তুমিময় ভালোবাসা পর্ব-২৪+২৫

0
1707

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব : ২৪
#লেখিকা : মার্জিয়া রহমান হিমা

অবশেষে সবাই রিসোর্টে এসে পৌঁছায়। সবাইকে সবার রিসোর্ট রুম দেখিয়ে দেওয়ার পর সবাই রেস্ট নিতে থাকে। প্রায় দুই ঘন্টা রেস্ট করার পর শান সোহাকে নিয়ে বের হয় চারপাশে হাটার জন্য। সোহা ইতিকেও ফোন করে নিয়ে আসে আর ইতির পেছন পেছন ইমনও চলে আসে। ভার্সিটি থেকে ফার্স্ট এবং থার্ড ইয়ার এর স্টুডেন্ট প্রায় ছয়শ স্টুডেন্ট ট্যুরে এসেছে। আরো অনেক স্টুডেন্টই আসেনি। এতো স্টুডেন্ট হওয়ায় স্যাররা নির্ধারিতভাবে কোনো একটা রিসোর্ট বুক করতে পারেনি। একটা রিসোর্টে এতো মানুষের জন্য রুম বুক করা অসম্ভব তাই কয়েকটা রিসোর্ট বুক করা হয়েছিলো সবার জন্য।
রুংরাং রিসোর্ট, পারাদিস রিসোর্ট, ক্লাসিক রিসোর্ট, দার্জিলিং রিসোর্ট, মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট, মেঘাদ্রি একো রিসোর্ট, অবকাশ একো রিসোর্ট, মেঘালয় রিসোর্ট, রুলুই রিসোর্ট, মেঘ মাচাং রিসোর্ট আরো কয়েকটা রিসোর্ট নিয়ে ভার্সিটির সব স্টুডেন্ট এবং স্যাররা রয়েছে।
সব গুলোর মধ্যে শান আর সোহা, ইতি, ইমন আরো কয়েকজন মেঘপুঞ্জির রিসোর্ট টা বেছে নিয়েছে। শান, সোহা দুজনের কাছেও এই রিসোর্ট টা খুব পছন্দ হয়েছে। শান,সোহা আলাদা কটেজে থাকতে চাইলেও প্রিন্সিপ্যাল স্যার দুজনকে একটা রুম অফার করেছে। তাই দুজন একটা কটেজেই থাকবে।”
শান, সোহা, ইতি, ইমন আরো কয়েকজন স্টুডেন্টরা চারপাশে ঘুরছে। বিকেল হওয়ায় বাইরের অনেক মানুষ রয়েছে।

সাজেক উপত্যকা বাংলাদেশের রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অন্তর্গত সাজেক ইউনিয়নের একটি বিখ্যাত পর্যটনস্থল। রাঙামাটির একেবারে উত্তরে অবস্থিত এই সাজেক ভ্যালিতে রয়েছে দুটি পাড়া- রুইলুই এবং কংলাক। সাজেক ভ্যালি “রাঙামাটির ছাদ” নামেও পরিচিত।
সাজেক রুইলুইপাড়া, হামারিপাড়া এবং কংলাক পাড়া, এই তিনটি পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। ১৮৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত রুইলুই পাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১,৭২০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত আর কংলাক পাড়া ১,৮০০ ফুট উচ্চতায় কংলাক পাহাড়-এ অবস্থিত।
সাজেকে মূলত লুসাই, পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা উপজাতি বসবাস করে। রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে। এই জন্য সাজেক ভ্যালিকে রাঙামাটির ছাদ বলা হয়।
কর্ণফুলী নদী থেকে উদ্ভূত সাজেক নদী থেকে সাজেক ভ্যালির নাম এসেছে।
সাজেক ভ্যালি রাঙামাটি জেলার সর্বউত্তরের মিজোরাম সীমান্তে অবস্থিত। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার। আর দীঘিনালা থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার। সাজেক রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও খাগড়াছড়ি থেকে এখানে যাতায়াত সুবিধাজনক।
সাজেকের উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা, দক্ষিণে রাঙামাটির লংগদু, পূর্বে ভারতের মিজোরাম, পশ্চিমে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা অবস্থিত।সাজেক ইউনিয়ন হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন; যার আয়তন ৭০২ বর্গমাইল। এখানে সাজেক বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে।

সোহা চারপাশ ঘুরেই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে এতো মনোমুগ্ধকর একটা জায়গা সাজেক। সোহা আফসোস স্বরে বলে উঠে
” এই সাজেকের নামটা যে কোন আলমারির ভেতরে লুকিয়ে ছিলো কে জানে !! আমি জানতামই না সাজেক বলে কোনো জায়গা আছে।” শান হা হা করে হেসে দেয় সোহার কথা শুনে। সোহা রেগে বলে
” কি হলো আপনি হাসছেন কেনো ?? হ্যা !! আমি হাসার মতো কি বলেছি ?? আমার দুঃখের সময়ই আপনাকে মন খুলে হাসতে দেখি। খুবই পচা ইনসান আপনি।” বলে মুখ ফিরিয়ে নেয় সোহা। শান হাসি আটকে সোহার হাত ধরে বলে
” আচ্ছা সরি পিচ্চি রাগ করো না। আমি তো তোমার কথা শুনে হাসছিলাম। তুমি পিচ্চি মানুষ তো তাই হয়তো সাজেকের মতো বিখ্যাত একটা জায়গায় নাম শোনোনি। বাচ্চা মানুষ নিয়ে এখানে আসলে তো অনেক রিস্ক। তুমি শুনলে এখানে আসতে চাইতে তাই আংকেল, আন্টি তোমাকে নামটা বলেনি।” সোহা রেগে বলে
” আপনি আমাকে লেগফুল করছেন ??” সোহাকে রাগতে দেখে শান আবার গা দুলিয়ে জোড়ে জোড়ে হাসতে থাকে। ইতি আর ইমন কিছুদূরেই হাটছিলো। হাটছিলো বললে ভুল হবে ইমন বারবার ইতির পেছনে লাগছিলো তাই ইতি ওর থেকে সরতে চাইছিলো কিন্তু ইমন কিছুতেই সরতে দিচ্ছিলো না। সোহার কথা দুজনের কানেই এসেছে তাই দুজন এগিয়ে আসে। এসে দেখে সোহা রাগি ভাবে তাকিয়ে আছে শানের দিকে কিন্তু চোখ ছলছল করছে আর শান সোহাকে বলছে
” কেঁদো না প্লিজ !! আমি তো এমনি বলছিলাম। তুমি তো গুড গার্ল মেয়ে কাঁদে না প্লিজ !!” সোহা চোখ মুছে নাক টেনে ছলছল চোখের কান্না নামিয়ে নেয়। ইমন এগিয়ে এসে চোখ বড়বড় করে বলে
” আপু কি বাচ্চাদের মতো কাঁদেন নাকি ??” সোহা এবার নাক ফুলিয়ে ইমনের দিকে তাকায়। কেঁদে দেবে এমন ভাব তখন শান এসে ইমনকে ধমক স্বরে বলে
” এই কোথায় কি বলতে হয় জানো না ?? আমার বউ বাচ্চাদের মতো কাঁদতে যাবে কেনো ?? বড় দের মতো করে কাঁদে।” বলে সোহার দিকে তাকিয়ে দেখে সোহা গম্ভীর ভাবে এবার ওর দিকে তাকিয়ে আছে। শান গলা ঝেড়ে বলে
” নাহ নামে তুমি কাঁদোই না। আচ্ছা চলো আমরা ওই পাশটা ঘুরে আসি।” শান সোহাকে নিয়ে অপরপাশে চলে গেলো। দুজনের কাহিনী দেখে ইমন ফিকফিক করে হেসে দেয়। ইতি হাসতে নিলেও ইমনকে দেখে রেগে চোয়াল শক্ত করে নিলো। গম্ভীর চেহারায় ইমনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ইতিকে দেখে ইমন মুচকি মুচকি হেসে বলে
” তোমার বান্ধবীর আচরণগুলো কিছুটা বাচ্চাদের মতো।” ইতি চোয়াল শক্ত করে ইমনের দিকে তেড়ে এসে বলে
” এই আপনার সমস্যা কি হ্যা ?? সেই কখন থেকে পেছনে পরে আছেন !! আপনাকে আগ বাড়িয়ে ওদের মাঝে কে কথা বলতে বলেছিলো ?? হ্যা !! আমার পেছন পেছন যদি আর একবার আপনাকে আসতে দেখি তাহলে পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবো। হুহ !!” ইমন তবুও মুচকি মুচকি হাসতে থাকে। ইতি ভেংচি কেটে সেখান থেকে চলে আসে।
শান সোহাকে নিয়ে মেঘ দেখতে দেখতে সোহার হঠাৎ হৃদয়ের দিকে চোখ যায়। রিমি হৃদয়ের হাত আঁকড়ে ধরে দুজন দুজনের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। সোহা ভ্রু কুচকে নিলো দুজনকে এভাবে দেখে। যখনই হৃদয়কে দেখে তখনই হৃদয়ের সাথে রিমিকে লেপ্টে থাকতে দেখতে পায়। সোহা নাক ছিটকে বলে
” ছিঃ !! এই মেয়ের লজ্জা শরম কিছু নেই। যেখানেই যায় এই বদমাইশ লোকটার সাথে লেপ্টে থাকে !! এখানে এতো মানুষের মাঝেও এভাবে লেপ্টে আছে।” শান একবার হৃদয় আর রিমির দিকে চোখ বুলিয়ে শান্ত গলায় বলে
” ওরা রিলেশনশিপ করতো পরে ওদের মা,বাবা ওদের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে তাই এভাবে লেপ্টে থাকে। ওরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে। বুঝেছেন ম্যাডাম ??” সোহা অবাক হয়ে বলে
” আপনি এতো কিছু কি করে জানলেন ?? আমি তো নিজেই কিছু জানতে পারলাম না !!” শান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে
” আমার কাছে সব ডিটেইলসই আছে। কিন্তু ওদের দেখে আমাদের লাভ কি ?? আমাদের তো বিয়েও হয়ে গিয়েছে কিন্তু একটু ভালো করে হাতটাও ধরতে পারলাম না।” সোহা ক্ষুদ্ধ চাহনি দিয়ে বলে
” এতো হাত ধরাধরি কিসের হ্যা ?? বিয়ের দিন থেকে কতোকিছুই না করলেন !! শুধু মারতে পারেন নি মামনি, ভাইয়াদের জন্য। আর এখন হাত ধরতে এসেছেন ?? আপনি নিজেই বলেছিলেন আগে বন্ধুত্ব তারপর সব। আমরা তো বন্ধুত্বের ধাপই পার করেনি এখনও !! আর আপনি তো একটু আগেই আমাকে বাচ্চা বললেন আর এখন হাত ধরতে চাইছেন ??” শান চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বলে
” একটু হাত ধরতে চেয়েছি বলে এতো কথা ??” সোহা জোড়ে জোড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে
” হ্যা।” শান আর কোনো কথা বললো না। ঢোক গিলে সোহাকে নিয়ে কটেজেই চলে আসে।
সোহা,শান রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাড়ির সবার সাথে অনেক্ষণ কথা বলে। ডিনার টাইমে সব টিচার, স্টুডেন্টরা আবার একসাথে হয়। সবাই মিলে কয়েক মিনিট হাটার পর আশেপাশেই প্রচুর রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলো। ফুডানকি, মনটানা, চিম্বাল এই তিনটি রেস্টুরেন্ট এর জনপ্রিয়তা বেশি এবং খাবার, পরিবেশ অসাধারণ। সবাই ফুডানকি, মনটানা রেস্টুরেন্টে ডিনার সেড়ে যার যার কটেজে ফিরে যায়।

আজকের সকালটার রচনা হয় একটু অন্যভাবে। সকালের শুরুতেই ঠান্ডা ঠান্ডা আভাস। সোহার ঘুম ভাঙতেই কিছুক্ষণ জেগে জেগে শুয়ে থেকে আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে ব্ল্যাংকেটে মুড়িয়ে নেওয়া আলগা খোলস থেকে ছাড়িয়ে নেয়। ঘুমঘুম চোখে কটেজের বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। চোখ খুলে চারপাশে তাকাতেই চোখ মুগ্ধ হয়ে যায়। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে মনে হলো এখানে না আসলে হয়তো কখনো এভাবে দেখাই হতো না। চারপাশে মেঘে আচ্ছন্ন দৃশ্য ফাঁকেফাঁকে সবুজ গাছগাছালিতে ঢাকা পাহাড়ের শরীর। উপরের দিকে পাহাড়ের সরু মাথাটা। সোহার মনে হলো কোনো এক মেঘের রাজ্যে এসে পড়েছে। মেঘরা নিজেদের মধ্যে খেলা করছে আর সোহা অতিথিরূপে এসেছে। সময় নষ্ট না করে শানকে ডেকে তোলে। এমন অপরুপ দৃশ্য দেখে কিছু মুহূর্তেই শানের ঘুমের রেশ কেটে যায়। শানও মুগ্ধ নয়নে মেঘের দৃশ্য দেখতে থাকে।

চলবে।

#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব : ২৫
#লেখিকা : মার্জিয়া রহমান হিমা

সোহার মনে হলো কোনো এক মেঘের রাজ্যে এসে পড়েছে। মেঘরা নিজেদের মধ্যে খেলা করছে আর সোহা অতিথিরূপে এসেছে। সময় নষ্ট না করে শানকে ডেকে তোলে। এমন অপরুপ দৃশ্য দেখে কিছু মুহূর্তেই শানের ঘুমের রেশ কেটে যায়। শানও মুগ্ধ নয়নে মেঘের দৃশ্য দেখতে থাকে।
সাজেক ভ্যালির পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় রিসোর্ট গুলোর মধ্যে মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট (Meghpunji Resort) অন্যতম একটি রিসোর্ট। এই রিসোর্ট এর প্রতিটি কটেজ গ্লাস দিয়ে ঘিরে দেবার কারণে কটেজের ভিতর থেকেই রয়েছে ফুল ইনিফিনিটি ভিউ! এছাড়াওপ্রতিটি কটেজেই পূর্ব দিকে মুখ করে খোলা বারান্দা আছে যাকে আমরা The Cloud Terrace বলে থাকি যেখান থেকেও মেঘ, পাহাড় ও আকাশের Open Infinity View পাওয়া যায়।
সোহারা যেই কটেজে রয়েছে সেটা তারাশা কটেজ যেটার ৮৯! ডিগ্রী ভিউ পাওয়া যায় এবং কটেজটি একটু বড়।
শান বাইরে থেকে দৃষ্টি সড়িয়ে সোহার দিকে তাকায়। সোহা ড্যাবড্যাব করে বাইরে তাকিয়ে আছে। শান ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সোহার দিকে। সোহার পেছনে গিয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। সোহা মেঘের রাজ্যে এতোটাই মগ্ন হয়ে ছিলো যে শান তার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালও করেনি। শানের নিশ্বাস সোহার কাধে বারি খেতেই সোহার শিরা উপশিরা দাঁড়িয়ে যায়। সোহা কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নেয়। শান ঝুকে সোহার কাধে থুতনি রাখে। সোহা চোখ বন্ধ করেই নিজের জামা খামছে ধরে শক্ত করে। শান সোহার কোমড়ে আলতো ভাবে হাত রেখে বলে
” প্রকৃতির সব রূপ একসাথে হলেও আমার কাছে তোমার রূপই অপরূপ সৌন্দর্য। তুমি আমার রাজ্যে অপরূপা। যার সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।” শান আরো কিছু বলার আগেই সোহা শানকে ছাড়িয়ে দূড়ে ছিটকে আসে। সোহা জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। শান ভ্রু কুচকে শান্ত গলায় বলে
” কি হয়েছে ??” সোহা ঢোক গিলে শানের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে বলে
” আপনি এভাবে ছোঁবেন না !!” শান সরু ভাবে তাকিয়ে বলে
” কেনো ??” সোহা অসহায় ভাবে কাঁদোকাঁদো গলায় বলে
” আমার এখন কেমন কেমন জানি লাগলো। মনে হয় কি আমার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে আবার শরীর কাঁপুনি উঠে আরো…..কেমন কেমন যেন লাগে।” সোহার আড়ালে শান ঠোঁট কামড়ে হাসে। সোহা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলে
” আমার এমন লাগলো কেনো ??” শান সোহার দিকে দুই অয়া এগিয়ে এসে মুখ শুকিয়ে বলে
” কারণ তুমি একটা অনেক বড়রকমের রোগে আক্রান্ত হতে যাচ্ছো। যেই রোগটার চিকিৎসা কেউ করতে পারে না। এই রোগে যে একবার আক্রান্ত হয় সে সারাজীবন এই রোগাক্রান্ত রোগি হয়ে থাকে। তুমি এখন এই রোগে প্রথম পর্যায়ে আছো ধীরে ধীরে এটা অনেক গভীর ভাবে তোমাকে আকড়ে নেবে।” সোহা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলে
” তাহলে তো আমি অসুস্থ হয়ে যাবো !! আমি কি পরে মরে যাবো ??” শানের বুকে চিনচিন ব্যাথা করে উঠে সোহার কথা শুনে। শান টান দিয়ে সোহাকে নিজের বুকে ফেলে দেয়। সোহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্থির গলায় বলে
” কিছু হবে না তোমার। কিছু হতে দেবো না আমি তোমার। এই রোগে কেনো !! হাজারো শক্তিশালী রোগ তোমাকে আমার থেকে দূড় করতে পারবে না। ” সোহা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আলতো ভাবে শানের পিঠে এক হাত রাখে। তারপর ভাবুক হয়ে বলে
” আচ্ছা রোগটার নাম কি ??” শান সোহার মাথায় থুতনি রেখে বিরবির করে বলে
” ভালোবাসার রোগে আক্রান্ত হচ্ছো তুমি !!” সোহা মুখ কুচকে নেয় শানের বিরবির করে বলা কথাটা তার কান পর্যন্ত এসে পৌছাতে সক্ষম হয়নি। সোহা মাথা উঁচু করে শানের দিকে তাকিয়ে বলে
” কি বললেন আপনি ?? শুনতে পাইনি আমি।”
শান ধীর গলায় বলে
” কিছু না, তোমাকে এসব জানতে হবে না এখন।গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও ব্রেকফাস্ট করে তো আবার বের হতে হবে।” কথা শেষ করে শান সোহা কপালে একটা চুমু একে দেয়। আবার সোহার শরীরে কাটা দিয়ে উঠে। শান সোহাকে ছেড়ে ওয়াসরুমে চলে যায়। সোহা কপালে হাত রেখে বিরবির করে বলে
” আবার এমন হলো ??” ভাবতে ভাবতে সোহা আবার মেঘের রাজ্যে হাড়িয়ে যায়।

কটেজ থেকে বেড়িয়ে সবাই ব্রেকফাস্ট শেষ করে নেয়। সবাই মিলে হাজাঝড়া ঝর্ণায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। স্যাররা সবাইকে নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে যায়। মূলত এখান থেকেই চাঁন্দের গাড়ি নিয়ে রওনা দেওয়া হবে।
শান কিছুক্ষণ ধরেই সোহাকে খুব গভীর ভাবে খেয়াল করছে। সোহা সেনাবাহিনীর একটা লোকের দিকে বারবার কেমন করে তাকাচ্ছে। শান লোকটাকে ভালো করে দেখে নিলো। সাজেক সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ার কারণে এখানের ট্যুরিস্টদের সেফটির জন্য প্রত্যেককে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীদের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হয়। কালকে দীঘিনালা ক্যাম্প থেকে আসার সময় এই সেনাবাহিনীদের মাঝে এই লোকটাকেও দেখেছিলো। এটা ভার্সিটি ট্যুর আর প্রচুর স্টুডেন্ট হওয়ার জন্য সেনাবাহিনীরা কিছুটা ঘনঘনই আসা যাওয়া করছে। এখনও স্যারদের সাথে কথাবার্তা বলছে। সোহাকে অনেক্ষণ ধরে সেই সেনাবাহিনীর লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে শানের মাথায় আগুন ধরে যায়। শান রেগে সোহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সোহার পাশে ইতি আর ইমন দাঁড়িয়ে ছিলো।ইমন শানকে দেখে কিছু বলতে নেওয়ার আগেই শান রাগি গলায় সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে
” সোহা !! প্রবলেম কি তোমার ?? তুমি।এভাবে ওইদিকে তাকিয়ে আছো কেনো ??” শানের কথা শুনে সোহা ঘার ঘুড়িয়ে শানের দিকে তাকায়। শান চোয়াল শক্ত করে রাগি ভাবে তাকিয়ে আছে। ইতি আর ইমন একে অপরের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসতে থাকে শানের কথা শুনে। শান আবারও বাজখাঁই গলায় বলে উঠে
” কি হলো কথা বলছো না কেনো ??” সোহা মাথা ঘুরিয়ে আবার লোকটার দিকে তাকিয়ে ফের শানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস গলায় বলে
” আপনি জানেন ?? লোকটাকে আমি কালকে সন্ধ্যায় দেখেছিলাম আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ের সাথে কিন্তু তখন মনে হয় অফডিউটি ছিলো তাই অন্য পোশাকে দেখেছিলাম। একটু আগে দেখলাম দুজন ইশারায় কথা বলছিলো।” শান তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে
” তোমার এতোদিকে চোখ যায় কেনো, হ্যা ?? কালকে রিমি আর হৃদয়কে নিয়ে পরেছিলে আজকে আবার ওদের নিয়ে পরে আছো। তুমি কি সাজেকে এনজয় করতে এসেছো নাকি ওদের দিকে গবেষণা করতে এসেছো সেটা বলো আমাকে।” শানের কথা শুনে সোহা মুখ ফুলিয়ে নেয়। ইতি সোহার গাল চেপে বলে
” তোর এই মুখ ফুলানো কবে কামাবি ?? কিছু হলেই মুখ ফুলিয়ে রাখিস !!” সোহা রেগে বলে
” অদ্ভুত !! আমি যা করি তাতেই সবার সমস্যা। করবো টা কি আমি ??” শান সোহার হাত ধরে বলে
” কিছু করতে হবে না। শুধু আমার সাথে থাকো। এদের নিয়ে গবেষণা করতে করতে কখন যে তুমি গবেষক হয়ে হারিয়ে যাও তার কোনো গ্যারান্টি নেই। চলো !!” সোহা ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইমন সোহার কাহিনী হাসছে সেই কখন থেকে। ইতি এবার চোখ রাঙিয়ে ইমনের দিকে তাকায়। ইমন হাসতে হাসতে ইশারায় জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। ইতি কিড়মিড় করতে করতে বলে
” আপনাকে আমি কালকে বলেছিলাম না ?? আমার পেছন পেছন আসবেন না !! আবার আপনি এসেছেন। ইচ্ছে করছে খুন করে ফেলি।” ইমন চোখ ছোট ছোট করে বলে
” আমি কখন তোমার পেছন পেছন এসেছি ?? আমি তো তোমার সাথে সাথে এসেছি। পেছন পেছন আসতে নিষেধ ছিলো কিন্তু সাথে সাথে আসার জন্য তো নিষেধ ছিলো না !!” ইতি হা করে তাকিয়ে থাকে ইমনের যুক্তি শুনে। ইমন দাঁত কেলিয়ে তাকায়। পাশ থেকে শান দুজনকে দেখে মনে মনে হাসছে।
কিছুক্ষণ পর স্যাররা আসতেই সবাই গাড়িতে উঠে বসে। একটা চাঁন্দের গাড়িতে প্রায় ১০-১২ জন বসতে পারে। একটা একটা করে সব গুলো গাড়ি চলা শুরু হয়।

———-
হাজাছড়া ঝর্ণাটি রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক পাহাড়ি ঝর্ণা। সাজেকগামী পর্যটকদের কাছে বর্তমানে এই ঝর্নাটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
হাজাছড়া ঝর্ণা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার বাঘাইহাট এলাকায় অবস্থিত। মূল রাস্তা হতে ১৫ মিনিট ঝিরিপথ ধরে হেঁটেই পৌঁছানো যায় ঝর্ণার পাদদেশে। ঝর্ণার হীমশিতল পানি আর সবুজেঘেরা ঝিরিপথ প্রত্যেক পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। শীতকালে এর পানির প্রবাহ কমে যায়। হাজাছড়া নামক এলাকা হতে ঝর্ণার উৎপত্তি বিধায় এর নাম হাজাছড়া ঝর্ণা। এটি শুকনাছড়া ঝর্ণা বা দশ নাম্বার ঝর্ণা নামেও পরিচিত। ঝর্ণাটির স্থানীয় পাহাড়িদের দেয়া নাম হল চিত জুরানি থাংঝাং ঝর্ণা; যার অর্থ মন প্রশান্তি ঝর্ণা।
হাজাছড়া ঝর্নাটি এখানে রিছাং নামেই বেশ পরিচিত। যাত্রা শুরু এই ঝর্নার পথ ধরে। বেশ খানিকটা খাড়া ঢাল, তবে ঢাল খাড়া হওয়ার পরও নিচে নামতে তেমন কোনও কষ্ট হয় না। ঝর্নার সামনে যাওয়া মাত্র ঝিরিঝিরি পানির ছিটা শরীরে এসে লাগলে,অদ্ভুত এক ভালো লাগা হৃদয় ছুঁয়ে যায়।মাঝখানে সুবর্ণ গতিতে পানির বয়ে চলা আর চারপাশটা সবুজে বিস্তৃত ঘেরা বনভুমি। এর যতোই গভীরে যাওয়া যায় ততোই গভীর অরণ্যের দেখা মিলবে।
সোহা মুগ্ধ হয়ে পুরো দৃশ্য দেখে যাচ্ছে। চারপাশে গাছের দৃশ্য আর ঝর্ণা থেকে পানি পড়ার শব্দ সবার ধ্যান কেরে নিয়েছে। সবাই এই প্রকৃতির দৃশ্যকে ক্যামেরায় বন্দি করে নিতে ব্যস্ত হয়ে আছে। শানও ক্যামেরা নিয়ে নেমে পড়েছে। সোহা শুরু ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখতে থাকে। ঝর্ণার কাছে এসে হাত দিয়ে পানি ছুঁয়ে দিতেই শরীরে শিহরণ বয়ে যায়। ঝর্ণার শীতলপানি মনের মধ্যে অন্যরকম একটা আনন্দ জাগিয়ে তোলে। সোহা ইতির সাথে পানি নিয়ে খেলতে থাকে। দুজন দুজমের উপর পানি ছিটাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে। শান মুগ্ধ হয়ে সোহাকে দেখছে সোহার আনন্দের প্রত্যেকটা মুহূর্ত ক্যামেরায় বন্দি করে নিতে থাকে। ইমন, ইতি, সোহা, শান সবাই ছবি তোলে শেষে ইমন এসে সোহা আর শানের কয়েকটা কাপল ফোটো তুলে দেয়।
হাজাছড়া ঝর্ণায় আরো কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সবাই আবার সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।
রিছাং বা হাজাছড়া ঝর্নাটি পার হলেই আলোক
নবগ্রহ ধাতু চৈত্য বৌদ্ধ বিহার। আলোক টিলাটির বাহিরে আশেপাশে খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং ভিতর দিয়ে গেলে দেখে মনে হবে একটু আগে কেউ একজন এসে একে সোনালী রং করে গেছে। সেখানকার হিন্দু আদিবাসীরা এখানে এসে প্রার্থনা করেন। চকচকে ও ধকধকে এই মন্দিরটি দূর থেকে দেখে যে কারো সবার নজর কাড়বে। সবাই এই বৌদ্ধ বিহারের চারপাশে ঘুরতে থাকে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে ভেতরে আসছে না শুধু বাইরে থেকে ঘুরে যাচ্ছে। সোহা, শান, ইতি, ইমন সবাই ভেতরে এসে পরিবেশটা দেখে নিলো। মনোমুগ্ধকর পরিবেশের মধ্যে এই স্থানটি আদর্শ স্থানগুলোর মধ্যে একটি।

চলবে~ইনশাল্লাহ……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে