তুই বিহনে পর্ব-০৩

0
295

#তুই_বিহনে
#লেখনীতে_নূরজাহান_আক্তার_আলো
#তৃতীয়_পর্ব

আজমত আলী আজিজুলের সঙ্গে তর্ক না করে হনহন করে চলে গেলেন। রাগে উনার শরীর জ্বলছে। এমন ছেলের জন্ম দেওয়ার জন্য নিজেকেই নিজের থাপ্পড় ইচ্ছে করে। জীবনে কী পাপ করেছিলেন যে, এমন হাড়ে বজ্জাত ছেলের বাবা হলেন একথা উনি ভেবে পান না। এদিকে আজিজুল বাবার দিকে তাকিয়ে নীরবে দাঁত বের করে শরীর কাঁপিয়ে হাসল।
তার কাজ রোজ বাবাকে একবার করে রাগিয়ে দেওয়া। এ যে পরিপূর্ণ তৃপ্তির কাজ। এই তৃপ্তি জগতের অন্য কোথায় পাওয়া যাবে না। এই তৃপ্তি বাবাদের রাগী মুখে বরাদ্দ করা।
তার মতে, সু-স্বাস্থ্যের জন্য যেমন হাসিহাসি জরুরি দেমনি রাগটাও। রাগ করলে মস্তিষ্ক ভালো থাকে। বুদ্ধির ধার বাড়ে।
যদিও একথাটা কেউ তাকে বলে নি তবে তার মনে হয়। মন নিশ্চয়ই ভুল বলবে না। তবে মন সবসময় উল্টাপাল্টা কিছু এটাও ঠিক। মাঝে মাঝে মনের মন রক্ষার্থে উল্টো কিন্তু করা উচিত। সে যেমন করে, বাবাকে রাগিয়ে দেয়। তবে আজকে সকাল সকাল বাবাকে রাগিয়ে দিয়ে ভালোই লাগছে৷ মনটা ফুরফুরে লাগছে। শরীরে চনচনে ভাব এসেছে। দিনটা ভীষণ ভালোই যাবে আশা করা যাবে। এমনিতেই তার দিন ভালো যায়। কারণ তার বাড়িখানা আস্ত একটা বিনোদনের কেন্দ্র।
যেখানে প্রত্যেকটা দিন নিত্য নতুন কাহিনির উৎপত্তি ঘটে।
আজও হয়েছে। আজ করেছে মেজভাবির ভাইয়ের মেয়ে মেহজাবিন আর তার বোনের ছেলে ইফতি। ইফতি টা যেই হাড়ে বজ্জাত যে তার পাল্লায় পড়ে সেই বুঝে। কিন্তু মেয়েটা কম না বোঝাই যাচ্ছে। এদের ঝগড়াটা বেশ ভালোই জমবে।
সে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে আরাম কেদারায় বসল। চা খেতে খেতে মারকাট ঝগড়া দেখার মজাই আলাদা। সে গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঝগড়া দেখায় মনোনিবেশ করল। ওইদিকে মেহজাবিন শক্তি দিয়ে ইফতির চুল টেনে ধরেছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ইফতির আজ টাকলা হবেই হবে। বাড়ির সদসরা
মেহজাবিনকে চুল ছাড়ার তাগাদা দিচ্ছে। কিন্তু মেহজাবিন চুল ছাড়ছে না বরং চুল টানতে টানতে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। যেন তারই লাগছে। ওদিকে ইফতি নিশ্চুপ। একপর্যায়ে রাগী মেহজাবিনকে থামানো গেল। মেহজাবিনের বাবা মেয়েকে
বসিয়ে পানি খাওয়ালেন এরপর পুনরায় ঘটনাটা জিজ্ঞাসা করলেন। জবাবে মেহজাবিন বলল,
-‘ওই অসভ্যটা আমার চুলে চুইংগাম লাগিয়ে দিয়েছে। ”
একথা শুনে ইফতি চুল ঠিক করে হাসি হাসি মুখেই বলল,
-‘অসভ্য বলার কারণে চুইংগাম লাগিয়েছিলাম। আবারও অসভ্য বললে, এবার কিন্তু ডাবল হয়ে যাবে বলে দিলাম।’
এতক্ষণে উপস্থিত সকলে বুঝল আসল ঘটনা। কিন্ত তারা
কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিলো না। তাদের তর্ক-বির্তক চলতে থাকল। মেহজাবিনের মা বাধ্য হয়ে মেয়েকে হড়হড় করে টেনে নিয়ে গেলেন। দু’ঘা বসিয়ে দিলেন মেয়ের পিঠে।
ছিঃ! ছিঃ! মেহমান বাড়িতে এসে এ কোন অনাসৃষ্টি। লজ্জার কাউকে মুখ দেখানো যাবে? এই বাসার নাতিকে মারতে এই মেয়ে আঁশবটি তুলেছে, এত বড় দুঃসাহস! না, উনি ভাবতেন
মেয়েটাকে মানুষ করতে পেরেছিলেন। এখন দেখছেন ভুল ভাবতেন। মায়ের মার খেয়ে মেহজাবিন কাঁদতে কাঁদতে পা বাড়াতেই ইফতি ডাকল। পকেট থেকে ফোন করে বের ডাটা কানেক্ট করে ইউটিউবে সার্চ দিলো, ‘বড় চুল থেকে চুইংগাম ছাড়ানোর সহজ উপায়।’ ব্যস ভিডিও পেয়ে গেল। তারপর মুখভর্তি হেসে ভিডিওটা তাকে দেখতে বলে শিষ বাজাতে বাজাতে উপরে চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল তার নাস্তাটা উপরে পাঠিয়ে দিতে। খেয়ে ঘুমাবে। বাসে ঘুম হয় নি, ঘাড় পিঠ ব্যথায় টনটন করছে। মেহজাবিনের মা ভিডিওটা দেখে চুল থেকে চুইংগাম ছাড়ানোর কাজে লেগে পড়লেন।
তখনকার মতো তাদের ঝগড়াটাও থামল। বাসাটাও শান্ত হলো। তারপর তাদের কাউকেই আর দেখা গেল না। সময় গড়িয়ে দুপুর হলো। তবুও কেউ নিচে নামল। তাদের খাবার উপরে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

বিয়ে উপলক্ষে দুপুরের পর থেকেই মেহমানদের আনাগোনা বেড়েছে। হইচই হচ্ছে। ধুম ধাড়াক্কা গান বাজছে। মহিলাগণ সেজে গুজে মেয়েলি কাজগুলো করছে। বাইরে সামিয়ানা টানানোর হচ্ছে। হলুদের স্টেজ হয়ে গেছে। সেখানে বড় বড় করে লেখা হয়েছে ‘ আজিজুল এর হলুদ সন্ধ্যা।’ কেন জানি লেখাটা আজিজুলের পছন্দ হলো না। সে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তারপর লেখালো, ‘আজ আজিজুল এর গায়ে হলুদ।’
হলুদ সন্ধ্যা আবার কি জিনিস? যত্তসব, ভুলভাল কথাবার্তা।
বাঙালি সহজ কথা সহজ ভাষায় বলে না, এটাই আফসোস।
অতঃপর আরো কিছু কাজ সেরে সে গেল ফুটবল খেলতে।
সঙ্গে গেল ইফতি। দুই মামা ভাগ্নেকে হাফ পরে খেলতে যেতে দেখে সকলে হাসল। কেউ কেউ বারণ করল। নতুন বরদের যেখানে সেখানে ঘুরতে নেই, এতে নজর লাগে। কিন্তু কে বক শুনে কার কথা? মামা ভাগ্নে গায়ের জোর দেখিয়ে খেলতে গেল ঠিকই, কিন্তু আজিজুল এলো খোঁড়াতে খোঁড়াতে। তার পা মচকে গেছে। এক পা ফুলে ঢোল। ছেলের কর্মকান্ড দেখে আজমত আলী ইচ্ছে মতোন গালাগাল করলেন। ইফতিকে
কিছু বলার আগে ইফতি বলল,
-‘নানুভাই খবরদার বলছি, আমাকে কিছু বলবে না। আমি তোমার ছেলেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেই নি। বরং তোমার ছেলেই আমাকে ধাক্কা মারতে গিয়ে পড়েছে। পড়ার কারণ
তোমার ছেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। বউ আনার আগে তাকে ভিটামিন খাওয়াও।’
-‘তোরা মানুষ হবি না? আর কত জ্বালিয়ে মারবি আমাকে?’
-‘মানুষ হবি না, এই কথার মানে কি? আর কত মানুষ হবো?
তোমার জ্বালিয়ে মারলামই বা কখন? জ্বালিয়ে মারলে কেউ বেঁচে থাকে? কথা বলে? গপগপ করে চিকেন রোল গিলতে পারে? নানুভাই, আমাকে খুঁচিও না নয়তো প্রচার করে দিবো তুমি তোমার প্রাক্তণকে বাদাম কিনে দিয়েছো।’
-‘এই ঘটনার আর কত খোঁটা দিবি? রুবিনাকে বাদাম কিনে দিয়েছিলাম তাও দশ বছর আগে। বেচারি কিডনি রোগে মারা গেছে পাঁচ বছর আগে। এই কথার ভয় দেখিয়ে টাকা নিয়েছিস আমার থেকে। বলি আর কত?’
-‘তোমার উপরে আমার প্রচুর রাগ আছে। যতদিন না সেই রাগ কমবে ততদিন তোমার ব্ল্যাকমেইল করে যাবো। দরকার হলে যাকে তাকে তোমার প্রাক্তন বানিয়ে কেস খাওয়াব।’
-‘আজকেই বলবি, আমার উপর এত রাগ কেন তোর? কি করেছি আমি?’
-‘কি করো নি তুমি? তুমি পারতে না ভালো একটা মানুষের সঙ্গে আমার মায়ের বিয়ে দিতে? দিয়েছো? দাও নি,দিয়েছো
বদমেজাজি, খারুস, এক লোকের সঙ্গে। যে আমার মতো ছেলেকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে। অবিবেচক মানুষ। ছিঃ! ছিঃ! কি লজ্জা! কি লজ্জা!”
-‘ওহ তুমি তোমার বাবার মার খেয়ে এখানে এসেছো। আর সবাইকে বলে বেড়াচ্ছো অফিসের কাজে এসেছো, ভালো খুবই ভালো। তা মার খেলে কেন? নিশ্চয়ই পূর্ণের কাজবাজ করেছো?’
-‘পূর্নের কাজই বটে। বাবার পি.এ রোজী আছে না? শালি আমাকে দেখলেও ঠোঁট কামড়ায়, বাবাকে দেখলেও ঠোঁট কামড়ায়। তাই তাকে ডেকে বলছিলাম হয় আমাকে সিগ্নাল দিতে নতুবা বাবাকে। বাবা, ছেলে, এক জনকেই ব্যাপারটা বিশ্রী দেখায়। সে এইকথা বাবাকে বলে দিয়েছে। বাবা এসে আমাকে স্যান্ডেল ছুঁড়ে মেরেছে। পরে জানতে পারলাম, এটা রোজীর পুরনো রোগ। ঠোঁট কামড়ানো রোগের কারণে তার বিয়ে হয় না। লোকে ভুল বুঝে, এজন্য সে বেশিরভাগ সময় মাক্স পরে থাকে। আমিও তো জানতাম না আসল কাহিনি।
জানলে একথা বলতাম না নিশ্চয়ই, বলো বলতাম? তোমার প্রাক্তনের কথা বলেছি? বলি নি তো। তাছাড়া রোজীকে পরে সরি বলেছি। কারণ আমি উপর উপর অভদ্র হলেও ভেতর ভেতর ভদ্র।’
আজমত আলী কথা বললেন না। অনড় হয়ে বসে রইলেন
টুলের উপরে। টুলের এক পা ভাঙা। ভেঙেছেন উনি নিজেই এইদিকে আজিজুলের কোনো বিকার নেই। সে পায়েসের উপরে চেরি দিয়ে তার বউয়ের নাম লিখতে ব্যস্ত। ডাক্তার এসে তার পা প্লিষ্টার করে দিয়ে গেছে। হাঁটা চলা বন্ধ। একথা মেয়ে পক্ষকেও জানানো হয়েছে। মেয়ে পক্ষই আগামীকাল মেয়ে নিয়ে বিয়ে পড়াতে আসবে। যেখানে ছেলেরা মেয়ের বাড়ি যায়, সেখানে মেয়েই আসবে ছেলের বাড়ি। ব্যাপারটা দারুণ উপভোগ করছে সে।

সন্ধ্যার পরপরই হলুদের অনুষ্ঠান হলো। ইফতির বাবা মাও চলে এসেছে। তারা খুবই মিশুক। উনারা মেহজাবিনের মা বাবার সঙ্গে গল্প করছেন। একটুপরে সেখানে সেজে গুঁজে মেহজাবিনকেও দেখা গেল, সে হলুদ রঙা আনাকলি পরে টইটই করে ঘুরছে। ঘুরছে না ঠিক, ফাঁকা জায়গা খুঁজছে। এত গ্যাদারিং ভালো লাগছে না তার খুব মাথা ব্যথা করছে।
তবে হালকা সাজে তাকে চমৎকার দেখাচ্ছে। এদিকে ইফতি আকাশি রঙের টি শার্ট আর কালো জিন্স পরে বসে আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজিজুল মিষ্টি খেতে পারে না। খেলে বমি হয়, মাথা ঘুরে। তাই যত মিষ্টি আছে সব ইফতি খাচ্ছে।
কেউ আজিজুলের কপালে হলুদ ছুঁয়ে মিষ্টি খাওয়াতে গেলে ইফতি বলছে,
-‘মামা মিষ্টি খায় না, আমি আ়ছি, আমাকে দিন।’
এরপর পেটপুরে মিষ্টি খেয়ে আজিজুলের পাশ থেকে উঠে গেছে। এমনিতেই গরম। এত চাপ নেওয়া যাবে না। যে বিয়ে করছে সেই নাহয় মজা বুঝুক। সে পকেট দুইহাত পুরে শিষ
বাজাতে বাজাতে হাঁটছে। হঠাৎ তার নজর পড়ল, জারুল গাছের নিচে চেয়ার পেতে বসা মেহজাবিনের দিকে। সে একগাল হেসে সেদিকে এগিয়ে গেল তারপর মেহজাবিনের পাশের চেয়ারে বসে একা একাই বলল,
-‘উফ! এত গরমে কেউ বিয়ে করে?’
মেহজাবিন জবাব দিলো না তাকাল না। মেহজাবিনের পাত্তা না পেয়ে বলল,
-‘ভয় পেয়ে মানুষ স্ট্রোক করে। স্ট্রোক করলে মারাও যায়।
এর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেও। আবার শুনছি, মেয়েরা রাতে একা শুতে ভয় পাই। ভূত টূতও নাকি দেখে। ভয়ে কান্নাকাটি করে। তাই আমরা পুরুষ জাতিরাই এই সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব নিয়েছি। ভয় যেহেতু স্ট্রোকেরই কারণ তাই আমরাই মেয়েদেরকে স্ট্রোক থেকে বাঁচাতে মেয়েদের বিয়ে করি। প্রাণ বাঁচায়। নয়তো তাদেরকে বিয়ে করতে আমাদের এত ঠ্যাকা পড়ে নি।’
একথা শুনে মেহজাবিন হাসল। দৃষ্টি তুলে তাকাল। এরপর চমৎকার হেসে বলল,
-‘শীত কিংবা গরম ছেলেরা সহজে গোসল করে না। ময়লা জামা কাপড়ের স্তুপ করে রুমের কোণায় কোণায়। গন্ধভরা মোজায় পারফিউম মেরে কাজ চালায়। রুম ঝাড়ু দেয় না। অকারণে রাত জাগে। নেশাভান করে। কথায় কথায় মিথ্যা বলে। হাতে বালা। কানে দুল। গলায় মালা। ছেঁড়া প্যান্ট,চুলে ঝুঁটি। বাহুতে ট্যাটু স্কিকার। একথায় বনমানুষ। আমরা তো মানুষ। আর মানুষ হিসেবে তাদের অধঃপতন সহ্য করতে পারি না। চোখের সামনে কারো ক্ষতি সহ্য করা যায়? যায় না। এজন্যই একটা ছেলেকে বনমানুষ থেকে মানুষ করতে আমরা বিয়ে করি। নয়তো এত ঠ্যাকা পড়ে তাদেরকে বিয়ে করে জীবন কয়লা করতে।’

To be continue…….!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে