তুমিময় পর্ব-০৫

0
1702

#গল্প-তুমিময়
#Aysha_khan
#পার্ট ৫
রাস্তার এক পাশে বেশ বড় বিল! বিলের পানি ল্যাম্পপোস্টের আলো চিকচিক করছে। অন্য পাশে ক্ষেত যতদূর দেখা যায়। তার মধ্যে সরু পিঁচ সচ্ছ রাস্তায় আমি আদনান ভাই নিরবে দাঁড়িয়ে। চারপাশ নিস্তব্ধতা চাপা ঝনঝন শব্দ গ্রাম্য পোকারা তৈরী করছে। পরিস্থিতিটা যেন তাতে আরও গম্ভীর করে তুলছে।

মনে চলছে কাল বৈশাখের ঝড়। এত গুলো বড় বড় কথা বড্ড দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে অটপকে বলে ফেললেও। আদনান ভাইয়ের রাগ, জেদ সম্পর্কে আমি বেশ পরিচিত। আমাকে এতো ভালোবাসার পরেও যখন উনি আমাকে তার অনুভূতি সম্পর্কে জানাতে অনিচ্ছুক। আর আমি সেটা টের পেয়ে গেছি এভাবে। তাতে উনি রেগে যাবেন। শুধু রাগবেন না মাত্রাধিক রেগে যাবেন। তিক্ত বানী আমি হজম করতে পারবো কিন্তু তার বেশি আমি সহ্য করতে পারবোনা। আমি বরাবরই কোমল হৃদয়ের অধিকারিণী। আমার হৃদয় হরনকারী আদনান ভাইয়ের থেকে এর থেকে বেশি কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবোনা।

ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আমি যখন নিজের কোমল হৃদয়কে কিছু তিক্ত বানী শোনাতে পুরো দমে প্রস্তুত করে চলছি। তখন আদনান আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন! উনার ক্রু ভয়ংকর শীতল হাসিতে ভেতরটা কেঁপে উঠলো! আমি ভালোই বুঝলাম আমি নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছি! আদনান তখনও পেট হাত চেপে হাসতে ব্যাস্ত। লক্ষ্য করলাম তার মুখ অসম্ভব লাল হয়ে গিয়েছে। রাগে কাঁপছে সে। এতটুকু যথেষ্ট ছিলো আমার ভয়ে কেঁদে দেওয়া। চোখ বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে আমার। ঠোঁট উলটে কেঁদে দিলাম আমি। মুহূর্তে চোখের জলে গাল ভেসে গেলো। আমার কান্নায় হাসি থামালেন উনি। রেগে চাইলেন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে।

ভয়ে আমি কান্না থামানো আপ্রাণ চেষ্টা করাতে ফোপাঁনি উঠে গেলো নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হতে লাগলো। আমার এহেন অবস্থা দেখে উনি উনার দৃষ্টি অন্য দিকে রাখলেন। চুলে ব্যাক ব্রাশ করে আচমকা আমার ডান বাহু ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরলেন আলতো করে। এত এত উষ্ণতা ছিলো উনার বক্ষঃস্থলে। আমি বিড়াল ছানার মতো উনার উষ্ণ বুকে মাথা আরও এঁটে দিগুন উদ্যোগে কাঁদতে লাগলাম। অনুভব করলাম উনার একটা হাত আমার চুলে হাত বুলাচ্ছে! তাতে কান্নারা আরও প্রগাঢ় হলো আমার। এতদিন আদৃতা আপুকে নিয়ে করা অভিনয়ের জন্য যে কষ্ট ছিলো আমার মনে সব কেঁদেই আমি ভাসিয়ে দিতে চাইলাম, উনার প্রতি আমার সকল অভিমান, অভিযোগ আমি আজ যেন শেষ করে দেবো বলেই ঠিক করেছি। বেশ কিছু ক্ষণ কাঁদার পর মস্তিষ্ক, মন সব আমাকে চিৎকার করে বলল, আজ এসব কিছু শেষ নয় শুরু যে কোনও একটা মেনে নিতে নয়তো মানতে প্রস্তুত হও অয়ত্রী এভাবে কষ্ট তুমি কেন পাবে? কি দোষ তোমার বরং দোষ তার যে তোমাকে যেনে শুনে কষ্ট দিচ্ছে আবার ভালোও বাসছে না। হয় তাকে শুধু কষ্ট দিতে হবে নয়তো ভালোবাসতে হবে। মনে মনে কথা গুলো ভেবেই অভিমানী স্বরে উনার বুকে পরে কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,

