#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৯
বিয়ে বাড়িতে আসার পর ভীরকে দেখে রাইয়ের কান্না অধিক হারে বেড়েছে। ভীর রোজের পরিচিত? নাকি রোজ নিজেও ওর কথা জানতো না? রাই চুপচাপ এক কোনায় দাড়িয়ে দেখছে বিয়েটা। কাজি সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছেন। রোজ এলো কিছু সময় বাদেই। দুহাতে বড়সড় ব্যান্ডেজ নিয়ে। রোজকে দেখে রাই এগিয়ে গিয়ে প্রশ্ন করবে তাঁর আগেই ওর সামনে একটা শ্যামবর্ণের হাত এসে থামলো। হাতের ওপর সফেদ রুমাল। রাই চোখ তুলে তাকায়। ভীর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। রাই ভীরকে উপেক্ষা করে চলে গেল। ভীর থতমত খেয়ে তাকায়। ব্যাপারটা কি হলো? ভীর তো উপকারই করতে এসেছিলো। কেঁদেকেটে মেক আপ নষ্ট করে পেতনি সাঁজছিল মেয়েটা।তাই রুমাল দিল যেন লেপ্টে যাওয়া কাজল লিপস্টিক মুছে সে কনের সুন্দরী বোনেদের মত চলা ফেরা করতে পারে। আর মেয়েটা মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল? দেশের মেয়েগুলো সব ভদ্রতা, সভ্যতা হারিয়ে ফেলেছে। রোজ একজন সকালে কথা শোনালো আর এই একজন অপমান করে চলে গেল।
রোজের কাছে এসে রোজের হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে রাই। রোজ ফোনে ইফতির সঙ্গে কথা বলছিলো। রাইয়ের কান্না শুনে ইফতি উত্তেজিত কন্ঠে বলে,
-” কি হয়েছে ওর? কাঁদছে কেন? রোজ কথা বলো। ”
-“কিচ্ছু হয়নি। তোমার বোন মিনিটে মিনিটে কাঁদে এটা নতুন কিছু না।তুমি ডেথস্পটে যাও,আমিও ঘন্টাখানেক পর আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত কাউকে ভেতরে এলাউ করবে না। ”
-“আচ্ছা। রাইকে দেখে রেখো একটু। ”
-“ওর চিন্তা করতে হবে না। আমার বাড়িতে বাঘভাল্লুক নেই যে তোমার বোনকে খেয়ে ফেলবে। রাখছি। ”
ফোন রেখে রোজ রাইকে টেনে নিয়ে নিজের ঘরে গেল। ভীর পুরোটা লক্ষ করে সন্দিগ্ধচোখে তাকায়। ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না সে, তবে কৌতুহল বাড়ছে। তাই ভীর চুপিসারে রোজের ঘরের সামনে চলে গেল। ফালাক শেরওয়ানী বদল করে এসে ভীরকে রোজের ঘরের সামনে আড়ি পাততে দেখে ভ্রু কুচকে তাকায়। এদের মতিগতি ভালো ঠেকছে না ফালাকের। বিশেষ করে ভীর রোজের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে এটা সহ্য করা বেশ মুশকিল।
রোজ রাইকে সোজা দাঁড় করিয়ে বলল,
-“একদম শান্ত হবি। তাও দু মিনিটের মধ্যে। নাহলে এই কান্না থামানোর বন্দোবস্ত আমি করবো। ”
রাই হিচকি তুলে কাঁদে। রোজের তা সহ্য হলো না। সে খানিকটা ধমকে বলল,
-“স্টপ ক্রাইং রাই। কেন কাঁদছিস? তোর জীবনটা জটিল এতে তো তোর কোনো হাত নেই। তাহলে কেন করছিস এমন? শরীর খারাপ করবে তো, সোনা। কান্না থামা। ”
রোজের শেষ কথাটুকুতে রাইয়ের কান্না থেমে গেলো। রোজ এবার কঠিন গলায় বলল,
-“তুই যদি কান্না না থামাস আমি কিন্তু ভীরকে সত্যটা বলে দেবো রাই। বলে দেবো আমিই মনিমালা। আর,,,”
দরজায় কড়াঘাতের শব্দ শুনতেই থেমে গেল রোজ। রাইয়ের চোখের পানি মুছে সে দরজা খুললো,সঙ্গে সঙ্গে ভীর জড়িয়ে ধরলো রোজকে। দৃশ্যটি দেখামাত্র রোজ, ফালাক রাই তিনজনেই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়। ফালাক হাত মুঠোবন্দি করে এগিয়ে আসে। কিন্তু পরের ঘটনাটি দেখামাত্র রাগে সারা শরীর কেঁপে উঠল। ভীর রোজকে শুধু জড়িয়ে ধরেনি, রোজের কপালে চুঁমু খেয়ে ভালোবাসার কথা অবধি বলছে। মনিমালা বলে ডাকছে। একদিনের মাঝে ডাকনামও পরিবর্তন করে ফেলেছে রোজ? এজন্যই ফালাককে সে সহ্য করতে পারছে না। এমন ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে ওখান থেকে চলে গেল ফালাক। ওদিকে ভীরের চুঁমাচুঁমি দেখে রাইয়ের কান্না থেমে গেছে। রোজ কাঠের মত শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রাই ভীরকে ভালো না বাসলে এখনই ভীরের অবস্থা শোচনীয় করে তুলতো রোজ। তাই লম্বা শ্বাস ফেলে রোজ কোমল কন্ঠে বলল,
-“স্টপ ইট ভীর। ছাড়ুন আমাকে। ”
ভীর কেঁদে উঠল, “তুমি যখন আমাকে চিনতে, জানতে তাহলে সকালে ওমন করলে কেন জিয়নকাঠি? কেন? আমি কি ভুল করেছি বলো। কেন আমার থেকে দূরে যেতে চাচ্ছো? বুঝতে চাচ্ছো না কেন আমি ভালোবাসি তোমাকে। আই লাভ ইয়্যু সো মাচ জিয়নকাঠি। তোমার জীবন কঠিন হলেও আমার আপত্তি নেই, তোমার পেশা তোমার স্বভাব কোনো কিছুতে আপত্তি নেই। আমি শুধু তোমাকে চাই। শুধু তোমাকে। ”
ভীর পাগলের মত কথা বলতে শুরু করলো। থামাথামি নেই দেখে রোজ সটান চর কষিয়ে বসালো ওর গালে। ভীর বাকরুদ্ধ তাকালো। রোজ ভীরকে ঘরের ভেতরে এনে দরজা বন্ধ করে বলে,
-“বুঝলাম না। আমার হাতে চর না খেয়ে কেউ থামেনা কেন? আর দুঃখিত আমি চর মারতে চাইনি। আপনি থামছিলেন না বলেই কাজটা করতে বাধ্য হয়েছি। নরম গলায় কাজ হচ্ছিলো না, আমি কথা বললেও আপনি আমার কথা শুনছিলেন না। তাই মেন্টালি একটা শক দিয়ে আপনাকে চুপ করাতে হলো। এবার আশা করি শুনবেন। ”
রোজ খাটের ওপর আসন কেটে বসে বলল,
-“প্রথমটুকু শুনেই আপনার আমাকে টাচ করাটা ভুল হয়েছে। পুরোটুকু শোনা উচিত ছিল।
মনিমালা আমার আইডি, প্রথমদিকে হয়তো আমি কথা বলেছি আপনার সঙ্গে। তবে আপনার জিয়নকাঠি আমি নই।আপনার কথা আমার বিরক্ত লাগতো। একদিন রাই আমার ফোনটা নিয়ে ওর ভাই ইফতিকে কল করেছিল। তখনই আপনার ম্যাসেজ ওর চোখে পড়ে। আমার কাছ থেকে শুনে ও আপনার সঙ্গে প্রাঙ্ক করতে গিয়েছিলো। কিন্তু দুমাস পর জানলাম আপনাদের মধ্যে সেই একটা কাহিনি চলছে। মানে, আমার আইডি দিয়ে, আমার বান্ধবি আমার ওপর লাট্টু খাওয়া ছেলেটার ওপর লাট্টু খেয়ে বসে আছে। তারপর আমি আইডিটা ওকে দিয়ে দেই। তারপর আপনাদের কনভারশেসন বাড়ে, ওর নাম জিয়নকাঠি রাখেন।ওকে প্রপোজ করেন। এসব কাহিনি শুনে আমি প্রথমে ওকে মানা করেছিলাম এমন না করতে। কারন আপনি প্রায় উন্মাদের মতো ব্যবহার করছিলেন। কিন্তু শুধু আপনি নন, রাইও আপনার জন্য পাগল। না দেখে, না জেনে, না শুনে এমন প্রেমের সূচনা আমি এই প্রথম দেখলাম। রাই আপনাকে ভালোবাসে আর আপনি যদি জিয়নকাঠিকে ভালোবাসেন তাহলে আপনার জিয়নকাঠি আপনার সামনেই বসে আছে। যান কয়েকটা চুঁমু টপাটপ তাকে খেয়ে ফেলুন। তবে কাজটা করার আগে রাইয়ের সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা দরকার আপনার।
রাই অনাথ। ওর ভাই আমার সঙ্গেই কাজ করে। সেই সূত্রে ওকে চিনেছি আমি। আর এখন ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর সম্পর্কে এমন কোনো তথ্য নেই যা আমি জানি না। ওর বাবা হার্টএ্যাটাক করে মা’রা গেছেন আর মা আচমকা। হয়তো ওর বাবার শোকে। কারন তার কোনো রোগ শনাক্ত করা যায়নি। ইফতি বিবাহিত তাঁর দুটো বাচ্চা আছে। এটা হচ্ছে ওর পারিবারিক অবস্থা। এবার আসি শুধু ওর কথায়, ও আপনাকে বলেছিলো ও সবাইকে ভালোবাসতে পারবে না, ওর জীবনটা কঠিন। কেন বলেছিল এই কথা? সব তো নরমালই আছে তাইনা? কারন রাইয়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছে। একমাসের বিয়ে, ছেলেটার চরিত্র ভালো ছিল না এটা ইফতি জানতো না। মাসের মাথাতেই ওর তালাক হয়ে যায়। এবং বছর দুয়েক আগে ও জানতে পারে “সি উইল নেভার বি এ্যা মাদার।” ও কখনও মা হতে পারবে না। একটা মেয়ের জীবন জটিল হওয়ার জন্য এই তথ্যটাই কি যথেষ্ট নয়? আপনার ভালোবাসা তখন কতটুকু থাকবে যখন জানবেন আপনি বাবা হতে পারবেন না। আপনার স্ত্রী কখনও সন্তান জন্ম দিতে পারবে না,এসব কারনেই রাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেছে। ও আপনাকে ভালোবাসলেও আপনার হতে চায়না। ”
ভীর রাইয়ের দিকে তাকালো। নিশ্চুপ মেয়েটার চোখের পানিতে বেডসীট ভিজে গেছে। ভীর উচ্চস্বরে হেসে বলে,
-“এই সামান্য একটা কারনে? ”
রোজ হেসে বলল, “মহত্ব দেখাতে আসবেন না। এসবে ওর জীবন চলবে না। জানতে চেয়েছিলেন সবকিছু। জানিয়ে দিলাম। এবার বিদায় হন। সেলেব্রিটি মানুষ তাই অপমান করছি না। বিসাইডস বেস্টুর ভালোবাসা নাহলে আপনার হাত আর ঠোঁটের এমন অবস্থা করতাম যে আগামী ছ’মাস তা কোনো কাজেই লাগতো না। ”
-“সারিম তোমার কি হয়? ”
রোজ সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো। ভীর হেসে বলল,
-“শুধু জন্ম দিলেই বাবা-মা হওয়া যায়না। তোমার বাবা মা তাঁর প্রমান দিয়ে গেছে রোজ। সারিম যে তোমার নিজের ভাই নয় তা জানি আমি। তোমার বাবা যদি সারিমের থেকে পিতৃত্বের স্বাদ পেতে পারে আমি কেন পারবো না? জিয়নকাঠিকে ভালোবাসার সময় আমি এসব ভেবে ভালোবাসিনি। আমি শুধু মানুষটাকে ভালো বেসেছিলাম। এমনও তো হতে পারতো, ওটা ফেক আইডি, কোনো মধ্যবয়স্ক নারীর বা বিবাহিত কারোর। কিন্তু ভাগ্য আমার সহায় আছে। তাই আমার ভালোবাসায় সামান্য একটা কারন কখনও বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। রাইকে আমি বিয়ে করবো এটাই ফাইনাল। ”
রোজ ভীরের আর রাইয়ের হাত ধরে বলল,
-“তাহলে শুভকাজে দেরি কিসের? আপনার মা রাইকে পছন্দ করেন। তখন শুনছিলাম তিনি বলছিলেন এমন একটা মেয়ে পেলে তিনি পুত্রবধু করবেন। কাজি যখন আছে তখন বিয়েটা সেরে নেওয়া যাক। আমিও দেখতে চাই আপনার সাহস আর ভালোবাসার দৌড় কতদূর।”
রাই বাঁধা দিল কিন্তু ভীর কিছু বললো না। কাজির সামনে গিয়ে রোজ চেহারা স্বাভাবিক করে বলল,
-“দাড়ান কাজিসাহেব আরও একটা বিয়ে দিতে হবে আপনাকে। এই দুজনও বিয়ে করবে। উপস্থিত সবাইকে জানাতে চাই এরা দীর্ঘদিন প্রণয়বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। আর ওরা চায় বিয়ে করতে, আন্টি আপনার কোনো সমস্যা আছে? থাকলেও বিয়েটা আপনার ছেলে করবে তাই ওনার ভালো উনি বুঝে নেবেন। কাজি সাহেব কি কি রিচুয়াল আছে বলে দিন ওদের। নোরা রাইকে নিয়ে যা, সাঁজিয়ে আন। আর মেহমেদ ভাই আপনি ভীরকে নিয়ে যান। ”
এটোম বোম ফাঁটিয়ে রোজ কাজির পাশে বসে পড়লো।সবাই এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। পাঁচমিনিটে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেছে। রোজ যে ভীষণাকারে রেগে আছে তা সবাই টের পেলো। রোজের হাতে বন্দুক। মনে হচ্ছে ধমকে ধামকে বিয়ে করানো হচ্ছে। কিন্তু রোজ শুধু চায় ভীর কি করে সেটা দেখতে। ফালাককে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। চলে গেছে হয়তো। ভালো হয়েছে। ওকে দেখলে রাগ বাড়তো। ভীরের মায়ের বোধ হয় এই পরিবেশটা পছন্দ হলো না। অতীব সুন্দর চেহারাটি কেমন থমথমে হয়ে আছে। ভীরের বাবার অবস্থাও তাই। ওনাদের এমন চেহারা রোজের মনে প্রশান্তির বাতাস বইয়ে দিলো। রোজ মনে মনে বলে,
-“এটাকেই হয়তো রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে আঙ্কেল। আপনিও আপনার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে পাশে দন্ডায়মান এক কালনাগিনীকে বাড়িতে তুলে এনেছিলেন। আর আজ আমি সেই কালনাগিনীর বিষদাঁত ভাঙলাম। খুব শীঘ্র তাঁর ফনাটাও ছিড়ে ফেলবো। প্রতিশোধ নেওয়ার খেলাটা তো সবে শুরু। ”
চলবে?