তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০৫

0
1760

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_পাঁচ

অয়ন্তি যে ঘরে থাকার কথা ভেবেছে তার ডান পাশের ঘরটা আরশানের। বা’পাশে অনা’রা থাকবে। আর নিচে কিচেনের পাশের ঘরটায় থাকবে সায়ন ও সৌফি। অনা ল্যাগেজ থেকে অয়ন্তির জামা-কাপড় বের করে খাটের ওপর রেখেছে। অয়ন্তি সেগুলো তুলে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
-আমরা কত দিন থাকবো এখানে?
-কেন কোনো সমস্যা হচ্ছে?
-না। কিন্তু অপরিচিত একটা মানুষের বাড়ি এভাবে না বলে এসে, থাকার পরিকল্পনা করা কি ঠিক অনাপি?
-অপরিচিত কে? আরশান হচ্ছে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। ওর বাড়ি মানে আমারও বাড়ি। আর তোরও বাড়ি!
-আমার বাড়ি? কিভাবে? উনি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড না।
-ওত বুঝতে হবে না তোকে। আলমারিতে জামাগুলো তুলে রাখ। এক সপ্তাহ থাকবো এখানে।

অয়ন্তি আলমারিতে জামা-কাপড় তুলে রেখে অনার দিকে ফিরে চাইল। অনা বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে। অয়ন্তি নিশ্চই এবার প্রশ্নে প্রশ্নে ওর মগজ খেয়ে ফেলবে।এই মেয়েটা এত প্রশ্ন কেন করে?বোকা একটা। অয়ন্তি প্রশ্ন না করে ঘরের জিনিসগুলো দেখতে থাকে। অনা নিজের কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়তেই অয়ন্তি গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুরু করল। মন ভালো থাকলে অয়ন্তি গুনগুন করে। এটা ওর অনেক পুরোনো অভ্যাস। আরশান অনাকে খুজতে ওর ঘরে আসতেই অয়ন্তির গান ওর কানে ভেসে আসলো।আরশান থমকে দাঁড়ালো। অয়ন্তি বিছানার চাঁদর ঝারছে। মাঝে মাঝে খাটের ওপর থাকা থ্রিপিচের ওরনা শাড়ির মত পেঁচিয়ে আয়নার সামনে হেলেদুলে নাচছে। ঘোমটা দিচ্ছে, মুখ ঢাকছে, লাজুক হাসছে। আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। পাগল হয়ে গেল নাকি মেয়েটা? আরশান গলা খাঁকড়ি দিয়ে ঘরে প্রবেশ করল।
-এহেম!!

অয়ন্তি ত্বরিত গতিতে পেছনে ফেরে। আরশান গম্ভির কন্ঠে শুধাল,
-অনা কোথায়?
-গোসল করছে।
আরশান মেঝেতে চোখ বুলিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকাতেই অয়ন্তি চোখ-মুখ খিচে ফেলল।
-আমি আসলে, আমি গুছিয়ে দিচ্ছি। হাত থেকে পড়ে গেছে সব। আমি ইচ্ছে করে করিনি। সত্যি!
-নিজের গায়ের ওরনা আগে খুলে তারপর গোছাও।

অয়ন্তি আরশানের কথাটা ঠিকঠাক শুনলো না। ব্যস্ততা নিয়ে এগোতেই ধপাস করে পড়ে গেল মেঝেতে। আরশান বুকের ওপর দু’হাত গুজে অয়ন্তির দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইল। অয়ন্তি ব্যাথা পেয়েছে কিনা বোঝা গেল না। চেহারার ভীত চাহুনির অর্থ আরশানকে ভয় পাওয়া। মেয়েটা পড়ে ব্যাথা পেল অথচ ব্যাথার কথা না ভেবে অযথা আরশানকে ভয় পাচ্ছে ব্যাপারটা আরশানকে প্রচন্ড বিরক্ত করল। আরশান এগিয়ে এসে ওকে জিজ্ঞেস করতে চাইল, ও ব্যাথা পেয়েছে কিনা। তার আগেই অয়ন্তি ভ্যাভ্যা করে কেঁদে উঠলো।আরশান ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকাল। কোমল কন্ঠে বলল,
-ব্যাথা পেয়েছ? দেখি ওঠো!

অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসলো আরশান। তা দেখে অয়ন্তি আরও জোরে কেঁদে উঠল। কি অদ্ভুত! আরশান দূরে সরে দাড়ায়। অনা অয়ন্তির কান্না শুনে দ্রুত গোসল সেরে বের হতেই দেখল অয়ন্তি মেঝেতে বসে কাঁদছে আর আরশান ওর সামনেই দাড়িয়ে আছে। অনার কপালে ভাঁজ পড়ল।আরশানের দিকে তাকাতেই ওদের চোখাচোখি হলো। আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-খাবার রেডি! নিচে আয়।
-আসছি।

খাবার টেবিলে আরশানকে দেখা গেল না। সায়নকে নিয়ে বেরিয়েছে সে। অয়ন্তির ভেজা চোখ দেখে মাহিন কৌতুহলী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,
-কি হয়েছে আমার ছোট বউটার?
-পড়ে গেছি ওরনায় বেঁধে।
-ওহ। তা কিসের ওপর পড়েছ? নরম কিছু নাকি শক্ত!
অনা চোখ রাঙালো। মাহিন থেমে যেতেই অয়ন্তি নাক কুচকে বলে,
-মেঝেতে। কি শক্ত, হাটু ফুলে গেছে।অনাপি বরফ দিল তাও ফোলা কমেনি।
-আরশানের ঘরে বাম আছে। লাগিয়ে নিও, ফোলা আর ব্যাথা দুটোই কমে যাবে।

সন্ধ্যায় আরশান সিগারেট নিয়ে ছাদে উঠল। রোজকার অভ্যেস হয়েছে এটা। দিনে একটা আর রাতে একটা টান না দিলে মস্তিষ্ক কাজ করেনা। চারপাশ অন্ধকারে নিমজ্জিত। যৎকিঞ্চিৎ আবছা আলো আছে তবে তা না থাকার সমান। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরাতেই একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর ভেসে আসল আরশানের কানে,
-বাচ্চাদের সামনে সিগারেট খেতে হয়না।

আরশান সবে ঠোঁটের ভাজে সিগারেট রেখেছিল।কন্ঠটা শুনে সে ডানে বামে চোখ বুলালো। কাউকে দেখতে না পেয়ে সে পেছনেও ঘুরল। আজব! ছাদে তো কেউ নেই। ঠিক তখনই টাঙ্কির ওপর থেকে ধপ করে কিছু একটা পড়লো ওর সামনে। আচমকা এমন ঘটায় ভয়ে দুকদম পিছিয়ে গেল আরশান। আরশানকে ভয় পেতে দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে অয়ন্তি। জামার ময়লা ঝেরে সে গম্ভির গলায় বলল,
-আমার দিকে ওভাবে তাকান কেন?
আরশান হকচকালো।
-কিভাবে?
-চোরদের মত।
-চোরদের মত? তুমি চোরদের দৃষ্টি জানো নাকি?
-অয়ন্তি সব জানে।
-কি জানে?
-সব জানে, সব।
-ওকে! তো বলো আজকে আকাশে কয়টা তারা দেখা যাচ্ছে।
-যে কয়টা উঠেছে সে কয়টা। যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।
-বাহ!
-ধন্যবাদ। এবার বলুন, ওভাবে কেন তাকান? ওভাবে কারা তাকায় জানেন? বখাটে, ইভটিজার’রা।
-তাই?
আরশান অয়ন্তির দিকে এগিয়ে আসতেই অয়ন্তির ভরা কনফিডেন্স মিইয়ে গেল। পিঁছিয়ে গিয়ে সে থতমত খেয়ে বলে,
-একি এভাবে এগোচ্ছেন কেন?
-তুমি পিছিয়ে যাচ্ছো বলে।
-তো আপনি এগিয়ে আসলে আমি তো পিছিয়ে যাবোই। তাইনা?
-কেন?
-কারন…
-কারন?
-কারন বলতে পারবো না।
-বাচ্চা মেয়ে বাচ্চার মত থাকবা। এসব নাটক আমার সামনে করবা না। যাও, অনার কাছে গিয়ে চাঁদের বুড়ির গল্প শোনো।
-অভদ্র।
-কি বললে? (ধমকের সুরে।)
-অনাপি! অনাপির কাছে যাচ্ছি। (তোতলাতে তোতলাতে বলে।)
-গুড।
যেতে যেতে অয়ন্তি পেছনে ফিরে কাঁপা কন্ঠে শুধাল,
-আপনি কি বিদেশি? বিদেশিদের মত চোখ। আপনার গায়ের রঙও অনেক সাদা।কোন দেশে থাকতেন আগে? আপনার চোখের রঙ কি সত্যিই নীল?নাকি লেন্স দিয়ে,
-এই তুমি যাবে? ( বিরক্ত হয়ে চেঁচাল আরশান।)

