালো।” নাইসা বড় একটা হাসি দেয়। সোহা আর নাইসার মধ্যে অনেক আগে থেকে অনেক ভাব। শান অনেক্ষণ ধরেই সোহার দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেটা কেউ খেয়াল করেনি। শান সোহার কথা ভাবছে। এই সোহা মেয়েটাকে দেখলে মনেই হয় না সোহা শানের দেখা সেই কাজটা করতে পারে বলে। কিছুক্ষণ বসে থেকে শান উঠে চলে গেলো রুমে।
রিসেপশন শেষ করে অনেক্ষণ পরে সোহা – শান সোহাদের বাড়িতে আসে। শান আসতে না চাইলেও শাহানাজ বেগমের জন্য আসতে হয়েছে তাকে আর নাইসাও এসেছে সোহার জন্য। নিলা শত চেষ্টা করেও আটকাতে পারেনি নাইসা আসার জন্য বায়না ধরেছিলো তাই সোহা নাইসাকে নিয়ে এসেছে। রাতের খাওয়া দাওয়া করে সোহা নাইসাকে নিয়ে তার রুমে শুয়ে পরলো। শান সোহার মা-বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজেও সোহার রুমে আসে। রুমে এসে সোহা আর নাইসাকে খাটে শুতে দেখে শান অবাম হয়ে বলে
” আমি কোথায় ঘুমাবো ??” সোহা দাঁত কেলিয়ে বলে
” আপনি সোফায় শুয়ে পড়ুন।” শান ছোট ছোট চোখে সোহার দিকে তাকাতেই সোহা ভ্রু কুচকে বলে
” কি হলো এভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো ??” শান রুমে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলে
” তোমার রুমের কোন কোণায় সোফা আছে আমাকে একটু দেখাবে প্লিজ ?? আমি দেখতে পারছি না।” সোহা থতমত খেয়ে উঠে বসে। তার রুমে যে সোফা নেই সেটা সোহার খেয়ালই ছিলো না। সোহা অবাক হয়ে বলে
” সত্যিই তো আমার রুমের সোফা কোথায় গেলো ?? এখানেই তো ছিলো।” শান রেগে নিজের চুল টেনে বলে
“পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি ?? সোফা কি উড়ে উড়ে চলে যাবে ?? নাকি এতো বড় সোফা তেলাপোকা খেয়ে ফেলবে ??” সোহা শানের কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। শান গিয়ে নাইসার পাশে বসে পরলো। নাইসা শানের হাত ধরে বলে
” শান তুমি আমার পাশে শুয়ে পরো।” শান হেসে বলে
” না বাবু তুমি আর তোমার মিষ্টি মনি এখানে ঘুমাও।” শানের কথা শেষ হতেই সোহা আসে। সোহা কোমড়ে হাত দিয়ে হয়রান গলায় বলে
” আরে আমার রুমের সোফাটা গেস্ট দের জন্য লিভিংরুমে নিয়ে গিয়েছিলো। এখন সেটা আনা জাবে না আপনাকে কোনোভাবে ম্যানেজা করে নিতে হবে।” নাইসা কাঁদোকাঁদো হয়ে সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” মিষ্টিমনি আমি তো একা তোমার সাথে ঘুমাতে পারবো না।” সোহা নাইসার পাশে বসে নাইসাকে কোলে তুলে আদুরে গলায় বলে
” কেনো নাইসা কি হয়েছে ?? তোমার ভয় করছে ?? আমি থাকবো তো তোমার পাশে।” নাইসা একই ভাবে বলে
” কিন্তু প্রতিদিন আমার দুই পাশে তো মা-বাবা থাকে। তুমি আমার এক পাশে থাকলে অন্য পাশে ফাকা থাকবে তখন আমার ভয় করে।” বলতে বলতে নাইসা ভয়ে কেঁদে দিতে নিলে সোহা বলে
” কাঁদে না বাবু। আচ্ছা শান ভাইয়া তোমার পাশে ঘুমাবে তাহলে আর ভয় করবে না তো !!” নাইসা চোখ মুছে মাথা নেড়ে না বলে। সোহা মুচকি হেসে নাইসাকে শুয়ে দিয়ে শানের দিকে তাকায়। শান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সোহা তাকাতেই শান সোহার হাত ধরে ব্যালকনিতে নিয়ে এসে রাগি বলে
” আমি কিছুতেই তোমার সাথে এক খাটে ঘুমাবো না।” সোহা দাঁতেদাঁত চেপে বলে
” তো কি রাস্তায় গিয়ে ঘুমানোর শখ হয়েছে ?? এই রুম থেকে অন্য রুমে গেলেই সবাই প্রশ্ন করবে আপনাকে কেনো যাচ্ছেন আর নাইসা একা ঘুমাতে পারবে না। তাই আপনাকে এমনিতেও ঘুমাতেই হবে। একদিন আমার সঙ্গে ঘুমালে আপনার কোনো ক্ষতি হবে বলে আমার মনে হয় না।” শান ভ্রু কুচকে বলে
” একদিন কিভাবে কালকেও তো থাকতে হবে।” সোহা মন খারাপ করে বলে
” জি না। আমার ফুপি অসুস্থ হয়ে গিয়েছে তাই মা-বাবা উনাকে দেখতে কালকে বিকেলে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দেবে তাই কালকে আমরা চলে যাবো বুঝেছেন ?? এবার ঘুমাতে আসুন আমার ঘুম পেয়েছে।” বলে সোহা রুমে গিয়ে নাইসার পাশে গিয়ে নাইশাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পরলো। শান উপায় না পেয়ে নাইসার অপর পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে পরলো।
পর্দা ভেদ করে সকালে রোদের তীক্ষ্ণ রশ্মিজাল এসে শানের মুখের উপর পরতেই শান বিরক্তিতে মুখের উপর হাত দিয়ে রাখে কিন্তু তাতেও রেহাই পেলো না শান। শান ঘুম ঘুম চোখে পাশে তাকাতেই সোহার মুখটা তার সামনে ভেসে উঠলো। সোহার নাইসাকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। শান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোহার উপরে থাকা নিজের হাতটা সরিয়ে নিলো শান। বিছানা থেকে উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলো। দুপুরের খাবারের পর্ব শেষ হতেই শান সোহা মা-বাবার সঙ্গে বসে বসে গল্প করতে থাকে। সোহা শানকে দেখে ভেংচি কেটে বিরবির করে বলে
” কালকে আসতেই চাইছিলো না আর এখন আমার আম্মু-আব্বু কাছ থেকেই সরছে না। এনার জন্য আমি ওদের কাছে গেলেও পাত্তা পাচ্ছি না। বজ্জাত লোক একটা।” নাইসা সোহাকে বিরবির করতে দেখে বলে
” মিষ্টিমনি কি কথা বলছো তুমি ?? আমি শুনতেই পারছি না।” সোহা হেসে বলে
” কিছু না নাইসা চলো আমরা বাইরে যাই।” নাইসা সোহার কোল থেকে টমিকে নিজের কোলে নিয়ে সোহার সাথে বাইরে চলে গেলো।
চলবে~ইনশাল্লাহ…….
#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ০৫
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা
নাইসা সোহাকে বিরবির করতে দেখে বলে
” মিষ্টিমনি কি কথা বলছো তুমি ?? আমি শুনতেই পারছি না।” সোহা হেসে বলে
” কিছু না নাইসা চলো আমরা বাইরে যাই।” নাইসা সোহার কোল থেকে টমিকে নিজের কোলে নিয়ে সোহার সাথে বাইরে চলে গেলো।
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতেই শানদের বাড়ি থেকে ইশান, নিলা, সামির সোহাদের বাড়িতে আসে ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপ্যায়ন শেষ হতেই সবাই আবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সোহা গাড়িতে মন খারাপ করে বসে আছে পাশে টমি আর নাইসা খেলছে কিন্তু সোহার কোনোদিকে খেয়াল নেই। সোহা গাড়িতে হেলান দিয়ে একমনে বাইরে তাকিয়ে আছে। শান আড়চোখে কয়েকবার সোহাকে দেখেও নিয়েছে। সামির শানকে চুপ করে থাকতে দেখে সামনের দিকে তাকিয়ে শানকে উদ্দেশ্য করে বলে
” আমরা বউ এর মন খারাপ থাকলে তার মন ভালো করার জন্য কতোকিছু করে থাকি আর আমার গুনোধর ছোট ভাই বসে বসে বউ এর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে।” সামিরের কথা শুনেই শান থতমত খেয়ে সামিরের দিকে তাকায় তবে সোহার কানে কোনো কথাই যায়নি। তার খেয়ালই অন্যদিকে। শান গলা ঝেড়ে বলে
” ভাই উল্টা-পাল্টা কথা বলছিস কেনো তুই ??” সামির হালকা ঘার হেলিয়ে বলে
” হ্যা কে উল্টা-পাল্টা কথা বলে আর কাজ করে সবই আমি দেখছি।” শান কথা না বাড়িয়ে চুপ করে বসে রইলো।
বাড়িতে আসার পরপরই শাহানাজ বেগম সোহাকে নিয়ে বসে পরলো। সবার সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে সোহা মন ভালো হয়ে গেলো।
সন্ধ্যায় সব লেডিসরা টিভি দেখতে বসে। সোহা সাধারণ বাড়িতে কার্টুনই দেখতো মাঝে সাঝে মায়ের সাথে নাটক দেখতো। আজকে শাহানাজ বেগমের সাথে বসে বসে নাটক দেখছে পাশে নিলা, সিমি, সালমা সবাই আছে। নাটক শেষ হতেই সোহা মুখ কুচকে বলে উঠে
” আচ্ছা এরা সতীনের সাথে ঝগড়া করে কেনো বুঝতে পারছি না। সতীন যখন হয়েছে তখন বান্ধবীর মতো থাকলেই তো পারে এতো ঝগড়ার কি আছে ?? আমার একটা সতীন থাকলে আমি টমির মতো সারাদিন দুজম একসাথে থাকতাম।” সোহার কথা শুনে নিলা, সিমি, সালমা একে অপরের দিকে তাকালো। শাহানাজ বেগম হেসে কিছু বলার আগেই শান সিরি দিয়ে নামতে নামতে বলে উঠে
” এমনভাবে বলছো যেনো তুমি তোমার জন্য একজন সতীন তৈরি করে রেখেছো !! আর সত্যি এমন কিছু করে থাকলে আমাকে জানিয়ে দিয়ো আমি আগে আগে প্রিপারেশন নিয়ে রাখবো।” সোহা হেসে বলে উঠে
” আপনার আরেকটা বউ লাগবে ?? আমার টমিকে বিয়ের করে নিন।” সোহার কথায় সবাই একসাথে হেসে দিলো। টমি ফ্লোরে বসেছিলো সোহার কথা শুনে কয়েকপা এগিয়ে শানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিলা উচ্চস্বরে হেসে বলে উঠে
” সোহা টমি বোধয় শানকে বিয়ে করতে রাজি। তুমি কাজি ডেকে আনো।” সোহা ফিকফিক করে হেসে দিয়ে বলে
” কাজির দরকার নেই আমি আমার বিয়ের সময় যা বলেছে সব মুখস্থ করে রেখেছি। তোমরা বললে আমিই মেয়ে কাজি হয়ে যেতে পারি।” শান বিস্ফোরিত নয়নে টমির দিকে তাকালো। টমি শানের বড়বড় চোখ দেখে সেখানেই ফ্লোরে পা গুটিয়ে বসে পরলো। শান টমির দিকে তাকিয়ে বলে
” তোকে এমনিই আমার শত্রু মনে হয়। তোকে বিয়ে করে সতীন বানানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই যাহ, ফুট এখান থেকে।”
টমির কি বুঝলো কে জানে !! টমি মুখ গোমড়া করে আগের জায়গায় এসে বসে পরলো। শাহানাজ বেগমও এবার হেসে দিলো টমি আর শানের ঝগড়া দেখে। ডিনার শেষ হতেই সোহা দৌড়ে শানের রুমে এসে আগে টমিকে তার বিছানায় শুয়ে পরে নিজে এসে খাটে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরে শান রুমে এসে দরজা লক করে খাটের কাছে এসে বুকে দুই হাত গুঁজে দাঁড়াল। সোহা মুখের উপর থেকে কিছুটা ব্ল্যাংকেট সড়িয়ে শানকে দেখে আবার নিজেকে মুড়িয়ে শুয়ে পরলো। শান গম্ভীর গলায় সোহাকে বলে উঠে
” সোহা বিছানা থেকে ওঠো আমি ঘুমাবো।” সোহাকে উঠতে না দেখে শান আবার একই ভাবে বলে উঠে
” সোহা !! উঠো বলছি !! এবার না উঠলে কিন্তু আমি তোমাকে কোলে তুলে বাথটবে ফেলে আসবো !!” সোহা মুখের উপর থেকে ব্ল্যাংকেট সরিয়ে উঠে বসে মুখ ফুলিয়ে বলে
” আপনি এতো খারাপ কেনো ?? বিছানায় ঘুমালে কি হবে ?? বর্ডার দিয়ে রাখবো দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না।” বলে সোহা আবার শুয়ে পড়তে নিলেই শান সোহার হাত ধরে আটকে দেয়। শান ঝাঁঝালো গলায় বলে উঠে
” একদম আমার কথার বাইরে কাজ করার চেষ্টা করবেন না !! আমি আগেই এসব নিয়ে কথা বলেছি তোমার সাথে। আমাকে আমার মতো থাকতে দেবে । সুতরাং তুমি নিজের জায়গায় গেলেই আমার বেশি সুবিধা হবে। আমি বেড শেয়ার করতে পারবো না।”
সোহা ভেংচি কেটে উঠে গেলো। আলমার থেকে কালকের ব্ল্যাংকেট বের করে সোফায় শুয়ে পরলো। টমিকেও সোফার পাশে এনে রাখলো।
শান শোয়ার সময় চোখ পরলো টমির দিকে। টমিকে মাঝারি আকারের ঝুড়ির মধ্যে তশোকে আরামে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে শান মুখ কুচকে বলে
” ছিঃ !! এই কুকুরটা আমার রুমে ঘুমাবে ??” শানের কিছু কথা সোহার কানে যেতেই সোহা ধপ করে চোখ খুলে রাগি গলায় বলে
” কি বললেন আপনি ??” শান ভ্রু কুঁচকে সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” আমার যা ইচ্ছে তাই বলেছি তোমার কি ?? আমাকে ঘুমাতে দাও নাহলে সত্যিই এবার বাথটবে রেখে আসবো।” বলে অপর পাশ হয়ে শুয়ে পরলো। সোহা মুখ ফুলিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
আজকের সকালেও সোহার বিচ্ছিরি গলার গান শুনে শানের ঘুমের সমাপ্তি ঘটে। তবে শান পুরপুরি ঘুম থেকে উঠার আগেই সোহা টমিকে নিয়ে রুম থেকে প্রস্থান করেছে। শান ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল ৯টা বাজে। শান ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে গেলো। ব্রেকফাস্ট টেবিলে আসতেই চোখ পরলো সোহার দিকে। সোহা টমির খাবার দিচ্ছে। শান বুঝতে পারলো না যে সে যেখানেই যায় সেখানে গিয়েই প্রথমে নিজের চোখটা আগে সোহার দিকে কিভাবে যায় !! শান নিজের এই কাজটায় নিজের উপরই খুব রাগ হলো। শান টেবিলে বসে খাবার খাওয়া শুরু করে তখন সোহা এসে পাশের খালি চেয়ারে বসে পরে। শান আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। কিছুক্ষণ পরে শান নিরবতা ভেঙে বলে
” মা আমি আজকে থেকে অফিসে যাচ্ছি।” শাহানাজ বেগম অবাক হয়ে বলে
” এতো তাড়াতাড়ি !! কিন্তু কেনো ?? তোদের হানিমুনের জন্য ছুটি নিবি না ??” শাহানাজ বেগমের কথা শেষ হওয়ার আগেই শানের নাকে মুখে বিষম উঠে গেলো। সোহা তাড়াতাড়ি করে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বলে
” নিন নিন তাড়াতাড়ি পানি খান।” শান পানি খেয়ে কোনো রকমে নিজের জীবনটা বাঁচিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে অসহায় গলায় বলে
” মা কি বলো এইসব তুমি ??” মুসফিক চৌধুরী খাবার খেতে খেতে বলে
” ঠিকই তো বলেছে। তোমরা কালকে খাগড়াছড়ি চলে যাও আমি তোমাদের জন্য রিসোর্ট বুক করে রাখবো। আর অফিসের ছুটি নেওয়া লাগবে না তোমার কাজ আমি আর সামির করে নেবো।” সোহা বিরক্তিকর চেহারায় বলে
” এখনি আবার ঘুরতে যাবো ?? কয়েকদিন পরে যাই !! মাত্রই বিয়ের সব কার্যক্রম শেষ হলো।” নিলা সায় দিয়ে বলে
” হ্যা বাবা, মা ঠিকই তো বলছে দুই দিনও হয়নি ঝামেলা শেষ হয়েছে এখনি আবার ঘুরাঘুরির কি দরকার ?? কয়েকদিন পর রিলেক্সে গেলেই হবে।” শাহানাজ বেগম নিশ্বাস ফেলে বলে
” ঠিকাছে। সোহা যখন বলবে তখন গেলেই হবে।” কিছুক্ষণ পর ইশান বলে
” সোহা তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট কখন দেবে ??” সোহা মুখের খাবার শেষ করে বলে
” এই তো দিয়ে দেবে দুইদিন পর।”
শান সোহার দিকে তাকিয়ে ঠাট্টা স্বরে বলে
” পাশ করবে তো তুমি ?? নাকি ফেল্টু মারবে।” সোহা তার পড়াশোনা নিয়ে খুবই সেনসিটিভ। এসব কথা সে একদমই পছন্দ করে না। তাই শানের কথা শুনে সোহা রেগে বলে
” আপনি তো মহা ঝামেলার মানুষ !! আমার সব কিছুতেই উল্টা-পাল্টা কথা বলেন। আমি সারা বছর পড়ালেখা করেছি কি ফেল করার জন্য নাকি ??” সিমি ধমক দিয়ে বলে উঠে
” সোহা !! কীভাবে কার সাথে কথা বলছিস তুই ?? কথা বলার ধরন ভুলে গিয়েছিস নাকি ??” সামির সিমিকে উদ্যেশ্য করে বলে
” আহ সিমি !! সোহা বাচ্চা মানুষ তাই রেগে এভাবে বলে ফেলেছে এতে ধমক দেওয়ার কি আছে ??” সিমি রাগি গলায় বলে
” সোহা এতোটা বাচ্চা নয় যে কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা ভুলে যাবে। বাচ্চা বলে আদর দিয়ে মাথায় তুলবে না একদম।” শান চুপ করে বসে আছে। তার ছোট একটা কথাতে যে সোহা এভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা ভাবেনি শান।
শান সিমিকে শান্তনা দিয়ে বলে
” থাক না ভাবি এই ছোট একটা কথায় কথা না বাড়ানোই ভালো। সোহা রেগে বলেছে আমরাও রেগে অনেক কিছু বলে থাকি।” শানের কথা শুনে সিমি আর কথা বাড়ালো না। সোহা মাথা নিচু করে বসে থেকে একটু খাবার খেয়ে উঠে গেলো। শাহানাজ বেগম পেছন থেকে সোহাকে ডাকলে সোহা খাবে না বলে দৌড়ে চলে যায়। নিলা সোহার জন্য খাবার নিয়ে বলে
” মা আমি সোহাকে খাইয়ে দয়ে আসছি।” শাহানাজ বেগম নিলাকে থামিয়ে বলে
” এখন যেও না। এখন রেগে আছে তাই খাবে না একটু পরে গিয়ে খাইয়ে দিও তুমি এখন খেয়ে নাও।” নিলা মাথা নেড়ে চেয়ার টেনে বসে পরে।
ইশান খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে মাকে উদ্যেশ্য করে বলে
” মা সোহার তো দুই দিন পর রেজাল্ট দিয়েই দেবে তাহলে আমি কি আমার হসপিটালের সামনের ভার্সিটি থেকে একটা ফ্রম তুলে আনবো ??” শাহানাজ বেগম মাথা নেড়ে বলে
” হ্যা ভালো বলেছিস। তোর সময় হলে আসার পথে নিয়ে আসিস।” ইশান মাথা নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। শান খাওয়া-দাওয়া শেষ করে উপরে চলে গেলো। রুমে ঢুকে সোহাকে কোথাও দেখতে পেলো না। সোহার খোঁজ না করে অফিসে যাবে বলে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে জেল লাগানোর সময় দেখতে পেলো বাইরে থেকে সোহা ঢুলতে ঢুলতে রুমে আসে। শান ভ্রু কুঁচকে বলে
” কোথায় ছিলে তুমি ??” শানের কথা সোহা পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না। আগের মতোই ঢুলতে ঢুলতে এসে খাটে বসে পরে। কিছুক্ষণ পর বলে
” কেউ বলেছিলো আমি আমার মতো সে তার মতো।” সোহা যে শানকে উদ্যেশ্য করে কথাটা বলেছে সেটা শান বুঝতে পারলো তাই আর কোনো কথা বললো না তৈরি হয়ে চলে গেলো।
চলবে~ইনশাল্লাহ……..