‘ আপনি আমাকে ভালোবাসেন। এই দেখুন এখনও আপনি আমার কান্না সহ্য করতে পারছেন না! যদি ভালো নাই বাসেন। তবে…! ‘

আদনান ভাই অস্ফুট স্বরে বলেন,

‘ তবে? তবে হোয়াট?!

আমি উনার থেকে নিজেকে ছাড়াতে চাইলাম পারলাম না বিন্দুমাত্র। বরংচ উনি দিগুন জোরে আমাকে জরিয়ে ধরলো। তবুও আমি রুঢ় কণ্ঠে বললাম,

‘ তবে আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। আমাকে স্বাধীন ভাবে বাঁচতে দিন। মুক্তি দিন আপনার এই অদৃশ্য ভালোবাসা অধিকারবোধ থেকে। আপনার এই অদৃশ্য ভালোবাসা আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ডুবে গেছে আদনান ভাই। তবে এখনও কিছু সময় আছে আমি মানিয়ে নিতে সেই ছোট্ট বেলা থেকে শিখেছি এখনও পারবো। কিন্তু আর একটু দেড়ি হলেওনা আদনান ভাই আমি পারবোনা আমি মরে যাবো। তাই আজ হয় আপনি আমাকে মেনে নিন। নয়তো কাল আদৃতা আপুর বাবা আপনার আর আদৃতা আপুর বিয়ের কথা বলবে… আর আপনাকে..!’

আমার কথা আকটকে। আদনান ভাই বললেন,

‘ তো আমাকে কি করতে হবে?’

আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে বললাম,

‘ আপনাকে বিয়েতে রাজি হতে হবে!’

আদনান স্বাভাবিক সুন্দর কণ্ঠে বললেন,

‘ ঠিক আছে! ‘

“ঠিক আছে!” একটা ছোট্ট শব্দ কিন্তু আমার মনে হলো এর থেকে তিক্ত, বিষাক্ত শব্দ আর একটি নেই। সত্যিই আজ মনে হলো একটা নির্দয় ছেলেকে ভালোবেসেছি আমি। আমার কিশোরী মনের প্রথম এবং শেষ অনুভূতি আদনাদ ভাই। বুঝাতে পারবোনা। তার ঠিক আছে কথাটায় আমার ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে। তবে আমাকে এতটুকু কষ্ট দিয়ে থামলেন না আদনান ভাই কিছু থেমে আবার বলে উঠলেন,

‘আমি আদৃতাকে ভালোবাসি। তাকে বিয়ে করতে রাজি হবোনাইনা কেন? আদৃতাকে আমি সেই অনেক আগে থেকেই ভালোবাসি। অনেক কষ্টে ওকে রাজি করিয়েছি আমাদের একটা সুন্দর রিলেশন আছে। যা বিয়ে পর্যন্ত যাবে এটাই স্বাভাবিক। তোমাকে এতটা টেক কেয়ার করার একমাত্র কারণ। তোর যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছিলো সে তোমার পিছনে এখানে অব্ধি চলে এসেছিলো। তাই তোমাকে তোমার বাড়ি আর যেতে দেইনি তোমার বাবা তাই আমাদের বাড়ি এসেই তোমাকে দেখে যেতেন। কলেজ যাওয়াও ওই ইকবাল এর জন্যেই বন্ধ করেছি সেটা দাদুর কথায়। তুমি এক প্রকার বন্দী থাকতি তাই তোমাকে আমি মাঝেমধ্যে বাইরে নিয়ে যাই। দুষ্টুমি করি বাসায় সেটা তুমি খেয়াল করলেই দেখতে সব কাজিনদের সাথেই করি তাই বলে সবাইকে তো ভালোবাসিনা আমি তাই না? ‘

