#তুমিই_আমার_পূর্ণতা
#মেহরাফ_মুন (ছদ্মনাম )
#পর্ব ৬
সন্ধ্যার দিকে পড়তে বসেছে মুন। পড়ার টেবিলটা জানালার সাথে। জানালা বন্ধ করাই ছিল। কী মনে করে যেন জানালাটা খুলে দেয় মুন। সঙ্গে সঙ্গে শা শা করে বাতাস প্রবেশ করে ঘরে। সারা শরীরে কম্পন তুলে যাই। এমনিতেই ঠান্ডা পড়ছে খুব আবার জানালা খুলে দেওয়াই বাতাসও যোগ হয়েছে। তবুও মুনের মন্দ লাগছে না। জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে মৃদু স্বচ্ছ আকাশ। তারাদের মেলা আজ নেই। তবে ঘোলা চাঁদ দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত হালকা কোয়াশার জন্য চাঁদটাকে ঘোলা মনে হচ্ছে। মনোযোগ সহকারে প্রকৃতিকে দেখে উপলব্ধি করছে মুন। পাশেই মিম শুয়ে অগোরে ঘুমাচ্ছে। এখন থেকেই ফাঁকিবাজি শুরু ওর। মিম থেকে চোখ সরিয়ে আবারও আকাশের দিকে মনোযোগ দিল মুন। মুহূর্তেই একরাশ বিষন্নতা এসে ঘিরে ধরল। আগের জীবনের কথা মনে পরে যায়। আজ থেকে দুইমাস আগেও জীবনটা এক অন্যরকম ছিল। আদ্রাফের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ । হয়তো বা মুনকে না পেয়ে আরেক মেয়েকে প্রস্তাবটা দিয়েছে এতদিনে। কোনোদিন মুন ভাবেওনি, আদ্রাফ এমন।
চট্টগ্রামের জীবন মন্দ কাটছে না।
তবুও কিছু তিক্ত স্মৃতির কথা মনে পড়ে যায়। ‘আজ ঢাকায় থাকলে তাঁর জীবনটা কেমন হতো! আচ্ছা, আদ্রাফ এমন প্রস্তাব কেন দিয়েছিলো? ও তো চাইলে সেরোগেশন ছাড়াও জোর করেই করতে পারতো। আর তা যেকোনো মেয়েকেই। এই প্রস্তাবটার জন্য মুনকেই বা কেন পছন্দ করল। আদ্রাফ কী কোনোভাবেই মেয়েদের সংস্পর্শে আসতে চায়তো না! আর ম্যানেজার থেকেই শুনেছি ওর জীবনে কোনো একটা বিষাক্ত অতীত ছিল। তাঁর মানে কী ওই অতীতটা নারী জাতি নিয়েই ছিল? তাঁর কাছে এখন পানির মতোই সব পরিষ্কার। শুধু অতীতটায় অজানা। তবুও কোনো মেয়েকে এমন একটা প্রস্তাব দেওয়া মোটেও সম্মানজনক নয়। তাও যদি মুনের মত এতিম মেয়েকে। ও কী জানতো না? মুনের এই ঢাকা-শহরে চলার মত কিছুই ছিল না। আচ্ছা আমি কেন উনার কথা এত ভাবছি? হয়তো মনের ভিতরেই কোনো কিছু লুকিয়ে ছিল যেটা প্রকাশ পাওয়ার আগেই সবকিছুই উলট-পালট করে দিয়েছে ওই মানুষটা, না না এইটা আমি কী ভাবছি?ওই মানুষটার জন্য আমার মনে কিছুই ছিল না, ওনাকে আমি শুধুই ঘৃণা করি। তবুও একটু উপদেশ তো দেওয়াই যায় মানুষটাকে, হয়তো বা মানবে না তবুও বলতে তো দ্বিধা নেই যাতে করে অন্যকোনো মেয়েকে যেন আর এমন প্রস্তাব না দেয়, আমি কালই একটা চিঠি পাঠাব ।’ আপন মনেই বিড়বিড় করে উঠল মুন।
কিন্তু মুন তো এটা জানে না তাঁর অনুপস্থিতে আদ্রাফ অন্য কোনো মেয়েকে নয় বরং মুনকে নিয়েই ভাবতে ভাবতে তিলে তিলে শেষ হচ্ছে।
-‘কিরে? কী ভাবিস অত?সেই কখন থেকেই নিচ থেকে ডাকছি রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। তোদের দুইজনের কোনো সাড়ায় নেই! তাই তো রুমে আসলাম। আর এই মেয়েটাও না সেরা ফাঁকিবাজ। পড়ার সময়ই ওর যতো ঘুম সব আসবে। আর জানালা খুলেছিস যে! ঠান্ডা ধরবে। বন্ধ করে ফেল। মিমকে ডেকে নিয়ে আয় নিচে। তোর আঙ্কেল তোদের সাথে খাবে বলে সেই কখন থেকে বসে আছে।’ আন্টি রুমে ঢুকতে ঢুকতেই বলে উঠলো।
-‘আমি মিমকে নিয়ে আসছি, তুমি যাও।’ আমি বললাম।
-‘আয় দ্রুত।’ বলেই আন্টি বেরিয়ে গেলেন।
মুন জানালাটা বন্ধ করেই মিমকে ডেকে নিয়ে নিচে চলে গেল। সারাদিন যতই হাসি-খুশি থাকুক না কেন রাত হলেই সব মনে পড়বে। যতই ভুলতে চায় ততই সামনে আসে সব। রাত হলেই অতীতটা তাঁকে ঘিরে ধরে। তবুও সবার সামনেই শক্ত মনের হয়ে থাকে মুন। যেন সব ভুলে গিয়েছে অতি তাড়াতাড়ি। অন্তত আর কারো সামনে না হোক, এই মানুষগুলোর সামনে সব ভুলে থাকতে হবে মুনের। কারণ এদের কাছে যে মুন ভীষণভাবে ঋণী।
—————————
আদ্রাফ মাথা ধরেই দুলু দুলু পায়ে হেটে অফিসে প্রবেশ করল। ম্যানেজার দেখেই ধরার জন্য এগিয়ে আসলে আদ্রাফ হাত দিয়ে ইশারায় বলল ও ঠিক আছে। আদ্রাফ ক্যাবিনে প্রবেশ করার সময়ই মুনের কাজের জায়গাটা চোখে পড়ে। মুনের জায়গায় এখন অন্য কেউ বসা। ওই জায়গায় বসে কতবারই মুনকে কাজ করতে দেখেছে। মজার ব্যাপার হলো, একটা সময় মুন নিজেই আদ্রাফকে লুকিয়ে দেখতো, আদ্রাফ তাকালেই চোখ সরিয়ে নিতো। সেই সময়টা আর এখনের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। সেই চঞ্চল্য,স্নিগ্ধ মুখ এখন হঠাৎ শুধু চোখের সামনেই ভাসে। বাস্তবে এখন আর দৃশ্যমান হয় না। বুকচিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে আদ্রাফের। মুন চলে যাওয়ার আগে এতটা খারাপ কখনোই লাগেনি আদ্রাফের। যতটা আজ, এখন লাগছে।
আদ্রাফ ক্যাবিনে প্রবেশ করেই চেয়ারে মাথা ধরে বসে পড়ল। সবকিছুই এখন স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক নয় আদ্রাফ। সবাই সবকিছু ভুলে গেলেও আদ্রাফ ভুলেনি। এই দুইমাস অফিস শেষে রাত পর্যন্ত ঢাকার কমবেশি সব জায়গায়ই গিয়েছে আদ্রাফ। হয়তো ভুলে হলেও মুনকে একটু দেখবে এই আশায়। কিন্তু কোনো জায়গায়ই মুনের দেখা পেল না। ঢাকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জায়গাগুলোরও আনাচে-কানাচে খুঁজে চলেছিল আদ্রাফ মুনকে। প্রতি জায়গায়ই গিয়ে মুনের ছবি দেখিয়েছিল কিন্তু কেউই মুনের খবর দিতে পারেনি। কোথায় হারিয়ে গেল মেয়েটা? এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে মুনের কাছে চলে যেতে। চোখ বন্ধ করলেই মুনের মুখ ভেসে উঠে। সারাদিন-রাত এখন শুধু বিষন্নতায় লাগে। হতাশারা ঘিরে ধরেছে আদ্রাফকে। সবকিছুই এখন বিষাদ লাগে। প্রচন্ড বিষাদ!
-‘স্যার, আসতে পারি?’ এক কর্মচারীই দরজা নক করেই বলে উঠলো।
আদ্রাফ চেয়ারে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করেই ছিল। কর্মচারীর ডাকে চোখ খুলেই হাতের ইশারায় ডাকল।
-‘স্যার, আপনার নামে একটি চিঠি এসেছে।’কর্মচারী বলল।
-‘চিঠি? আমার নামে অফিসে কে চিঠি দিবে? সামনাসামনিই তো বলতে পারে। প্রেরক কে?’
-‘স্যার, প্রেরকের নাম, ঠিকানা কিছুই উল্লেখ নেই শুধু আপনার নামটা আর অফিসের এড্রেসটাই দেওয়া।’
-‘আচ্ছা, টেবিলের ওপর রেখে যাও।’
ছেলেটি ‘হ্যাঁ’ বোধক মাথা নাড়িয়ে চিঠি আদ্রাফের সামনে রেখে বেরিয়ে গেল।
আদ্রাফ চিঠিটা হাতে তুলে নিল।
নীল মলাটের একটা খাম। কে দিবে এমন চিঠি? নিজের নাম, ঠিকানা না দিয়ে!
আদ্রাফ চিঠিটা খুলেই পড়তে শুরু করল।
‘আসসালামু আলাইকুম,
কেমন আছেন ফারহান আদ্রাফ স্যার ? আশা করি ভালোই আছেন। কিছু কথা বলার জন্যই আপনাকে চিঠিটা লিখা। হয়তো বা চিঠি খোলার আগে চিনেননি কিন্তু এই দুইলাইন পড়েই চিনে ফেলেছেন চিঠিদাতা কে হতে পারে? আচ্ছা, তবুও পরিচয় দিয়ে দিচ্ছি, আমি মুন। আপনার অফিসে একমাস চাকরি করেছিলাম। মনে আছে আপনার? হয়তো বা মনে পড়েছে। জানেন, আমার আপনজন বলতে কেউই ছিল না এই পৃথিবীতে, আপনার প্রস্তাবটা শোনার পর একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল মারা যাই। কারণ বেঁচে থাকলে ওই শহরে আপনার থেকে লুকিয়ে থাকতে পারতাম না। চাকরির খোঁজে বের হতেই হতো আমার। তবুও ওই সময়ে আমার জীবনে একটা মানুষ ছিল তাঁর জন্যই আজ আমার আরেকটা নতুন সকালের সূচনা হয়েছিল। আপনি কী মনে করেছিলেন? টাকার জন্য সবাই সবকিছু করতে পারে? এটা আপনার ভুল ধারণা, সবাই এক নয়। আপনার এই অশালীন প্রস্তাবটা শুনে আমার ভীষণ রাগ হয়েছিল সেদিন। এটা যেকোনো মেয়ের জন্যই অসম্মানজনক। একটা মেয়ে সমাজে ভালোভাবে বাস করলেও তাঁর থেকে কোনো না কোনোদিকে কথা শুনতেই হয়। নারীদের ভালোভাবে কোনো স্বাধীনতা নেই। কোনো মেয়ে পড়ালেখা শেষ করে বিয়ে করতে গেলেও দোষ। তাঁর ওপর যদি একটি মেয়ে বিয়ে ছাড়াই গর্ভবতী হয় তাহলে তো কোনো কথায় নেই! একটা ছেলে মেয়েটাকে ব্যবহার করে চলে গিয়েছে এখানেও ছেলেটাকে কোনো দোষ দিবে না, সব দোষ মেয়েটারই হবে। আর আপনার প্রস্তাব অনুযায়ী কোনো মেয়ে যদিও বা এমন করে তাহলে ওই মেয়েটা প্রতি নিয়তে কথা শুনবে মানুষের কাছ থেকে। একেকটা শব্দই একেক জগন্য। জানেন, পৃথিবীতে কিন্তু সব মেয়ে এক নয়। সব মেয়েকে এক পাল্লায় মাফবেন না। আপনি এমন প্রস্তাব আর কোনো মেয়েকেই যাতে না দেন সেই জন্য চিঠিটা লেখা। আমার জীবনটা আপনি ওই এক মুহূর্তের মধ্যে ওলোট-পালোট করে দিয়েছিলেন। যায় হোক,হয়তো বা চিঠিটা অগোছালো হয়েছে তবুও মূল কথা যেটা বোঝাতে চেয়েছি আশা করি বুঝেছেন। ভালো থাকবেন।’
আদ্রাফ চিঠিটা পড়েই স্তব্ধ। যাকেই এতদিন যাবৎ খুঁজে চলেছে তাঁরই চিঠি। চিঠিটা পড়েই আরও একরাশ হতাশা এসে ঘিরে ধরলো। সে তো মা জাতিকেই ঘৃণা করে তবে আর সব মেয়েকে তো যথেষ্ট সম্মান করে। মুন ওকে খারাপ ভেবেছে। আদ্রাফ চিঠিটা নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখল, না, চিঠিতে কোনো ঠিকানা নেই। একবার যদি মুনের সামনে দাঁড়াতে পারতো! কিছুই ভালো লাগছে না আদ্রাফের, চিঠিটা পড়ে সবকিছু আরও বিষাদময় লাগছে। মুনের কথাটাই ঠিক, সব নারী এক নয়। সবাই যদি এক হতো তাহলে এই শহরে এত এত ভালো মা থাকতো না। অন্যায় করেছে সে। একজনের শাস্তি আরেকজনকে কেন দিতে চেয়েছে সে? মেয়েটার জীবনটাই তছনছ করে দিল। কোথাই আছে মেয়েটা? এই জীবনে তো ওর আপনজন কেউই নেই ওর সাথেই এমন অন্যায় করতে আদ্রাফের বাঁধ মানলো না! ওর সাজানো গোছানো লাইফটাকে এমন না করলেও পারতো আদ্রাফ। মাথা ধরে বসে পড়লো আদ্রাফ। চিঠিটা পড়ার পর থেকেই অন্যায়েরা সব এসে ঘিরে ধরছে।চিঠিটা পড়ার পর থেকেই সব হতাশা এসে ঘিরে ধরলো যা আদ্রাফ কল্পনাও করেনি। আজকের সারা দিনটাই বিষন্নতায় কাটবে। কী করবে ও!
#চলবে ইনশাআল্লাহ।