#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_চার
দরজার সামনে গিয়ে আরশান দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। অয়ন্তি এদিক সেদিক উঁকি দিয়ে আরশানের দিকে তাকায়।দেওয়ালে হেলান দিলেও দরজার অর্ধেক আরশানের শরীরে বন্ধ হয়ে আছে। বাকি অর্ধেকে উঁচু ল্যাগেজ ভর্তি। ঠেলেঠুলেও তা সরানোর উপায় নেই। ভেতর থেকে তপ্ত বাতাস আসছিল বলে, অয়ন্তি এখানে শীতল বাতাসের মাঝে দাড়িয়ে ছিল কিন্তু জার্নি করায় শরীর ম্যাজম্যাজ করছে। গোসলের প্রয়োজন! সবাই ওকে ফেলে ঢুকে গেল কি করে? আরশানের নির্নিমেষ দৃষ্টি অয়ন্তিকে বরাবরের মত ভীত করে তুলল। ধমক দেওয়া লোকটা ওর দিকে এভাবে তাকায় কেন? তখন মা’রামা’রিই বা করছিল কেন? ভেতরের কথাগুলো স্পষ্ট শোনেনি অয়ন্তি। শোনার প্রয়োজনও নেই, ভেতরে ঢুকতে হবে। এটাই ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। আরশানের দিকে চেয়ে অয়ন্তি অস্ফুটকন্ঠে বলল,
-ভাইয়া একটু সরুন। আমি ভেতরে যাবো।
ভাইয়া ডাক শুনেই আরশানের চেহারার হাসি বিলিন হয়ে গেল। কালো মেঘের আনাগোনা দেখা দিল তাঁর শুভ্র মুখশ্রীতে। মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠলো। আরশান ভ্রু কুঁচকে সরে দাড়াতেই ভেতরে থাকা চারজন শব্দ করে হেসে ওঠে। তাদের হাসির কারন জানেনা অয়ন্তি। তাই চুপচাপ পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। অনা অয়ন্তিকে যে কোনো ঘরে যাওয়ার কথা বলে পাঠিয়ে দেয়। অয়ন্তিও পুরো বাড়িতে চোখ বুলিয়ে দো’তলার একটা ঘরে চলে গেল। মাহিন সকৌতুকে বলল,
-ওহে ভায়া! চিলিক মা’রে, অন্তরে?
আরশানের ঠোঁটের হাসি চওড়া হলো, বন্ধুদের সামনে হেরে যাওয়ার পাত্র নয় সে। নিজের ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে সে ভাব নিয়ে বলল,
-চিলিক মা’রবে কেন? ভাইয়া, ভাই যাই বলুক না কেন! তা থেকে সাইয়্যা, জামাই আমি বানিয়ে নিতে জানি। বয়স নিয়ে টেনশনে ছিলাম, এখন যখন গ্রিন সিগন্যাল পেয়েছি তখন আর থামাথামি কিসের?
অনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল,
-থামাথামি কিসের মানে? তোর মত ই’তর’রে বিশ্বাস করবো আমি! তাই মনে হয়? খবরদার! ওর সঙ্গে কিছু করার কথা মাথাতেও আনবি না।নাহলে তোর বাপের রেডিও সেন্টার আর তোর ব্যাবসার নামে এমন রটনা ছড়াবো যে কাইন্দা কূল পাবা না চাঁন্দু!
সায়ন হেসে বলে,
-তা আর বলতে! জার্নালিস্ট ম্যাডাম কিন্তু মারাত্মক মহিলা হয়ে উঠেছেন আরশান। সাবধানে থাকিস, তাঁর ব্যাগে অলটাইম ক্যামেরা থাকে। সেটা কখন, কোথায় ফিট কইরা দেয়! আমরা তো বিবাহিত, বউ সব দেখে, জেনে নিয়েছে। তাই প্রবলেম নেই। কিন্তু তুই! তোরটা ভাইরাল হইলে তো লাভের ওপর লাভ।
সায়নের কথায় কেউ হাসলো না। সায়ন সিরিয়াস মুখ করে সবার দিকে একনজর তাকিয়ে বলে,
-হাসির কথা কইলেও তোগো হাসি আহে না। যা আমি একাই হাসমু! আরশান মাহিন যখন ই’ত’রামির লিস্টে আসে তখন কিছু হয় না, আর সায়ন কিছু বললেই সে লুচ্চা! যা, থাকুমই না তোগো লগে। সৌফি আসো বেবি আমরা ঘরে যাই, ঠান্ডা পানিতে গাত্র চুবানোর প্রয়োজন।
সায়ন চলে যেতে লাগলে সবাই হেসে দিল।মাহিনও চলে গেল উপরের একটা ঘরে। আরশান সোফায় বসে এখনও কাঁপছে। অনা পাশে বসে আরশানের কাঁধে হাত রাখে।
-জানিস সেদিন তোর কথা শোনার পর তোর ওপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছিল।বারবার ভাবছিলাম আট বছরের এক বাচ্চার প্রেমে পড়েছিস? আর সেই বাচ্চাটা কে? আমার অয়ন। রাগে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছিল আমার। ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখবো না। আমাদের ব্যাচের সবাই মাস্টার্সের পর চাকরি-বাকরি করে, এক একজন যখন বিয়ে করে নিচ্ছিল তখন সায়ন তোর কথা বলল। চার চার’টা বছর কে’টে গেল আরশান, তুই দেশে ফিরিস’নি। আঙ্কেলের সঙ্গে কথা বলে জানলাম তুই নাকি বলেছিস দেশে ফিরবি না।বিয়ের কথা দশবছরের আগে মাথাতেও আনবি না। তখন বুঝলাম তোর এহানো পরিবর্তনের কারন। কিন্তু তুই নিজে একটু হিসেব কর, অয়ন তোর থেকে তেরো বছর দু’মাসের ছোট। পাঁচ-ছয় বছর হয় তাহলে সেটা মানিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু এতটা গ্যাপ? অয়নের মন মস্তিষ্ক এখনও পরিপক্ক হয়নি। সবে ষোলো’তে পা দিয়েছে ও। জীবনের নতুন অধ্যায় সম্পর্কে জানতে শুরু করেছে। আর সেখানে তোর বয়স আটাশ! অয়ন যে একদম বাচ্চা তা নয়, বুঝতে শিখছে, হয়তো বোঝে। কিন্তু ভবিষ্যৎ? তুই ওর জন্য যেভাবে ডেসপারেট হচ্ছিস ও তো তেমন নাও হতে পারে।তোকে ভালোবাসা, তোর ভালোবাসা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার আরশান। তোকে আমি কলেজের প্রথমদিন থেকে চিনি। আমি জানি অয়ন তোর কাছে কতটা ভালো থাকবে। কিন্তু অয়নের কথাটাও ভাব। ও তোকে মানবে না। দেশে চল, তোর বাবা-মা অপেক্ষা করছে তোর জন্য। প্রয়োজন হলে তোর জন্য আমি মেয়ে খুজবো। দরকার পড়লে মাহিনরে ছেড়ে আমি তোরে বিয়ে করে ফেলবো।
মাহিন সিড়ি দিয়ে নামছিল, অনার কথা শুনে সে চকিত দৃষ্টিতে নিচে তাকাল। এরপর ব্যস্তভঙ্গিতে বলল,
-এসব প্লানিং চলছে নাকি? বউ কিন্তু বাসি হইয়্যা গেছে আরশান। ভাইবা কাজ করিস। দেখা গেল রেডিমেড বাচ্চা পাচ্ছিস! নিজের বংশের বাত্তি নিভাইয়া আমার বাত্তি লইয়া টানাটানি ভালা না, বুঝলা মামা।
অনা চোখ রাঙালো। মাহিন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে অনার পাশে শুয়ে অনার কোলে মাথা রাখলো। অনা মাহিনের চুল টেনে দিতে দিতে বলে,
-অয়নকে ভুলে যা আরশান। মুভ অন কর লাইফে। এভাবে আর কতদিন চলবে? আট বছর আগে তোর প্রেমের বয়স পার হচ্ছিল, এখন কি বিয়ের বয়স থেমে আছে? তোর ফ্যামিলি, তুই, তোদের রেপুটেশন এতো ভালো। যেকোনো মেয়ের বাবা তোকে তার মেয়ে দিতে প্রস্তুত। বাস্তবতায় চোখ না বুলিয়ে তুই মরিচিকার পেছনে কেন ছুটছিস? অয়নকে এখানে এনেছি শুধুমাত্র তোকে দেখাবো বলে। অয়ন নিজের জীবনে খুশি, তোকে সে মনেও রাখেনি। তাহলে তুই কেন ওকে ভালোবেসে কষ্ট পাবি? আমি তোকেও সমান ভালোবাসি আরশান তাই বলছি নিজের জীবন নষ্ট করিস না। আঙ্কেল বলছিলেন অরুনির সঙ্গে তোকে ভালো মানাবে।
আরশান মাথা নিচু করে সবটা শুনছিল। এবার মাথা তুলে তাকাল সে। এরপর কঠিন গলায় বলল,
-তোর চাচাতো বোন অরুনি? তোরা কি আমাকে সস্তা প্রডাক্ট পেয়েছিস অনা? যার তার ঘাড়ে গছিয়ে দিতে চাচ্ছিস। আরশান খাঁন এতটাও সস্তা না।কুসুম আমাকে ভালোবাসবে কি বাসবে না, তা জানি না। কিন্তু আরশান কুসুমকে ছাড়া আর কাউকে চায় না। কুসুম আমার না হোক, অন্যকারো হবে। আমি শুধু চাইবো ও যার’ই হোক, যার কাছেই থাকুক, ভালো থাকুক। সুখে থাকুক। কিন্তু আমি ওকে ছাড়া অন্য কোনো নারীকে বিয়ে করবো না। ভালোবাসতে পারবো না। ও ছাড়া আমি কাউকে চিন্তাতেও রাখতে পারি না অনা। ট্রাস্ট মি! আমার জন্য তোদের কারোর কোনো সমস্যা হবে না। তুই বাবাকে নিয়ে ভাবছিস তাই না? বাবা সত্যটা জানলে তোদের ভুল বুঝবে, কষ্ট পাবে সেটা নিয়ে ভাবছিস? আমি কাউকে বলবো না সত্যটা। শুধু তোরা চারজনই জানবি।তবুও আমার ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করিস না। আমি কোনো বিয়ে-টিয়ে করতে পারবো না। আর রইল বাকি বংশরক্ষা। আরসালান ভাই তো বিয়ে করেছেন। দুটো ছেলেও আছে। ভাবি আবারও সন্তানসম্ভবা, মেয়ে হবে এবার। ব্যাস হয়ে গেল প্রবলেম সল্ভড।
-তার মানে তুই অয়নকে ছাড়বি না?
-না।
মাহিন হাই তুলে বলল,
-বাচ্চা বড় হতে দে। তারপর দেখ ওর মতামত কি হয়। দেন বিয়ের চিন্তা করিস। বাট আমার একটা ডাউব্ট থেকে যাচ্ছে। অয়ন বড় হতে হতে তুই বুড়ো হয়ে যাবি তখন তোর টাওয়ারে কারেন্ট থাকবে তো?
আরশান হতভম্ব চোখে চাইল। অনা মাহিনের চুলগুলো মুঠো করে জোরে টান দিতেই মাহিন ‘আহ’ করে উঠল। শব্দটা শুনে সায়ন সৌফি বেরিয়ে আসে। সায়ন কপালে ভাঁজ ফেলে বলে,
-দিনে দুপুরে কিসব সাউন্ড করছিস ভাই! বাড়িতে যে দুইখান সিঙ্গেল পোলাপান থুরি একটা কচি মাইয়া আর একটা বুড়ো ভাম আছে সেদিকে নজর দিবি না?আমরা তো ঠান্ডা থাকুম ওরা কি করবে?
অনা পাশ থেকে কুশন তুলে ছুড়ে মারল সায়নের মুখে। এরপর কয়েকটা আঞ্চলিক গালি দিয়ে বলল,
-অয়নকে আনাই ভুল হইছে। তোদের মত অশ্লীল, অসভ্য, বেয়াদবগুলো আমার ছোটবোনটার কি হাল করবি তা বোঝা হয়ে গেছে। তাই আমি একটা কথা ক্লিয়ারলি বলতে চাই।
আরশানের দিকে ফিরলো অনা।
-অয়নকে পেতে হলে ওকে এসব অশ্লীলতা থেকে দূরে রাখতে হবে আরশান। আমাকে কথা দিতে হবে বিয়ের আগে অয়নের সঙ্গে কোনো কিছু করবি না। নট এ্যা সিঙ্গেল লাভ টাচ! এমন কি ওকে টেরও পেতে দিবি না তুই ওর ওপর এট্রাক্টেড।ও যদি স্বেচ্ছায় তোকে চায়, বাড়িতে কারোর কোনো আপত্তি থাকবে না। বাবার সঙ্গে কথা বলেই এসেছি আমি। অয়ন যা চাইবে তাই হবে, সেজন্য সবার বিশ্বাস রক্ষা করার দায়িত্ব তোর। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম তুই ওকে কতটা চাস্। জানা হয়ে গেছে এবার মাহিন্না ও সায়ন্নার কি করবি তা তুই জানিস। মাথায় রাখিস আমার বোন যেন অকালে না পাঁকে। হুহ!
অনা গোসলের উদ্দেশ্যে উঠতেই, আরশান জামার হাতা ভাজ করতে লাগল। মাহিন, সায়ন হাসার চেষ্টা করে বলে,
-তোর জিগারের দোস্ত লাগি আমরা। আমাদের মা’রতে পারবি না তুই। তোর হাত কাঁপবে দোস্ত, তুই মনে মনে কষ্ট পাবি। আমরা জানি।
আরশান ভ্রু কুঁচকে বলে,
-রিয়েলি? তো আমারও জানা উচিত। আমি মনে মনে কতটা কষ্ট পাই! তোরা সবগুলো মজা নিছিস আমার প্যারা দেখে। এবার আমার পালা।
অয়ন্তি জানালার পাশে দাড়িয়ে আরশানদের হাতাহাতি দেখছে। অয়ন্তির আরশানকে মনে নেই। মনে থাকার কথাও না। যখন আরশান ওদের বাড়িতে গিয়েছিল তখন অয়ন্তির বয়স সার্টিফিকেট অনুযায়ী ছয় বছর এগারো মাস চলছিল। হাতে গোনা কয়েকটা দিন পরেই সাত বছরে পড়বে এবং বাস্তবিক বয়স আটে পড়বে। আর আরশান সবে একুশে পা দিয়েছিল। সেই হিসেবে স্মৃতিশক্তি প্রখর হলেও অয়ন্তির স্মৃতিতে আরশান নাম স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। অনার অনেক বন্ধুই তো বাড়িতে এসেছে।সবার নাম মনে রাখার মত ইচ্ছে অয়ন্তির তখন জাগেনি। আর সবার নাম মুখস্থ করাও অসম্ভব ব্যাপার ছিল। আজও তো আরশানকে চিনতো না সে, যদি না অনা আসার আগে জানাতো। প্রথম আলাপ থেকেই আরশান অয়ন্তির অপছন্দের তালিকায় যুক্ত হলো। ছোটবেলার ধমকের গল্প, এখন মা’রামা’রি! অয়ন্তি তো ভয় পায় এসব। আর যা ভয় পাওয়া হয় তার সঙ্গে সহজ হওয়া কঠিন বিষয়। অয়ন্তি বিছানার ওপর বসে ভাবতে থাকে, এত বন্ধু থাকতে অনা’রা দেশ পাড়ি দিয়ে এই বাজে বন্ধুর কাছে কেন এসেছে? যে মানুষ কথায় কথায় ঝারি দেয়, কেমন মাদকতায় পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অপ্রস্তুত করে দেয় সে আসলেই একটা বাজে লোক। ভালো মানুষ কি এভাবে তাকায়? ব’খা’টেদের মত দৃষ্টি দেয়? একদমই না। কিন্তু তবুও অয়ন্তির চোখ বারংবার আরশানের ওপর গিয়ে আটকাচ্ছে। অনার সব বন্ধুদের থেকে আরশান দেখতে শুনতে ভালো। শুভ্র চেহারা, পেশিবহুল দেহ, উচ্চতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিবার, আর তাঁর চোখ। নীল চোখ এই প্রথম দেখেছে অয়ন্তি। পুরো বিদেশিদের মত চোখ আরশানের। আচ্ছা আরশান কি বিদেশি? বাজে মানুষটার প্রতি অয়ন্তির মনোভাব কি বদলাচ্ছে?কিছুসময় পূর্বে ভয়ে ভয়ে যাকে বাজে বলল, তাঁর কথাই এখন ভাবছে সে।কেন ভাবছে? অয়ন্তি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে মন খারাপ করে বসে রইল খাটের কোনায়। আরশান নামক জটিল ধাঁধাটা সমাধান না করা পর্যন্ত, স্বস্তি পাবে না সে। আরশানের দৃষ্টি, ব্যবহার, আর এমন স্বভাবের কারন কি? সেটা জেনেই ছাড়বে অয়ন্তি। জীবনে প্রথম কোনো ছেলের ব্যাপারে জানতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছেটাকে পূরণ করা অতি আবশ্যক। তাছাড়া আরশান তো বাইরের কেউ না, অয়ন্তির অনাপির বেস্টফ্রেন্ড। তাই সমস্যা হলে তা সামলানোর জন্য অনা তো আছেই।
চলবে?