#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_১০ (বোনাস)
রাইভীরের বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। রোজ এখনও চুপচাপ বসে আছে।ইফতিকে আসতে বলেছে বোনের বিদায়ীর জন্য। রোজ এখনও বসে আছে শুধু ভীরের মা সোহানা রাইকে কেমনভাবে গ্রহণ করবে সেটা দেখার জন্য। তিনি বিয়ের সময় ছিলেন না। ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে ছিলেন। ভীরের বাবা অবশ্য সবাইকে দেখে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছেন “ছেলেটা ঠিক আমার মত হয়েছে, আমি যেমন ওর মা’কে ভালোবেসে সবার অমতে বিয়ে করেছিলাম। সেও করেছে। আমি তো বেশ ভালো আছি সোহানাকে নিয়ে, ও’ও যেন সুখী হয়। ” কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে মহাশয়ের দুমদাম বোম ফাঁটছে তা রোজ বেশ টের পেয়েছে। তাঁর প্রিয় স্ত্রী তাকে এত সহজে ছাড়বেন না। তবে রোজের আফসোস থেকে গেল একটা বিষয় নিয়েই। খেলাটা সে এভাবে খেলতে চায়নি। আরও সময় নিতে চেয়েছিলো। ভীরের আড়ি পাতার কারনে সবটা ভেস্তে গেল। ভীরকে কঠিন একটা শাস্তি দিলে মন শান্ত হত কিন্তু রাইয়ের কথা ভেবে সেই চিন্তা মাথা থেকে বের করে ফেললো। তবে অন্তরে তাঁর ভয় থেকে যায়। রোজ যাদের জন্য এসব করলো তারা এরপরেও কি ভালো থাকবে? শত্রুরা নিশ্চই চুপ করে বসে থাকবে না। রোজের চেহারায় বিষন্নতা ছেয়ে গেল মুহুর্তেই। একদিক আলোকিত হলে অন্যদিকে যে আঁধারে নিমজ্জিত হবে তা রোজ জানে। কিন্তু রোজ তো চায়নি ওরা কষ্ট পাক। সারিম এসে ভীরের পাশে বসে বলল,
-“আপিয়া আজ দু দুটো বিয়ে হলো। তোমার বিয়েটা কবে হবে? ”
রোজ নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে বলে,
-“তুমি ভাইয়া খোজো। তোমার যাকে পছন্দ আমি তাকেই বিয়ে করবো। ”
সারিম দ্রুতগতিতে বলে,
-“তাহলে ফালাক ভাইয়াকে করে ফেলো। আজ তিনটে বিয়ে হয়ে যাক। আমি সবাইকে বলবো আমাদের বাড়ি তিনখুশির বাড়ি। আগে আমরা তিনজন ভাইবোন ছিলাম, আজ তিনটা বিয়েও হবে। ”
রোজ কিছুটা মিইয়ে পড়া কন্ঠে বলে,
-“এসব নিয়ে পরে কথা বলবো। তুমি খেয়েছ? তোমার না, খেয়ে ঘুমানোর কথা? গত তিনদিন ধরে রাতজেগে চোখের নিচে কালি পড়েছে। শুকিয়ে গেছ নক্ষত্র। যাও ঘুমিয়ে পড়। ”
সারিম বিয়ের কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়ে অভিমান নিয়ে বলে, “বিদায়ী দেখবো না? ”
-“যখন বিদায়ী হবে আমি তোমাকে ডেকে দেবো। এখন গিয়ে ঘুমাও। বিদায়ী সন্ধ্যার পর হবে। বুঝেছ? ”
-“ঠিক আছে। কিন্তু ফালাক ভাইয়ার কথাটা মনে রেখ। ভাইয়া খুব ভালো, আমাকে অনেক আদরও করে। তুমি ওনাকে বিয়ে করলে আমি ফালাক ভাইয়াকে প্রিয়ভাই বলে ডাকবো। ”
ফালাক এসে সবেমাত্র দাঁড়িয়েছিল। সারিমের পুরো কথাটাই শুনেছে। সে অপেক্ষা করছে রোজের উত্তরের। সারিমকে উত্তর না দিয়ে রোজ থাকে না। সারিম যেটাই প্রশ্ন করুক না কেন, সারিম উত্তর পাবে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফালাককে দেখে রোজ হেসে বলে,
-“আসলে কি হয়েছে জানো নক্ষত্র? উনি যদি ঠিক সময় বিয়ে করতো।ওনার তোমার মতো একটা ছেলে থাকত। উনি তোমার বাবার মত, তাই বেশি আদর করে।তুমি বরং ওনাকে চাচা বলে ডাকবে।”
সারিম বোকা চোখে তাকালো। আশেপাশের সবাই দম ফাটিয়ে হেসে ওঠে। ফালাক জ্বলে উঠলো মুহূর্তেই। রোজ নিজেও চাপা হাসে। সারিম প্রশ্ন করে,
-“চাচা ডাকবো?তুমিও কি চাচা ডাকবে আপিয়া? আগে তুমি ডাকো তারপর আমি ডাকবো। ওই তো ফালাক ভাইয়া না, না ফালাক চাচ্চু দাড়িয়ে। ডাকো চাচ্চু। তুমি ডাকলেই কিন্তু আমি ডাকবো। নাহলে ডাকবো না।”
ফালাক দ্রুত ফোন কানে দিয়ে কে’টে পড়লো ওখান থেকে। রোজকে বিশ্বাস নেই চাচ্চু কেন দাদা, নানা, কাকা, মামা, আব্বাও ডেকে উঠতে পারে। যাকে বউ করার স্বপ্ন আট বছর ধরে দেখছে তাঁর মুখ থেকে এই বিষাক্ত ডাকগুলো সহ্য হবে না। ফালাক চলে যেতেই সারিম বলে উঠল,
-“চাচ্চু ফোনটা কানে ধরে ওভাবে চলে গেল কেন? কেউ তো ফোন করেনি, আমি লকস্ক্রিনে দেখলাম। ফোন না করলেও কথা বলা যায়? আচ্ছা আপিয়া এটা কি নতুন কোনো টেকনোলজি? আমাকে তুমি বলোনি কেন?”
-“এটাকে কে’টেপড়ানোলজি বলে নক্ষত্র। যখন বড় হবে তখন বুঝবে। আমি তখন ভালো করে বোঝাবো। এখন যাও ঘুমিয়ে পড়। ”
সারিম চলে যেতেই হাসির রোল পড়ে গেল চারপাশে। বেকায়দা লজ্জায় পড়ে ফালাক শেষে বাড়ি ছেড়েই চলে যায়। মনে মনে বলে, “শালা ফাঁসানোর আর সময় পেলো না। ভরা বিয়েবাড়িটাই পেলো এভাবে ইজ্জত খাওয়ার জন্য? হবুবউটাও হয়েছে জাঁদরেল। ”
আরশান অয়ন্তি ফিসফিসিয়ে কিছু একটা বলছে।রোজ কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করতেই ও শুনতে পেলো ফালাক আর রোজের নাকি চলছে। রোজ তেতে উঠল, চলছে মানে?কি চলছে?র’ক্তার’ক্তিই শেষ হলো না আর লোকটা সবার মাথায় উল্টাপাল্টা ভরে দিয়েছে? মুগ্ধতা কোথায়?মুগ্ধতার কানে কথাটা চালান হচ্ছে না? সেদিন তো ভালোই গরম দেখালো, দারুন খেলা দেখালো আজ কোথায় সে? নিজের বয়ফ্রেন্ডকে সামলে রাখতে জানে না আবার রোজের পেছনে লাগতে আসে। ফালাককে সামনে পেলে গনধোলাই খাওয়াবে রোজ। মুগ্ধতা যদি ঠেকাতে আসে তাহলে রোজ নিজে ওকে ঝুলিয়ে পেটাবে। রোজ উঠে পড়তেই দেখলো সবাই ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। কি অদ্ভুত! বিয়ে বাড়িতে দুই দুইটা বর-বউ তাদের রেখে সবাই ওকে দেখছে কেন? রোজ কিছুদূর যেতেই হোচট খেয়ে পড়ে যেতে লাগলে সিয়াম এসে ধরে ফেলল। মুখে বলল,
-“সাবধানে চলবেন তো ভাবি। এখুনি তো পড়ে যেতেন।”
রোজ কপোট রাগ দেখিয়ে বলে,”থাবড়ে গাল লাল করে দেবো বেয়াদব। আমি তোমার ভাবি লাগি?”
-“না, মা। আমরা সবাই আপনাকে মায়ের নজরে দেখি। কিন্তু আম্মা বলে তো ডাকা সম্ভব না। ভাইকে তো ভাই বলি। তাই আপনাকে ভাবি বলতে হচ্ছে। ভাবি না ডেকে ছোট বউমনি বলবো? নাকি রাজরানি মানে হচ্ছে রোজারানি? রোজরানি?”
-“আমার সামনে আর একমিনিট দাঁড়ালে তোমার ঠ্যাঙ ভে’ঙে হাতে ধরিয়ে দেবো। ”
সিয়াম দ্রুত পাশ কাটিয়ে চলে গেল।ফালাক বলে রেখেছিল। রোজ রেগে গেলে খু’ন করতেও পিছপা হয়না। তাই সে কথা মাথায় রেখে সিয়াম শুধু গেল না একপ্রকার দৌড়ে, ছুটে চলে গেল। রোজ বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেলে। চারঘন্টাও হয়নি ছাদের ঘটনার। এইভাবে সে শত্রুতা নেভাচ্ছে? একদম রোজের জায়গামত ঘা দিয়ে নেভাচ্ছে। এর থেকে অন্য কোনো কিছু রোজের রাগের মাত্রা বাড়াতে সক্ষম না। ভাবি, ভাই শুনে যতটা রাগ হচ্ছে অন্যকিছুতে হত না। কারন রোজ ঠান্ডা মাথাতে সবটা সামলাতে জানে।শুধু এটাতেই মনে হচ্ছে এক কড়াই গরম তেলের মধ্যে এক ফোটা পানি দিলে যেমন চিরচির করে ওঠে রোজেরও তেমন অনুভূত হচ্ছে। রোজ ঘরে আসতে আসতে প্রায় দশ বারোজন রোজকে সালাম দিয়ে ভাবি ভাবি করে চেঁচালো। রোজ রেগে হনহনিয়ে ঘরে চলে আসে। ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। জনে জনে মানুষ আসছে আর ছাগলের মত ভ্যাবি ভ্যাবি করছে। গায়ক বর, জকি বরের থেকেও পলিটিশিয়ানদের জোর বেশি নাকি? কোন দল করে কে জানে? এত শুভাকাঙ্ক্ষী কোথ থেকে আসে? কলেজেও কতগুলো আছে। ভাই ছাড়া চোখের পলকও ফেলতে পারে না। এগুলো ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া শ্বাস নেয় কেন?
রাতে বিদায়ীর সময় বেশ কান্নাকাটি হলো। রোজের তা দেখে বিরক্তি ছাড়া আর কোনো অনুভূতি প্রকাশ পেল না। একঘন্টার রাস্তাই তো পার করে যাচ্ছে। তাতে এত কেঁদে ভাসানোর কি আছে? রোজের চিন্তা হলো রাইকে নিয়ে। সোহানা বেগম, মহিলা সুবিধার না। রোজ হলে ঠিক টাইট দিতে পারতো। রাই তা পারবে না, তার ওপর বাচ্চা নিয়ে রাইয়ের দূর্বলতাও আছে। সেজন্য রাই তো মুখই খুলবে না। রোজ সবার সামনে থেকে ভীরকে ডেকে আড়ালে নিয়ে যায়। এরপর সরাসরি বলে,
-“আপনার মা রাইকে পছন্দ করেন না। এটা বুঝেছেন? নাকি চোখে পড়েনি? ”
-“ওসব কিছু না রোজ। হঠাৎ এসব হয়েছে বলে আম্মা শকের মধ্যে আছে। পরে ঠিক মানিয়ে নেবে। তুমি চিন্তা করো না। আর সকালের কাজের জন্য লজ্জিত আমি।”
-“রাইকে আমি আপনার ভরসায় পাঠাচ্ছি। আশা করি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখবেন।নাহলে আপনার এই প্রেমকাহিনি আমি শোককাহিনিতে পরিণত করবো। এ্যান্ড আই মিন ইট। আমার ব্যাপারে নিশ্চই শুনেছেন। আমি কিন্তু অন্যায় মেনে নেবো না। আপনি স্বেচ্ছায় ওকে বিয়ে করে নিজের জীবনে এনেছেন। এরপর যদি ওকে কোনোরূপ টর্চার করা হয়, বাচ্চা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয়… ”
-“আমি কথা দিচ্ছি। এসব কিচ্ছু হবে না। ”
-“ধন্যবাদ। ”
সোহানা রোজকে ভীরের সঙ্গে দেখে এগিয়ে আসলেন। এরপর মধুর হেসে বললেন,
-“চিন্তা করো না মা, বিয়েটা যেভাবেই হোক। মেনে নিয়েছি। আমার কাছে আমার ছেলের সুখের থেকে আর কোনোকিছু বেশি বড় না। ”
রোজ তাচ্ছিল্য করে বলে,
-“সেটাই নিজের সন্তানের সুখের জন্য সবাই সবটা করে। কিন্তু পরের সন্তানের কথা একবার চিন্তা করেও দেখে না।”
সোহানা খোঁচাটা বুঝতে পারলেও ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে বললেন, “দিন-দুনিয়া বড়ই অদ্ভুত। ভালো থেকো। ভীর চলো। ”
সোহানা ভীরকে নিয়ে যেতে লাগলে রোজ পেছনে ঘুরে তাকায়। সহ্য হচ্ছে না আর। মহিলাটা একদম বিষধর। সময় সুযোগের যথাযথ ব্যবহার করতে জানেন। ভীরের সামনে ভালো মা হওয়ার অভিনয়টা কি সুন্দর করে করলেন।রোজের মনে হলো প্রতিশোধটা প্রথমে এনাকে দিয়ে শুর করা উচিত। স্বার্থপর সুবিধাবাদী মহিলা।
অয়ন্তির বিদায়ীর সময় সবাই একে একে এসে রোজের কাছ থেকেও বিদায় নিলো।মুখে ভাবি ডাক বহাল রইল, রোজ মনে মনে ঠিক করে নিল, হয় এদের ভাবি ডাক থাকবে নয়তো ভাই। ভাই না থাকলে ভাবি ডাকেরও সম্ভাবনা নেই। ওদিকে সারিমের কান্না দেখে রোজের মনটা বিষাদে ভরে উঠলো। সারিমকে ডেকে সে ঘরে নিয়ে যায়। আজ সারারাত সে সারিমকে গল্প শোনাবে। ছোটবেলায় রোজ কত বোকা ছিল, ভীতু ছিল, কিভাবে মা’র খেয়ে কান্না করতো, সেসবই অভিনয় করে দেখিয়ে সারিমকে ঠান্ডা করলো সে।
রাতে রাইয়ের সঙ্গে কথা বলে রোজ জানলো সোহানা রাইকে মেনে নিয়েছেন পুরোপুরি এবং মেয়ের মতই যত্ন করছেন। রোজ ফোন রেখে দেয়। মহিলাটির ব্যবহারে কারোর কোনো সন্দেহ থাকবে না এমন ব্যবস্থাই তিনি করছেন। যাক রাই ভালো থাকলেই হলো।
চলবে?