অয়ন্তি দাঁড়ালো না আর। একছুটে নিচে চলে গেল। তা দেখে। মৃদু হাসে আরশান। যাক, অয়ন্তি তাঁর চেহারার ওপর অন্ততো নজর দিয়েছে, মনের খোজ না’ইবা নিল।



-এই বেয়াদব! এসব কি?

অয়ন্তির কন্ঠে আরশানের চেতনা ফিরলো। স্মৃতিচারণ থেকে বাস্তবে ফিরে সে নিজের চেহারা যথাসম্ভব গম্ভির করার চেষ্টা করল । এরপর অয়ন্তির দিকে তাকিয়ে বলল,

-বেয়াদব? আর আমি? গাড়ির ভেতর আসতে বলেছি দেখে কোলের ওপর এসে পড়লে তুমি। আর বেয়াদব হলাম আমি?

অয়ন্তি ভড়কে গেল। তবুও কন্ঠের তেজ কমলো না। সে কোলের ওপর এসে পড়েছে মানে? আরশানই তো ওকে টান দিল। ওভাবে কেউ হ্যাচকা টান দিলে ব্যালেন্স সামলে রাখা যায়? অয়ন্তি নিজের শরীরে লেপ্টে থাকা শার্টটা আরশানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে বলে,

-এসব কি? কি করেছেন আমার সাথে?

আরশানের ভাবলেশহীন উত্তর,
-যাস্ট ঘাড়ে চুমু খেতে চেয়েছিলাম।তুমি তোমার লোহার মত হাত দিয়ে এমন চর মা’রলে যে চুঁমুর নেশা কর্পূরের মত উবে গেল। রোম্যান্টিক মোমেন্টে এমন টর্চার কিন্তু ভালো না মাই লাভ! তুমি এমন করলে আমিও এমন করতে বাধ্য হবো।

অয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। লোকটা ওকে মা’রবে? কিন্তু ওসব ভাবার সময় নেই অয়ন্তির। লোকটাকে থা’প্প’ড় মে’রেছে এটা শুনে ওর নাচতে ইচ্ছে করছে। আহা! কি সীন! দ্যা গ্রেট রেডিও জকি আরশান খাঁনের গালে জেসমিন মীর্জা অয়ন্তির হাতের পাঁচ আঙ্গুলের ছাঁপ। জার্নালিস্ট হওয়ার পর অয়ন্তি নিশ্চই এমন একটা নিউজ ছবিসহ ছাঁপাবে। অয়ন্তি ভাবনাতে এত হারিয়ে গেল যে আনমনেই হেসে উঠলো। আরশান শার্ট পড়তে পড়তে বলে,

-এভাবে হাসবে না মাই লাভ! তোমাকে এভাবে হাসতে দেখলে আমার বাসর বাসর ফিলিং আসে।

অয়ন্তি মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,
-স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে না। তাই আমাকে পাওয়ার এই স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দিন।

-আফসোস!তুমিময় কোনো কিছুই ছাড়তে পারবো না। পারলে আগেই ছেড়ে দিতাম। এবার জলদি গুড নাইট কিস দাও, ঝড় থেমে গেছে। কিস দিয়ে দ্রুত বাড়ি যাও।

-হোয়াট?

-ইংলিশ বোঝোনি? ওকে বাংলায় বলছি। ওকে বালিকা স্যরি ওহে যুবতি আমাকে তুমি শুভরাত্রির মিষ্টিমধুর এক চুঁম্বন দিয়া দ্রুত পলায়ন করো। নাহলে তোমার পিতা আমাদের এই রাতে এভাবে ধরিতে পারিলে, ধরে বেঁধে বিবাহ করিয়া দিবেন। এর থেকে ভালো বাংলা আসে না আমার। সো ডু দ্যাট ফাস্ট, কিস মি!

-নেভার। আমি কিস করবো? তাও আপনাকে?অসম্ভব।

আরশান আগেই গাড়ি লক করে চাবি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছিল। অয়ন্তি চারপাশে চোখ বুলিয়ে যখন চাবি খুজে পেল না তখন আরশানের দিকে করুনচোখে তাকাল। আরশান ঠোঁট চেপে হাসছে। অয়ন্তি আসফাস করে উঠে বলল,

-আমি আমার হাসবেন্ড ছাড়া অন্য কাউকে চুঁমু দেবো না।

আরশান ফ্রন্টসিটে এসে বসলো। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিররে তাকিয়ে চুলগুলো ঠিক করলো। গাড়ি চলা আরম্ভ করতেই অয়ন্তি হতচকিত দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করে। দ্রুততার সঙ্গে বলে,

-একি কোথায় যাচ্ছেন? গাড়ি থামান। থামান বলছি। আমি বাড়ি যাবো তো।

-না।

-না মানে? এই রাতে আমাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন? থামান গাড়ি। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

-করো। এমনিতেও এত রাতে তোমার চিৎকার শোনার অপেক্ষায় কেউ বসে নেই। তবে চাইলে গভীর রাতে আমাকে শোনাতে পারো। আমি শুনবো, শুধু চিৎকার না, গালি, হাসি, কান্না,ন্যাকামি গলা সব শুনবো। কিন্তু তোমার এতসব কিছু শুধু আমি এবং আমিই শুনবো। বুঝেছ?

-না। আপনাকে কেন শোনাবো? আপনি কে?

-কেউ না। কিন্তু দ্রুতই কেউ হবো।

-মানে?

-যাস্ট একটা কিস বলেছিলাম। দিলে না, বললে বিয়ের পর জামাইকে দেবে। বাট আমি যা চাই তা না পাওয়া পর্যন্ত আমার শান্তি হয়না। যখন বলেছি কিস নেবো তখন নেবোই। তার জন্য যদি এখন বিয়ে করতে হয়, করবো। তোমার পরিবার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে দ্যান বলবো তুমি আমাকে নিয়ে পালাতে চেয়েছে কারন তুমি আমাকে দেখার পর থেকে স্থির থাকতে পারছো না। বিয়ের জন্য, বাসরের জন্য পাগল হয়ে গেছ তাই মাঝ রাতে আমাকে ডেকে কাজি অফিসে যাচ্ছো। আর এটা সবাই চোখবুজে বিশ্বাসও করবে। কারন তুমি আমার সঙ্গে সত্যিই যাচ্ছো। কোনো মতলব না থাকলে তুমি বাড়ির বাইরে, আমার গাড়িতে এত রাতে কেন আসবে জান?

অয়ন্তির চেহারা রাগে জ্বলে উঠলো। সাংঘাতিক মানুষ তো। এমন মানুষ অয়ন্তি জীবনেও দেখেনি। বানিয়ে বানিয়ে কি সব বলছে? এই ব্যাটাই তো ওকে ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসলো। অয়ন্তি রেগে আরশানের বা’হাতে কামড় বসিয়ে দিল। মুহূর্তেই গাড়ি থেমে যায়। অয়ন্তির কাজে হতভম্ব আরশান। বিস্ময়ে যেন পাথর হয়ে গেছে সে। অয়ন্তি গাড়ির লক খুলেই দৌড় দিল। তা দেখে আরশানের মেজাজ তুঙ্গে। এটা কোন এরিয়া তা কি সে জানে? এমন বোকার মত কাজ করার চিন্তা ওর মাথায় আসলো কি করে? আরশান রেগে থম মেরে বসে রইল। কারন সে জানে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কুসুম নিজ থেকেই ফিরে আসবে।

গাড়ি থেকে বের হয়েই দিক বিবেচনা না করে ছুটতে থাকল অয়ন্তি। এই লোককে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই কয়েক হালি কুকুরের সামনে পড়তে হলো। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে আসলো। অয়ন্তির ভয় লাগে প্রাণী। বিড়াল দেখলেও সে ভয়ে দৌড় দেয়। আর এগুলো তো বাছুরের সাইজের কুকুর। এত বড় কুকুর কোথ থেকে আসল? এই রাতে বাইরে কি করে এরা? অদ্ভুত, বাড়ি থাকতে পারে না? তারপর আবার ভাবল অয়ন্তি, এদের তো বাড়ি নেই। ভয়ানক এই প্রাণীগুলোর অবশ্যই বাড়ি থাকা উচিত,কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে উঠতেই অয়ন্তির কেঁদে ফেলার জোগাড় হলো। এরা চেঁচায় কেন? কামড় দেবে নাকি? অয়ন্তি পেছন ফিরে জোরে হাটতেই বুঝলো কুকুরগুলোও আসছে।এরা আবার আসে কেন?অয়ন্তি ভয়ে আবারও চোখ বুজে দৌড় লাগালো। গাড়ির কাছে আসতেই আরশান গাড়ির দরজা খুলে দেয়। অয়ন্তি ভেতরে ঢুকে জোরে দরজা লাগিয়ে হাঁপাতে লাগলো, এরপর উত্তেজিত কন্ঠে বলল,

-আরে গাড়ি চালাচ্ছেন না কেন? কুকুরগুলো কি বাড়ি নিয়ে যাবেন? ব্যাকসিটের দরজা খুলে দেবো? দ্রুত চলুন।

আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। অয়ন্তি রেগে তাকাতেই আরশান বলল,
-কামড়ে যে হাতের গোশত খেয়ে ফেললে সেই গোশত আগে ফেরত দাও। নাহলে গাড়ি নড়বে না। বরং আমি তোমাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেবো। কুকুর আর তুমি সারারাত গল্পগুজব করে সকালে ঠিকানা চিনে একা একাই বাড়ি চলে যাবে।

-কি?

-বাংলাও বোঝো না?

অয়ন্তি কেঁদে ফেলল। বাইরে কুকুরের ডাকে ভয়ে ওর বুক কাঁপছে। ভয় পেলে অয়ন্তির মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। হাত পা কাঁপে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ঘুরে ওঠে। বাড়ির কেউ থাকলে অয়ন্তি তাঁর কোলে ঝাপিয়ে পড়ে ভয় মেটাতো। এখনও তো তারও উপায় নেই। ডান পাশে বসা নিষ্ঠুর মানুষ তো ওর ভয়, কষ্ট বুঝতেই পারে না। আরশান নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসে। দারুন জব্দ হয়েছে ওর কুসুম। আরেকটু জব্দ করা উচিত। সকালে মিথ্যা বলার শাস্তিস্বরূপ। বাচ্চা নিয়ে ওসব কিভাবে বলতে পারলো কুসুম? ওসব শুনে আরশানের ভেতরটা যে জ্বলছিল তার পরিবর্তে একটু ভয় দেখালে ক্ষতি কি? পরে না’হয় ভয়টাও ভেঙে দেওয়া যাবে। আরশান রাশভারি কন্ঠে বলল,

-আচ্ছা গোশত ফেরত দিকে হবে না। বিষে বিষে বিষক্ষয় করে দিলেই হয়।

-ম,মানে?

-যেটা নেওয়ার জন্য এতদূর আসলাম সেটা আমাকে দিলেই আমি গাড়ি ঘোরাবো।

অয়ন্তির কান্না থেমে গেল। স্তব্ধচোখে ক্ষণিক তাকিয়ে লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। পরক্ষণেই নিজের কাজে নিজে হতবাক হয়ে গেল অয়ন্তি। হাসলো কেন ও? হাসি পেল কেন এমন মুহূর্তে? আরশান কি ওর প্রেমিক? নাকি স্বামী যে এমন কথায় লজ্জা আসবে। লজ্জা পাবে না অয়ন্তি, কিছুতেই না। কিন্তু লজ্জা তো লাগছে, আর তা বেশ আয়োজনের সহিত ঘিরে ধরছে অয়ন্তিকে। মাথা নত করে বসে রইল অয়ন্তি। অচেনা এক অনুভূতি অয়ন্তির সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে তুললো। দুহাতের নখ ঘসে অয়ন্তি সামনে তাকায়। আরশান স্টিয়ারিং’য়ে আঙ্গুল রেখে গুনগুন করছে। রেডিও চালালে মন্দ হয়না। রোজ এখনও আছে? কয়টা বাজে? দেড়টা? আরশান রেডিও চালাতেই একটা গান বেজে উঠল, অন্য ফ্রিকোয়েন্সিতে তার মানে আড়াইটা বাজে, রোজের শো শেষ। আরশান মৃদু ভলিয়মে গানটা চালিয়ে রাখলো,

সার্দিকি রাতো’মে হাম শো’য়ে রাহে
এক চাঁদার মে
হাম দোনো, তানহা হো না কোই ভি রাহে
ইশ ঘার মে।
জারা জারা বেহেকতা হ্যায় মেহেকতা হ্যায়!!!

আরশান দুষ্টু হেসে বলে,
-রোম্যান্টিক ওয়েদার, রোম্যান্টিক সং, রোম্যান্টিক ফিল, আহা! সবকিছু বুঝি রোম্যান্টিক কিছু ঘটারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তোমার কি মনে হয় কুসুম? রোম্যান্টিক কিছু হলে ভালো হবে না?

অয়ন্তির লজ্জা বেড়ে গেল। লোকটাকে আস্ত চিবিয়ে খাওয়ার চিন্তা মগজ থেকে বেরিয়ে গেল ঠিক কিন্তু রাগ বের হচ্ছে না। মাঝরাতে তুলে এনে এভাবে হেনস্থা করা কি ভদ্রলোকের কাজ?অয়ন্তিতে লজ্জায় নুইয়ে পড়তে দেখে আরশান অয়ন্তির দিকে ঝুঁকে বলে,

-একি তুমি লজ্জা পাচ্ছো নাকি? সকালে টেক্সট করে বলেছিলাম না? বাসর রাতে হিসেব চুকানোর মত ভদ্র জামাই আমি। এখন বেশি কিছু করবো না, তোমার এই লজ্জা দেখে কিছু করার মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। বুঝলে! আমার আবার লাজুক মেয়ে পছন্দ না। এরা রোম্যান্সে বাঁধার সৃষ্টি করে। যাও আজকের মত মাফ। তবে কিস তো তোমাকে দিতেই হবে। তুমি স্বেচ্ছায় দেবে নাকি?

-না। এসব হবেনা এখন। আমাকে ভালোবাসলে আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ নিশ্চই করেন।

-সেজন্যই তো জিজ্ঞেস করছি।নাহলে চেপে ধরে কবেই চুঁমুটুমু খেয়ে ফেলতাম। তুমি তালপাতার সেপাই আমাকে আটকাতে পারতে না।

-আপনার সঙ্গে আমার মাত্র একদিনের পরিচয়।আপনি আমাকে হয়তো আগে থেকে চেনেন কিন্তু আমি তো চিনি না। পরিচয় হতেও তো সময় লাগে বলুন।

আরশান জবাব দিল না। পুরোনো ক্ষতে যেন নতুন করে ঘা লাগলো। গাড়ি স্টার্ট দিল আরশান। বুকের ভেতরে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল মুহূর্তেই। এত পরিচিত, এত কাছের কুসুম ওকে চিনতে পারছে না। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই চোখ ভিজে আসে। কিছু সময় বাদে আরশান রুদ্ধ কন্ঠে বলে,

-হুম। সময় নাও, আমি বোধ হয় তাড়াহুড়ো করছি অনেক। কিন্তু সময় দিচ্ছি, এর মানে এই না যে তুমি তোমার নতুন প্রেমিকের কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করবে। তুমি শুধু আমার কুসুম। তুমি যদি কারোর হও সেটা শুধু আমার হবে। কথাটা মনে রেখো।

অয়ন্তি সন্দিগ্ধ চোখে তাকায়। আরশানের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? কন্ঠ, শব্দ কেমন কাঁপাকাঁপা কেন? কাঁদছে নাকি? কিন্তু কাঁদছে কেন? অদ্ভুত মানুষ তো। অয়ন্তি ভাবলো একবার জিজ্ঞেস করবে কিন্তু তার আগেই আরশান ভেজা কন্ঠে বলে,

-নামো। বাড়ি চলে এসেছি। বেশি রাত জাগবে না। বেশি চিন্তাও করবে না। বেশি চিন্তা করলে তোমার মাথাব্যথা বাড়বে। গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। ওকে?

অয়ন্তি মাথা নাড়লো। বাড়ির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে অয়ন্তি আরশানের গাড়ির দিকে তাকায়। নীলচোখটা ভেজা। শুভ্র চেহারার মলিনতা অয়ন্তির ভালো লাগলো না। মানুষটা বেয়াদবই ভালো, এমন নরমশরম স্বভাবে তাকে একদমই মানায় না। অয়ন্তি বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেট লাগিয়ে নিজের ঘরে এসে খাটের ওপর বসতেই টের পেল ওর গায়ে ওরনা নেই, বরং আরশানের শার্ট আছে। তখন না শার্টটা ছুড়ে মা’রল? তাহলে এটা কোথ থেকে আসলো। পরক্ষণেই মনে পড়ে, টি-শার্ট দিয়েছিল শার্ট তো গায়েই ছিল, যেটা সে ওরনা ভেবে আগলে রেখেছিল। তখনই ফোনে একটা ম্যাসেজ আসল,

“ওরনা রেখে দিলাম। আমার শার্টের বদলে।তাই এখন ওসব নিয়ে চিন্তা না করে জামা-কাপড় বদলে ঘুমাও। জামা তো ভিজে গিয়েছিল।পাল্টে নিও, ”

আরেকটা ম্যাসেজ,
“ভালোবাসি কুসুম।”

অয়ন্তি বেখেয়ালে হাসে। কৌতুহলবশত শার্টটা নাকের কাছে টেনে ঘ্রাণ নেয়। বন্ধুদের প্রেমিককে গল্প বহুত শুনেছে সে। প্রেমিক না হলেও, জীবনে প্রথম কোনো প্রেমিকজাতের পুরষের শার্ট পেয়েছে সে। এটুকু সাধ পূরণ করা যেতেই পারে। ঘ্রাণ নিয়ে অয়ন্তি ভাব নিয়ে বলে,
-মন্দ না, ঘ্রাণটা বেশ। তবে মানুষটা, একদমই ভালো না।
বলেই উচ্চস্বরে হাসলো অয়ন্তি। ভাগ্গিস আরশান এটা শোনেনি। তাহলে এই হাসির অন্য মানে বের করে ফেলতো অদ্ভুত মানুষটা!

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে