#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১২
রোজের সামনে সাফোয়ান আনসারীর কলেজ জীবনের বন্ধুদের একটা সাদা-কালো ছবি পড়ে আছে। সেখানে আনসারী সাহেবের পাশেই হাস্যজ্জ্বল চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে আছেন সোহানা।যিনি আনসারী সাহেবকে নাকি পাগলের মত ভালোবাসতেন। রেণুকে বিয়ে করার তারিখ নাকি নিকটেই চলে এসেছিলো। ঠিক তখন সোহানা আনসারী সাহেবকে নিজের মনের কথা জানান। আর আনসারী সাহেব তার প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দেন। বাবার হতে হতে না হওয়া প্রেয়সীর কাহিনি জেনে রোজ কি বলবে? কি ভাবে সবটা নেবে বুঝে উঠতেই পারছিল না। তখন ওর সামনে আসে আরও একটি অতৃপ্ত প্রেমিকের কাহিনি। সেই অতৃপ্ত প্রেমিক হচ্ছে ইরফান। যিনি নাকি রেণুকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। রোজ বিদ্রুপ হেসে বলে,
-“স্বার্থপর মানুষ সব।স্বার্থের নাম ভালোবাসা দিয়েছিল। এদের তো কে’টে টুকরো টুকরো করা উচিত। বিয়েশাদী করে ছেলে-মেয়ে জন্ম দেওয়ার পরেও এমন লেইম এস্কিউজ যারা দেয় তাদের জিভ কে’টে ফেলা উচিত। ”
রোজ ছবিটার এক কোনায় আগুন জ্বালিয়ে দিল।ইরফান অবশ্য ভালোবাসার কারনে নয়, সাফোয়ান সাহেবের টাকার জন্য ও রোজকে মা’রার জন্য এমন করছেন। তবে সোহানা নামক নারীটি আসলেই ভালো বেসেছিলেন। কিন্তু জীবনের এতগুলো বছর বাদেও যে নারী পরপুরুষকে ভালোবেসে যেতে পারে তাঁর ব্যাপারে রোজ ভাবতে চায়না। এই নারী সে, যে নিজের কারনে শশুড়কে অবধি মে’রে ফেলেছেন।রোজের খারাপ লাগে ভীরের বাবার জন্য। কিন্তু তিনিও তো খুব একটা ধোঁয়া তুলসি পাতা নন। সোহানার টাকার লোভে সোহানাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি। সোহানার বাবা ছিলেন একজন চলচ্চিত্র পরিচালক। সে হিসেবে সোহানা বাবার একমাত্র মেয়ে হবার সুবাদে সব সম্পত্তির মালিক হয়েছিল। কিন্তু ভীর? সে তো একজন ভালো মানুষ। তাঁর মা-বাবার অন্যায়ের শাস্তি রোজ তাকে কিভাবে দেবে? এজন্যই শেষ মুহূর্তে প্রতিশোধের আগুনে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিলো রোজ। মুগ্ধতার মা’য়ের সম্পর্কে যতটা জেনেছে রোজ তাতে তিনি নরম মনের একজন স্বচ্ছ নারী যে নিজের স্বামী ও মেয়েকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসেন। তাঁর ভালোবাসার কিছু সুন্দর কাহিনি শোনার পর তাকেও কষ্ট দিতে রোজের মন সায় দিচ্ছে না। কিছু পাপিকে শাস্তি দিতে গিয়ে কিছু নির্দোষ মানুষকে কষ্ট দেওয়া অনুচিত। শুধুমাত্র এদের দুজনের জীবনের কথা আর নিজের জীবনের বেদনার মিল পেয়ে রোজ চায়না প্রতিশোধ নিতে। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ কতটা যন্ত্র’ণাদায়ক তা রোজের থেকে ভালো কে জানে? ফালাকের প্রতি মুগ্ধতার একপাক্ষিক যে তীব্র ভালোবাসা সেটাও অন্যায় নয়। তবে রোজকে হ’ত্যার চেষ্টা করাটা অন্যায়। তাই ওকে কিছুটা হলেও শাস্তি দিতে চেয়েছিল রোজ। কিন্তু এটা করলে প্রতিশোধের অবস্থা আগে যা ছিল সেটাই থেকে যাবে। ইরফানের রাগ কমবে না।
সাফোয়ান আনসারী খু’ন হওয়ার মিথ্যা কাহিনি এবং রেণুর নিখোঁজ দুটোই সোহানা নিজে করিয়েছেন। বলা যায় বাপকা বেটি সে। বাবার মতই অভিনয় সম্পর্কে তাঁর দারুন জ্ঞান এবং অভিনয় করার দক্ষতা আছে। তবে ইরফান সাহায্য না করলে সবটা সম্ভব হত না। সে নিজের সন্ত্র’স জীবনের কিছুটা জ্ঞান উপুড় করে ঢেলে দিয়েছিল এই অপহরণে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন জানা যায় সাফোয়ান সাহেবের সব সম্পত্তির মালিক তাঁর মেয়ে। অথচ তাঁর মেয়ের খোঁজ কেউ জানে না। স্বয়ং ফারদিন মাহতাবরাও না। আরশান দেখেছে ঠিক কিন্তু সেটা ইরফান জানতেন না। ব্যাস শুরু হলো রোজকে খোঁজার চেষ্টা। কিন্তু রোজ তো নিজের পরিচয় পাল্টে ফেলেছিল। সারিম বাড়িতে থাকলেও রোজ থাকতো না। তাই রোজের ব্যাপারে তারা জানতে পারেনি। শেষ দিকে কিছুদিন আগে টের পেয়েছে সবাই। এজন্যই মুগ্ধতা রোজকে মা’রার চেষ্টা করল। মূলত বাবার কথা মেনে কাজটা করেছে সে, ফালাকের জন্য না। এটা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো রোজকে। ফালাকের শান্ত স্থির চেহারা দেখে মনে হয়েছে সে সবটাই জানে। এজন্য চুপ ছিল। রোজকে রাগিয়ে দেয়নি। চাঁদের শুভ্রমানবের এই গুনটা চাঁদের ভালো লাগে। চাঁদের মুখ ফুটে কিছু বলা লাগে না। কথা পাড়লে মানুষটা আপনাআপনি সব বুঝে যায়। তবে প্রথমদিকে চাচার কথায় গলে গিয়ে যে বোকামি করেছে সেটা হয়তো এবার সংশোধন করবে সে।
যেদিন আনসারী সাহেবদের অপহরণ করে লরিতে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেদিন ফালাক চাচার সঙ্গে সেখানেই ছিল। আইজি সাহেব তদন্তের কারনে সেখানে গিয়ে যখন জিজ্ঞাসাবাদ করেন তখন ফালাক চাচার কথা শুনে চাচাকে বিশ্বাস করে বলেছিল ওটা চাচার কাজের ট্রাক। ট্রাকের নাম্বারও ইরফান যা বলেছিল সেটাই আওড়েছিলো। এটা সে না জেনে করেছিলো। যেটা রোজ কিছুদিন আগে সিয়ামের কাছ থেকে শুনেছে। যে ভুল মানুষ না জেনে করে, না বুঝে করে তাঁর জন্য রাগ পুষে রাখাটা ঠিক নয়। রোজ তো এটা ভেবেছিল যে ফালাকেরও এর পেছনে হাত আছে। তাই ফালাকের সঙ্গে শত্রুতা করে গিয়েছে।কিন্তু না,মাহতাব মঞ্জিলের কেউ এবিষয়ে কিছু জানে না। শুধু ইরফান আর বর্তমানে ফালাক জানে।
🍁🍁🍁
ফালাকের সামনে নিশ্চুপ দাড়িয়ে আছে মুগ্ধতা। হঠাৎ ফালাকের ফোন পেয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে সে। কি কারনে ডেকেছে ফালাক? তাও এত তাড়া দিয়ে? আর এসেধরে সে শুধু এটা পর্যবেক্ষণ করেছে, ক্ষ্যাপাটে বাঘ পুনরায় ক্ষেপেছে। কিন্তু কেন? নিরবতা ভে’ঙে মুগ্ধতাই প্রশ্ন করে,
-“কিছু বলবে না যখন তখন ডেকেছো কেন? ফালাক।”
-“ভাইয়া ডাকবে। ফালাক বলে সম্বোধন করার সুযোগ হারিয়েছো তুমি। তুমি বলেছিলে আমার নাম ধরে ডাকতে ভালোলাগে তোমার সেজন্য পার্মিশন দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে ভালোবাসা বা আমার ভালোবাসাকে আ’ঘাত করার অনুমতি, সাহস কোনোটা কি দিয়েছি?” চেঁচিয়ে বলল শেষের কথাটা।
মুগ্ধতা ভয়ে পেছনের দিকে কয়েক কদম পিঁছিয়ে গেল। ফালাকের ব্যবহার ইদানিং বেশ বদলেছে।আগে কখনও ধমক দিত না, রাগ হত না। যথেষ্ট স্নেহপূর্ণভাবে কথা বলতো। রোজ আসার পর থেকে রাগ যেন ওর সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কথা নেই, বার্তা নেই দুমদাম রেগে আগুন হয়ে যায়। মুগ্ধতার নিরব থাকা ফালাকের রাগ আরও বাড়িয়ে দিলো। বোন বলে যথেষ্ট সহ্য করেছে সে। কিন্তু মুগ্ধতা এবার নিজের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফালাক পুনরায় ধমকে ওঠে,
-“উত্তর দিচ্ছো না কেন? কিছু জিজ্ঞেস করেছি তো। ”
-“আমি তোমাকে ভালোবাসি এটার জন্য তোমার কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে? ”
-“হ্যাঁ হবে।একশবার নিতে হবে। তোমার এই পাগলামির জন্য আমি নিজের ভালোবাসা হারাতে বসেছি।(রাগ দমন করে বলল) তুমি খুব ভালো করে জানো আমি ওতটাও মহৎ নই যে তুমি আর তোমার এই ননসেন্স ভালোবাসার জন্য আমি নিজের এত বছরের ভালোবাসাকে ছেড়ে দেবো। ”
-“এত বছরের মানে? কাকে ভালোবাসো তুমি? ”
-“সে প্রশ্নের উত্তর আমি তোমাকে দেবো না। তুমি এটা বলো বউমনির বোনকে গু’লি করেছো কেন? সমস্যা কি তোমার? মেয়েটাকে ক্ষ্যাপালে তোমার কি হাল হবে তার অনুমান করেছ কখনও? না করলে আজ কল্পনা করে নাও। তোমার শরীর টুক’রো টুক’রো করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর খ’ন্ডবিখ’ন্ড তুমি ভেসে ভেসে নর্দমার পানি আরও দূষিত করছো।”
-“তুমি আর বাবা থাকতে আমার কি হবে? ”
-“আমি?তোমার মনে হয় আমি আর তোমাকে বাঁচাবো? আমার জীবন নিয়ে তোমরা খেলছো আর আমি তোমাদের বাঁচানোর জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছি!না? তোমার ব্রেইনে কি একটুও বুদ্ধি নেই? ইডিয়েট গার্ল। ”
-“এভাবে কথা বলছো কেন? আমি বাবাকে বলে দেবো। তুমি এমন করেছো আমার সঙ্গে।”
-“যা, গিয়ে বল তোর ওই স্বার্থপর বাপকে। আমিও দেখতে চাই সে তোকে কতটা ভালোাসে। আরে! তোকে যদি কে’টে ভাসিয়েও দেই, তবুও ওর কিছু যাবে আসবে না। ও শুধু নিজেকে ভালোবাসে। জীবন তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে তাও লোভ কমেনি। ”
মুগ্ধতা কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি এসব কি বলছো?”
-“ফালতু কথা বলে মাথা গরম করিস না। অনেক কষ্টে ঠান্ডা মাথায় কথা বলছি। ”
-“কি চাও তুমি? ”
-“তোদের প্রজেক্ট কোথায় হচ্ছে? কোন এরিয়া। শুধু সে টুকু জানতে চাই। ”
-“এটার জন্য তুমি এমন করলে? ”
-“এরিয়া!!!” চেঁচিয়ে।
-“রাঙামাটি। ”
-“মেহমেদ এটাকে আটকে রাখ। খবর যেন পাঁচার করতে না পারে। আমি ফিরে আসা না অবধি আটকে রাখবি। ছাড়বি না। এসে এর ব্যবস্থা করছি।ব্লাডি বি*”
🍁🍁🍁
“রোজ, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মা, সবার সামনে আমায় ভালোবাসেন দেখালেও উনি আমাকে পছন্দ করেন না। বাড়ির সব কাজ আমাকে দিয়ে করান, এমনকি শুধু কাজ না, বিশ্রিভাবে কথা বলেন, গায়েও হাত তোলেন। আমার বাচ্চার কথাটা জানেন তিনি। ওটা নিয়ে আমাকে অনেক.. মাঝে মাঝে ম’রে যেতে ইচ্ছে করে। শুধু ভীরের জন্য পারছি না। কি করবো, কোথায় যাবো কিছু বুঝতে পারছি না। তোকে তো বলেছিলাম সংসার আমার জন্য না। তবুও কেন জোর করলি?ওনাদের তো বাচ্চা পাওয়ার কামনা থাকবেই। এতে তো ওনাদের কোনো দোষ নেই। ভীর আমার সঙ্গে থাকে কতক্ষণ? সে সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। তখন ওকে তো এসব বলা যায় না। প্লিজ কিছু জানাস। আমি ম্যাসেজ করছি দেখলে মা রেগে যাবেন। শোন রাতে ফোন দিস। দিনে ফোন দিলে সবাই দেখবে। ”
ম্যাসেজটা পড়ে রোজের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কালনাগিনী খোলস পাল্টাবে জানতো রোজ। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? সেটা ভাবেনি। ভীরকেও দোষ দেওয়া যায় না। সে তো জানেনা কিছু, জানলে নিশ্চই কোনো ব্যবস্থা করতো। রোজ হাতের কফিমগ টেবিলের ওপর রেখে বেরিয়ে গেল ইউনিটের উদ্দেশ্যে। শেষের সেই কেসটা নিয়ে বসবে আজ।
ইফতির কাছ থেকে সব তথ্য পাওয়ার পর রোজ যেটা বুঝতে পারলো তা হচ্ছে। ছেলে চারটি রোজের আশে পাশেই ছিল। রোজ তাদের নিজের চারপাশে প্রায় সময় দেখেছে। যেটা এতদিন মনে পড়েনি। রোজের পরিচিত ছেলেগুলোকে বেঁছে বেঁছে কে মা’রবে? লাস্ট ছেলেটা তুশিব। আর খু’নটা বেশি না, দশদিন আগে হয়েছে। ভালো করে সবটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে রোজ যা বুঝলো তা হচ্ছে। কাজটা ফালাকের। তুশিবও সিরিয়া’ল কিলার তাই আগের তিনটা খু’ন সে করেছে। তাঁর প্রমাণও আছে। তবে তুশিবকে ফালাক মে’রেছে। রোজ ফাইলগুলো ক্লোজ্ড করে দিল। এই কেসের তদন্ত করে লাভ নেই। ফালাক কোনো প্রমাণ রাখেনি। এটাকে অন্যগ্যাংয়ের নামে চালিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ। ইফতি ফানুশের মত উড়ে গিয়ে খবরটা জানিয়ে দিল সবাইকে। যে এটা বিপরীত কোনো দলের কাজ।
চলবে?