তুই হবি শুধু আমার ২ পর্ব-০২

0
1886

#তুই_হবি_শুধু_আমার (২)
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_০২

ক্যাম্পাসের সামনে দাড়িয়ে হাতঘড়িটা ঠিক করছে রোজ। পাশে রাই দাড়িয়ে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। মেহমেদ আসছে ওদের দিকেই, সঙ্গে আরও তিনচারটা ছেলে। রোজের সামনে এসে মেহমেদ গলা পরিষ্কার করে খুক খুক করে কেঁশে উঠতেই রোজ তাকে ইগনোর করে বাম দিকের রাস্তা বরাবর হাটা শুরু করলো। রাই নড়তে পারছে না। কারন সামনে তিনচারজন পাঁচিল তৈরি করে রেখেছে। রোজ একবার পেছনে ফিরে তাকালো।

-“রাই? ”

রাই চটজলদি বলে ওঠে, “আমাকে নিয়ে যা। ব’জ্জা’ত মেয়ে। ”

রোজ ফেরত আসলো। মেহমেদ কঠোর কন্ঠে বলল,
-“চলো।”

-“কোথায়?”

-“ফালাকের কাছে। ওকে থা’প্পড় কেন মে’রেছো? কোন সাহসে? প্রথমদিন এসেই সিনিওরদের সঙ্গে ঝামেলা? তাও ফালাকের সঙ্গে। চেনো ওকে? ”

-“না। আর আমার মনে হয় না তাকে চেনার প্রয়োজন আমার আছে। আমার কখনও প্রয়োজন পড়লে নিজেই চিনে নিতে পারবো। আপনাদের বাড়তি সাহায্য লাগবে না।”

-“বড্ড বেশি ফটর ফটর করো। মুখে বুলি ফুঁটেছে খুব তাইনা? ”

-“না, সবাই বলে, ছোট থেকেই আমার মুখে ধান দিলে খই ফোঁটে। বুলির ব্যাপারটা কেউ বলেনি। তাই জানিও না। ”

-” লাস্টবার বলছি, চলো।”

রোজ রাইয়ের দিকে তাকালো। প্রায় কেঁদে ফেলেছে ও। অল্পতে কেঁদে ফেলে কেন মেয়েটা? অদ্ভুত! কি এমন হয়েছে যে ওকে নাকের জল চোখের জল এক করতে হবে। রোজ ক্লান্ত গলায় জবাব দেয়।

-“ক্ষুধা লেগেছে। ক্যান্টিনে এখন কি পাওয়া যাবে? বাইরে না গিয়ে যদি ক্যান্টিনে যাই, আপনাদের নেতা সেখানে আসবেন? তাহলে তাকে ক্যান্টিনে আসতে বলুন। দেখি সে কি বলে, কি বলার জন্য এতগুলো চামচা পাঠিয়েছে।”

মেহমেদ রেগে গেল। কিন্তু ফালাকের বারন থাকার জন্য সেই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না,মুগ্ধতা আর ওর বেশ কিছু বন্ধু ইতিমধ্যেই ক্যান্টিনে প্রবেশ করেছে।রোজের বুঝতে বাকি রইল না রাইয়ের কান্নার কারন কি? এরা ওদের র‍্যাগিং করবে। সেজন্যই ভয় পাচ্ছে রাই। কিন্তু র‍্যাগিং তো অপরাধমূলক কর্মকান্ড। কলেজের সুনামের সঙ্গে র‍্যাগিং শব্দটা রোজ শোনেনি আগে। এখানে এমন কিছু হয় সেটা প্রায় বছর চারেক আগে শুনেছিলো। সব তো আপাতত বন্ধ, প্রিন্সিপ্যাল স্যার নিজে এই ব্যাপারে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তারপরেও এরা ওর সঙ্গে র‍্যাগ ডে র‍্যাগ ডে খেলা খেলবে? রোজের ঠোঁটের কোনায় সূক্ষ্ম হাসি ফুটে ওঠে। তবে খেলা যাক, তাদের সঙ্গে অতিপরিচিত র‍্যাগিং র‍্যাগিং খেলাটা। রাই বসে পড়ে চিন্তায়। রোজ রাইয়ের হাত টেনে ওকে দাড় করিয়ে বলে,

-“চিল ইয়ার! চল গিয়ে দেখি ভাইয়ারা কেন ডাকছেন।”

রাই রোজের কানে ফিসফিসিয়ে বলে,
-“চিল ছুটায় দেবে। ওদের চিনোস না তো, কাইন্দা কূল পাবি না। চোখ দিয়ে পানি বের কইরা ছাড়বে দেহিস। ”

-“অনেকদিন হলো কাঁদি না। কাঁদার অনুভূতি প্রায় ভুলে গেছি। যদি কাঁদাতে পারে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো ওদের প্রতি। এবার চল। ”

-“কি মতলব রে তোর? ঠান্ডা কেন এত? অস্বাভাবিক আচরণ করছিস। ”

-“আমি এমনই। চল, নাহলে ওরা তোকে কোলে তুলে নিয়ে যাবে। দেখ কেমন শেয়ালের মত তাকাচ্ছে। বাই এ্যানি চান্স তোকে মুরগির লেগপিস ভাবছে না তো? আমি তো চললাম, সাথে এলে আয়। নাহলে থাক ওদের সঙ্গে। ”

-“এই না, না আসছি আমি। আমাকে একা ফেলে যাবি না তুই। এরা আমারে ছিড়ে খাবে। ”

-“পা চালিয়ে আয়।”

ক্যান্টিনে প্রবেশ করতেই রোজের ওপর পানির ঝাপটা এসে পড়ে। সামনে বোতল হাতে মুগ্ধতা হাসছে। রোজ রাগলো না বরং ওরও হাসি পাচ্ছে কারন মুগ্ধতার এই হাসি সে বেশিক্ষণ টিকতে দেবে না। সুন্দর চেহারার এই মেয়েটি কাঁদলে চিড়িয়াখানার সাদা বানরগুলোর মতো দেখাবে। যেটা দেখলে বরাবরই রোজের হাসি পায়। রাই যাবে যাবে করেও গেটের কাছে আটকে আছে।রোজের ওপর পানি ছুড়েছে ওর ওপর যদি ডিম টমেটো ছোড়ে? কেমন দেখাবে তখন?ভাবতেই ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেল রাইয়ের। রোজ কাধের ব্যাগটা রাইয়ের হাতে দিয়ে ডান হাতে মুখের সমস্ত পানি ঝেরে নিচে ফেললো। এরপর বাঁধা ভেজা চুলের রাবার ব্যান্ড খুলে ফেললো। পিঠময় ঘন কালো চুলগুলো ছড়িয়ে পড়তেই সকলে হা করে চেয়ে রইলো। কোমর ছাড়িয়ে চুল রোজের। হাটু প্রায় ছুঁইছুঁই করছে। খোপা করে থাকায় এতক্ষণ বোঝা যায়নি ওর চুলের পরিমাণ। এবার দেখা যাচ্ছে। এত বড় চুল সচারচর দেখা যায় না। খুব কমই দেখা যায়। রোজ চুলগুলো ঝেরে হাত দিয়ে চুল ব্রাশ করে বলে,

-“উফ! কি গরম। বরফ পাওয়া যাবে? ”

সবাই সন্দিগ্ধচোখে তাকালো। রোজ রাগ হয়নি? বরং বরফ চাচ্ছে? ফালাক দূরে দাড়িয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। রোজ সেটা দেখে এগিয়ে যায়। ফালাকের চোখের পলক পড়ে না। রোজ তর্জনি দিয়ে কপাল ঘসে বলল,

-“কি বলবেন জলদি বলুন। কাজ আছে আমার। ”

ফালাক জবাব দিল না। সিয়াম এগিয়ে এসে বলল,
-“স্যরি বলো ভাইকে। ”

-“কেন?”

-“কারন ভুল করেছো তুমি। আর ভুলের শাস্তি পেতে না চাইলে ক্ষমা চাও। ভাই দয়ালু মানুষ, ক্ষমা করে দেবেন। জলদি স্যরি বলো। ”

-“যে ভুল আমি করিনি তাঁর জন্য ক্ষমা কেন চাইবো? ”

ফালাক গম্ভির গলায় শুধালো,
-“ভুল করোনি? ”

-“না।”

ফালাক মুচকি হেসে চেয়ার টেনে বসে। মেহমেদ হাসির অর্থ বুঝে নিজেও চেয়ার টেনে বসলো। সিয়াম ক্যান্টিন থেকে নুডুলস, বার্গার, পাস্তা এনেছে। ফালাক মৃদু হেসে বলে,

-“বসো। ”

রোজ বসে পড়লো। রাই স্বাভাবিক পরিবেশ দেখে চলে আসলো ভেতরে। রোজের পাশের চেয়ারটা টেনে বসল রাই। সিয়াম খাবারগুলো টেবিলের ওপর রাখে। রোজ খাবারের দিকে তাকিয়ে রাইয়ের দিকে তাকালো। এরপর ব্যাগ থেকে টাকা বের করে রাইয়ের হাতে দিয়ে বলে,

-“তোর জন্য খাবার কিনে আন। ”

ফালাক এক ভ্রু উচু করে প্রশ্ন করে,
-“একা খাবে? চাপ হয়ে যাবে নতুন মানুষ! বন্ধুকে সঙ্গে রাখো। এগুলো শেষ না করে উঠতে পারবে না তোমরা। এগুলো শেষ না হলে তোমাদের সেটাই করতে হবে যেটা আমি চাইবো। ”

-“আর যদি খেতে পারি? তখন? ”

-“কি চাও? ”

-“রিভেঞ্জ! যদি বাজিটা আমি জিতি, এগুলো সব খেতে পারি। তাহলে আমি যা চাইবো তাই করতে পারবো।আপনি আমাকে এই কথাটা দিলে আমি আপনার শর্তে রাজি।”

ফালাক, মেহমেদ, মুগ্ধতাসহ সবাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। ফালাক সবার পক্ষ থেকে বাজি স্বীকার করে বলে,

-“ওকে। তবে খাবারের টুইস্ট আনতে কিছু সস দরকার। সিয়াম চিলিসস আন। সঙ্গে কোল্ডড্রিংক আর কাঁচা মরিচ। ”

সিয়াম দ্রব্যগুলো এনে দিলো। ফালাক যত্নসহকারে বার্গারের মধ্যে কাঁচা মরিচ ঢুকিয়ে দিলো। নুডুলস ও পাস্তার ওপর ঢেলে দিল চিলিসসের পুরো বোতল। রাই ঘেমে উঠলো তা দেখে। ফালাক চামচ দিয়ে সস আর পাস্তা নুডুলস মিশিয়ে চামচটা ঠিক করে রোজের হাতে ধরিয়ে দেয়। রোজ ব্যাগ থেকে চুইংগাম বের করে চিবুচ্ছে। ফালাক হেসে বলে,

-“নাও। খেয়ে ফেলো চটপট। বাজি যখন ধরেছো তখন ভেবেচিন্তেই বোধ হয় ধরেছো।তাই আমিও আমার নরম হৃদয়টার মায়াকে এখানে আসতে দিলাম না। ”

রোজ চুইংগাম ফেলে বলল,
-“তাকে নিজের কাছেই রাখুন। আমার সামনে তাকে না আনাই ভালো।কারন আমি মানুষটা নরমশরম মানুষকে বড্ড পছন্দ করি। তাদের দেখলে আমার শক্ত, কঠিন মনটা নিমিষে গলে যায়। সেদিক থেকে আপনি পার্ফেক্ট আমার আসল মেজাজ সহ্য করার জন্য।”

রোজ কথাগুলো বলে রাইয়ের দিকে তাকালো। সে বসে আছে চুপচাপ। মেহমেদ রাইকে ধমক দিয়ে বলে,

-“কি ব্যাপার খাচ্ছো না কেন?”

রাই ভয়ে একচামচ মুখে দিতেই ঝালে ওর মুখ জ্বলে উঠলো। চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে গেছে। রোজ টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলে,

-“তোকে বললাম না নতুন খাবার আনতে। কথা শুনিস না কেন? যা, খাবার কিনে আন। আমি একাই সব খেতে পারবো। ”

মুগ্ধতা ব্যাঙ্গসুরে বলে,
-“কনফিডেন্স ভালো তবে ওভার কনফিডেন্স না। ”

রোজের হাসি চওড়া হলো। সে সকৌতুকে বলল,
-“চামচামি ভালো, ওভার চামচামি না। আশা করি তুমি বুঝতে পেরেছো আমি কি বোঝাতে চেয়েছি। ”

মুগ্ধতা তেড়ে আসতেই মেহমেদ ওকে আটকালো। তা দেখে রোজ তাচ্ছিল্যে ভরা হাসি হেসে চামচ হাতে নিল। এরপর টু-শব্দও শোনা গেল না। রোজ খেতে আরম্ভ করে। চেহারা স্বাভাবিক, ঝালে শিসানোর আওয়াজও নেই। সবাই চোখ বড় বড় করে তাকায়। রোজ থামছে না। খেতে খেতে পাস্তা শেষ। নুডুলসের প্লেট ধরতেই রাই আটকালো। রোজ স্বল্পস্বরে বলল,

-“আ’ম ওকে। ডোন্ট ওয়ারি রাই। তুই খেতে থাক, তোর আলসারের প্রবলেম আছে, না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে। খা তুই। ”

রাই খেলো না। গলা থেকে নামছে না খাবার। সবার অবস্থা একই। বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় সবাই। হতবাক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে আছে রোজের দিকে। ফালাকও চিন্তিত চোখে তাকালো। মেয়েটা জিতে গেলে কি করতে বলবে? সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। প্রশ্ন করা বাদে যা ইচ্ছে করুক আপত্তি নেই ফালাকের।

রোজ খাওয়া শেষ করে ঢেকুর তুলে বলে,
-“মুগ্ধতা আপু, বরফ এনে দেবে একটু? ”

মুগ্ধতা চোখ রাঙাতেই, সিয়াম বরফ আনলো।রোজ সে বরফের টুকরোগুলো নেড়ে চেড়ে মুগ্ধতার হাত টেনে বরফের বাটির মধ্যে ঠেসে ধরলো। সবাই উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে আসতেই রোজ বলে,

-“বাজিতে জিতেছি আমি। এখন যা ইচ্ছে তাই করতে পারবো। কেউ বাঁধা দিতে আসবেন না প্লিজ। ফালাক আপনি আপনার কথা রাখবেন না? তখন তো আপনি সহ আপনার সব চ্যালারা মাথা নাড়লেন। মুগ্ধতাও তো নাড়লো। এখন বাঁধা দিলে হবে? ”

সবাই পিছিয়ে গেলো।অতারিক্ত ঠান্ডায় মুগ্ধতার হাতের চামড়া শক্ত হয়ে আছে। যন্ত্রণা হয়। মুগ্ধতার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। রোজ প্রায় কুড়ি মিনিট পর হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

-“আমি মানুষটা ওতটাও ভালো নই যতটা ভেবেছো। তাই আমার পেছনে লাগতে এসো না,তোমাদের লেজে আমি পা দেইনি তবুও ছোঁবল দিতে আসছো। তাই সাবধান করছি, আমি সাপের বিষদাঁত ভেঙে ফনা টেনে ছেড়ার মত সাপুরিয়া। একবার যাকে ধরি, তার জীবন ধ্বংস করে দেই। তোমাদের অন্যায় নিতান্তই তুচ্ছ তাই সামান্য ট্রেইলার দেখালাম। আমি সত্যিই চাইনা তোমাকে বা তোমাদের ক্লাইম্যাক্স দেখাতে। ”

রোজ ফোন বের করে সময় দেখছে। ব্যাগ গুছিয়ে সে রাইয়ের দিকে তাকালো।ঠিক তখনই ইউনিফর্ম পরিহিত এক পুলিশ অফিসার এসে রোজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-“স্যার আপনাকে যেতে বলেছেন। আপনার ফোন বন্ধ তাই আমাকে পাঠানো হয়েছে। বিকেল চারটায় মিটিং এখন তিনটা বাজে,অফিসের গাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি হবে। ”

রোজ আঙ্গুল তুলে বলে,
-“স্কুটার এনেছি আমি।চারটার আগে পৌঁছে যাবো। তবে এরপর থেকে আমাকে ফোনে না পেলে কলেজে আসবেন না। এটা আমার প্রফেশনাল সাইট নয়। তাই সবাই সবটা ভালো নজরে দেখবে না। গো নাও।ওহ হ্যা, আমার বন্ধুকে নামিয়ে দেবেন ওর বাড়িতে। রাই ওদের সঙ্গে যা। ওরা তোকে সেফলি বাড়িতে পৌঁছে দেবে। কেউ হ্যারাস করার সুযোগ পাবে না। ”

কথাটা সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল রোজ।রাই পুলিশ অফিসারের সঙ্গে চলে গেল। রোজও বের হয়। যেতে যেতে রোজ শোনে মুগ্ধতা চেঁচিয়ে বলছে, “সাইকো গার্ল”রোজ মৃদু হাসে।হাসিতে মেতে ওঠে ওর চক্ষুদ্বয়ও। ঠোঁটের হাসি বজায় রেখেই রোজ পেছনে ফিরে জবাব দিল,

-“রাইট।”

শব্দটির তীক্ষ্ণতা আন্দাজ করার মত না। ধাঁরালো, এক হুমকির মতো শোনালো। রোজের ক্রোধান্বিত চাহুনিতে মুগ্ধতা ভয় পেয়ে যায়। মুগ্ধতাসহ ওর বন্ধুরা পিঁছিয়ে গেল কয়েক কদম। রোজের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। সে হেসে ফালাকের দিকে একনজর তাকিয়ে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে। এতক্ষণ দম খিচে ছিল মেহমেদ সিয়াম। মেহমেদ এবার দম ছেড়ে বলল,

-“ফালাকের ডুবলিকেট।”

জবাবে ফালাকও এক ধাঁরালো দৃষ্টির সঙ্গে এক চিলতে হাসি উপহার দেয়।

🍁🍁🍁

অয়ন্তির ফুড পয়জনিং হয়েছে। এজন্যই পেটে ব্যাথা ও বমি হচ্ছে। গতকাল লুকিয়ে লুকিয়ে ফুচকা, চটপটি, মুড়িমাখাসহ নানা ধরনের ফাস্টফুড খাওয়ার ফল এটা।ইফতি সকালে ভুল করে অয়ন্তির বদলে অয়ন্তিকা নামক একজনের রিপোর্ট নিয়ে চলে এসেছিল। রোজ অয়ন্তির রিপোর্ট চেক করে বলে,

-“এবার ঠিকঠাক রিপোর্ট এনেছো। গোয়েন্দা তুমি, আর তোমার কাজ এমন অগোছালো কেন? তোমাকে কি নতুন করে শেখাতে হবে সব? ডাফার! তোমাকে সিলেক্ট করেছে কে? তাঁর ট্রিটমেন্ট আগে করানো উচিত দ্যেন তোমার। ”

-“স্যরি ম্যাম। আসলে আমি নাম ভুলে গিয়েছিলাম। তাই ভুল হয়ে গেছে। ”

-“ইটস ওকে। সারাদিন তো মনে হয় চিন্তায় পেটে কিছু পড়েনি। বাড়িতে চলে যাও, আজ তোমার ছুটি। ”

-“কিন্তু ম্যাম। ”

-“বললাম তো ছুটি। বিরক্ত করবে না একদম। গাড়ি বের করো আমিও বাড়ি ফিরবো। ”

-“ওকে। ”

বাড়িতে ফিরেই রোজ শুনতে পেলো তাঁর অতিআদরের ছোট ভাই সারা বাড়িময় জুড়ে দৌড়ে আশ্চর্যজনক এক বাক্য আওড়ে চলেছে। রোজ নিজের শ্রবণেন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ করে শোনার চেষ্টা করল সে আদৌ ঠিক শুনছে কিনা।কিন্তু না, ঠিকই শুনছে। রোজের ছোটভাই সারিম গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে আর বলছে,

-“আমি প্রেগনেন্ট, আমারও বাচ্চা হবে, আমার তিনটা হবে, আমার চারটা হবে, আমি ওদের শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাবো।”

রোজের মগজ ফাঁকা হয়ে আসলো। চারপাশে এতশত প্রেগনেন্টের কথা শুনে রোজের নিজের হাতও ওর পেট স্পর্শ করলো।সকালে শুনলো অয়ন্তির ভুল প্রেগনেন্সির রিপোর্ট, দুপুরে রাইয়ের পেটের আলসারের ব্যাথা, এখন আবার সারিমের প্রেগনেন্সি। হচ্ছে টা কি? সাতবছরের ছেলে বাচ্চা এসব কোথ থেকে জানলো? কোথ থেকে শুনলো? কে বলেছে? এতটুকু বাচ্চাকে আবোলতাবল কে শেখাচ্ছে? রোজ বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সারিম ছুটে এসে রোজকে জড়িয়ে ধরে। বলে,

-“আপিয়া আজ দুটো চকলেট দেবে।একটা আমার আর একটা আমার বাচ্চার।আমি প্রেগনেন্ট জানো? ”

রোজ হেসে বলল,
-“তাই? কে বলেছে তোমাকে এসব? কিভাবে প্রেগনেন্ট হলে তুমি?”

-“কুকুর কামড়ালে চৌদ্দটা ইঞ্জেকশন দিতে হয় কারন, ইঞ্জেকশন না দিলে পেটে কুকুরের বাচ্চা হয়। হীরামন বলেছে আমায়।এটাও বলেছে বিড়াল কামড়ালেও ঠিক এভাবে বাচ্চা হয়। এজন্যই তো আমি বিড়াল ধরিনা। কিন্তু আজ তোমার মিনিক্যাট আমায় কামড়েছে। এখন তো আমার পেটেও বাচ্চা হবে। আমার সব বন্ধুদের আমি বলেছি, আমাদের বাড়িতে অনেক বিড়াল আসবে ওরা কিনবে বলেছে। আমি আমার বাচ্চা বিড়ালগুলো ওদের কাছে বেঁচে বড়লোক হয়ে যাবো। ভালো বুদ্ধি না?”

রোজ সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে কোলে তুলে নিল। এরপর নিজের ঘরে যেতে যেতে বলল,

-“এসব মিথ্যা কথা, সারিম। বিড়ালের গায়ে জার্মস থাকে তাই হীরামন তোমায় এসব বলেছে যেন তুমি আর বিড়াল নিয়ে মাখামাখি না করো। আর কুকুর যদি কামড়ায় তাহলে বাচ্চা হবে না। তোমাকে তো সব জেনে নিতে হবে। তুমি ব্রেভ বাচ্চা তাই এখন থেকে ঠিক ভুল শিখতে হবে। শোনো, কুকুরের কামড় অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক এবং মারাত্নক হয়। কুকুরের কামড় থেকে জলাতঙ্ক রোগ হতে পারে। রেবিস নামক ভাইরাস থেকে জলাতঙ্ক রোগ হয়ে থাকে। এটি একটি স্নায়ুর রোগ।মানে নাড়ির অসুখ হয়। রেবিস ভাইরাস কুকুরের লালা থেকে ক্ষতস্থানে লেগে যায় এবং সেখান থেকে স্নায়ুতে পৌঁছে জলাতঙ্ক রোগে সৃষ্টি করে। বুঝেছ?
আর বিড়ালের মুখে ব্যাকটেরিয়া থাকে যা মানুষের দেহে গেলে মানুষের শরীরের ক্ষতি হতে পারে। তুমি তো ছোট। যদি বিড়ালের সঙ্গে খেলতে গিয়ে ব্যাথা পাও তাই হীরামন তোমাকে বাচ্চার কথা বলেছে। আসলে ওসব ভুল। ”

-“তাহলে আমার বন্ধুদের আমি বিড়াল দেবো কি করে? আমি তো ওদের বলে রেখেছি।আনসারীর ছেলে কথার খেলাফ করবে? ” মুখ ভার করে বলল।

-“আমি এনে দেবো। এবার খুশি?”

-“হুম অনেক। কিন্তু বাবাই আর মামনি কবে আসবে আপিয়া? ”

রোজের হাসিমুখ মলিন হয়ে গেল। এই প্রশ্নটার উত্তর সে কখনই সারিমকে দিতে পারবে না। বাকিসব প্রশ্নের উত্তর জানা থাকলেও এই প্রশ্নের উত্তর তো জানা নেই রোজের। কিভাবে ছোট ভাইকে বলবে সে? তাদের মা বাবা ফিরবে না। তারা একেবারের জন্য ঘুরতে গেছে। রোজ সারিমের মাথায় হাত বুলিয়ে, সারিমের কপালে চুঁমু খেয়ে বলে,

-“কেন?আপিয়ার কাছে থাকতে ভালো লাগে না? বাবাই মামনি ঘুরতে গেছে, তাদের বিরক্ত করতে চায় আমার নক্ষত্র? ”

সারিম মাথা দুদিকে নাড়িয়ে “না”বোধক উত্তর দিল।রোজ ব্যাগ থেকে চকলেট বের করে সারিমের হাতে দিয়ে বলে,

-“তারা ফিরে আসবে নক্ষত্র। তুমি তাদের কথা না ভেবে পড়ায় মনোযোগ দাও। অঙ্কে বাংলায় নাকি একশতে একশ পেয়েছ? ইংরেজিতে আটানব্বই।”

-“হুম। ইংরেজিতে বানান ভুল করেছি। ” মন খারাপ করে বলল।

-“তাতে কি? আমার নক্ষত্র পরের বার একশ পাবে। এতে মন খারাপ করতে আছে? ভালো নাম্বার পেয়েছো। আরেকটু চেষ্টা করলে আরও ভালো হবে। ”

-“তোমার মত ভালো হবে আপিয়া?”

-“আমার থেকেও ভালো হবে। যাও চকলেট খাও আর হীরামনের সঙ্গে গল্প কর। আমি পরে পড়ার সময় ডাক দিবো। ”

-“তোমার মাথা ব্যাথা করছে? আমি টিপে দেবো? ”

রোজ সচকিত দৃষ্টিতে তাকায়। সত্যিই কাজের চাপে আর কলেজের কান্ডে রেগে মাথা ধরে আছে ওর। এখন ঘুমাতে যাচ্ছিলো তাই। কিন্তু সারিম বুঝলো কি করে? রোজ ‘না’ সূচক মাথা নাড়লে সারিম বিজ্ঞকন্ঠে বলে,

-“আমি ছোট কিন্তু এতটাও না, তোমার কষ্ট হলে আমি বুঝি। চলো, শুয়ে পড়ো। আমি টিপে দিচ্ছি। দেখবে ব্যাথা ভ্যানিশ হয়ে যাবে। কোনো না শুনবো না আমি। তোমার নক্ষত্র তোমার থেকেও জেদি। হুহ।”

সারিমের আবদার ফেলতে পারলো না রোজ। বিছানায় উঠে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বালিশে মাথা রাখা মাত্র সারিমের ছোট ছোট আঙ্গুলের স্পর্শ পেল কপালে। শান্ত হলো মন। ঘুমঘুম ভাব চলে আসলো। মুহূর্তেই রোজ তলিয়ে গেল ঘুমের অতলে।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে