#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)💙
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০৩
ঘড়ির কাটা রাত এগারোটা বেজে আটাশ মিনিট! বড় চাচ্চুর ডাকে ঘুম ভা’ঙে রোজের। এত রাতে চাচ্চু ডাকছেন কেন? কি হয়েছে? মস্তিষ্কে আতঙ্ক পরিলক্ষিত হতেই রোজ উঠে বসে। পাশ থেকে চশমা নিয়ে পড়ে নিল চোখে। হাই তুলতে তুলতে সে গায়ের ওপর থেকে কম্বল সরায়। এরপর উঠে দরজা খোলে। বড় চাচ্চু বেশ চিন্তিত চোখে চেয়ে আছেন। রোজ কিছু বলবে তার আগেই তিনি কোমল কন্ঠে বললেন,
-“একটু বসার ঘরে আয়। জরুরি কথা আছে। ”
চাচ্চু চলে গেলেন। রোজ বাথরুমে যায়। ব্রাশ করে, মুখে পানি দিয়ে তারপর আসে বসার ঘরে। চাচি, অয়ন্তিও বসে আছে সেখানে। চাচ্চু এলেন মিনিট পাঁচেক পরে। রোজ ততক্ষনে ভাত নিয়ে বসেছে। রাতে খাওয়া হয়নি ওর। চাচ্চু রোজের দিকে একনজর চেয়ে চিন্তিত মুখ করে সোফায় বসলেন।রোজ ভ্রু কুঁচকে ফেলল নিমিষে।ভাত মেখে মুখে তুলতে যাচ্ছিলো,হাতটাও থমকে গেল। কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ পড়লো। চাচ্চু সেটা লক্ষ করে বললেন,
-“খা। চিন্তার কিছু নেই। ”
রোজ হাত ধুয়ে উঠে পড়ে।বাড়ির কারোর মলিন চেহারা দেখার পর গলা দিয়ে ভাত নামবে না। রোজের হেলদোল না দেখে চাচি নিজেই ভাত মাখতে শুরু করলেন। রোজ কিছু বলল না। চাচ্চু বলতে শুরু করলেন।
-“তোর বাবার বন্ধু ফারদিন মাহতাবকে চিনিস রোজ? কিংবা তাঁর ছেলেদের? ”
রোজ অপ্রতিভ দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে বলে,
-“না। তবে নাম শুনেছি, তাও বছর সাত-আট আগে। এটাও শুনেছি তারা এই জেলাতেই থাকে। তবে আমার সঙ্গে তাদের তেমন পরিচয় নেই। তাদের কথা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে কেন? ”
-“না, এমনি।”
-“কি হয়েছে? এনিথিং রং চাচ্চু? ”
-“না, ওরা অয়ন্তির জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।হয়তো আগামীকাল অয়ন্তিকে দেখতেও আসবেন।”
-“এতে চিন্তিত হবার কি আছে? আসবে, খাবে, দেখবে, চলে যাবে। পছন্দ হলে হ্যাঁ বলবে নাহলে না। ”
রোজের কথা শুনেই ভীষম খেলো অয়ন্তি। রোজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। চাচির চেহারা থমথমে, চাচ্চু চিন্তিত, অয়ন্তি ভীষম খাচ্ছে। যার অর্থ বাড়ির সবাই বিষয়টা আগে থেকেই জানে একমাত্র রোজ বাদে। রোজের কন্ঠ এবার আরও স্পষ্ট শোনালো,
-“হীরামন প্রেম করছে? ”
অয়ন্তি তড়িঘড়ি করে বলে,
-“না, না, বিশ্বাস কর ব্যাপারটা সেরকম না। আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছু। ”
অয়ন্তির বিচলতাই সবটা খোলসা করে দিলো। রোজের ভাবমূর্তি তখনও স্বাভাবিক। তবে ধীরে ধীরে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চেহারায় ছড়িয়ে পড়লো গাম্ভীর্যতা। চাচ্চু নিশ্চুপ চেয়ে আছেন, চাচির অবস্থাও তাই। রোজ অবিশ্রান্ত কন্ঠে বলে,
-“আমি প্রেম ভালোবাসা পছন্দ করি না। সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত ও ব্যাপার। আমার জন্য তুমি কেন এসবের থেকে দূরে থাকবে। ভালোবাসা তো খারাপ নয়। যেহেতু তোমাদের সবার ওদেরকে পছন্দ সুতরাং কথা এগোও। বিয়েটা হীরামন করবে আমি না। তাছাড়া সম্পর্ক তোমাদের সঙ্গে হচ্ছে আমার সঙ্গে না। আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র চারটা মানুষকে ঘিরে তোমরা তিনজন আর সারিম। তাই তোমাদের যদি আপত্তি না থাকে আমারও আপত্তি নেই। ওরা আসুক, কলমা পড়িয়ে নিক বা বিয়ের তারিখ ঠিক করে যাক। ”
চাচ্চু হতাশ কন্ঠে বলেন,”বিয়েতে তুই থাকবি তো? ”
রোজ প্রথমে উত্তর দিল না। কিছুসময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পর বলল,
-“জরুরি হলে থাকবো। প্রয়োজন ছাড়া থাকতে হবে কেন? তাছাড়া ইউনিটে অনেক কাজ জমা হয়ে আছে। সেগুলো শেষ করত হবে। নতুন ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, সেখানেও পড়ার চাপ আছে। আমি তো গত কয়েকদিন ধরে এটা ভাবছিলাম যে আমি যদি এখানে না থেকে অন্যকোথাও সিফট হই তাহলে ভালো হয়।”
-“মানে? বাড়ির ছেলেমেয়েগুলো বাড়ি ছেড়ে কোথায় থাকবে? ”
-“উহু, নক্ষত্র এখানেই থাকবে। শুধু আমি চলে যাবো। বাবাই কি বলতো ভুলে গেছ? এই পেশার কথা ভুলে গেছ? যখন তখন…”
-“থাম। আজেবাজে কথা ছাড়া মুখে কিছু আসে না তাই না? কিচ্ছু হবে না তোর। আর বিয়েটাও তোকে ছাড়া হবে না। তাছাড়া তোর হীরামনের বিয়ের কাজগুলো কে করবে? শুনি!”
-“কাজ আমি করে দেবো। কিন্তু বিয়েশাদীর সময় প্লিজ থাকতে বলো না। আমার বিরক্ত লাগে এসব। ”
-“তোর বিয়ের জন্যও অনেক প্রস্তাব আসছে। ”
রোজ খেতে খেতে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে, “মানা করে দাও সবাইকে। এসব বিয়ে আমার জন্য না। ”
-“সারাজীবন একা থাকবি? ”
-“একা কোথায়? তোমরা তো আছোই। ”
🍁🍁🍁
ভোর হতেই রাই ফোন করল।রোজ আজ কলেজে যাবে কিনা সেটা জানার জন্যই ফোন করেছে সে।রোজ ফোন রিসিভ করে ব্যস্তকন্ঠে বলে,
-“বল”
-“কলেজে আসবি? ”
-“হ্যাঁ। ক্লাস আছে মে’বি। তুই আসবি? ”
-“আমি তো ডেইলি যাই। ক্লাস না থাকলেও ঘুরেফিরে সব দেখেশুনে চলে আসি। কিন্তু গতকাল কি হয়েছিলো রে তোর? আমার মনে হয় তোর ওপর প্রেতাত্মা ভর করেছিল। নাহলে ওসব কান্ড ঘটাতে পারতিস? আর তুই না বললি চুল খুলবি না। তাহলে পরে খুললি কেন? ”
-“প্রথমে খুলবো না ভেবেছিলাম বলেই বেনী খুলে খোপা করেছিলাম। পরে ওরা পানি ঢেলে চুল ভিজিয়ে দিলো। ভেজা চুল বাঁধা থাকলে গন্ধ হয়। তাই খুলেছিলাম।কেন কোনো সমস্যা হয়েছে? ”
-“ভাইয়ার বন্ধুরা তোকে দেখে তো পুরাই ফিদাহ দোস্ত। আমি ছিলাম তোর সাথে তাই সব প্যারা আমার ওপর এসে পড়েছে। জনে জনে এসে তোর কথা জিজ্ঞেস করছে। তোর নাম, বাড়ি ঘর, সিঙ্গেল কিনা? আমাকে অতিষ্ট করে তুলেছে প্রশ্নের চক্করে। ”
-“উত্তরে কি বলেছিস? ”
-“যা সত্য তাই। তোর নাম, তুই সিঙ্গেল। এসব শোনার পর থেকে কলের পর কল আসছে। ”
-“এবার বলবি, আমি বিবাহিত, দুটো বাচ্চাও আছে। দুই নাম্বার বরের সংসার করছি, ওকে? এখন ফোন রাখ। আমি আসন অনুশীলন করছি। ”
ফোন রাখ বললেও ফোনটা নিজেই কাটলো রোজ। এই প্রেম,ভালোলাগায় রোজের ঘোরতর আপত্তি আছে। সে সহ্যই করতে পারে না এসব। ওর মন হয় সবাই শুধু ওর বাহ্যিক দিকগুলো, বাহ্যিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে সে। তাই এসবের ওপর থেকে ও আগ্রহবোধ হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ সৌন্দর্যের পূজারি। সৌন্দর্যে সে সর্বদা আকর্ষণবোধ করবে এটা স্বাভাবিক। তবে এর নাম চট করেই ভালোবাসা দেওয়া ঠিক না। কারন এর ফলাফল কতটা যন্ত্রণাদায়ক রোজ তা ভালো করেই জানে।
রোজ আসন ছেড়ে উঠে দাড়ালো। ঘর্মাক্ত শরীরে স্লিভ লেস গেঞ্জিটা লেপ্টে আছে। পাশ থেকে পানির বোতল তুলে ঢকঢক করে পানি গিলে সে তোয়ালে ঝোলালো গলায়। চিন্তামুক্ত হতে কিছু আসন অনুশীলন করছিল সে। কিন্তু কাজ হলো না, চিন্তার পরিবর্তে রাগ এসে হানা দিল মস্তিষ্কে।
সকাল আটটায় ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে গেল রোজ। নয়টায় ফারদিন সাহেবরা আসবেন। প্রথম আলাপে রোজের না থাকলেও চলবে তাই রোজ সোজা ইউনিটে চলে আসে।নতুন একটা কেস ফাইল হয়েছে। বেশ কিছু দিন যাবৎ পুরুষদের খন্ডবিখন্ড কিছু লা’শ পাওয়া যাচ্ছে, কেসটা তদন্তের ভার এসে পড়েছে রোজের ওপর। রোজ ফাইল খুলে, লা’শের ছবি, বর্ণনা পড়ে বন্ধ করে ফেলল ফাইলটা। সামনেই ইফতি বমি করছে। ভয়ঙ্কর ছবিগুলো দেখে সহ্য করতে পারেনি। রোজ ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এমন কেন ছেলেটা? ভয় পেলে এমন পেশায় এসেছে কেন? ভীতুর ডিম একটা। রোজ পানি এগিয়ে দিয়ে বলে,
-“বাড়িতে চুড়ি পড়ে বসে থাকবে।গোবরগণেশ! ছেলে।”
-“নিজেই দেখুন ম্যাম, এভাবে কেউ খু’ন করে? লা’শটা দেখেই তো বমি আসছে। কিভাবে কে’টেছে। কোনো মানুষের কাজ না এগুলো। ”
রোজ বিরক্তিতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো। রাইয়ের মতো এই ছেলেও ভুতের প্যাঁচাল পাড়বে। তাই আগেই বলে ওঠে,
-“তুমিও ভুত প্রেতের কথা তুলো না তো। এসব ভুতটুত বলে কিছু হয় না। মানুষের কাজ এগুলো। সাইকিক কোনো কিলারের কাজ। ভুতের নয়। ”
ইফতি বিরবির করে বলল, “ঠিকই ধরেছেন। রতনে রতন চেনে। আপনি যেমন, তেমন কোনো মানুষই হবে।”
রোজ ইফতির চেহারা পড়ে বলল, “ঠিক। আমার মতই কেউ। কিন্তু আমি কেমন তা তুমি জানলে কি করে? ”
ইফতি থতমত খেয়ে তাকালো। ভড়কালো, চমকালো। রোজ বুঝলো কি করে ইফতি মনে মনে কি বলেছে? রোজ দৃষ্টি হাতঘড়ির দিকে রেখে বলে,
-“সাড়ে ন’টা বাজে।মর্গে যাও, পোস্টমর্টেম রিপোর্টগুলো আর কেসের পরিপূর্ণ তথ্য কালেক্ট করে আনো। আমি বিকেলে এসে দেখবো। ”
-“জি ম্যাম। ”
-“শোনো, ”
-“ইয়েস ম্যাম। ”
-“আমি তোমার ছোট,তাই নাম ধরে ডাকো। ম্যাম বলতে হবে না। ”
-“সিনিওর অফিসারকে সম্মান দেওয়াটাও রুলস ম্যাম। না মানলে, স্যার রেগে যাবেন। ”
-“রাগবে না।বলবে আমি অনুমতি দিয়েছি। বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ম্যাম ডাকটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না।ইয়্যু ক্যান কল মি রোজা অর রোজ। ”
-“ওকে রোজ। ”
🍁🍁🍁
কলেজের গেট দিয়ে ঢোকার সময় হঠাৎ এক বাচ্চা এসে রোজের হাতে ছোট্ট এক চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। রোজ সন্দিগ্ধচোখে তাকিয়ে বাচ্চাটাকে ডাকে। কিন্তু বাচ্চাটা সাড়া দিল না। রোজ চিরকুট খুলে দেখে,
❤️একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘ বরণ কেশ,
ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ।
দুই চোখে তার আহা রে কী মায়া?
নদীর জলে পড়লো কন্যার ছায়া।
তাহার কথা বলি,
তাহার কথা বলতে বলতে নাও দৌড়াইয়া চলি।
কন্যার ছিল দীঘল চুল, তাহার কেশে জবা ফুল।
সেই ফুল পানিতে ফেইলা কন্যা করলো ভুল।
কন্যা ভুল করিস না,
ও কন্যা ভুল করিস না,
আমি ভুল করা কন্যার লগে কথা বলবো না।
গানটা হুমায়ুন আহমেদ তোমার মতই কোনো কন্যাকে নিয়ে ভেবে লিখেছিলেন হয়তো। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা তোমার জন্যই লেখা হয়েছে। তোমার রূপের যথার্থ বর্ণনাই আছে। চুল, চোখ! “নদীর জলে” কেটে পানিতে বসিয়ে নেবে আর “জবা ফুল”কেটে রাবার ব্যান্ড! গানটা কোনো এক সময় নিজকন্ঠে তোমায় শোনানোর ইচ্ছে জাগছে মনে। কিন্তু নিরুপায় আমি তা পারছি না। কেন পারছি না? কারন তুমি আমায় তা করতে দিচ্ছো না। এমন কেন তুমি? ভালোবাসা অন্যায় না, ভুল না। পাপও না। তাহলে? এত আপত্তি কিসের তোমার? যদি আমায় নিয়ে কোনো ভাবনা থাকে তোমার তাহলে চিরকুটটি রেখে দাও। নাহলে ফেলে দাও। ❤️
রোজ চিরকুটটি পড়ে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল ডাস্টবিনে। রোজের মনে পড়লো গতকাল হাতের ফাঁক থেকে রাবার ব্যান্ড পড়ে গিয়েছিল। ছেলেটা বোধ হয় সেটা কুড়িয়ে নিয়েছে। রোজ যেতে যেতে বলে,
-“প্রেমিক না, তুমি একটা টোকাই। বেয়াদব টোকাই যে মেয়েদের জিনিস কুড়িয়ে বেড়ায়। আমার রাজকুমার কোনো টোকাই হবে না।সে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হবে। রোজের উপযুক্ত হওয়ার সকল গুণ তাঁর আগে থেকেই থাকবে। নিজেকে পরিবর্তন করে আমার মনের মত হতে হবে না তাকে। যে আমার জন্য নিজেকে বদলাবে, সে নতুন কাউকে পেলে তাঁর জন্য আবারও বদলে যেতে পারে। আর আমার পরিবর্তনশীল মস্তিষ্কের মানুষ পছন্দ না। ”
চলবে?
[ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। অনুভূতি প্রকাশ করে যাবেন। ধন্যবাদ❤️]