শরীর টা মিইয়ে ছিলো কষ্টে উনার এক্সপ্লেইন গুলো শুনে তীক্ষ্ণ ব্যাথায় বুকে রক্তক্ষরণ হলো। এককেকটা কথা তীরের মতো তীব্র গতিতে বুকে গিয়ে বাধল। সেগুলো থেকেই রক্তক্ষরণ এর উৎপত্তি। আমি বহু কষ্টে উনার দিকে একবার তাকালাম। উনি স্বাভাবিক ভাবে উনার তীক্ষ্ণ সুন্দর চোখ জোরা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। আগের ভয়ংকরী রাগান্বিত আভা আর চোখে মুখে নেই। আমি স্মিত হাসলাম অতঃপর বললাম,

‘ তাহলে পিহু আপু প্রান্ত ভাইয়ার আগেই আপনার আর আদৃতা আপুর বিয়ের শপিং করতে হবে আমাকে?’

উনি উনার সুন্দর মুখশ্রীতে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ হ্যাঁ। এবং তুমি সুন্দর ভাবে বুঝার জন্য ধন্যবাদ আশা করি কোনও ঝামেলা করবেনা আর এসব বলে আমার মাথাও গরম করবেনা!’

আমি দুর্বল থাকলেও প্রথমের মত রূঢ় কণ্ঠে বললাম,

‘ চিন্তা করবেন না আর কখনও বলবো না! বলেই সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললাম আমার কষ্টের অশ্রুপাত আমি এই নির্দয় লোকটাকে দেখাতে চাইনা যে!

জীবনের প্রথম এত কষ্ট পেয়েছি আমি মস্তিষ্ক নিতে পারেনি এক সময় জ্ঞান হারাই৷ জ্ঞান পুরোপুরি হারানোর আগে আদনান ভাই কিছু বলছিলেন আমাকে আমি শুনতে পেলেও মস্তিষ্ক ক্যাচ করতে পারেনি শব্দ গুলোর অর্থ। শুধু বুঝতে পারছিলাম আমি শূন্যে ভাসছি।

যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সকাল ১১ টা। মাথার পাশে বড় মামী বসে আছে আমাকে চোখ খুলতে দেখে বলল,

‘ কিরে এক বোনের বিয়ে দিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলি? এখনও তোর যমের বিয়ে বাকি। অসভ্যটা বিয়েতে রাজি হয়েছে। দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠ। বাসায় সবাই তোকে নিয়ে চিন্তিত!’

ঘুম থেকে উঠেই আবারও আদনান ভাইয়ের বিয়ের কথা শুনতে পাবো ভাবিনি৷ মামী আমাকে খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। একটু পর একে একে সব কাজিন বররাও এসে দেখে গেলেন এলেন না শুধু আদনান ভাই আদ আদৃতা আপু।

আদৃতা আপুকে আশা করি না আমি। কিন্তু আদনান ভাই? সে একবার এলেন না এতে অবাক আমি। কেননা আমার জ্বর হলে আকাশ পাতাল এক করে ফেলতেন লোকটা। আজ বড্ড আফসোস হচ্ছে। কাল নিজের অনুভূতির প্রকাশ না করলেই হয়তো আজ উনার কেয়ার গুলো পেতাম। হয়তো বা ওভাবেই ভালো ছিলো।

কিন্তু আসলেই কি তাই? না বরং পরে আমার বেশি কষ্ট হতো! তাই এখন থেকে আবার নতুন অভ্যাসে নিজেকে মানিয়ে নিতে প্রস্তুত হবো এটাই ভালো মায়া বারিয়ে লাভ কোথায় নির্দয় লোকটারতো কষ্ট হয়না। যা হওয়ার সব আমারি হোক। সে ভালো থাকুক সেটাই আমি চাই।

চলবে!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে