#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ০২
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা
ব্যালকনিতে এসে বাইরের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে
” সোহা কতোটা বাচ্চা সেটা আমি অনেক আগেই নিজের চোখে দেখেছি। সোহাকে আমি যতোটা চিনেছি ততোটা হয়তো তোরাও চিনতে পারিসনি। কেনো আমি সোহাকে বিয়ে করতে চাইছি না সেটা একমাত্র আমিই জানি।”
দেখতে দেখতে দুজনের বিয়ের দিন এগিয়ে আসতে থাকে। সোহা তার নিজের মতো ঘুরে, ফিরে আনন্দ করে সময় কাটাচ্ছে। এদিকে শান ইচ্ছে করে নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছে কারণ শাহানাজ বেগম প্রতিদিন শানকে সোহার সাথে দেখা করার জন্য তাড়া দিয়ে যাচ্ছে। শান প্রতিদিন কাজের বাহানা দিয়ে সোহার সঙ্গে দেখা করতে না গেলেও আজকে শান কোনোমতেই পার পেলো না। মায়ের কথায় বিয়ের জন্য প্রায় সাত দিনের ছুটি নিয়েছে। আর সেই সুযোগে শাহানাজ বেগম আজকে শানকে ধরে বেধে সোহার সঙ্গে দেখার জন্য তৈরি করে হাতে একটা ক্যাফের এড্রেস দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। শান তার মা আর সোহার উপর বিরক্ত হয়ে গাড়ি চালিয়ে কোনোরকমে সেই ক্যাফে এসেছে। কিন্তু সেখানে এসেই বাধলো এক বিপত্তি। শাহানাজ বেগম দুজনের প্রাইভেসির জন্য ক্যাফের একটু দিকে টেবিল বুক করেছে। সেখানে মানুষ নেই বললেই চলে সেটা ঠিক থাকলেও প্রায় আধ ঘন্টা ধৈর্য ধরে সোহার অপেক্ষায় বসে ছিলো শান কিন্তু এখন পর্যন্ত সোহার আসার কোনো হুদিস পেলো না। শান রাগে ফুসফুসতে দাঁতেদাঁত চেপে বলে
” আমি নাকি সোহাকে সময় দেবো। আমার তো এখন মনে হচ্ছে সোহা আমাকে সময় দিতে পারছে না। এতো কিসের কাজ ওর ?? আধ ঘন্টা হয়েছে গিয়েছে কিন্তু এখনও তার দেখা নেই। কি দেখে যে এই মেয়েকে আমার জন্য ঠিক করেছে বুঝতে পারছি না আমি।” পাশে একজন ওয়েটার দাঁড়িয়ে ছিলো শানকে বিড়বিড় করতে দেখে এগিয়ে এসে বলে
” কিছু বলছেন ভাইয়া ??” শান ভ্রু কুচকে তাকায় ওয়েটারের দিকে। রাগে মাথা এতো গরম হয়েছে যে ইচ্ছে করছে এই ওয়েটারকে ডিটারজেন্ট ছাড়াই ধুয়ে দিতে। শান করলও সেই রকম, ওয়েটারের দিকে তাকিয়ে রাগি গলায় বলে
” আপনাদের ক্যাফের এতো নাম কিভাবে হলো আমাকে একটু ডিটেইলসে বলুন তো !! প্রায় ঘন্টা খানেক সময় ধরে বসে আছি এখানে অথচ কোনো ওয়েটার এসে জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না কিছু অর্ডার করবো কিনা। এটা কি নিয়ম ??” ওয়েটার মাথা কিছু করে বলে
” সরি স্যার। মেবি কেউ খেয়াল করেনি তার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আপনি বলুন কি নেবেন আমি এক্ষনই নিয়ে আসছি।” শান শান্ত গলায় বলে।
” ঠিকাছে আমার জন্য ওয়ান কাপ হট কফি নিয়ে আসুন।” ওয়েটার মাথা নেড়ে দ্রুত পা বাড়িয়ে চলে গেলো। ওয়েটার চলে যেতেই শান ঠোঁট চেপে হাসলো। ওয়েটার টা সরল মনের থাকায় এতো কথা শুনে মাথা নিচু করে সরি বলে চলে গিয়েছে। অন্যকেউ হলে হয়তো ঝামেলা পাকিয়ে দিতো। ভাবতে ভাবতে শানের চোখ গেলো ক্যাফের থাই গ্লাসের দিকে। লাল টুকটুকে বিয়ের শাড়ি পড়ে একটা মেয়ে আসছে। মেয়েটা সামনে আসতে আসতে তার চেহারা স্পষ্ট হয়। শান হা করে তাকিয়ে থাকে। সোহা লাল টুকটুকে কাতান শাড়ি পড়ে ঠোঁটে লাল গাঢ় লিপস্টিক, বড় এক জোড়া কানের দুল, হাত ভর্তি লাল রঙের চুড়ি, চুল ছেড়ে এক গুচ্ছ বেলি ফুলের মালা দিয়েছে আর শেষে টমির গলায় বাধা দড়িটা হাতে পেঁচিয়ে এগিয়ে আসছে। সোহাকে দেখে শান কথা বলতে ভুলে গেলো। এই মেয়ে এতো সেজে এসেছে কেনো শান বুঝতে পারছে না। শানের এক সময় চোখ গেলো সোহার চারপাশে। সব ছেলেরা চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে সোহাকে। শান এবার একটু চেহারায় গম্ভীরতা আনলো। সোহা শানের সামনে এগিয়ে এসে মুচকি হেসে বলে
” হাই !! কেমন আছেন ??” শান কিড়মিড় দৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকালো। রেগে বলে
” পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেট করে এসে সরি না বলে কেমন আছি জিজ্ঞেস করছো তুমি ?? আর এইসব কি সেজে এসেছো তুমি ?? দেখা করতে এসেছো নাকি বিয়ে করতে এসেছো সেটা যদি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো তাহলে আমি খুবই উপকৃত হবো।”
সোহা হেসে পাশের চেয়ারে বসে পরলো। শান ভ্রু কুচকে তাকাতেই সোহা চেয়ার দেখিয়ে বলে
” আরে আপনিও বসুন। বসেই তো সব কথা হবে। বসুন, বসুন।” শান তার চেয়ার টেনে বসতেই সেই ওয়েটার এসে শানের কফি দিয়ে গেলো। সোহা ওয়েটারকে উদ্দেশ্য করে বলে
” আমার জন্য একটক কোল্ড কফি আনবেন।” ওয়েটার মাথা নেড়ে চলে যায়। শান এবার কফিতে চুমুক দিয়ে কফি খেয়ে বলে
” এবার দয়া করে বলুন এবার এইসব সেজে এসেছেন কেনো ?? লোক দেখানোর জন্য ??” সোহা ছোট ছোট চোখে শানের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখে ভেংচি কেটে টমিকে কোলে নিয়ে বলে
” আসলে আমি এতো সাজগোছ করি না। তবে আজকে আমার শাশুড়ি মা মানে হবু শাশুড়ি মা আমাকে ফোন দিয়ে বলেছে যে আজকে যেনো আমি হুর পরী সেজে আপনার সামনে আসি। টমির জন্য নাকি আপনি রেগে আছেন সেই রাগ ভাঙাতে আমাকে বেশি করে সাজতে বলা হয়েছে। so, আমি আমার হবু শাশুড়ির বাধ্য বউমা তো তাই আমি তার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। আচ্ছা এখন বলুন তো আমাকে কেমন লাগছে ??” শানের মাথা ঘুরতে লাগলো সোহার কথা শুনে। সোহার এই সাজের পেছনে যে তার মায়ের হাত সেটা শুনে খুবই অবাক হলো। সোহার কথার উওরে শান গম্ভীর গলায় বলে
” তোমাকে আমি সেইদিনই বলেছি আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না। তোমার মতো একটা মেয়েকে আমি কিছুতেই নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে পারবো না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতো মার কারণে আমার তোমাকেই বিয়ে করতে হচ্ছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না। আমার এসব কথার জানার পরও কি করে তুমি এতো সাজগোছ করে এসেছো। তুমি কি মনে করেছো তোমার এই সাজে মুগ্ধ করে তুমি আমাকে ইম্প্রেস করতে পারবে ??”
সোহা ভ্রু কুচকে বলে
” আপনি নিজেকে এতো ইম্পরট্যান্ট কেনো দিচ্ছেন ?? আমি কি নিজের ইচ্ছে মতো সাজতে পারি না ?? আমি আপনাকে ইম্প্রেস করতে যাবো কেনো ?? আমি চাইলে আপনাকে সহ এখানের সবাইকে ইম্প্রেস করতে পারি। কিন্তু এসব কোনোটাই আমি করতে চাই না।” শান তাছিল্য হেসে বলে
” হ্যা তোমার মতো মেয়ে এসব ছাড়া আর কিই বা করতে পারে !!” সোহা রেগে বলে
” আপনার সমস্যা কোথায় বলুন তো ?? আপনি সেই প্রথম দিন থেকে তোমার মতো মেয়ে, তোমার মতো মেয়ে বলে কি বোঝাতে চাইছেন আপনি ?? আপনার মতে আমি কেমন মেয়ে ?? আমি কি এমন খারাপ কাজ করেছি যে বারবার আমাকে এই কথাটা শুনতে হচ্ছে ??”
শান আবারো তাছিল্য সেই ভরা হাসি দিলো। কথা ঘুড়িয়ে বললো
” সেই সব তো পরে জানতেই পারবে। যাই হোক আমি শুধু তোমার সাথে কিছু কথা দরকারি কথা বলে চলে যাবো। দয়া করে আমার কথা গুলো ভালো করে শুনবে।” সোহা কিছু না বলে শক্ত চেহারায় বসে রইলো। শান সোহার দিকে পাত্তা না দিয়ে বলা শুরু বলে
” পরশু আমাদের বিয়ে। বিয়ের পর তুমি তোমার মতো আমি আমার মতো থাকবো। কেউ কারো ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করবো না। আমাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর কোনো সম্পর্ক থাকবে না তবে সেটা শুধুমাত্র আমাদের রুমের ভেতর। আর দয়া করে আমাদের রুমের ভেতরের কোনো কথা যাতে বাইরে না যায়। সবাই যেনো বুঝতে পারে আমরা হ্যাপি মেরিড কাপল।
আমি বলছি বুঝতে পারছো তুমি ??”
সোহা ভ্রু কুচকে বলে
” মানে সবার সামনে মিথ্যা একটা সম্পর্কের ছবি তুলে ধরার দরকার কি ?? যা সত্য তা সবাই একদিন না একদিন জানতে পারবে এভাবে মিথ্যা নাটক করলে যেইদিন সবাই এসব জানতে পারবে সেইদিন সবার মনে আঘাত লাগবে। এর থেকে আমার মনে হয় আমরা যেমন তেমনই থাকবো সবার সামনে।”
শান শান্ত গলায় বলে
” হ্যা ঠিকই বলেছো। তোমার মতো মেয়েরা আর কিছু জানুক না না জানুক কাছের মানুষদের কষ্ট দিতে খুবই এক্সপার্ট। এই বিয়েটার জন্য দুই পরিবার বেশি করে আমার মা এতো খুশি। আমি আমার পরিবারের কষ্ট দেখতে পারবো না তাই এসব মিথ্যার পথে যেতে বাধ্য হতে হচ্ছে। সেখানে তুমি আমার পরিবারকে কষ্ট দেওয়ার জন্য ওদের সামনে আমাদের সম্পর্কের সত্যিটা প্রকাশ করতে চাইছো ?? লাইক সিরিয়াসলি !! আসলেই তোমাকে যা ভেবেছিলাম তুমি সেইরকম। স্বার্থপর, চরিত্রহীন মেয়ে নিজের কথা ছাড়া আর কারো কথা ভাবো না তুমি।”
চরিত্রহীন, স্বার্থপর কথাটা সোহার বুকে গিয়ে লাগলো।
” শান !!” চিৎকার করে সোহা চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। শান দাঁড়িয়ে বলে দাঁতেদাঁত
” চিৎকার করছো কেনো ?? যা সত্যি আমি তাই বলেছি।” সোহা রেগে বলে
” শান আপনি অযথা আমার উপর মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন। আমি আজ পর্যন্ত এমন কোনো কাজ করিনি যার কারণে এই দুটো জঘন্য উপাধি আমি পেতে পারি।” শান রেগে টেবিলে জোড়ে বারি দিয়ে এক হাত রাখে। শানের হাতের কাছে গরম কফির কাপটা ছিলো যেটা জোড়ে হাত রাখায় শানের হাত লেগে কাত হয়ে যায় আর সোহার হাতের উপর গিয়ে পরে।
” আহহ !!” বলে ব্যাথায় কুকড়ে সোহা তার হাত ধরে। কফিটা খুবই গরম ছিলো তাই সোহার হাত সাথে সাথেই লাল আকার ধারণ করে। শান নিজেও চমকে গিয়েছে গরম কফিটা এভাবে পড়ায়। অস্থির হয়ে বলে
” সোহা দেখি হাত দেখাও তোমার।” ব্যস্ত ভঙিতে সোহার হাত ধরতে চাইলে সোহা হাত সড়িয়ে নেয়। ছলছল চোখে শানের দিকে তাকিয়ে বলদ
” আজকে যা করলেন সেটা সারাজীবন মনে থাকবে আমার। আপনারা থেকে অন্তত এসব কথা আশা করিনি আমি।” বলে এক মুহূর্ত দেড়ি না করে একহাতে টমিকে কোলে তুলে পোড়া হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে চলে গেলো। অজান্তে হলেও সোহাকে আঘাত করায় শান খুবই অনুতপ্ত বোধ করলো। শান বিল পে করে ক্যাফ থেকে প্রস্থান করে।
বাড়ি আসারা পর থেকে সোহা মন খারাপ করে ঘর বন্ধি হয়ে আছে। হাত অনেক লাল হয়ে ছিলো বাড়িতে এসেই হাতে ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিয়েছে। এখন টমিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় ডিভানে বসে আছে মন খারাপ করে। বারবার শানের করা অপমান গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দরজায় কড়া পরতেই সোহা উঠে গেলো। পরশু বিয়ে হওয়ায় বাড়িতে প্রচুর আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। তাই দরজা বন্ধ করে বসেছিলো। দরজা খুলতেই মাকে দেখতে পেলো সোহা। সোহা অবাক হয়ে বলে
” মা তুমি এতোরাতে ??” রিয়ানা রহমান মুচকি হাসি দিয়ে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। বিছানায় বসে বলে
” আজকে তোর সাথে ঘুমাবো। দুইদিন পর তো চলেই যাবি আজ নাহয় মেয়ের সাথে সময় কাটিয়ে নেই।” সোহার আবার মন খারাপ হয়ে গেলো। সোহা রিয়ানা রহমানের গা ঘেঁষে বসে বলে
” মা আমি চলে গেলে কাকে আদর করবে তোমরা ??” রিয়ানা রহমান মলিন হাসি দিয়ে বলে
” তোকে আদর করতে ইচ্ছে করলে তোকে ফোন দেবো আর তুই চলে আসবি টমিকে নিয়ে। তখন ইচ্ছে মতো আদর করে দেবো।” সোহা মুচকি হেসে রিয়ানা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। সোহাদের দেখেই টমি বড়বড় করে তাকিয়ে বারান্দা থেকে দৌড়ে এসে ওদের কোলে বসে পরলো। সোহা ভ্রু কুচকে টমিকে উদ্দেশ্য করে বলে।
” কিরে এখানে কি চাই তোর ?? আমাদের মা-মেয়ের মাঝে কেনো এসেছিস ?? আমি এখন আমার মার আদর খাবো যা সর এখান থেকে।” বলে টমিকে হাত দিয়ে সড়িয়ে দিতেই টমি আবার ঘেউ ঘেউ করে আগের জায়গায় এসে বসে পড়লো। রিয়ানা বেগম হেসে বলে
” টমিও আদর খেতে চাইছে। ওওতো চলে যাবে তোর সাথে তাই।” সোহা মুচকি হেসে টমিকে কোলে তুলে নিলো।
———-
অনেক্ষণ আগেই সোহা আর শানের বিয়ের কার্যক্রমের সমাপ্তি ঘটেছে। এখন বিদায়ের পালা এসেছে। সোহার কাদঁতে কাদঁতে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে সিমি আর সামির গিয়ে কোনো রকমে সোহাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। সোহার মা-বাবা শানের দিকে আকুলতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে
থেকে বলে
” আমাদের মেয়েটাকে দেখো বাবা। মেয়েটা অনেক বাচ্চামো করে নিজের মতো শাসন করে সামলে নিও আর কষ্ট দিও না।” শান দুজনের হাত ধরে চোখে পলক ফেলে আশ্বস্ত করে গাড়িতে উঠে বসে।
চলবে~ইনশাল্লাহ……..
#তুমিময়_ভালোবাসা
#পর্ব: ০৩
#লেখিকা: মার্জিয়া রহমান হিমা
সোহার মা-বাবা শানের দিকে আকুলতা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে
” আমাদের মেয়েটাকে দেখো বাবা। মেয়েটা অনেক বাচ্চামো করে নিজের মতো শাসন করে সামলে নিও আর কষ্ট দিও না।” শান দুজনের হাত ধরে চোখে পলক ফেলে আশ্বস্ত করে গাড়িতে উঠে বসে।
বাসর ঘরে মানে শানের রুমে খাটের মাঝে গোল হয়ে বসে আছে সোহা। তবে চুপচাপ হয়ে বসে নেই বসে বসে আফসোস করছে সে। কিছুক্ষণ আগে সিমি, নিলা ভালো করে বলে দিয়ে গিয়েছে শান আসলেই যেনো সোহা তাকে সালাম করে। ভাবতে ভাবতে সোহা খাট থেকে নেমে গেলো। সোহা লাগেজ থেকে ঔষধ বের করে হাতে লাগাতে থাকে। দুইদিন আগের শানের করা অপমান গুলো কোনো মতেই ভুলতে পারছে না সোহা। ঔষধ লাগাতে লাগাতে সোহা শান্ত গলায় বলে
” গরম কফি পরে যেভাবে আমার হাতটা পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছে সেইভাবে আজকের দিনটা আমি নষ্ট করে দেবো। শান ভাইয়ার বাসরের স্বপ্ন সব বৃথা যাবে।” বলে বাকা হাসি দেয়। লাগেজ এর নিচ থেকে খুঁজে কয়েকটা পলিথিন বের করে লাগেজ নিচে নামিয়ে নিলো। বেডের চাদর আর বালিশ সরিয়ে সেই বিছানা গুলো ভালো করে বেডে বিছিয়ে উপর আগের মতো করে চাদর বিছিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর হাতে পানি ভরতি একটা বালতি নিয়ে আসে। হাসতে হাসতে একটু একটু করে পুরো বিছানায় পানি দিতে থাকে আর বলতে থাকে
” এবার দেখবো শান ভাইয়া আজকে এখানে ঘুমায় কি করে।” বলে হেসে দেয়। পুরো বিছানা ভেজানো শেষ হলে সোহা বালতি রেখে আসলো। সোহা সোফায় বসে শানের অপেক্ষা করতে লাগলো।
এদিকে শান যতো রুমের দিকে এগোচ্ছে ততোই তার অস্বস্তি বাড়ছে। শান ঠিক করে রেখেছে রুমে গিয়ে সোহাকে আগে তার হাতের কথা জিজ্ঞেস করবে আর সরিও বলবে। রুমে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতেই পায়ে কারো ছোঁয়া পেয়ে শান ভয় পেয়ে গেলো। ফিকফিক করে হাসির শব্দ শুনে শান পেছন ফিরে দেখে সোহা মুখে হাত দিয়ে হেসে যাচ্ছে। শান রাগি গলায় বলে
” কি করেছো তুমি ?? এতো হাসছো কেনো ??”
সোহা হাসি থামিয়ে বলে
” আরে আমি তো আপনাকে জাস্ট সালাম করেছি কিন্তু আপনি এভাবে ভয় পেয়ে যাবেন সেটা জানতাম না। হা হা হা ” সোহা আবার উচ্চস্বরে হেসে উঠে। শান নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সোহাকে উদ্দেশ্য করে বলে
” তোমার হাত এখন কেমন আছে ?? আর সেইদিন আমি ইচ্ছে করে তোমার হাতে কফি ঢালিনী তাই সরি।” শানের কথায় সোহার হাসি বন্ধ হয়ে যায়। সোহা উত্তর না দিয়ে শান্ত গলায় বলে
” গরম কফি হাতে পড়ায় সরি বলছেন আর সেইদিন যে আমাকে অকারণে কিছু কথা বলেছিলেন সেইগুলোর জন্য কি শুধুমাত্র সরি যথেষ্ট ??” শান চোখ মুখ শক্ত করে পেছন ঘুরে বলে
” আমি কোনো কথাই অকারণে বলি বা করিনা। আমি সেইদিন যা বলেছি প্রত্যেকটা কথা সত্যি বলেছি। এসব কথা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পরো।” সোহা এবার রাগে চোখ মুখ শক্ত করে নিলো। সোহা শানের সরি কথাটা শুনেও ধরে নিয়েছিলো শান সেই কথা গুলোর জন্যেও অনুতপ্ত কিন্তু সোহাকে ভুল প্রমাণ করে দিলো শান। শান বিছানার দিকে দুই পা এগিয়ে নিয়েও আবার পেছন ঘুরে সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” আরেকটা কথা তুমি বিছানায় না ঘুমালেই ভালো হবে। আমার একা ঘুমানোর অভ্যাস আমি কারো সঙ্গে বিছানা সেয়ার করতে পারবো না। তুমি সোহায় শুয়ে পরো। বলে গিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
সোহার মাথায় প্রচণ্ড রাগ জেকে বসেছে। সোহা কোনো কথা না বলে তার ড্রেস বের করে ওয়াসরুমে চলে গেলো।
শান বিছানায় শুতেই তার ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভব হলো। শান বিছানা থেকে নেমে ভালো করে দেখে অবাক হয়ে বলে
” বেড এতো ভিজেছে কি করে ?? কে ভিজিয়েছে ??” শান মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সোহাও ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে আসে। শানকে মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সোহা বুঝে গেলো তার কাজ হয়ে গিয়েছে। সোহা মুখ চেপে হেসে বিয়ের লেহেঙ্গা রেখে ধীর পায়ে শানের পাশে এসে দাঁড়াল। অবাক স্বরে শানকে উদ্দেশ্য করে বলে
” কি হলো আপনি এখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ?? আর আপনার পাঞ্জাবি দেখে মনে হচ্ছে ভিজে গিয়েছে।” শান অসহায় গলায় বলে
” বিছানা পুরোটাই ভিজে গিয়েছে এখন ঘুমাবো কি করে ??” সোহা মুখ টিপে হেসে বলে
” হ্যা সত্যি তো এবার ঘুমাবেন কিভাবে আপনি ?? আপনাকে ফ্লোরে বিছানা করে দেবো ??” শান অগ্নীদৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকাতেই সোহা দাঁত কেলিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করে গেলো। শান কিছুক্ষণ ভেবে সন্দেহজনক ভাবে সোহার দিকে তাকিয়ে বলে
” সবাই জানে আজকে আমাদের বাসর। আমি সিউর আজকে এইরকম মজা কেউ করবে না। আচ্ছা…..এসব তুমি করোনি তো ?? হ্যা তুমিই করেছো নাহলে এতোক্ষণ তো তুমি বিছানায়ই বসে ছিলে। ভেজা থাকলে তুমিও জানতে আর কেউ এসে এসব সড়িয়ে নিতো।” সোহা ঢোক গিলে ঝাঁঝালো গলায় বলে
” আপনি কি পাগল নাকি ?? আমি কেনো এসব করতে যাবো ?? বোর হচ্ছিলাম দেখে আমি তো নিজেই এতোক্ষণ সোফায় বসেছিলাম।” শান ভ্রু কুচকে আরো কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সোহা এবার রেগে বলে
” এই এভাবে তাকাচ্ছেন কেনো আপনি ?? আমি কি করেনি বলেছি না ?? আর করলেও বেশ করেছি।” বলে ভেংচি দিয়ে আলমারির কাছে চলে গেলো। আলমারি খুঁটিয়ে নিচ থেকে একটা বিছানা বের করে রাখলো আর একটা ব্ল্যাংকেট বের করলো। শান সোহার হাত থেকে ব্ল্যাংকেট টা কেড়ে নিয়ে বলে
” এসব ধরছো কোনো সাহসে তুমি ?? আমার জিনিসে একদম হাত দেবে না।”
সোহা ভেঙিয়ে বলে
” তো আমি কি আপনার মাথা দিয়ে ঘুমাবো ?? রুমে এসি আছে আমারো ঠান্ডা লাগে তাই এটা আমার লাগবে বুঝেছেন ??” শান ব্ল্যাংকেট দিয়ে গম্ভীর চেহারায় সোফায় বসে বলে
” আমি এখানে ঘুমাবো তুমি নিচে শুয়ে পরো।” সোহা শানের সামনে এসে হালকা চেঁচিয়ে বলতে থাকে
” আপনি আমাকে স্বার্থপর বলেছিলেন তাই না ?? তাহলে আপনি কি, হ্যা ?? আপনি নিজেই এখন স্বার্থপরের মতো কাজ করছেন। অন্য কেউ হলে তার বউকে সোফায় শুতে দিয়ে নুজে ফ্লোরে ঘুমাতো।” শান ব্ল্যাংকেট গায়ে দিতে দিতে বলে
” অন্য কেউ হলে কি করতো সেটা তো আমি জানি না। তবে কি বলো তো তুমি যদি সেইসব মেয়েদের মধ্যে একজন হতে তাহলে তোমার জায়গাটা এখানে নয় বিছানায়ই হতো। তুমি আর অন্যদের মাঝে অনেক পার্থক্য রয়েছে তাই তোমার জায়গা এখন ফ্লোরেই যথেষ্ট।” সোহা অবুজের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শানের সব খাপছাড়া কথা গুলো সে একদমই বুঝতে পারে না। বিয়ে ঠিক করার সময় বাড়িতে বলা কথা, ক্যাফে করা অপমান আর এখনের বলা কথা একটাও বুঝতে পারছে না। সোহা তার স্মৃতি শক্তি কাজে লাগিয়ে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে যে সোহা কি এমন করেছে যার কারণে শান বারবার একই কথা তার সামনে তুলে আনছে। মাথা খাটাতে খাটাতে সোহা বেডের উপর থেকে ভেজা বিছানার চাদর সড়িয়ে পলিথিন গুলোও সড়িয়ে নতুন বিছানা বিছিয়ে নিলো। কাজ শেষ করে বেডে থাকা ব্ল্যাংকেট নিয়েই শুয়ে পড়লো সোহা।
শান সোহার অবস্থান দেখার জন্য চোখ খুলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। সোহাকে বিছানায় দেখে শান অবাক হয়ে গেলো। শান শোয়া দেখে উঠে দাঁড়ায়। বেডের কাছে আসতেই দেখতে পেলো বেডের একপাশে ভেজা বিছানা আর বড় পলিথিন গুলো পরে আছে। সব দেখে শানের বুঝতে বাকি রইলো না সোহা কি করেছে। সোহার কাছে গিয়ে দেখে সোহা উপরের দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবে কি যেন ভেবে যাচ্ছে কিন্তু শান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রেগে সোহার কাছে গিয়ে সোহার দুই হাত বেডে চেপে ধরে সোহার দইকে ঝুকে অগ্নিদৃষ্টিতে সোহার দিকে তাকায়। সোহা চমকে শানের দিকে তাকায়। শান হঠাৎ এভাবে ওলে চেপে ধরেছে কেনো সেটা বুঝতে পারলো না। শান দাঁতেদাঁত চেপে বলে
” খুব সাধু সাজছিলে না ?? সাধু সাজতে চাইলেই সাজা যায় না। তোমার প্রত্যেকটা কাজেই প্রকাশ পাচ্ছে তুমি কেমন। আমি কি বলবো বুঝতে পারছি না। কথাটা ভাবতে ভাবতেই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি আমি। আমি তোমাকে যেরকম ভেবেছিলাম তুমি সত্যি সেই রকম। স্বার্থপর আর.. হুহ।” সোহা শান্ত গলায় বলে
” কি হলো থামলেন কেনো ?? বলুন আমি চরিত্রহীন !! একবার যখন মুখ থেকে এসব কথা বেড়িয়েই গিয়েছে তাহলে এখন থেকে আর কিছু আটকে রাখার দরকার নেই। যা বলার সামনা সামনি বলবেন।” শান তাছিল্য হেসে বলে
” তুমি কি আমাকেও তোমার মতো ভেবেছো নাকি ?? আমি যা বলার এবং করার সব সামনা সামনিই করি। তোমার মতো নই যে সবার সামনে মুখে সাদা আর আড়ালে মুখে কালো রং মাখবো।”
সোহা দাঁতেদাঁত চেপে শরীরের শক্তি দিয়ে শানকে ধাক্কা দিয়ে সড়িয়ে দিয়ে উঠে বসে বলে
” আমি যেমনই হই না কেনো সেটা আমি দেখে নেবো। আপনি তো আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানেন না। so, আমার ব্যাপারে ভাবতে হবে না আপনাকে। কখন কোন রঙ মাখবো সেটাও আমি ভেবে নেবো। এবার দয়া করা আপনার এই কথাটা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ুন আর আমাকেও ঘুমাতে দিন। আমি অনেক টায়ার্ড।” বলে সোহা ব্ল্যাংকেট টেনে পা থেকে মাথা মুড়িয়ে ঘুমিয়ে পরলো। শান বড় একটা শ্বাস নিয়ে সোফায় এসে মাথায় রেখে শুয়ে পরে।
” লালালালায়ায়ায়ায়ায়া ওওও লালালায়ায়া” প্রতিদিনের সকাল বেলার ব্যস্ত শহরের কোলাহলযুক্ত গাড়ির হর্ন, কুকুরে ডাক এসবের শব্দের জায়গায় আজকে বেসুরে গলার গান শুনে শানের ঘুমের বারোটা বেজে গেলো। গানের সুর শুনে মনে হচ্ছে এতোদিনের বিরক্তিকর গাড়ির হর্ন গুলোর শব্দও এই বিচ্ছিরি গানের গলার থেকে দ্বিগুণ ভালো। ঘুমের মাঝে শান অনুভব করলো বেসুরে গলার গানটা প্রতিনিয়ত শানের কানের কাছে বেজে যাচ্ছে। শান অনেক কষ্টে তার চোখ জোড়া খুলে উঠে বসে। বিরক্তি চোখে পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে দেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে আর বেসুরে গলায় গান গেয়ে যাচ্ছে। শান থম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলো। এতো সকাল সকাল তার রুমে এতোবড় মেয়ে কোথা থেকে এসেছে মনে করতে পারলো না।
” লালালালালা লালালালালা” সোহা গান গাইতে গাইতে পেছনে ঘুরে তাকালো। শানকে উঠে বসা দেখে কিছু না বলে ভেংচি মেরে দিলো। শান হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো সোহাকে ভেংচি দিতে দেখে। সোহার চেহারা দেখে এতোক্ষণে সে মনে করতে পারলো কালকে তার সোহার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে এবং রাতে তুমুলঝগড়া হয়েছে।
শান সোহাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে হা করে তাকিয়ে থেকে বলে
” এটা কি পেরেছো তুমি ??” সোহা শানের কথায় নিজের দিকে তাকায়। শানকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে সোহা মনে করলো তাকে দেখতে নিশ্চই অনেক সুন্দর লাগছে। সোহার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে। সোহা দুই লাফে শানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে বলে
” সত্যি আমাকে দেখতে অনেক সুন্দর লাগছে ?? আমি ইউটিউব থেকে দেখে দেখে শাড়ি পরেছি। দেখেছেন আমি কতো ব্রিলিয়েন্ট ??”
শান সোহাকে দেখতে দেখতে বলে
” তুমি শাড়ি পেরেছো ?? আমি তো ভাবলাম গায়ে সাপ পেচিয়ে রেখেছো।” বলে হেসে দেয়। সোহার হাসি মুখ চুপসে যায়। সোহা মন খারাপ করে বসে পরে। শান সোহাকে দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
চলবে~ইনশাল্লাহ…….