তুই হবি শুধু আমার পর্ব-০২+০৩

0
2178

#তুই হবি শুধু আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_দুই_তিন

‘স্লাং ইউজ করলাম না’ বাক্যটি প্রায় দশবার পড়েছে অয়ন্তি। রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে। সারাদিন ধরে যা যা বলেছা সেগুলো কি মধুর কথা ছিল? মধু দিয়ে সব ভেজানো ছিল? লিভ ইন টাইপ কথা কি মধুর সাগর ছিল? অয়ন্তির পাশেই ওর বোন অরুনি সবটা পড়ছে আর অয়ন্তির দিকে তাকাচ্ছে। অয়ন্তির হাতে রাবারের তৈরি একটা গোলাপী বল,সেটা অয়ন্তি চেপে চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। অরুনি বোনের ক্রোধ দেখে বিস্মিত হয়ে বলে,
-বাদ দে অয়ন্তি!

অয়ন্তি পাশে অরুনির দিকে ফিরে বলে,
-বাদ দেবো? কতকিছু সহ্য করেছি! শুধু বিয়েটা ভাঙবে বলে। আমাকে বলে আমি অত্যন্ত বাজে প্রকৃতির মেয়ে। সেই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য দু পায়ে খাড়া কেন ওই লোক?আবার ম্যাসেজে পিরিতির কথা লিখছে। সামনে পেলে ওনাকে আমি পানি ছাড়া গিলে ফেলবো অরুপি। ট্রাস্ট মি! যাস্ট গিলে ফেলবো।

অরুনি ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এটা বাদে আগের আটটা বিয়ে ভেঙেছে অয়ন্তি! তারা সবাই বেশ বড়লোক এবং প্রভাবশালী ছিল। সেখানে আরশান শুধু বিখ্যাত মানুষ। টাকা পয়সা কেমন তা জানা নেই ওদের। তবে মানুষ হিসেবে নাকি সে সেরা একজন। সেই সেরা একজনের নমুনা এমন? অরুনির কোলে ওর বছর তিনেকের মিষ্টি বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। অরুনি হতাশ কন্ঠে বলে,

-বিয়ে করতে কি সমস্যা অয়ন? সে তো ভালো মানুষ। তোকে ভালোওবাসে।

-ভালোবাসে?ভালোবাসতে কি আমি বলেছি?অয়ন্তিকে ভালোবাসবে এটা তাঁর নিজস্ব অভিলাষ। আমি সেটা নিয়ে কিছু বলবো না। কিন্তু এভাবে? প্রাপ্তকে কিভাবে মে’রেছে তা তুমি জানো না অরুপি। প্রাপ্তর বন্ধু দিশান ফোন করেছিল। ছেলেটা নাকি ছমাসের আগে বিছানা থেকেই উঠতে পারব না। এটা কোনো মানুষের কাজ?

-চাচা,বাবা’র বিরুদ্ধে যাবি?

– এমন একটা মানুষকে আমি বিয়ে করতে পারবো না। যদি তার জন্য বাবার সঙ্গে কথা বলতে হয়, তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু বলতে হয় বলবো আমি।

-আরশানকে তুই ওসব কেন বলতে গেলি? বাচ্চা না হওয়ার ব্যাপারটা শুনে হয়তো সে সত্যিই রেগে গিয়ে বলেছে ওসব।

-নুমা বলেছিল, এটা বলামাত্র বিয়ে ভা’ঙবে। ও নিজেও তো ওর প্রথম বিয়েটা এভাবে ভে’ঙেছিল।পরে নিজের প্রেমিককে বিয়ে করে।

-নুমার কথা শুনে তুই এত বড় একটা কাজ করে আসলি? তোর কোনো ধারনা আছে আরশান যদি এটা বাড়িতে বলে? তখন কি করবি?

-তুমি কি আমাকে আরও মানসিক চাপে ফেলতে চাচ্ছো অরুপি? ভালো কিছু বলো, ভালো কথা বলো! আমার রাগ হচ্ছে।

-ওকে। রেডিও অন কর। বারো’টা বাজতে গেল। তোর সেই আর’জের শো শুরু হবে।

অয়ন্তি এবার শান্ত হলো। অয়ন্তি হচ্ছে মীর্জা বাড়ির ছোট মেয়ে। পুরো নাম জেসমিন মীর্জা অয়ন্তি। এবার সে উচ্চমাধ্যমিকের ডিঙ্গি টপকিয়েছে। রেজাল্ট বের হবে কিছুদিন পরেই। ওর ইচ্ছে ও জার্নালিজমে পড়বে। তবে বাড়ি থেকে কেউ রাজি নয়।কিন্তু অয়ন্তি নিজের জেদে অটল থাকায়, অয়ন্তির জেদের সামনে বাড়ির কেউ আর দ্বিমত পোষণ করেনি। অয়ন্তি চায় মুক্ত পাখির মত জীবন। যেখানে সে শুধু উড়তে পারবে। যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে, কোথাও কোনো বাঁধা থাকবে না। কোথাও আটকে থাকার মত পরিস্থিতি তৈরি হবে না। নিজের বোনের প্রতিটা ইচ্ছে সে নিজে পূরণ করবে। অনামিকা যেমন তুখোড় জার্নালিস্ট ছিল অয়ন্তিও ঠিক তেমন হতে চায়।
এমন মুক্ত একটা জীবনে আবারও ঝড় বইয়ে আরশান নামক বিশ্রি তুফানকে আসতে হলো? এভাবে ওর স্বপ্নগুলো লন্ডভন্ড করতে তাঁর আগমন কি সত্যিই কাম্য ছিল? না। একদমই নয়। প্রাপ্ত জার্নালিজমে পড়ছে, ফোর্থ সেমিস্টার কমপ্লিট! কলেজেই ওদের প্রথম আলাপ আর তারপরেই বন্ধুত্ব। মূলত পেশার প্রেমে পড়ার পরই অয়ন্তি প্রাপ্তর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিল।প্রাপ্ত বলেছিল অয়ন্তিকে সে সাহায্য করবে যেন জার্নালিজমে পড়ে সে নির্বিঘ্নে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে পারে। প্রাপ্তর সঙ্গে সদ্য প্রেমের ডানা মেলতে গিয়েছিল অয়ন্তি আর সেই প্রাপ্তকে,অয়ন্তির বন্ধুকে এক বে’য়াদব আর’জে মে’রে ফাটিয়ে দিল?

অয়ন্তি পাশ থেকে ডিজিটাল রেডিওটা অন করলো। সঙ্গে সঙ্গে এক সুস্পষ্ট কন্ঠস্বর ভেসে আসলো ওদের কানে।
“আসসালামু আলাইকুম! হ্যালো ডিয়ার লিসেনার! আপনারা শুনছেন ভালোবাসার রংমহল এবং আমি আর’জে রোজ আছি আপনাদের সঙ্গে। কেমন আছেন সবাই? নিশ্চই ভালো। আজকের এই মিষ্টি মধুর আবহাওয়ায় খারাপ থাকার কোনো কারন হয়তো নেই। তবুও যারা দুঃখি, যাদের মনে দুঃখ আছে, রাগ আছে, অভিমান আছে তারা তাদের এই দুঃখ কষ্ট আমার সঙ্গে শেয়ার করার জন্য কল করতে পারেন, *** এই নাম্বারে। আর যাদের মন ভালো আছে, বৃষ্টির আমেজে ফুরফুরে থাকা এবং তাদের ভালোলাগাও শেয়ার করতে পারেন। আজ আমরা কথা বলবো বৃষ্টি ও প্রকৃতি নিয়ে। সবাই বলে, বর্ষণ প্রেমের জন্য উপযুক্ত সময়! রোম্যান্টিক ওয়েদার! তাই বর্ষণপ্রেমিকদের জন্য শুরুতেই একটা মিষ্টি গান!
রিমঝিম এ ধারাতে, চায় মন হারাতে।
রিমঝিম এ ধারাতে, চায় মন হারাতে।
এই ভালোবাসাতে আমাকে ভাসাতে।
এলো মেঘ যে ঘিরে এলো
বৃষ্টি সুরে সুরে সোনায় রাগিনী।
মনে স্বপ্ন এলোমেলো
এই কি শুরু হলো প্রেমের কাহিনী।

গানের মতই আজ আমরা শুনত চলেছি কিছু প্রেমিক, না বর্ষণপ্রেমিকদের প্রেমের কাহিনি। আর আজ আমার সঙ্গে অতিথি হিসেবে আছেন আমাদেরই পরিচিত এক প্রতিভাবান কম্পোজার ও সিঙ্গার রোয়েন তালুকদার। ভাইয়া তো থাকবেনই, আমাদের আড্ডাও চলবে। তার আগে আমি শ্রোতাদের কিছু কল এ্যাটেন্ড করে নিচ্ছি। আমাদের আজকের ফার্স্ট কলার, (ফোন রিসিভ হতেই) হ্যাঁ, বলুন!
– হ্যালো, হ্যালো আমার আজ ব্রেক আপ হয়ে গেছে।

অকস্মাৎ বাক্যে হকচকালো সবাই কিন্তু রোজ নিজের মধুরহাসি বজায় রেখে বলে,
-জি! আপনার নাম বলে, আপনি যেটা বলতে চান সেটা বলুন।

-আকরাম! আপনি বললেন বর্ষণ প্রেমের জন্য উপযুক্ত কিন্তু এই বর্ষণ আমার প্রেমিকা কেড়ে নিল। কিছুক্ষণ আগে যখন ঝড়ে সারা দুনিয়ে কাঁপছিল তখন আমার প্রেমিকা আচার, আর মোড়ের হোটেলের বিরিয়ানি খেতে চাইলো।এনে দেইনি বলে রাগ দেখালো, তারপরই এক কথায় দু কথায় ব্রেকআপ! মেয়েদের স্বভাব এমন কেন? এটা জানতে চাই!

রোজ হাসতে হাসতে বলে,
-আপনার প্রেমিকা নিশ্চই এইট নাইনে পড়ে! কারন কোনো প্রাপ্ত বয়স্ক নারী এমন বাচ্চাসূলভ আবদার এই রাতে ঝড়ের মধ্যে করবে না। টেনে উঠলেই কমবেশি সকল নারীর মন পরিপক্ক হতে শুরু করে। তারা কখনও এমন আবদার করতেই পারে না। আর যদিও বা করে তবে সেটা পরিস্থিতি দেখে। বাচ্চাদের সঙ্গে প্রেম করলে তাদের বাচ্চামি সহ্য করার ক্ষমতা রেখেই করতে হবে প্রিয় ভাই। তাই এই পরিস্থিতির জন্য বর্ষণকে দোষ্ দিলে চলবে না।

পরবর্তী কলার,
-আপু আমার নাম ইলোরা, আমি নারায়ণগঞ্জে থাকি। আপনার কথাগুলো আমার অনেক ভালো লাগে। যদি কখনও নারায়ণগঞ্জে আসেন তাহলে রেডিওতে জানিয়ে দেবেন প্লিজ। আমি আর আমার বন্ধুরা দেখা করতে চাই আপনার সঙ্গে।

-ধন্যবাদ ইলোরা! নারায়ণগঞ্জ গেলে অবশ্যই জানাবো।

পরবর্তী কলার,
-হ্যালো! আমি পরিচয় দিতে পারবো না। আমি একটা কথা জানাতে চাই।

-জি! বলুন। সমস্যা হলে পরিচয় গোপন রাখতে পারবেন।

-আমার বিয়ে হয়েছে তিনবছর আগে। এমনই এক বৃষ্টি মুখর দিনে আমি আমার স্বামীকে আমি আপন করে পেয়েছিলাম। সৌভাগ্যবশত ভাবে আজ আমাদের বিয়ের তিনবছর পূর্ণ হয়েছে এবং আজও সেদিনের মত বৃষ্টিতে ধরণী ভিজে আছে। সেই সঙ্গে ভিজছে আমার নয়ন। বিয়ের সময় থেকে আজ অবধি আমি আমার শশুড়বাড়িতে কখনও উঁচু গলায় কথা বলিনি। কারোর সঙ্গে কোনো ঝামেলা করিনি। তবুও তারা আমাকে মেনে নিতে পারেন না। কারন আমরা গরীব। অথচ বিয়ের সময় আমার শাশুড়ি আমাকে বলেছিলেন তিনি আমার শাশুড়ি নন, বরং আপন মা। তাঁর মেয়ে এবং আমি সমান। সারাদিন বাড়ির সমস্ত কাজ আমাকে দিয়ে করান, অথচ তার পরিবর্তে সামান্যটুকু স্নেহ বা আদর আমার প্রাপ্য নয় এমন ব্যাবহার উপহার দেন। ননদ আমার রায়বাঘিনী! চুন থেকে পান খসলেই আমার বাবার বাড়ি নিয়ে কথা শোনায়। আবার যখন আমার স্বামী সামনে থাকে তখন ভালো ব্যবহার করে। আমার স্বামীকে যদি আমি এসব বলি উনি বিশ্বাস করবেন না। কারন তারা ওনার সামনে ভালো ব্যবহার করে। এই মানসিক চাপ আমি সহ্য করতে পারছি না। কি করবো বুঝতে পারছি না। ছয়মাস হয়েছে আমি জানতে পেরেছি আমি সন্তানসম্ভবা। বাচ্চার পুষ্টির জন্য যে আলাদা যত্ন পাবো তারও জো নেই। শাশুড়ি বলেই দিয়েছেন তাঁর নাতি চাই। নাতি না হলে তাঁর চলবে না। স্বামীর ভালোবাসা যেটুকু পাচ্ছি, তাদের অনাদর তার থেকেও দ্বিগুণ। প্রথম প্রথম বেশ ভালোবাসা দেখিয়েছিল। পরে যখন জানলেন মেয়ে হবে তখন সেই ভালোবাসার রেশটুকুও টিকলো না। আমার স্বামী কাজের জন্য বাইরে থাকেন। মাসে এক-দু বার আসেন। তখন মানসিক শক্তি পাই আমি। কিন্তু বাকি দিনগুলো! এ কথাগুলো আমি কাউকে জানাতে পারিনা। আমি বলছি না এসব মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তির কারন বলতে। শুধু মনের কথাগুলো জানালাম, তুমিই একদিন বলেছিলে মনের কষ্ট ভাগ করে নিলে কমে যায়। আজ তোমাকে সবটা বলতে পেরে হালকা লাগছে। ভালো থেকো, তুমি খুব ভালো মেয়ে রোজ। আর দোয়া করো আমার মেয়েটাও যেন তোমার মত হয়।

কল কে’টে গেল। রোজের হাসি ক্ষণিকের জন্য থামল। পরক্ষণেই পূর্বের ন্যায় হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,
-একটা মেয়ে দুটি পরিবারের প্রদীপ হয়। তারা নিজেরা জ্বলে ঠিক কিন্তু আলো ছড়াতে কার্পণ্য করে না।
আপনার কথা শুনে প্রথমে ভেবেছিলাম বর্তমান যুগে আদৌও এমন ঘটনা এখন ঘটে? কিন্তু আপনার কন্ঠের কম্পন বলে দিল ‘হ্যাঁ’। চিন্তা করবেন না আপু, আপনার স্বামী যেহেতু আপনাকে ভালোবাসে, আর আপনার শাশুড়ির যেহেতু মেয়ে আছে। তাই তারা উভয়েই আপনার সন্তানের মর্ম বুঝবেন। হয়তো আপনাকে তারা পছন্দ করেন না, কিন্তু আপনার গর্ভে বেড়ে ওঠা সন্তান তাদের রক্ত! কোনো দাদী নিজের নাতি-নাতনিকে দূরে রাখতে পারেনা। আর রইল বাকি আপনার প্রতি তাদের উদাসিনতা। আপনার ব্যবহারেই, আপনার গুনেই আপনি তাদের মন জয় করতে পারবেন। বিধাতা, স্বামী এবং নিজের ওপর ভরসা রাখুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।
এবার আমার এই অনুষ্ঠান যারা শুনছেন শিশু থেকে বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবাইকে, বিশেষ করে নারীদের উদ্দেশ্যে যারা শাশুড়ি হয়েছেন, যারা হননি, যারা বউ হয়েছেন, যারা হননি। তাদের জন্য বলছি বিয়ের পর শাশুড়ি যেমন মায়ের হক নিয়ে আসেন বউমাও কিন্তু মেয়ে হয়েই আসে। মা হতে গেলে আগে বউমাকে মেয়ে বলে স্বীকার করতে হয়। আমি শাশুড়িমায়েদের দোষ্ দিচ্ছি না। অবশ্যই বউমা’কে আগে শাশুড়িকে মা ভাবতে হবে, মায়ের নজরে দেখতে হবে, নিজের মায়ের স্থান দিতে হবে।তারপর তারা সেই মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার অধিকার পাবে তার আগে নয়। আর যারা শাশুড়িকে মা ভাবেন, মা মানেন মায়ের মত ভালোবাসেন তারা কখনই নিজের মায়ের নামে অভিযোগ করতে পারবে না। তাই সকল শাশুড়িমা চেষ্টা করবেন পুত্রবধুকে নিজের মেয়ের সমান ভালোবাসার। দোষেগুণে পূর্ণ মানুষ ভুল করবে, তাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দিয়ে তাদের ভুল শোধরানোর চেষ্টা করবেন। গরীব ঘরের মেয়ে যদি পছন্দ না হয় তাহলে বাড়িতে না আনাই ভালো। কারন একটা মেয়ে নিজের পরিবার ও প্রিয়জন ছেড়ে আপনাদের বিশ্বাস করে, আপনাদের ভালোবেসে নতুন সংসারে আসে। সেখানে সে তার নিজের পরিবারের তুল্য ভালোবাসা আশা না করলেও কিছু পরিমান ভালোবাসা আশা করবেই। সেটুকু তাঁর অভিলাষ নয় বরং অধিকার। কোনো মেয়েকে তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। বাকিটা যার যার নিজস্ব মনোভাব। আমি কারোর ব্যক্তিগত মনোভাবে হস্তান্তর করতে চাইনা, কারন সেই মহা-মূল্যবান অধিকার আমার নেই।

তাই সংসার জীবনের কলহ থেকে বেরিয়ে আমরা আবারও এই সুন্দর প্রকৃতির রূপে ডুব দিতে চাই। আর তার আগে আপনারা শুনুন রোয়েন ভাইয়ার গলায় মিষ্টি এ’গানটি।

আকাশে রিমঝিম বাদল জমেছে
তোমাকে পাবার মাদল বেজেছে,
কিছু তো শোনা যায় না
তোমাকে ছাড়া।
প্রকৃতি নতুন সাজে সেজেছে
তোমার আমার দেখা হয়েছে,
কিছু তো ভেবে পাই না
মন যে আর মানে না।

স্পিকারের সামনে থেকে মুখ সরিয়ে চেয়ারে মাথা লাগিয়ে বসল রোজ। গুমোটভাব’টা এখনও কাটেনি। বর্ষণের ফলে শীতলভাব নেমেছে মেদিনীতে কিন্তু তার সেই শীতলতা রোজের শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে না। শরীরের তাপমাত্রা গাণিতিক হারে বাড়ছে। আজকের শো’টা বাদ দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ওর পরিবর্তে কেউ এই শো করতে না চাওয়ায় বাধ্য হয়ে রোজকেই থাকতে হলো।রোয়েনের গান শেষ হতেই রোজ আবারও নিজের কায়দায় অনুষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ঠিক তখন আরও একটা কল আসে,

-হ্যালো! আমি প্রিয়া!

-জি বলুন প্রিয়া!

-আমার প্রেমের ব্যর্থ কাহিনি শোনাতে চাই আমি। আজ আমার সঙ্গে আমার বাড়ি থেকে ঠিক করা ছেলেটার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছে। তাকে আমি ঠিক করে চিনিও না। তাকে বিয়েও করতে চাইনা। একথা তাকে জানানোর পরেও সে আঠার মত আমার পেছনে লেগে আছে। আমার বয়ফ্রেন্ডকে মে’রে হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। যেকোনো মূল্যে সে আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি এটা কিভাবে আটকা…

তখনই ফোন কেটে গেল। অয়ন্তি নিজের ফোনের দিকে তাকাল। আরশান বারবার ফোন দিচ্ছে বলে ভুল করে ফোন কে’টে গেল। অয়ন্তি আরশানের ফোন কে’টে রেডিও সেন্টারে ফোন করার চেষ্টা করল কিন্তু ফলাফল শূণ্য। রোজ বাকিটা শুনতে না পেয়ে ‘দুঃখিত’বলে বাকি কল এ্যাটেন্ড করছে। কি জ্বালা! বিরক্ত হয়ে অয়ন্তি ফোন রিসিভ করেই দিল ঝারি,

-কি সমস্যা?

-তুমি আর’জে রোজের কাছে আমাদের সম্পর্কের পুরো কাহিনি বলছ? বলতে চাইলে আলাদা করে বলতেই পারো। তাই বলে লাইভে, ফোন করে বলছ? আর ই্যয়ু এ্যান ইনশেইন?

-আমি পাগল? পাগল তো আপনি? শুধু পাগল না ইতর বেয়াদবও। প্রাপ্তকে মে’রে কি পেয়েছেন? কি ভেবেছেন এসব করলে আমি সুড়সুড় করে আপনাকে বিয়ে করে আপনার সংসার করব?

-এসব তোমাকে দেখানোর জন্য করিনি কুসুম। আমার নিজের মনের খোরাক মেটাতে করেছি। তোমার পেছনে কেউ ঘুরলে, তোমার দিকে বাজে নজরে তাকালেও তাকে শাস্তি পেতে হবে। কাউকে ছাড় দেবো না আমি। আর তুমি সুড়সুড় করে আমাকে বিয়েও করবে আমার বাচ্চাও পালবে। সে ব্যবস্থাও আরশান করে রেখেছে।

-পালবো না, কিচ্ছু পারবো না। পারলে এসব করে দেখান। আমিও দেখতে চাই আপনি কতটা খারাপ!

-এভাবে চ্যালেঞ্জ দিও না মাই লাভ। আরশান খাঁনের ডিকশোনারিতে ‘ডিফেট’ বলে কোনো শব্দ নেই। বিয়ে তুমি আমাকেই করবে। আর কাউকে না, কারন অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করার মত অবস্থায় আমি তোমায় রাখবো না। প্রাপ্ত’র কেস’টা তার ডেমো মাত্র। আমি তার থেকেও ডেঞ্জারাস। তাই বাড়ি থেকে পালানো, আমার থেকে পালানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেরে ফেলে বিয়ের যাবতীয় স্বপ্ন মাথায় ঢোকাও। আর সেগুলোই চিন্তাতে রাখো, অবশ্যই চিন্তার কেন্দ্রবিন্দুতে আরশান থাকবে।

-সকালের ওমন ব্যবহারের পর আপনি ভাবলেন কি করে আমি আপনাকে নিয়ে চিন্তা করবো? আর কুসুম কি?আমার নাম অয়ন্তি, কুসুম মীর্জা কাকে বলেছেন? সকালে কিছু বলিনি বলে এখনও বলবো না? ফারদার বিরক্ত করতে আসবেন না আমাকে। অসভ্য লোক।

-অসভ্য? এর মানে কি তা আদৌ জানো? নিশ্চই জানো না। তাই তোমার কোমল সহৃদয়বান হবু স্বামী তোমাকে এই শব্দের অর্থ জানাতে তোমার বাড়ির সামনে উপস্থিত হয়েছে। পাঁচ মিনিট সময় দিলাম। নিচে নামো নাহলে সকালে তুমি তোমার মাতৃত্ব নিয়ে যেসব বলেছ তা তোমার বাড়িতে বলতে বাধ্য হবো।

ফোনটা রেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো আরশান। অয়ন্তি যে আসবে এব্যাপারে নিশ্চিত আরশান। কারন কুসুমের হৃদয় অতি কোমল! কুসুমের বাইরের আবরণ সে শক্ত দেখানোর চেষ্টা করলেও আরশান জানে কুসুমের ভেতরটা এখনও নরম! সে নিজেকে বুদ্ধিমতি, রাগি, তেজি প্রকাশ করতে চায়। কিন্তু আসলে তাঁর কুসুম অভিমানি, বোকা ও ভীতু।একটুতে কেঁদে ফেলা মেয়েটা জার্নালিজমে ভর্তি হয়ে কি করতে চায়? শুধু বোকামি? নাকি বোনের মত মৃ’ত্যু? আরশানের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে আসলো। কুসুমকে সে হারাতে পারবে না। অনাকে যেভাবে হা’রিয়েছে সেভাবে তো একদমই না। অয়ন্তি ঠিক চার মিনিটের মাথায় গেটের কাছে এসে হাজির। ছাতাতেও বৃষ্টির ঝাপটা মানাচ্ছে না। অয়ন্তির একপাশ পুরো ভিজে গেছে। শরীরের সঙ্গে গোলাপী রঙয়ের জামাটা একদম মিশে গেছে। পাতলা কাপড়ের ওপর থেকে বোঝা যাচ্ছে অয়ন্তির শরীর। আরশান এক নজর তাকিয়ে অন্যপাশে ফিরে জোরে জোরে শ্বাস নিল। কিন্তু বেহায়া চোখজোড়া তাঁর এই নিয়ন্ত্রণ শুনলো না। আবারও দৃষ্টিপাত নিক্ষেপ করল অয়ন্তির পানে। অয়ন্তির ডান গালে বিন্দু বিন্দু পানির ফোটা লেগে আছে। আরশান নড়েচড়ে বসে। অয়ন্তিকে বলতে বলতে সে নিজেই না আজ ভুলেভালেই ভুল করে বসে। অয়ন্তি গাড়ির সামনে আসতেই আরশান দরজা খুলে একটানে অয়ন্তিকে গাড়ির ভেতর নিয়ে আসলো। টান দেওয়ার গতি এত বেশি ছিল যে অয়ন্তি ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছে। দরজা খোলার সময় আরশান কিছু একটা বলেছিল,কিন্তু ঝড়ের ঝাপটার সঙ্গে মেঘের তীব্র গর্জনে সেটা শোনা গেল না। কি বলেছিল আরশান?

চলবে?

[এটা আমার লেখা প্রথম ধারাবাহিক গল্প। তাই আমিও জানি ভুলত্রুটি থাকবে। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, তাই সেই ভুলগুলো গঠনমূলক মন্তব্যের মাধ্যমে ধরিয়ে দিলে খুশি হতাম।

বেতার বিষয়ক গল্পটা বোরিং লাগতে পারে আপনাদের কাছে। কিন্তু ওটা আমার পরিচিত একজনেরই জীবনে ঘটেছে তাই মনে পড়ায় লিখে দিলাম। রোজ মেয়েটির বিশেষ ও গুরুত্বপূৃৃর্ণ ভূমিকা থাকবে গল্পটিতে তাই তাকে হাইলাইট করতে পর্বটি বড় করা হয়েছে। প্রথম পর্ব থেকেই সে পরোক্ষভাবে গল্পের সঙ্গে সংযুক্ত।

আরশানের চরিত্র মানে একেক সময় একেক রকম নিয়ে আপত্তি যাদের তাদের বলছি, চরিত্রটিই এমন। আর কুসুম নামটি আরশান জেসমিনের পরিবর্তে ডাকে। প্রথম পর্বে কুসুম থাকলেও এখন অয়ন্তি থাকবে।

আমার যেকোনো ভুল ভদ্রতার সঙ্গে ধরিয়ে দেবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ!❤️❤️]

#তুই_হবি_শুধু_আমার
#সাইরাহ্_সীরাত
#পর্ব_তিন

অয়ন্তির ঘাড়ে আরশানের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়তেই শিউরে উঠল অয়ন্তি। মৃদু কম্পনে কেঁপে উঠল ওর সর্বাঙ্গ। অচেতন অবস্থায় থাকা অয়ন্তিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে আরশান। কিছু সময় পূর্বে, অয়ন্তি ভিজে যাচ্ছে দেখে আরশান ওকে টেনে গাড়ির ভেতর বসাতেই ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে অয়ন্তি। আরশান প্রথমে ভড়কালেও পরক্ষণেই আলতো হেসে অয়ন্তির মাথা নিজের কোলের ওপর রেখে ব্যাকসীট থেকে তোয়ালে এনে অয়ন্তির মাথার চুলগুলো সযত্নে মুছে দিল। বৃষ্টিতে ভেজার সম্ভাবনা ছিল বলে, আরশান তোয়ালেসহ এক্সট্রা জামা-কাপড়ও এনেছিল। সেটা যে এত দ্রুত কাজে লেগে যেতে পারে তা অকল্পনীয় ছিল। আরশানের এক হাত অয়ন্তির কোমর ছুঁয়ে উদর স্পর্শ করছে। আর অন্য হাতে রয়েছে জলন্ত সিগারেট। মাঝে মাঝে সেই সিগারেট ঠোঁটের ভাঁজে রেখে লম্বা টান দিয়ে অয়ন্তির দিকে তাকাচ্ছে সে। কয়েকমুহূর্ত চেয়ে থেকে যখন বুঝছে নিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে তখনই বাইরে চোখ রাখছে।অয়ন্তি নড়ে উঠলো কিছুটা, শীত লাগছে। আরশান নিজের শার্ট’টা খুলে অয়ন্তির শরীরে জড়িয়ে ধরলো। আরশানের লাল শার্টের নিচে থাকা সাদা টিশার্ট’টি অয়ন্তির ভেজা জামা লেগে ভিজে গিয়েছে অনেকটা। আরশানের ঠান্ডার দোষ্ আছে, দেখে ও সেই টিশার্ট খুলে ফেলল। আরশানের উদাম শরীরের উষ্ণতা আর অয়ন্তির শরীরের শীতলতা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। উষ্ণতা পেয়ে অয়ন্তি আরশানের আরেকটু কাছে ঘেসে ওকে জড়িয়ে ধরে আরাম করে ঘুমালো। ওদিকে আরশানের চোখ লাল হয়ে এসেছে। হাতে থাকা সিগারেটটা কাঁপছে। আরশান দীর্ঘশ্বাস ফেলে অয়ন্তির চেহারায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। এরপর ধীরে ধীরে নিজের মুখ এগিয়ে নিল অয়ন্তির দিকে। অয়ন্তির ঘাড়ে মুখ গুজতেই ওর সদ্য বেড়ে ওঠা মাঝারি দাড়ির খোঁচায় অয়ন্তি চোখমুখ খিঁচে ফেললো। এরপর মশা ভেবে ঠা’স করে চর বসালো সেখানে। চর’টা আরশানের গালে পড়তেই আরশান থতমত খেয়ে বাচ্চাদের মত ভগ্নস্বরে বলে,
-থ্যাংকস কুসুম। তোমার থা’প্পড়ের জোরে ভুলটা করতে গিয়েও করা হলো না। এ্যান্ড অলসো স্যরি।

আরশান সরে আসতেই অয়ন্তি পিটপিট করে চোখ খুলল। আবছা আলোয় আরশানকে দেখতে পেল কিনা বোঝা গেল না। বিরবির করে কিছু একটা বলে সে চোখ বুজতেই আরশান ঝুকে শোনার চেষ্টা করল অয়ন্তি কি বলছে। অস্পষ্ট ভাবে যা শুনলো তা হচ্ছে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি অনাপি। আমাকে ছেড়ে যেও না। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমার মাথায় অনেক ব্যাথা করে। ‘

আরশানের বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। অয়ন্তির চুলের মাঝে হাত রেখে সে বুলিয়ে দিতে দিতে চোখ বুজে অয়ন্তির চুলে নাক ডুবালো। শ্যাম্পুর নাকি তেলের ঘ্রাণ আসছে তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে এই পরিচিত ঘ্রাণটা আরশানের বড্ড প্রিয়। ঘ্রাণ নিতে নিতে আরশান অধর ছোঁয়াল অয়ন্তির মাথায়, ধীরে ধীরে ঠোঁট কপালে নেমে আসে। অয়ন্তির দুগালে, ঠোঁট রাখার এক পর্যায়ে আরশানের চোখ খুলল। নিজের ওপরই চরম বিরক্ত সে। বারবার অয়ন্তিকে ছুঁয়ে দেখার প্রবৃত্তি থেকে নিজেকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে। কিন্তু এমন অবস্থায় অয়ন্তিকে নিয়ে বাড়ির ভেতর যাওয়াও তো সম্ভব না। ঝড়ের তান্ডবও বেড়েছে। বের হওয়ামাত্র ভিজে একাকার হয়ে যাবে দুজনে। কয়েক ঘন্টা বাদেই ঠান্ডা-জ্বর, সর্দি কাশি সব শুরু হবে। আরশান অয়ন্তিকে লম্বা করে সীটে শুইয়ে দিয়ে সীটবেল্ট লাগিয়ে ব্যাকসীটে এসে বসে। অয়ন্তির কাছে আর থাকা যাবে না। একটা ভুল হলে অয়ন্তি অনেকটা দূরে চলে যাবে যা আরশান চায় না। পেছনের সীটে বসে আরশান অতিতের কথা স্মরণ করল।



১২বছর আগে, আরশানের বয়স তখন একুশ। অনার সঙ্গে সে প্রথম মীর্জা বাড়িতে আসে। অয়ন্তির বয়স তখন ছয় বছর। বাড়ির সামনের উঠানে আরও দুটো বাচ্চার সঙ্গে খেলছিল অয়ন্তি। আরশান যখন গেট দিয়ে ঢুকছিল তখন অয়ন্তি খেলা বাদ দিয়ে আরশানের দিকে হা করে চেয়েছিল। আরশান মৃদু হেসে অয়ন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-অনা এটা তোর বোন না? ভারি মিষ্টি তো! কি নাম পিচ্চির?

অনা হাসল। মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল। কিন্তু অয়ন্তি হাসল না। বরং রেগে আগুণ হয়ে ছিটকে দূরে সরে দাড়াল। আরশান ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অনা চোখ রাঙাল। অয়ন্তি গাল ফুলিয়ে বলে,
-আমি পিচ্চি না। মিমি পিচ্চি। রুনা পিচ্চি।আমি ওদের থেকেও বড়।

সেদিন অয়ন্তির বাচ্চামিতে হেসে উঠলেও আরশানের নজর অয়ন্তিতেই নিবদ্ধ থেকেছিল। আরশান বারংবার তাকাচ্ছিলো দেখে অয়ন্তি ভয় পেয়ে অনার পেছনে লুকিয়ে দাড়িয়ে চোরা দৃষ্টিতে আরশানকে লক্ষ করছিল। আরশান যখন অনার সঙ্গে অনার ঘরে আসে অয়ন্তিও পিঁছু পিঁছু এসেছিল। কিন্তু দরজার আড়ালে দাড়িয়েই আরশানকে দেখছিল, ভেতরে আসেনি। অনা ওয়াসরুমে যেতেই আরশান উঠে সমগ্রঘরে পাইচারি করে প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। তখনই ওর চোখ পড়ে দরজার পাশে ছোট্ট একটা ছাঁয়ার ওপর যা রোদের আলোয় অনেকটা লম্বা হয়ে এসেছিল।আরশান গলার স্বর একটু উঁচু করে চেঁচিয়ে বলল,
-কে ওখানে?

সঙ্গে সঙ্গে অয়ন্তির গলা ফাটানো চিৎকার শোনা গেল। হিচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে এক দৌড়ে নিচে চলে যায় সে। আরশান বেকুবের মত তাকায়! এরপর গলা পরিষ্কার করে আয়নার সামনে দাড়িয়ে দু তিনটা বাক্য বলে চেক করে কন্ঠ ঠিক আছে কিনা। ঠিকই তো আছে তাহলে বাচ্চাটা ভয় পেল কেন? অনা বাথরুম থেকে বের হতেই আরশান অয়ন্তির কথা জিজ্ঞেস করল। অনা শব্দ করে হাসে,
-আর বলিস না, অয়নটা একটুতেই ভয় পায়। সবার আঁদরে আঁদরে বাঁদর তৈরি হয়েছে। কিছু হতে না হতেই ন্যাকাকান্না জুড়ে, এটা সেটা বায়না করে আবদারগুলো হাতানো ওর কাজ। এই যেন কান্না করল, নিচে গিয়ে দেখবি বাবাকে বলে একগাদা খেলনা আনিয়েছে, চাচা আর ভাইয়াদের সঙ্গে ঘোরার প্লানিং করেছে। তবে তোর ইমেজ’টা একটু কালারিং হবে, এই যা!

-আমার ইমেজ কালারিং? মানে?

-নিচে গিয়ে ও বলবে, তুই ওকে ধমক দিয়েছিস। গাল টেনেছিস।

-কখন করলাম এসব? তোর বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করে নেবে নাকি তোর ছলনাময়ী বোনের কথা? মানইজ্জত সহিত বের হইতে পারুম তো?

-ধ্যাত! বিশ্বাস করবে কেন? সবাই জানে অয়ন এমন। সামনাসামনি তোকে একটু ঝারবে বাবা, নাহলে তাঁর আদরের দুলালি তো থামবে না। তারপর ঠিক হয়ে যাবে।

-ফাজিল মেয়ে! তোর স্বভাব পেয়েছে। তুই যেমন ব্লাকমেল করে কাজ হাতিয়ে নিস, তোর বোনটাও ঠিক তেমন।

-এবার আমার কম্পিউটার ঠিক কর দোস্ত! পরশু পরীক্ষা! ফেইল করলে তিন বছরের জার্নালিজম পড়ার সাধ মিটে যাবে। অর্নাসের দু বছর না চাইতেও পড়তে হচ্ছে, কি জ্বালা! ভাবলাম টুকে পাস করবো। বাট তোর সীট অনেক দূরে।

-জার্নালিজমে কি আছে? এতগুলো বছর নষ্ট করে ওতে পড়া লাগবে কেন? বিয়েশাদী কর, তোর ননদদের দেখে আমারও হোক! আর কতকাল সিঙ্গেল থাকবো? বয়স তো কম হলোনা, প্রেম করার উপযুক্ত সময় পর হয়ে যাচ্ছে।

-তুই ব্যাটা প্রেম নিয়াই থাক। বাই দ্যা ওয়ে সিনিওর আপু ট্রাই কর। তোর পিছে তো জোঁকের মত লেগে থাকে ফাইনাল ইয়ারের আপুরা।

-ধুর! বড় আপুরা আগে থেকেই বোঝে সব। আমার ওত বেশি বুঝা পাবলিক ভালো লাগে না। বাচ্চা-কাচ্চা দেখ। আমি ধৈর্যশীল মানুষ! বাচ্চা পালতে পছন্দ করি।

-বাচ্চা?বিয়ে কইরা একটা পয়দা করে নিলেই হয়।বাচ্চা বউ লাগবো ক্যান? আর বিয়ের পর কোন মাইয়া বাচ্চা থাকে?

-ঘসেটির নিউ ভার্সন! ওই বাচ্চা পালার মজা, আর বাপ হয়ে বাচ্চা পালার মজা আলাদা। এই বাচ্চা বউকে ধমকানো, গাল টিপে চুম্মানো, ভয় দেখানোর মজা তুই ক্যামনে বুঝবি? প্লাস, ইয়ে, মানে বুঝোসই তো! আমি মানুষটা এক্সট্রিম রোম্যান্টিক! ভীতু বাচ্চাদের আদর করতে গেলে রোম্যান্টিকতা বাড়বে বৈ কমবে না।

-ছি! তুই দেখি মহা শয়তান। কোন মাইয়্যার কপাল পুড়াবি বিধাতাই জানে। বেয়াদব। লুচ্চা প্রজাতির এমন বন্ধু আমার ফ্রেন্ডলিস্টে আছে জানতামই না। সায়নটা লুচ্চা জানতাম, কিন্তু ও’ও তোর মত এত না। সভ্য হ। আমার মত না হলেও, একটু হ। তোদের নিয়ে তো বের হওয়াই মুশকিল।

-রোম্যন্টিকতার অন্য মানে বের করছিস তো। কর! এই থাকল তোর কম্পিউটার, নিজে ঠিক করে নে। পারবো না আমি তোর এই ভা’ঙাচোরা কম্পিউটার ঠিক করতে। বালের সভ্যতার প্রতীক আসছে।

সেদিনও অয়ন্তির প্রতি আরশানের তেমন কোনো বিশেষ অনুভূতি জন্মায়নি। মীর্জা বাড়িতেও আরশানের তেমন যাওয়া হয়নি। তবে বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার সুবাদে ছাদে বাচ্চা অয়ন্তিকে প্রায় দেখতো আরশান। ‘বাচ্চা হিসেবে সে চমৎকার! তাই তাঁর দিকে দৃষ্টি যায়।’ এমন বাক্য নিজেকে চড়া গলায় শুনিয়ে ধমকাতো সে। কিন্তু যখন অয়ন্তি ওরনা নেওয়া শুরু করলো। কিশোরী হওয়ার ছাঁপ প্রকাশ পেল তখন আরশান বুঝলো এটা শুধু বাচ্চার প্রতি ভালোলাগা ছিল না। অন্যকিছু ছিল। অনা জার্নালিজমে যখন দুই বছর কাটালো আরশান তখন হুট করেই দেশের বাইরে চলে যায়। অনা ভারি চমকায়। বেস্টফ্রেন্ডের এমন বিশ্রি কাজে ক্ষেপে গিয়ে ফোন করে ইচ্ছেমত ঝারে। আরশান প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। কিন্তু অনার জোরাজুরিতে শেষে বলেই দিল সে অয়ন্তিকে পছন্দ করে। অনা স্তব্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ চার বছর আরশানের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রাখে। আরশান ভাবে ওর অন্যায়ের শাস্তি এটা। কিন্তু সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে কলকাতায় ওর বাড়িতেই এসে হাজির হলো অনা, অয়ন্তি, মাহিন,সায়ন ও সায়নের বউ। আরশান দরজা খুলতেই ওর ওপর অতর্কিত হামলা করে বসে সবাই।অয়ন্তি সবার পেছনে অস্বস্তিতে আসফাস করছে। আরশানের দৃষ্টি তখনও অয়ন্তির ওপর পড়েনি। অনা সবাইকে থামিয়ে কড়া কন্ঠে বলে,

-আরে থাম! দুমিনিট মা’রামা’রির কাজটা ওফ রাখ, আরশানের বাড়িতে নতুন মেহমান এসেছে তাকেও আপ্যায়ন করার সুযোগ দে ওকে।

আরশান সোফার ওপর থেকে উঠে দাড়াল। দরজার বাইরেই উঁকি মেরে দাড়ানো অয়ন্তিকে দেখে আরশানের চোখ ভিজে আসল। বেশ কিছু সময় স্তব্ধতা ঘিরে রাখল ওকে। যখন মস্তিষ্ক সচল হলো, বুঝতে পারলো অয়ন্তি এসেছে তখন ছুটে গিয়ে অনাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-থ্যাংক্স দোস্ত! আমি তো ভাবছিলাম ফ্রেন্ডশিপটাই বোধ হয় জলে গেল।

মাহিন তেড়ে এসে আরশানকে ছাড়িয়ে মুখটা বিকৃত করে বলে,
-ছাড় শালা! আমার বউরে চাইপ্পা ধরছোস ক্যান? ছাড় কইতাছি নাহলে আমিও কিন্তু অয়নরে…! আর তুই জানোস আমি কাউরে ধরলে ঘন্টাখানেকের আগে ছাড়ি না।

আরশান মাহিনের হাটু বরাবর লাথি মেরে বলে,
-টাচ কইরা দেখ, পিস পিস কইরা কা’ইট্টা বুড়িগঙ্গায় ভাসায় দিমু। আম্মার নজরে দেখবি ওরে। বোন, শালি আপু সব বাদ।

আরশান দরজার দিকে এগোতেই পেছন থেকে কয়েক কন্ঠের সমস্বর শোনা গেল,
-ফুল কিন্তু ছোঁয়ামাত্র নেতিয়ে পড়ে। লজ্জাবতী লতার মানবী প্রকাশ। দেখিস, চারবছরের প্রেম যেন একবারে উপচে না পড়ে। তুই তো মামা সুবিধার না।

মাহিন তেতে বলে,
-আমার শালির চোখে পানি আসে না যেন। লোহার থেকে আমার ফুল বেশি প্রিয়। মানে তোর থেকে আমার শালি বেশি প্রিয়। আর আমার বউয়ের চৌদ্দগুষ্টি ওর ব্যাপারে প্রচন্ড সেন্সিটিভ।

আরশান ঠোঁট কামড়ে হাসল। বা হাতে চুলগুলো ব্রাশ করে দুষ্টুমিতে ভরা কন্ঠে বলে,
-ফার্স্ট অফ অল আমারও প্লাস আমিও।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে