#তুই_বিহনে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#চতুর্থ_পর্ব (অন্তিম পার্ট)
-‘শীত কিংবা গরম ছেলেরা সহজে গোসল করে না। ময়লা জামা কাপড়ের স্তুপ করে রুমের কোণায় কোণায়। গন্ধভরা মোজায় পারফিউম মেরে কাজ চালায়। রুম ঝাড়ু দেয় না। অকারণে রাত জাগে। নেশাভান করে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। হাতে বালা। কানে দুল। গলায় মালা। ছেঁড়া প্যান্ট,চুলে ঝুঁটি। বাহুতে ট্যাটু স্কিকার। একথায় বনমানুষ। আমরা তো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে তাদের অধঃপতন সহ্য করতে পারি না। চোখের সামনে কারো ক্ষতি সহ্য করা যায়? যায় না। এজন্যই একটা ছেলেকে বনমানুষ থেকে মানুষ করতে আমরা বিয়ে করি। নয়তো এত ঠ্যাকা পড়ে তাদেরকে বিয়ে করে জীবন কয়লা করতে।’
মেহজাবিনের একথা শুনে ইফতি ভ্রুঁ কুচকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটার সাহস দেখে অবাক না হয়ে পারে না সে। খোঁচা মারা কথা তো বলবেই সঙ্গে আবার আইক্কা ওয়ালা বাঁশও যুক্ত করবে। সে কি সুন্দর মানবতা সমেত যুক্তিটা দেখাল।
মেয়েদের কথা চিন্তা করে কথাগুলো বুঝিয়ে বলল। আর এই মেয়েটা তাকে হাতে হারিকেন আর পেছনে ড্যাস দিয়ে দিলো। ছেলেরা নাকি গোসল করে না, এটা কোনো কথা?
ছেলেটা গোসল না করলে নিউজে নিউজে হেডলাইন হতো। কই হয় নি তো। সে এবার খ্যাপাটে গলায় বলল,
-‘কি বললে, ছেলেরা গোসল করে না?’
-‘কানে কি কম শুনেন? যা বলার বললামই তো একবার।’
-‘বড্ড বেয়াদব তুমি।’
-‘ভালো করে মেপে দেখুন আপনার থেকে কমই আছি।’
-‘তুমি আর কখনো আমার সাথে কথা বলবে না। ভুলেও না। যদি বলো তাহলে তুমি একটা পেঁচা।’
-‘আপনিও বলবেন না। যদি বলেন তাহলে আপনার একটা কান কাটা হনুমান।’
-‘বড়দের সন্মান করা শিখো। আদব কায়দা জানো বলে তো মনে হয় না। সময় আছে শিখো নাও নয়তো বরের মার খেতে খেতে প্রাণ হারাবে।’
-‘হাতের নখগুলো কি সাধে রেখেছি? বরের দুটো মার খেলে একটা খামচি অবশ্যই দিবো।’
একথা শুনে ইফতি বসল না হনহন করে হেঁটে চলে গেল। গা জ্বলানো কথা বলতে পেরে মেহজাবিন হেসে ফেলল। আজ পর্যন্ত অকারণে কারো সাথে ঝগড়া করে নি। বাঁকা কথাও বলে নি। কিন্তু ইফতির সঙ্গে বার বার লেগে যায়। আর কেন জানি ছেলেটা ইচ্ছে করে তাকে খোঁচাতে আসে,ঝগড়া করে,
পরে হারও মানে। যাক এতক্ষণ ইফতি গাম্বাটটাকে উপযুক্ত কিছুর সঙ্গে তুলনা করতে পেরে মনে শান্তির হাওয়া বইছে।
গাইতে ইচ্ছে করছে, ‘ আহা, কি আনন্দ আকাশে বাতাসে।’
কিন্তু তার শান্তি বেশিক্ষণ রইল না। পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরানোর আগে ঝপাৎ করে কেউ তার গায়ে এক বালতি পানি ঢেলে দিলো। গোবর গোলা পানিতে তার বমি পেয়ে গেল। এত সুন্দর জামাটাও নষ্ট করে দিলো এই অসভ্যটা। তার অবস্থা দেখে ইফতি দাঁত বের করে হাসছে।হাসতে হাসতে ঘাসের উপর শুয়ে পড়েছে। এখন শুয়ে শুয়ে
হাত তালি দিচ্ছে আর হাসছে। তার হাসি আর পঁচা গোবরের গন্ধে, মেহজাবিন বমি করে ফেলল। বমি করে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দিলো। তার কান্না দেখে জড়ো গেল মানুষজন, তখন
ছুটে এলেন ইফতি আর মেহজাবিনের বাবা-মা। উনারা এই দুটোকে এক হতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। এরা আবারও?
এই দুটোকে কি করবেন উনারা? এরা সুযোগ পেলেই একে অপরের পেছনে লাগে। কতক্ষণ বা চোখে চোখে রাখা যায়?বড়দেরকে দেখে ইফতি উঠে বসলেও এখনো হাসছে, তবে মিটমিটিয়ে। মেহজাবিনের অবস্থা দেখে কারো বুঝতে বাকি রইল কি ঘটেছে। তবুও জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে না থাকলেও ইফতির বাবা জিজ্ঞাসা করলেন,
-‘ইফতি তোমার গায়ে পানি ঢালল কেন মা? তুমি কি তাকে কিছু বলেছো?’
মেহজাবিন হেঁচকি তুলে কাঁদছে। সে মনে মনে বিরাট একটা পরিকল্পনা কষে নিলো। তারপর বলল,
-‘আঙ্কেল, আপনার ছেলে গতকাল রাত থেকে আমার পেছনে পড়ে আছে। সে আমাকে পছন্দ করে। বিয়ে করতে চায়। আমি তার প্রস্তাবে নাকচ করেছি তাই এভাবে আমাকে জব্দ করছে।’
মেহজাবিনের কথা শুনে সকলের দৃষ্টি পড়ল ইফতির দিকে।
সে বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। মেহজাবিনের কথা শুনে সে অবাক হলো না। বরং সে সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বলল,
-‘মেহজাবিন ঠিকই বলেছে। ওকে আমি বিয়ে করব বাবা। তুমি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বলো। রাজি করাও। বিয়ের জন্য কাজি ডাকো। যদিও উনারা রাজি না হোন আমি ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। কিন্তু ওকেই বিয়ে করব। আমি আমার বউকে নিয়ে মামার বিয়ের বরযাত্রী হতে চাই। এখন আমি রুমে গেলাম। ঠিক এক ঘন্টা,দ্রুত বিয়ে সাদির ব্যবস্থা করো। যদি না পারো তাহলে আমি ঘুমের ওষুধ খাব, এটাও
কনফার্ম। ঠিক এক ঘন্টা মনে রেখো।’
-‘এটা কেমন কথা? সব সময় হেয়ালি করা ঠিক না। তুমি তাকে বিয়ে করলেও সে তো করবে না। তার ইচ্ছেরও দাম আছে। বুঝলাম জোর করে বিয়ে করবে ঠিক আছে, কিন্তু সংসার? জোর করে কি সংসার করা যায়? জীবন কি ছেলে খেলা?’
-‘ঠিক এক ঘন্টা। বিয়ে কথা যখন উঠলোই বিয়ে না করে আর থামছি না।’
ইফতি শীতল দৃষ্টিতে মেহজাবিনের দিকে তাকাল। যেন চোখ পড়ার যুদ্ধে নেমেছে। মেহজাবিন মুখ কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে বিয়ের কথাটা বলেছে ইফতিকে বকা খাওয়াতে। কিন্তু এখন দেখি এখানকার সুর বদলে যাচ্ছে। ইফতি রাজি।সে মিথ্যা বলল আর ইফতি মেনে নিলো, কিন্তু কেন? ইফতি কথা বাড়াল না থমথমে মুখে দ্রুত প্রস্থান করল। আর বড়রা পড়ল বিপাকে। ছেলেটা ভীষণ জেদি। যখন বলেছে বিয়ে করবে মানে করবেই। ইফতির কান্ডে ইফতির বাবা মা এখন কি বলবে বুঝতে পারছে না।ছেলেকে বিয়ের কথা বলে বলে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলেছেন অথচ আজকর ছেলের কান্ডে পরিস্থিতি গুবলেট করে দিয়েছে। মেহজাবিনের সঙ্গে যেসব কান্ড করেছে, কোন মুখে উনারা বিয়ের প্রস্তাব দিবে। বিয়ের আগেই তো মেয়েকে নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। বিয়ের পরে কি হবে,আল্লাহ মালুম। ওদিকে মেহজাবিনের বাবা মাও কি বলবে বুঝছে না। উনারা বিব্রত। ছেলেটা দেখতে শুনতে এক রাজপুত্রের মতো। কিন্তু চঞ্চল স্বভাবের। একে মেয়ে জামাই বানানো ঠিক হবে কি না বোধগম্য হচ্ছে না। যদিও ছেলেটার খারাপ চরিত্রের অথবা নেশাখোর মনে হয় নি। এরপরেও…!
গোবরগোলা পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে মেহজাবিন অবাক
তাকিয়ে ছিল। ফুপি তাকে এনে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলেন।
ফ্রেশ হতে বলে দ্রুত বেরিয়েও গেলেন। মেহজাবিন পড়েছে মহাবিপদে। ধুর কি বলতে কী বলে ফেলল। এখন যদি সত্যি সত্যিই বিয়ে হয়ে যায় তখন কি হবে?এমন ঝগড়ুটে ছেলের সঙ্গে সারাজীবন থাকবে কিভাবে? ভুল যখন করেছে ভুল শুধরে নেওয়া উত্তম। সে শাওয়ার নিতে নিতে অনেককিছুই ভাবল। তারপর ড্রেস পরে চুল না মুছে গুঁটি গুঁটি পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে ইফতির রুমে গেল। আশেপাশে তেমন কেউ নেই, সকলে হলুদের আসরে। ইফতির রুম অন্ধকার ঠিকই দরজা হাঁট করে খোলা। সে রুমে ঢুকে উঁকিঝুঁকি দিতেই কে যেন পেছনে থেকে দরজা আঁটকে দিলো। অন্ধকার রুমটা আরো অন্ধকার হয়ে গেল। হঠাৎ সে অনুভব করল একজন
তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। নিঃশব্দে পড়ছে তার কাঁধে। সে নিজেকে ছাড়াতে গেলে অগন্তুক তাকে শক্ত করে ধরল, তারপর ফিসফিস করে বলল,
-‘সত্যি সত্যি আমার বউ হয়ে যাও, ভীষণ ভালোবাসব।’
-‘ চুলে চুইংগাম লাগানো, গোবর জলে স্নান করানোর মতো ভালোবাসা? লাগবে না আপনার ভালোবাসা। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করতে নিষেধ করুন। আমি মিথ্যা বলেছি, সব দোষ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি। আপনি বিয়েটা ক্যান্সেল করুন। একটা মিথ্যার শাস্তি সারাজীবন বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়, প্লিজ।’
-‘এত কথা থাকতে বিয়ের কথাই কেন বললে? আমার তো মনেই ছিল না বিয়ের কথাটা। তুমি বলার পরে স্মরণ হলো।
আর আমার মনটাও সঙ্গে সঙ্গে বলে বসল,,অনেক হলো দূর থেকে দেখা, ফলো করা বিপদে রক্ষা করা, ভালোবাসি না বলেও পাগলের মতো ভালোবাসা, এবার এসবের সমাপ্তি টানা দরকার। এবারের গল্পটুকু নাহয় হোক কাছে আসার গল্প।’
-‘ভুলভাল বুঝিয়ে লাভ নেই। আমি বিয়ে করব না মানে করবই না। আপনি বাইরে চলুন আমি সবার সামনে বলবো, আমি মিথ্যা বলেছি। বিয়ের ব্যবস্থা যেন না করে। এই বিয়ে আপনি জেদের বশে করছেন। তাছাড়া আমিও রাজি নই।’
-‘কেন, রাজি না কেন শুনি? আমি কি খুব বেশি খারাপ?’
-‘জানি না। তবে যে আমাকে সামান্যটুকুও সন্মান দেয় না আমি তাকে বিয়ে করব না।’
-‘বাসে একা একা ঘুমাচ্ছিলেন আমিই তো ডাকালাম। ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমিই তো পাহারা দিচ্ছিলাম। ক্ষুধার চোটে মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গিয়েছিল, আমিই তো হেল্পপারের সাহায্য ভালো রেস্তোরায়
নিয়ে গেলাম। খোলা চুল দিয়ে সারাদিন জ্বালিয়েন একটুও ঘুমাতে পারি নি, আপনি যেন নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন তাই নিজের বুকে টেনে নিয়েছিলাম। দুষ্টুমি করে চুলে চুইংগাম
র লাগানোর আগে দেখে নিয়েছিলাম এর সমাধান আছে কি না, যখন দেখলাম তখন চুইংগাম লাগিয়েছি। সারারাত বুকে ঘাপটি মেরে, শার্ট আঁকড়ে ধরে তো খুব ঘুমিয়েছিলেন, ঘুম যাতে না ভাঙে তাই একটু নড়তেও পারি নি। পুরো জার্নিতে চোখে চোখে রেখেছি তবুও এই অপবাদ? কেন দুষ্টমির ছলে করা ভালোবাসা দেখা যায় না?’
-‘চেনা নেই, জানা নেই, গতরাতে প্রথম দেখা এর মধ্যে কি না ভালোবাসাও হয়ে গেল? তা হলো, হলো, কই বুঝলাম না তো। আর আমি কারো বুকে টুকে ঘুমায় নি,এসব ডাহা মিথ্যা কথা।’
-‘কাল হয়তো আমাকে প্রথমবার দেখেছো। কিন্তু আমি আট মাস ধরে রোজ তোমাকে ফলো করছি, ভালোবেসে যাচ্ছি।
বিশ্বাস নাহলে তোমার ফুপি মানে আমার মামনিকে নাহয় জিজ্ঞাসা কোরো। মামনিও তোমার সন্ধান দিয়েছে আমাকে।
ভেবেছিলাম আদা মাদা কেউ হবে। দেখার ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু ছবি দেখে আমার মন টা তো কাড়লে কাড়লেই আমার ভালো থাকাটুকুকেও কেড়ে নিলো। এখন তুই বিহনে আমি নিঃস্ব। তাই প্লিজ রাজি হয়ে যাও।’
-‘তাহলে শর্ত মানতে হবে, রাজি?’
-‘বলো কি শর্ত?’
-‘আমি অনেক অনেক অনেক ভালোবাসতে হবে।’
-‘বাসলাম।’
-‘মন থেকে বিশ্বাস করতে হবে?’
-‘করলাম।’
-‘কখনো কাঁদানো যাবে না।’
-‘ভুলেও না।’
-‘আমাকে ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না, কোথাও না।’
-‘যাব না।’
-‘ঠিক আছে, তবে একটা সুযোগ দিলাম। বাইরে গিয়ে বলুন আমি রাজি।’
একথা বলে মেহজাবিন ইফতিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল। ইফতি নিঃশব্দে হাসতে লাগল। এতদিনের অপেক্ষা।
বাগানে চেয়ার পেতে আজমত আলীই দুই পরিবারকে ডেকে বৈঠক বসালেন। সকলে নিশ্চুপ। তখন আজমত আলী গলা পরিষ্কার করে কথা শুরু করলেন।তিনি নাতির বিয়ের প্রস্তাব রাখলেন মেহজাবিনের বাবার কাছে। জলদি সিদ্ধান্ত নিতে
অনুরোধও জানালেন। সঙ্গে জানালেন ইফতির বায়োডাটা।
ইফতি বিজনেসম্যান। নিজের চেষ্টায় ব্যবসা দাঁড় করিয়েছে।
বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। তার নিজস্ব বৃদ্ধাআশ্রম, চাইল্ড কেয়ারসহ রয়েছে। সেখানকার খরচ সেই টানে। ইফতি কিন্তু জেনে শুনে মেহজাবিনকে এত জ্বলায়। তারমানে এই না সে ছ্যাবলামার্কা। বরং ব্যাক্তিত্বের ধার অন্যরকম। সে শুধু তার কাছের মানুষের সঙ্গে এভাবে মিশে, দুষ্টুমি করে, এছাড়া সে পুরো পৃথিবীর কাছে এটিটিউড ওয়ালা। মোদ্দাকথা, ইফতি মেহজাবিনকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু মেহজাবিনের কারণে অফিসের ডিল ক্যান্সেল করে এখানে এসেছে। যে ছেলেটা বছরের পর বছর কেটে গেলেও মামা বাড়িতে পা রাখে না, সে মেহজাবিনের কারণে এত গ্যাদারিংয়ের মধ্যেও এখানে উপস্থিত। যেটা আশ্চর্যের ব্যাপার। মুখ্য কথা, মেহজাবিনের ফুপিই তাদের বিয়ের ঘটকালি শুরু করেছে। এইকথা শুনে
মেহজাবিনের বাবা বোনের দিকে তাকাল। মেহরু মৃদু মাথা নেড়ে বললেন,
-‘ভাইজান রাজি হয়ে যাও। ইফতির সঙ্গে বিয়েটা হলে মেহজাবিনের জীবনে সুখের অভাব হবে না। ছেলেটা খুব ভালোবাসে তোমার মেয়েকে। এর সাক্ষীও আমি। তাছাড়া এই দেখো তোমার মেয়ে মেসেজ পাঠিয়েছে আমাকে, সেও রাজি।’
এরপর আর কথায় থাকে না। অতঃপর তাদের পরিবারের উপস্থিতিতে কাজি ডেকে বিয়ে পরানো হলো। পাশাপাশি বসিয়ে মিষ্টি মুখ করানো হলো। ইফতির পরণে পাঞ্জাবি আর মেহজাবিনের পরণে ইফতির কিনে আনা লালরঙ্গা শাড়ি।
দু’জনকে কি যে সুন্দর লাগছে। তখন অনুষ্ঠান করার কথা উঠল। ইফতি রাখঢাক না রেখে সরাসরিই জবাব দিলো,
-‘দু’জনকে এক বাসায় রেখে অনুষ্ঠান করলে ঠিক আছে। কিন্তু দু’জনকে আলাদা বাসায় রেখে সপ্তাহের পর সপ্তাহ
অনুষ্ঠানের নামে মানসিক অত্যাচার করা মানব না আমি। যে যা করবা করো তবে বউ নিয়েই বাসায় ফিরব এই বলে দিলাম।’
বেহায়ার মতো কথাটা বলে সে জুসের গ্লাসে চুমুক দিলো।
মেহজ লজ্জায় লাল হয়ে চুপটি করে বসে আছে। ওদিকে উপস্থিত সকলে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। মজা করছে। ইফতি সেদিকে মন দিলো না বরং মেহজাবিন চোখ ভরে দেখে ফিসফিস করে বলল,
-‘ আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, কাজ আছে। ঘুমিও পড়ো না যেন। আর ঘুমালেও আবার গোরব জলে গোসল করাব।’
-‘ফুপি বলল না, অনুষ্ঠানের আগে দু’জনকে আলাদা থাকতে।’
-‘বললেই হবে? আমার বউ আমার সঙ্গে থাকবে, ব্যস। তুমি শুধু তোমার রুমে থেকো ফিরে বাকিটা আমি বুঝে নিবো।’
একথা বলে ইফতি বেরিয়ে গেল। মানুষ বিয়ে করলে নাকি ঘরকুনো হয়। অথচ সে হবে উল্টো টা। সে হবে ভবঘুরে তবে বউকে সঙ্গে নিয়েই। তার এতদিনের ইচ্ছে ছিল দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো। বেড়িয়েছেও। কিন্তু মেহজাবিন তার জীবনে আসার পর থেকে সে কোথাও যায় নি। যেতে পারে নি। দম আঁটকে মারা যাবে এমন মনে হতো। কিন্তু আজ থেকে সেই ভয় নেই, বাঁধা নেই, এখন যখন তখন প্রিয় মানুষটাকে সে কাছে পাবে। যেখানেই যাবে সঙ্গী হিসেবে সঙ্গে নিয়ে নিবে।
এসব ভেবে সে সাজেকের রিসোর্ট বুক করে ফেলল। কাল মামার বিয়ের পরপরই সেও মেহজাবিনকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। বউ নিয়ে যত শখ আহ্লাদ মনে পুষে রেখেছে সবটা পূরণ করবে। তখনও কি পাগলিটা বলবে, সে ভালোবাসতে জানে না? প্রকাশ করতে পারে না? রাত বাড়ছে। আজিজুল
খোঁড়া পা মেলে দিয়ে বই পড়ছে। বাইরে এতক্ষণ চেঁচামেচি শোনা গেলেও, এখন সবাইই নিশ্চুপ। ঘড়ির কাঁটা একটার ঘরে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মেহজাবিন ইফতি তারা কেউই বাসা নেই। ইফতি আগে বের হলেও মেহজাবিন কিছুক্ষণ আগেই বাইরে গেছে। আজিজুল তাদেরকে প্রাইভেসি দিতে
ফাইভ স্টার হোটেলের একটা রুমও বুক করেছে। জীবনের বিশেষ একটা দিন তাদের। এজন্য স্পেশালভাবে বাসরঘর সাজিয়েছে। যেটা ইফতি করার জন্য বাইরে যেতে চাচ্ছিল,
কিন্তু সে বুঝতে করতে দেয় নি। তাদের জন্য যতটুকু করা যায় সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে।
এদিকে হোটেলের রুমে ঢুকে মেহজাবিন হতবাক। ইফতিও মুগ্ধ হয়ে দেখছে আশপাশ। এত সুন্দর ডেকোরেশন! চোখ ফেরানো দায়। সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে বিছানা।
পুরো রুমে ছোটো ছোটো মোমবাতি জ্বলছে। লাভ বেলুনের ছড়াছড়ি। সাদা বেডশীটের উপর ইংলিশে লেখা ‘ Best Of luck.
ইফতি নিজে ফ্রেশ হয়ে মেহজাবিনকেও ফ্রেশ হতে তাগাদা দিলো। তারপর দু’জনে বেলকণিতে গিয়ে বসল। আজ চাঁদ
উঠেছে। মিটিমিটি আলো ছড়াচ্ছে ধরণীর বুকে। ইফতি টান দিয়ে মেহজাবিনকে মেঝেতে বসিয়ে দিলো। তারপর তার কোলে মাথা রেখে চুল টানতে ইশারা করল। মেহজাবিনও আলতো করে ইফতির মাথার চুল টেনে দিতে লাগল। কারো মুখে কথা নেই। অথচ মনজুড়ে ভালোলাগা। মেহজাবিনের অবাক লাগছে, কারণ সে কখনো কোনো ছেলের এতকাছে
যায় নি। মিশে নি, কথা বলে নি, অথচ ইফতি কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, কত কথা বলছে, তবুও তার অস্বস্ত্বি কাজ করছে না। লজ্জা লাগলে ঠিক তবে ভালোও লাগছে। তখন ইফতি তার মাথাটা ধরে কপালে চুমে এঁকে দিলো। তারপর চোখের পাতায়, গালে, ঠোঁটে। কথা নেই, শব্দহীন পরিবেশ,
মৃদ বাতাসের গুনগুন স্বর, চাঁদের মিটিমিটি হাসি। এভাবেই সময় কাটল। রাতও বাড়ল। বাড়ল ভালোবাসার তীব্রতাও। সেই সঙ্গে সূচনা হলো তাদের সুখ দুঃখে ঘেরা জীবনে কাছে আসার গল্পও
সমাপ্ত।