তুমিময় ভালোবাসা পর্ব-২৮+২৯

0
1718

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব : ২৮
#লেখিকা : মার্জিয়া রহমান হিমা

ইমন ইতির কটেজের রুমে পকেটে হাত গুঁজে আরামে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে। আর ইতি তার বেডের এক কোণায় গুটি শুটি মেরে বসে আছে। ইতি বারবার ইমনের দিকে তাকাচ্ছে ইমনের মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না সে। ইমন বারান্দায় হাটতে হাটতে বলে
” এদিকে আসো তো !!” ইতি ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকায়। গুটি গুটি পায়ে বারান্দার দিকে যেতে থাকে। ইতি ইমনের সামনে এসে দাঁড়াতেই ইমন কপাল কুচকে বলে
” পায়ে কি আঠা লাগানো নাকি ??” ইতি নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে দুই পা দেখে ইমনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে না বলে। ইমন এক ভ্রু উঁচু করে বলে
” তাহলে কচ্ছপের গতিতে হাটছো কেনো ?? আর মুখে কি কষ্টিপ মারা নাকি ?? কথা বলছো না কেনো ??” ইতি বিরক্ত হয়ে বলে
” এই আপনি এখানে এসেছেন কেনো সেটা বলুন !! আমার সাথে যারা থাকে তারা কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে। আপনাকে দেখে কি না কি ভাববে !!” ইমন ইতির দিকে কিছুটা ঝুকে বলে
” কি ভাববে ?? যা ভাবার ভাবতে দাও। আমারই ভালো। বেশি কষ্ট করা লাগবে না।” ইতি রেগে বলে
” আপনি যাবেন ??” ইমন আরেকটু ঝুকে বলে
” কোথায় যাবো জান ??” ইতি হা করে তাকিয়ে থাকে ইমনের কথা শুনে। ইমন ঠোঁট চেপে হাসি দিয়ে তুড়ি বাজাতেই ইতি মুখ বন্ধ করে চোখ বড় বড় করে রাগি গলায় বলে
” কে আপনার জান ??” ইমন বুকে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলে
” হায় !! এভাবে জান বলো না আমার এখানটায় লাগে।” ইতি রাগে ফুসতে থাকে ইমনের কথা শুনে। ইমন ইতিকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেলো। রুম থেকে পানির গ্লাস এনে ইতির সামনে ধরে বলে
” নাও জান পানিটা খেয়ে নাও। নাহলে পরে তুমি আমাকে তোমার মাথার গরম গরম রক্তে সিদ্ধ করে খেয়ে ফেলবে।” ইতি কিড়মিড় করতে করতে পানিটা একটা চুমুক দিয়ে খেয়ে নেয়। ইতি খেয়াল করলো পানি খেয়ে সত্যি মাথার গরম গরম রক্ত ঠান্ডা হচ্ছে। ইমন ভ্রু নাচিয়ে বলে
” কি হলো ঠাণ্ডা হয়েছে নাকি আরেকটু সময় লাগবে ??” ইতি গম্ভীর গলায় বলে
” হয়েছে। এবার এসেছেন কেনো সেই কারণটা বলুন।” ইমন হালকা হাসি দিয়ে বলে
” এসেছি তো অনেক কারণেই কিন্তু সব একসাথে হবে না। আচ্ছা তোমার নাম্বার টা দাও তো !!” ইতি অবাক হয়ে বলে
” আমার নাম্বার দিয়ে আপনি কি করবেন ??”
ইমন আগের ন্যায় জ্যাকেটে হাত ঢুকিয়ে হাটে হেটে বেডে পা তুলে পেছনে হেলান দিয়ে বসে বলে
” করার কি আর শেষ আছে ?? অনেক কিছুই করবো। তারমধ্যে একটা হলো তোমার সাথে কথা বলবো। তুমি চাইলে আমি তোমার বাবার নাম্বারও দিতে পারো আংকেল এর সাথেও কথা বলতে পারি। তোমার বাবার সাথে কথা বললে আমাদের ভবিষ্যৎ প্লেনের কথাও হয়ে যাবে।” ইতি বুকে দুই হাত গুঁজে বাকা হাসি দিয়ে বলে
” আমার বাবার নাম্বার কোথায় পাবেন আপনি ?? আমার বাবার নাম্বার কোথাও খুঁজে পাবেন না আপনি আর আমার নাম্বার তো কোনোদিনও না।” ইমন চিন্তিত হয়ে বলে
” তাই ??” ইতি টেডি স্মাইল দিয়ে মাথা নাড়ায়। ইমন চিন্তিত চেহারায় তার মোবাইল বের করে কিছু করতে থাকে। ইতি স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মুচকি হাসি দেয়। ইমন ইতির সামনে মোবাইল ধরতেই ইতির মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়। মুচকি হাসির জায়গায় ফ্যাকাসে চেহারা দেখে ইমন মন খারাপের অভিনয় করে বলে
” আহারে মুখের সেই মুচকি হাসি চলে গেলো কেনো ?? তোমাকে ফ্যাকাসে মুখে একদমই মানায় না। একটু হাসো প্লিজ জান !!” ইতি ঢোক গিলে বলে
” আপনি এসব কোথায় পেয়েছেন ??” ইমন ইনোসেন্ট ফেস করে বলে
” সত্যি বলছি আমি পাইনি। প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিজেই আমার কাছে এগুলো দিয়েছে। কতোজন স্টুডেন্ট যাচ্ছে, কে কে যাচ্ছে এবং তাদের গার্ডিয়ান এর নাম্বার সহ সব লিস্ট রয়েছে এখানে। সেখান থেকেই তোমার বাবার নাম্বার বেরিয়েছে। আমি কি করতে পারি বলো !!” ইতি কাঁদোকাঁদো চেহারা করে বলে
” ব্ল্যাকমেইল করছেন আপনি আমাকে ??” ইমন মাথা নেড়ে বলে
” উঁহু !! আমি তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করার কে তুমিই বলো ?? তোমার সব কিছু তোমার হাতেই আমি শুধু তোমার কাজ গুলো মনে করিয়ে দেবো। আচ্ছা আগে ট্রাই করে দেখি এটা তোমার বাবার নাম্বার কি না। ঠিকাছে ??” ইতি চোখ বড়বড় করে হালকা চেঁচিয়ে বলে
” নাহ !!” ইমন নাম্বার ডায়াল করে কল দিয়ে মৃদু হেসে বলে
” হ্যা !!” ইতি কপালে হাত দিয়ে বেডের কোণায় বসে পরে। ইমন ইতিকে দেখে ঠোঁট হেসে স্পিকারে দেয়। রিং হওয়ার পর কল ধরতেই ওইপাশ থেকে একজন পুরুষের গলা ভেষে আসে। ইমন গলা ঝেড়ে প্রথমে সালামের উত্তর দিয়ে কথা শুরু করে। ওইপাশ থেকে বলে
” কে আপনি ?? কোনো পরিচিত বলে তো মনে হচ্ছে না।” ইমন বিড়বিড় করে বলে
” আপনার একমাত্র জামাই।” ইতি শুনতে পেয়ে চোখ বড়বড় করে দ্রুত পায়ে ইমনের কাছে এসে দাঁড়ায়। ইমন জোড়ে বলে
” আমি মিস ইতির ভার্সিটি থেকে বলছি। আপনি কে হন ইতির ??”
” আমি ইতির বাবা। এতোরাতে ভার্সিটি থেকে ফোন কেনো ?? আর ইতি তো ভার্সিটি ট্যুরে গিয়েছে। সেখানে কিছু হয়েছে নাকি ??” ইতির বাবাকে অস্থির হতে দেখে ইমন শান্তনা স্বরে বলে
” আংকেল তেমন কিছুই হয়নি আপনি চিন্তা করবেন না। ভার্সিটির পক্ষ থেকে সব স্টুডেন্ট এর গার্ডিয়ানকে ফোন করা হচ্ছে তাই আপনাকেও ফোন দেওয়া হয়েছে।”
” ওহ !! আমি চিন্তায় পরে গিয়েছিলাম। তোমার কথায় প্রাণ ফিরে পেলাম।” ইমন আরেকটু কথা বলে ফোন কেটে দেয়। ফোন কেটে হাই তুলে ইতির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চুলগুলোতে হাত ঢুকিয়ে পেছনের দিকে ঠেলতে ঠেলতে বলে
” তো ম্যাডাম নাম্বার দেবেন নাকি আরেকবার ফোন দিয়ে বিয়ের কথাও সেরে নেবো ??” ইতি রেগে বলে
” ইইইই !! আপনার মাথা ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।” ইমন দাঁত কেলিয়ে বলে
” আমার একমাত্র হবু বউ বলে কথা !! তোমার জন্য প্রাণ দিয়ে দিতেও রাজি এবার নাম্বারটা দাও প্লিজ !! নাহলে সবাই এসে পরলে তোমারই বিপদ।” ইতি রাগে রি রি করতে করতে ইমনের ফোনে নিজের নাম্বার ডায়াল করে দেয়। ইমন মুচকি হাস দিয়ে জ্যাকেটের টুপি মাথায় দিয়ে নিজেকে কাভার করে কটেজ থেকে বেড়িয়ে যায়।

আজকেই সাজেকে সবার শেষদিন। রুইলুই পাহাড় আর কংলাক পাহাড় দিয়ে সাজেকের সমাপ্তি ঘটাবে সবাই। সোহার পায়ের অবস্থা আজকে মোটামুটি ভালো হওয়ায় আজকে সোহাকে নিয়ে যাবে বলে শান ঠিক করেছে। যদিও সোহা আর কোথাও যেতে চায়নি তবে সহান, ইতি, ইমনদের জোড়াজুড়িতে যেতে রাজি হয়েছে। কালকে সবাই চলে যাবে তাই আজকে শান সোহাকে শাড়ি পড়তে বলেছে। সোহা কিছুই বলেনি বোকার মতো দাঁড়িয়ে ছিলো। দুপুর হয়ে যেতেই সবার তৈরি হওয়ার ধুম পরে যায়।
শান তৈরি হয়ে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। সোহা ওয়াসরুম থেকে বেরোচ্ছেই না। শান সোহাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু আধ ঘন্টা হয়ে যাওয়ার পরও সোহা না আসায় শান ওয়াসরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে
” সোহা হয়েছে তোমার ?? আর কতোক্ষণ লাগবে ??” ভেতর থেকে কোনো উত্তর আসলো না। শান আবার ডেকে ওঠার আগেই দরজা খুলে সোহা বেড়িয়ে আসে। সোহাকে দেখে শান স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সোহা গায়ে টাওয়াল জড়িয়ে
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে শুধু শাড়ির বাকি অংশ গুলো পরে রয়েছে। শান কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে চোখ সড়িয়ে নেয়। সোহা বারবার টাওয়ালটাকে সামনে আর পেছন দিকে টানছে আর সোহা লজ্জায় লাল হয়ে আছে। শান বেডের উপর থেকে শাড়িটা হাতে নিয়ে কাঁপাকাঁপা গলায় বলে
” এখানে এসো !!” সোহা ধীর পায়ে শানের সামনে এসে দাঁড়ায়। শান সোহার দিক থেকে চোখ নামিয়ে শাড়ি খুলে সোহার দিকে এগিয়ে যায়। সোহার কাছে আসতেই শানের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। কিভাবে কি শুরু করবে বুঝতে পারছে না বারবার ঢোক গিলছে। এতোটা নার্ভাস শান কোনোদিন হয়নি যতোটা আজকে হচ্ছে। শান হঠাৎ আলতো হাতে শাড়িটা হাত থেকে ফেলে দিলো। সোহা চোখ উঠিয়ে শানের দিকে তাকাতেই শান সোহার চোখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে ঘাম মুছে নেয়। অসহায় গলায় বলে
” আমি পারবো না শাড়ি পড়াতে। আমি ইতিকে পাঠাচ্ছি।” বলে এক ছুটে বেড়িয়ে গেলো। সোহা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেডে বসে পরে কিছুক্ষণ পর ইতি আসে।

তৈরি হয়ে সবাই একসাথে হয়। শাড়ি পরে শানের সামনে আসতেই সোহা লজ্জায় মাথা নিচু করে নেয়। আগেও শাড়ি পরে একবার শানের সামনে এসেছিলো তখন তার এতো লজ্জা লাগেনি কিন্তু আজকে কেনো সোহার লজ্জা লাগছে সেটা নিজেও বুঝতে পারছে না। তবে আরেকটা জিনিস খেয়াল করলো হৃদয় বারবার সোহার দিকে কেমন করে তাকাচ্ছিলো। শান সোহা দুজনই সেটা খেয়াল করেছে। সোহা প্রচণ্ড অস্বস্তি আর ভয়ে ভয়ে আছে হৃদয়কে দেখে। শানও সোহাকে নিজের পাশ থেকে হাত ছাড়া করছে না।

রুইলুই পাড়া, কংলাক পাহাড়চূড়া বা সাজেকের অনেক স্থান থেকে মেঘবালিকাদের উড়তে দেখা যায়। আমরা ওপরে আর নিচে মেঘ ভেসে যায়।
ভাসতে থাকা মেঘরা বলে পেছনের দিকে আছে আরও। সূর্যের ঝলমলে আলো। মেঘের প্রতিফলিত আলো এক চমৎকার দৃশ্যের অবতারণা করে। লাল-সাদা নানা ফুল ফুটে আছে পুরো রুইলুই পাড়ায়। রিসোর্ট আর মেইন রোডের সঙ্গেই। এসবের মধ্যেই শুভ্রসাদা মেঘের সারি! এক মোহনীয় দৃশ্য! চম্বুকময়তার আবেশীয় পরিবেশ কখনও ভুলে যাওয়ার নয়!
বিকালবেলা হওয়ায় পাহাড়ের সবুজ অংশ বের হয়ে আছে। খণ্ড খণ্ড মেঘবালিকা উড়ে যায়। রাস্তার ধারে বা রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে এসব দৃশ্য অন্যসব চিন্তাকে তাড়িয়ে দেবেই। ক্ষণিক ক্ষণিক মনে হবে, মেঘ ভাসে না আমরা ভাসি। আমরাই মনে হয়, সাদা মেঘের সঙ্গে ভেসে যাচ্ছি! চা-কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ ডাক- আমার মোটরবাইকার কাম গাইডের! হ্যালিপ্যাডে সন্ধ্যারাতের দৃশ্য নিশ্চই বড়ই চমৎকার হবে। তাছাড়া আজ তো পূর্ণিমা রাত। সোনায় সোহাগা হবে সেই দৃশ্য।
আজকে কংলাক পাহাড়ে যাওয়ায় মূল উদ্দেশ্য হলো সূর্যাস্ত দেখা। সেই সময়ের জন্য সবাই বেশি এক্সাইটেড হয়ে আছে।

চলবে~ইনশাল্লাহ……..

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব : ২৯
#লেখিকা : মার্জিয়া রহমান হিমা

আজকে কংলাক পাহাড়ে যাওয়ায় মূল উদ্দেশ্য হলো সূর্যাস্ত দেখা। সেই সময়ের জন্য সবাই বেশি এক্সাইটেড হয়ে আছে।
সোহা মুগ্ধ হয়ে রুইলুই পাড়ার মেঘের দৃশ্য দেখছে আর শান সোহাকে দেখছে। সোহা সামনে তাকাতে তাকাতে একসময় শানের দিকে চোখ পরে। শান পলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সোহার দিকে। শাড়ি যেনো সোহাকে অন্যরকম ভাবে সাজিয়ে তুলেছে। আগেরবার সোহা শাড়ি পড়লে দেখেনি কারণ শানের মনে তখন অন্যকিছু চলছিলো আর এখন সেটা ভালোবাসা। সোহাকে পুরোই অন্যরকম লাগছে। আজকে বউ বউ একটা ভাব লাগছে খোলা চুল গুলো হালকা বাতাসে উড়ছে দৃশ্যটাই অন্যরকম। শান-সোহার অজান্তেই তাদের মুহূর্ত গুলো কেউ চুরি করে ক্যামেরায় যত্নসহকারে তুলে রাখছে সেটা তাদের দুজনের কারোরই খেয়াল নেই। শানকে এভাবে তাকাতেই দেখে সোহার মুখটা লাল হয়ে যায়। সোহা লজ্জামাখা চেহারায় মুখ নামিয়ে নেয়। শানের চোখের সামনে হঠাৎ ইমন তুড়ি বাজাতেই শান চমকে যায়। শান ইমনের দিকে তাকিয়ে আবার সোহার দিকে তাকায়। কি হয়েছে বুঝতে পেরে শান চুলে হাত দিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে সেখান থেকে একটু দূড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। ইতি বাহু দিয়ে সোহাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে তাকাতেই সোহা লজ্জায় আরো নুয়ে যায়।
ইতি সুযোগ পেয়ে সোহার সাথে মজা করতে থাকে। আর ইমন গিয়ে শানের পাশে ঘুরতে ঘুরতে ছবি তুলতে থাকে আর শানকে খোঁচা দিয়ে কথা বলতে থাকে।
সাজেকের রুইলুই পাড়া থেকে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার ব্যবধানে রয়েছে কংলাক ঝর্ণা। সুন্দর এই ঝর্নাটি অনেকের কাছে পিদাম তৈসা ঝর্না বা সিকাম তৈসা ঝর্না নামে পরিচিত। কংলাক ঝর্ণা যা দেখে মনে হবে কোনো এক সবুজ ছায়াতল থেকে শুভ্র পরী উপর থেকে নীচে বেয়ে নামছে!
আর এই শুভ্র পানি যদি স্নিগ্ধ বাতাসে আমাদের শরীরকে শীক্ত করে তাহলে কার না ভালো লাগবে?? সাজেকের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে কংলাক ঝর্ণায় এসে এই অরূপা ঝর্ণার দৃশ্য দেখে
সোহার চোখ জুড়িয়ে গেলো। প্রকৃতির সাথে প্রকৃতির তুলনা করা নিতান্তই বোকামো কিন্তু সোহা সেটা না করে পারলো না। হাজাছড়া ঝর্ণার থেকেও এই ঝর্ণা টির দৃশ্য মনে বেশি জায়গা করে নিলো সোহার। ছিটে ছিটে পানির ছোঁয়ায় নিজেকে একদম স্নিগ্ধা মনে হয়।
সন্ধ্যা হওয়ার আরো কয়েকঘন্টা বাকি তখন সবাই আবার কমলাক ঝর্ণার উপরে কংলাক পাহাড়ে উঠতে থাকে।

কংলাক পাহাড়ে রাস্তা মোটেই সুবিধাজনক নয়। উঠার সময় এদিক থেকে ওদিক হলেই খাদে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সোহা একদম শানের বাহু জড়িয়ে ভয়ে গুটি শুটি পায়ে উপরে উঠছে। শান একদম নির্ভয়ে বসে আছে যেনো কোনো চিন্তাই নেই। খাদে পরে গেলেও চিন্তা থাকবে না তার। সোহার চারপাশে তাকাতেই মাথা ঘুরতে থাকে তাই সেদিকে না তাকিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে।
কংলাক পাহাড়ের উপরে কংলাক পাড়া অবস্থিত।সাজেক ভ্যালি মূলত রুইলুই পাড়া এবং কংলাক পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায়।
কংলাক পাহাড় থেকে লুসাই পাহাড় স্পষ্ট দেখা যায়। চারদিকে পাহাড়, সবুজ আর মেঘের অকৃত্রিম মিতালী চোখে পড়ে। সাজেক ভ্রমণরত পর্যটকদের কাছে এটি এখন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। রুইলুই পাড়া হতে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরত্বে এটি অবস্থিত। সাজেকের হ্যালিপ্যাড হতে ৩০-৪০ মিনিট ট্রেকিং করে কংলাক পাড়ায় আসতে হয়।
কংলাক পাড়াটি কমলাক পাড়া নামেও পরিচিত। স্থানীয় তথ্য মতে, এই পাড়াটির পাশে বড় বড় কমলা বাগান অবস্থিত বলে এটিকে কমলাক পাড়া বলা হয়। পাহাড়ের নিচে কংলাক ঝর্ণা রয়েছে এবং এই ঝর্নার নামানুসারেই এই পাহাড়ের নামকরণ করা হয়েছে।
পাহাড়ের উপরে উঠটেই সবাই একপ্রকার স্তব্ধ হয়ে গেলো। এখান থেকে পুরো সাজেকের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। সূর্যাস্ত হওয়ার এখন কিছুটা সময় রয়েছে। তাই সবাই কংলাক পাহাড়ের আশেপাশে ঘুরতে থাকে।
সোহা হাটতে দেখে সবাই ছোট ছোট বাশের টুকরো নিয়ে চুমুক দিচ্ছে। সোহা মুখ কুচকে
বলে
” ব্যাম্বু চিকেন খেয়ে কি পাগল হয়ে গিয়েছে নাকি সবাই ?? এখন এসব বাশ নিয়েও খাওয়া শুরু করে দিয়েছে চিকেন পাওয়ার আশায়।” সোহার কথা শুনে শান, ইতি, ইমন একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠে। সোহা বোকার মতো তাকিয়ে থাকে। ওদের এমন হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছে না সোহা।
শান হাসতে হাসতে বলে
” আরে গাধী এটা ব্যাম্বু টি !!” সোহা অবাক হয়ে যায় শানের কথায়। শান গিয়ে চারটা ব্যাম্বু টি কিনে নিয়ে আসে। সোহার হাতে দিয়ে আবার হেসে দিয়ে বলে
” নাও খেয়ে দেখো সবাই এতোক্ষণ কি খেয়েছ !!” সোহা ব্যাম্বু হাতে নিয়ে উপর নিচ সব দেখতে থাকে। শানদের খেতে দেখে নিজেও খেয়ে টেস্ট করে। খেয়ে অবাক হয়ে বলে
” ওয়াও !! ব্যাম্বু টি তে এতো কিউট টেস্ট ?? আমি তো জানতামই না এসব পাওয়া যায় !! ইশ তাহলে আরো আগেই খেতাম। কিন্তু কেমন যেনো একটা স্মেল আসছে।” শান ব্যাম্বুতে চুমুক দিয়ে বলে
” এটা ব্যাম্বুর স্মেল। বাট অসাধারণ এটা। আমি আগের বারও টেস্ট করেছিলাম।” সোহা কথা না বলে চা খেতে থাকে। পাহাড়ের উপর একটা বাশের ছাউনিও রয়েছে। ভেতরে বসার জন্য বাশের তৈরি চেয়ারের মতো কয়েকটা সিট রয়েছে।
সবাই মিলে একসঙ্গে সন্ধ্যার সূর্যাস্ত দেখে। সাজেকের মূল দৃশ্যের মধ্যে অন্যতম একটা দৃশ্য সূর্যাস্ত।

সোহা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিয়ে শানের বাহু আকড়ে ধরে মাথা এলিয়ে দেয়। শান একহাতে সোহার কোমড় জড়িয়ে ধরে বলে
” তো কেমন লাগলো সাজেক ভ্রমণ ??” সোহা জড়ানো কণ্ঠে বলে
” অসম্ভব আর অসাধারণ !! এখানে এসে এমন দৃশ্য দেখবো আমি ভাবিইনি। আপনার কেমন লেগেছে দ্বিতীয় বার এসে ??” শান মুচকি হাসি দিয়ে সামনে তাকিয়ে বলে
” অকল্পনীয় ভাবে দারুণ !! আগেরবার বন্ধুদের সাথে এসেছিলাম আর এবার তোমার সাথে। তোমার সাথে সাজেক ভ্রমণ অনুভূতিটাই অন্যরকম !!!” সোহা লজ্জামাখা মিষ্টি একটা হাসি উপহার দিলো শানকে। শান সোহার কোমড় আরেকটু শক্তভাবে আকড়ে ধরে বলে
” একটু সাবধানে থেকো। আজকে তো এখানেই পার্টির আয়োজন করা হয়েছে।” সোহা হালকা হেসে মাথা নাড়ায়।
কয়েকজন স্যার আর সিনিয়ার স্টুডেন্টরা মিলে বার বি কিউ এর আয়োজন করছে তাই সবাই কংলাক পাড়া ঘুরার উদ্দেশ্যে হাটতে থাকে।
প্রায় ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর ভারতের লুসাই পাহাড়ের উপর একটা গ্রাম। গ্রামের নাম কংলাক। তিনটি লুসাই জনগোষ্ঠী দ্বারা গঠিত এই কংলাক পাড়া। এর হেড ম্যান চৌমিংথাই লুসাই। কংলাক পাড়া থেকে ভারতের লুসাই পাহাড় দেখা যায়। যেখান থেকে উৎপন্ন হয়েছে কর্ণফুলী নদী।
পাহাড়ের উপর অসাধারন একটা জনবসতি। চমৎকার সুন্দর ও অতি সাধারন একটি গ্রাম এই কংলাক। গ্রামের মানুষগুলো অসাধারন ও অতি মিশুক প্রকৃতির। তারা খুব আপন প্রকৃতির ও অনেক অতিথি পরায়ন ও বটে।
রাতে কংলাক গ্রাম থেকে সাজেকের রুইলুই পাড়ার দৃশ্য অতি মনোরম, দূর থেকে লাল, নীল, ঘরগুলোর রঙ পুরোপুরিভাবে বোঝা না গেলেও কিছুটা বোঝা যাচ্ছে আর এটা পোস্টারের মতো লাগছিল! আসলে সাজেক এর অপরূপ এই সৌন্দর্য শুধু মাত্র কংলাকে আসলেই দেখা যায়। মূলত সাজেক আসার মূল রহস্য এই কংলাক গ্রামটি।
শীতে পাহাড়ের চূড়া যখন হালকা কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে তখন বসন্তের শেষ বিকাল পেরিয়ে পশ্চিমের আকাশ বিদায়ি সোনার সিংহ সূর্য দেবতা সম্পূর্ণ হেলে পড়ার সেই অপূর্ব দৃশ্যটি দেখা মিলে শুধু মাত্র এই কংলাক গ্রামটিতে। বলতে গেলে কংলাকে দাঁড়ালে সাজেকের পুরো সৌন্দর্য একসাথে দেখা যায়। প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত আমাদের এই কংলাক গ্রামটি।
সোহারা এখানের জনগোষ্ঠীদের মধ্যে অনেকের সাথে কথা বলে। তারা সোহাদের খুব সুন্দর করে অতিথি আপ্যায়ন করে। তাদের থেকে অনেক কিছুই জানা যায়। জুম চাষ এ পাড়ার প্রধান খাদ্য ও উপার্জনের উৎস। বেশি চাষ হয় হলুদ, আদা ও কমলার। কংলাকে পানি সংকট রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতেই চোখে পড়বে একাধিক ও বড়বড় পানির রিজার্ভার। বৃষ্টির জমানো পানিই এ পাড়ার পানির মূল উৎস। অধিবাসীরা ঘরের চালা থেকে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে রিজার্ভারে ধরে রাখেন ও দৈনন্দিন কার্যাদি সম্পন্ন করেন।এলাকায় পানি কিছুটা অপ্রতুল বলে পর্যটকদের সাথে করে পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য বলা হয়।

কংলাক পাড়া ঘোরা-ঘুরি করে অনেক্ষণ পর সবাই তাদের গন্তব্যস্থলে ফিরে আসে। সবাই তাদের ববন্ধুবান্ধব নিয়ে গল্প করতে থাকে, গান গাইতে থাকে। শানকে স্যারদের সাথে দেখে সোহা একাই পাহাড়ের কোণার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নিজের কোমড়ে অপরিচিত একহাতের ছোঁয়া পেয়ে সোহার বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। বুকে সাহস নিয়ে নিশ্বাস আটকে সোহা না দেখেই ঘুরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। থাপ্পড়ের প্রতিদ্ধনি বাজতে থাকে চারপাশে। চারদিকে নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে থাকে। শান, ইতি, ইমন সোহার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে দ্রুত পায়ে। সোহার চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরে। হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে দেখে হৃদয় গাকে হাত দিয়ে হিংস্র ভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হৃদয় সোহার দিকে এগিয়ে এসে সোহার মুখ চেপে ধরে বলে
” খুব বেশি দেমাক তোর তাই না ?? এবার দেখবো তুই আর তোর দেমাক কোথায় থাকে !!” বলে সোহাকে পেছনের দিকে ধাক্কা দেয়। সোহা ভয়ে জোড়ে চিৎকার করে উঠে সাথে সাথে সবাই একসঙ্গে পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে। পা ফসকে পরে যাওয়ার আগেই সোহা হৃদয়ের এক হাত ধরে নেয়। হৃদয় তা দেখে শয়তানি একটা হাসি দেয়। সোহাকে এমন অবস্থায় শানের পা জোড়ে থেমে যায় সেখানেই। শানের পুরো পৃথিবী টাই থমকে যায় বুকের ভেতর খা খা করতে থাকে। হৃদয় নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বলে
” এবার কি করবে মিসেস শান চৌধুরি ?? এখন তোমার প্রাণটাই আমার হাতে। আমি হাতটা ছারলেই, ফুসস !!!” সোহা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” আমাকে ছাড়বেন না প্লিজ !! শান কোথায় আপনি !!” শান সোহার মুখে নিজের নাম শুনে সোহার দিকে তাকায়। সোহা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে তার দিকে। শান দৌড়ে এগিয়ে যেতেই হৃদয় সোহাকে আরো ঠেলে বলে
” একদম না !! আর এক পা এগোলেই তোর প্রাণের সোহা আকাশের তারা হয়ে যাবে।” একবার নিচে তাকিয়ে সোহার মাথা ঘুরে উঠে। এখান থেকে পড়লে বাঁচার কোনো সম্ভাবনা নেই। সোহা কাঁদতে কাঁদতে আকুতি ভরা গলায় আরো জোড়ে বলে উঠে
” শান আমাকে নিয়ে জান এখান থেকে।” শান কাঁপাকাঁপা গলায় বলে উঠে
” হ-হৃদয় !! সোহাকে ছেড়ে দে বলছি ?? এ-এমন কেনো করছিস তুই ??” হৃদয় চেঁচিয়ে বলতে থাকে
” আরে চুপ কর !! তুই আর তোর বউ আমাকে কম জ্বালাস নি !! পুরো আমাকেই বিরক্ত করে তুলেছিস। রাতের ঘুম হারাম করে নিয়েছিস তোরা। তোর বউ এর সাহস কি করে হয় আমাকে থাপ্পড় মারার ??” সোহা কাঁদতে কাঁদতে বলে
” আপনি কেনো আমাকে বাজে ভাবে ছুঁয়েছেন ??” হৃদয় সোহার হাত আলগা করে দেয়। সোহা চিৎকার করে উঠতেই আবার ধরে নেয়। শান সোহার কথা শুনে রেগে যায় আর সোহার অবস্থান দেখে ভয় হরে থাকে। শান কাপঁতে কাপঁতে বলে
” হৃদয় ভালোভাবে বলছি আমি ছেড়ে দে ওকে নাহলে তুই পস্তাবি !!” হৃদয় বাকা হাসি দিয়ে বলে
” যা পস্তানোর তোরাই পস্তাবি। আমার আর কি হবে ??” ইমন চুপিচুপি হৃদয়ের পেছনে আসতেই হৃদয় রেগে বলে
” তোরও দেখছি খুব সাহস ?? এবার যা করবো সেটার পর কেউ আর আমাকে সাহস দেখাতে পারবি না।” ইমন দুই অয়া পিছিয়ে বলে
” কিছু করবে না !! আমি আসছি না।” রিমি ভীতু গলায় বলে।
” হৃদয় !! এই কাজটা অন্তত করো না !! এটা করলে তোমার জেল সহ ফাসি ও হবে। তোমার ভালোর জন্য বলছি এমন করো না প্লিজ !!” হৃদয় বিরক্ত গলায় বলে
” রিমি প্লিজ !! তুমি আমার কাজে বাধা দিও না।” প্রিন্সিপ্যাল স্যারসহ সবাই সোহাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য বলতে থাকে। রিমি বুঝে গেলো হৃদয় তার কথায় অটল। হৃদয় কিছু করেই ছারবে। শানও হৃদয়ের কাছে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু হৃদয়ের সামনা সামনি থাকায় শান নড়তেও পারছে না। এদিকে সোহার হাতও প্রায় আলগা হয়ে আসছে। সোহা জোড়ে জোড়ে শানের নাম নিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।

চলবে~ইনশাল্লাহ……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে