#তুই_বিহনে
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
[০১]
_’এই যে মিস গোলাপি পেট দেখানো হয়ে গেলে সরে দাঁড়ান, আমি বসব।’
চলন্তবাসে পাশে দাঁড়ানো যুবকের এমন অসভ্য কুটুক্তিতে মেহজাবিন বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল। তাকে বলল কী না দেখতে সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল। যখন দেখল তাকেই বলেছে তখন কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। জবাবে কিছু বলার খৈই হারিয়ে ফেলল। রাগে দুঃখে মেজাজ গরম হয়ে গেল। তাকে পেছনে তাকাতে দেখে যুবকটি বিরক্তিকর দৃষ্টি ছুঁড়ে, মুখে চুইংগাম পুরে পুনরায় বলল,
-‘ওহ হ্যালো আমি আপনাকেই বলেছি। সরুন এবার, এটা আমার সিট।’
ছেলেটার স্পর্ধা দেখে সে সচকিত। নড়লো না, সরলোও না।
কেবল ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার আঠারো বছরের জীবনে এর আগে কখনো এমন নোংরা ইঙ্গিত শোনে নি সে।
তাছাড়া কোনো ছেলের ভাষা এতটা নোংরা হতে পারে জানা ছিল না। কোনো মেয়েকে সন্মান দিতে না’ই পারল, তাই বলে মুখের উপর চটাস করে এই ধরনের কথা বলে বসবে? কোন আক্কেলে বলবে? মেয়েরা কি সস্তা? পেট দেখানো মানে কি?
কখন পেট দেখালো সে? সে কি বাজারি সস্তা মেয়ে যে বাসে উঠে পরপুরুষকে পেট দেখিয়ে বেড়াবে? নেহাৎ আজ শাড়ি পরে বাসে উঠেছে তাও জীবনে প্রথমবার। প্রথমবার শাড়ি পরলে এমন একটু আধটু সবারই হয়। শাড়ির আঁচল ধরলে কুঁচি খুলে যায়, কুঁচি ধরে হাঁটতে গেলে উস্টা খেতে হয়। এই তো জানা কাহিনি, পুরনো ঘটনা। তাছাড়া ভারি ব্যাগটা টেনে উপরে তুলতে গিয়ে এক্সিডেটলি তার শাড়িটা সরে গিয়েছিল বোধহয়। তাই বলে এমন নোংরা ইঙ্গিত ছুঁড়বে?ভাগ্যিস অন্য
সিটের কেউ ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। নয়তো সকলে তার দিকে তাকিয়ে মজা নিতো। নোংরা দৃষ্টি ছুঁড়তো। মেহজাবিন আশপাশ দেখে কঠিন কথায় জবাব দিতে গিয়েও বহুকষ্টে
নিজেকে সামলে নিলো। যতই হোক, সে মেয়ে। তার উপরে একা। এখন যদি কিছু বলতেও যায় তবে এই ছেলেটা লাই পাবে, কথা বাড়াবে, তখন বাসের বাকি সদস্যরাও ব্যাপারটা জেনে যাবে। লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। মনে মনে এই
কথা ভেবে মেহজাবিন কথা বাড়াল না,নীরবে সরে গিয়ে ওর বরাদ্দকৃত জানালার ধাঁরের সিটে বসল। ছেলেটাও কাঁধের ব্যাগ উপরে রেখে সিট হেলিয়ে বসল। পানি খেলো। কানে ব্লু টুথ গুঁজে কার সাথে যেন কিছুক্ষণ কথা বলল, হাসাহাসিও করল, এরপর সিটে মাথা এলিয়ে চোখজোড়া বুজলো। এই সময়টুকু মেহজাবিন দাঁতে দাঁত চেপে কাঠ হয়ে বসে রইল। তার মনে হলো ছেলেটার কলার ধরে তার দিকে ঘুরিয়ে ঠাস্ করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বলতে, ‘সরি বল বেয়াদব, এক্ষুণি বল।’
কিন্তু বলতে পারল না। আর পারল না বলে নিজের উপরেই রাগ হলো। রাগে চোটে ভুলেও চোখ তুলে তাকাল না। কথা বলা দূর টু শব্দও করল না। এমনভাবে বসল যেন ছেলেটার সঙ্গে ভুলক্রমেও স্পর্শ না লাগে। এই ছোট্ট জীবনে কতশত ছেলে দেখেছে, ক্রাশ খেয়েছে, কিন্তু এমন অসভ্য ছেলে এর আগে দেখে নি। যার মধ্যে ভদ্রতাজ্ঞানটুকুও নেই। ভাই তো তারও আছে। কই তারা তো এমন নয়। এমনভাবে কাউকে নোংরা ইঙ্গিত করে না। বাজে কথা বলে না। বলবে কিভাবে তার ভাইরা তো এমন নোংরা মানসিকতার নয়। যারা নোংরা মানসিকতার তারাই এসব বলবে। ছিঃ! এখন পাশ বসতেও বিরক্ত লাগছে। তখন সিটে বসার সময় ঢং করে পায়ে পাড়া দেওয়া উচিত ছিল। নয়তো পড়ে যাওয়ার ভাণ করে হাতে নখ বসানো উচিত ছিল। এতে মনের জ্বালা কিছুটা কমলেও কমতে পারতো। ইস! মিস হয়ে গেল। তার স্বভাবটাই এমন সময়ের কাজ সময়ে করতে পারে না। ঝগড়া করার সময় মেইন পয়েন্ট মনে থাকে না। পরে আবার ঠিকই মনে পড়ে,
কথা বলে না, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে ওর তেমনই অবস্থা।
তখন তার ফোন ভাইব্রেট হলো। স্কিণে মায়ের নাম দেখামাত্র তার রাগের পারদ আরো একডিগ্রী বেড়ে গেল। সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল আলাভোলা মায়ের উপর। মায়ের কারণে শাড়ি পরে বাসে উঠেছে। মায়ের কারণে তাকে সিলেট যেতে হচ্ছে। মায়ের কারণে ফ্রেন্ডদের সঙ্গে কক্সবাজার যেতে পারল না। তাই সব দোষ মায়েরই। ততক্ষণে কল কেটে গিয়ে, পুনরায় কল এসেছে। সে এবার রাগে গজগজ করে কলটা রিসিভ করে বলল,
-‘শাড়ি পরেই আসছি। শুনেছো? হয়েছে শান্তি?’
-‘কি আশ্চর্য, রেগে যাচ্ছিস কেন?’
-‘ রাগ করব কেন? রাগ করা কি আমাকে সাজে? রাগ শুধু তোমাদেরই আছে। আমি আছি হুকুম তামিল করতে। আর কোনো হুকুম স্থগিত আছে, বলো বলো।’
-‘ না নেই, রাস্তাঘাটে রাগ করে না মা। সাবধানে আয়।’
-‘পারব না সাবধানে যেতে। কি ভেবেছো সব তোমার কথা হবে?’
-‘এভাবে কথা বললে আশপাশের মানুষ কি ভাববে? মাথা ঠান্ডা কর মা।’
মেহজাবিন জবাব দিলো না রাগে দুঃখে কল’ই কেটে দিলো।
তার এখন চোখ জ্বালা করছে।কান্না পাচ্ছে। অস্থির লাগছে। কান্নার চোটে দম আঁটকে আসছে। নিজের মাকে মাঝেমধ্যে অচেনা লাগে। সে কান্না আঁটকে দু’হাতে মুখে ঢেকে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল। একটু পানিও খেলো। তারপর জানালা খুলতেই এক পাগলাটে বাতাস এসে শরীরে ছুঁয়ে দিলো তার তনুমন। সে চোখে মুখে পানি দিলো। অশান্ত মন শান্ত করতে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিলো। তাতে কাজও হলো। এখন একটু ভালো লাগছে। ভেজা মুখে বাতাসের ঝাপটা এসে লাগছে।
অনেকক্ষণ ধরে ভেজা চুল বেঁধে রাখায় মাথা ব্যথা করছে।
শাওয়ার নিয়ে চুল শুকাতেও পারে নি ওমনি চুল বেঁধে ছুটে এসেছে। ঘুমিয়েছিল আর জাগা পায় নি। ফলে কোনোমতে, বুয়ার সাহায্যে শাড়িটা পরে লাগেজ নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছেছে। এই পাগলাটে বাতাসে বেশিক্ষণ লাগবেও না চুল
শুকিয়ে নিতে। একথা ভেবে সে চুলের কাঁটা সরাতেই ঝপাৎ করে পিঠময় ছড়িয়ে গেল ভেজাচুল। ভুরভুর করে শ্যাম্পুর সুগন্ধ এসে ধাক্কা দিলো নাকে। অবাধ্য বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে চুলগুলো যেন বেপরোয়া রুপ ধারণ করল। সমুদ্রের
উত্তাল ঢেউয়ের মতো বাতাসের প্রবঞ্চনায় উড়তে লাগল।
একেই বুঝি বলে, মুক্তির স্বাধীনতা। মুক্ত মনে, মুক্ত আকাশে একা উড়তে পারার অদম্য সাহসীকতা। বাস চলছে নিজস্ব গতিতে। রাস্তায় কৃত্রিম আলোর সাজসজ্জা। এখনো চলছে মানুষের আনাগোনা। সময় কতই বা হবে, রাত সাড়ে দশটা। তার যাত্রা সিলেটের পথে। বড় ফুপির বাসায়। বড় ফুপির দেবরের বিয়ে। তারা নিমন্ত্রিত। মা বাবা ওখানেই আছে। তার পরীক্ষার কারণে আসতে লেট হয়েছে। যদিও তার আসার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু ফুপির ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল, মায়ের ঘ্যানঘ্যানি, বাবার চিন্তার অবসাদ ঘটাতে আসতেই হয়েছে।
এখন ভালোই ভালোই ক’দিন থেকে ফিরে আসতে পারলেই হলো।রাতের জার্নি তার ভীষণ পছন্দ। ধুলোবালি নেই, গরম নেই, ভিড়ভাট্টাও কম। এই প্রথমবার একা জার্নি করছে সে। একা জার্নির মজাও আছে। রাতের নিস্তব্ধতা, বেহায়া চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে পথ চলা, রাস্তার দু’ধাঁরে বেড়ে ওঠা বুনো ফুলের গন্ধ, সবকিছুতে এক আলাদা রকম ভালোলাগা কাজ করে। নিজের ভাবনায় মশগুল হয়ে সে কত কী ভাবছে। চিপসের প্যাকেট ছিঁড়ে চিপস্ খেতে খেতে সে রাতের সৌন্দর্যে ডুবে গেছে। তার মন এখন বেশ ফুরফুরে। ভুলে গেছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। পাশে বসা অভদ্র ছেলেটার কথাও। কিন্তু এসব তাকে বেশিক্ষণ ভুলে থাকতে দিলো না। হঠাৎ পাশের সিটের ছেলেটা হাঁচি দিয়ে বিরক্তিকর সুরে বলল,
-‘এই যে মিস গোলাপি আপনার সমস্যাটা কি? আমাকে দেখে স্বামী স্বামী ফিল পাচ্ছেন নাকি? প্রথমে পেট দেখালেন এখন আবার সাপের মতো বড় বড় চুল দিয়ে নাকে সুড়সুড়ি দেওয়াচ্ছেন। এসব কিসের ইঙ্গিত? ক্রাশ খেয়েছেন? বিয়ে করবেন আমাকে? মতলব বুঝি না মনে করেছেন?দেখে তো ভদ্রঘরের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, তা বিহেভিয়ার থার্ডক্লাস মার্কা কেন?’
আবার! আবারও গা জ্বলানো বাজে কথা। তাকে দেখে সে নাকি ক্রাশ খাবে, বিয়ে করবে, একথাও শুনতে হলো। তবে পাগলে কত কী বলে সব কথা কানে নিতে নেই। পাগল তার প্রলাপ আওড়াবেই এটা তো সে জানেই। ছেলেটার একথা শুনে মেহজাবিন রাগল না মুচকি হাসল। হাসির সঙ্গে সঙ্গেই
তার দুইগালে ছোট্ট একটা গর্ত হলো। যাকে বলা হয় টোল।
তাকে হাসতে দেখে ছেলেটা কিছু বলার আগে সে জবাব দিলো,
-‘আমি থার্ডক্লাস তাই আমার বিহেভিয়ারও থার্ডক্লাসমার্কা। তাছাড়া সমস্যা যখন আপনার, সমস্যার সমাধান খোঁজাও বোধহয় আপনারই দায়িত্ব, তাই নয় কি? বাই দ্যা ওয়ে, ভদ্র ঘরের ছেলেরা কাউকে আলতু ফালতু নামে ডাকে না।’
-‘তা আপনার নামটা জানতে পারি? ‘
-‘না, পারেন না। অপরিচিত কাউকে আমি আমার নাম বলতে ইচ্ছুক নই।’
একথা শুনে ছেলেটা ভ্রুঁজোড়া কুঁচকে তাকিয়ে রইল। পেছন ফিরে দেখল, সিট ফাঁকা নেই অগত্যা সেভাবেই বসে রইল।
সুপারভাইজারকে বলেও লাভ হলো না। কেউই তাদের সিট ছাড়তে রাজি নয়। বাসের প্রায় অনেকে ঘুমে তলিয়ে গেছে। কেউ বা পাশের জনের সঙ্গে গল্পে মশগুল। কেউ খাচ্ছে তো কেউ ফোনালাপ ব্যস্ত। যাত্রী ওঠা নামার ব্যাপারও নেই তাই
বাসের ভেতরের লাইটটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ছেলেটা এখন ফোন টিপছে। ফোনের সল্প আলোয় বোঝা গেল তার মুখ থমথম করছে। অপমানিত হয়ে রাগে ফুঁসছে। এমনই হওয়া উচিত। অন্যকে যাতা বলার সময় হুঁশ জ্ঞান থাকে না। বেশ হয়েছে। এবার দেখ কেমন লাগে।
এতক্ষণে মনমতো জবাব দিতে পেরে মেহজাবিন মনে মনে হাসল। তবে চুল বাঁধল না। মন কেমন করা সুগন্ধি মেশানো
চুলগুলো সেভাবেই উড়তে থাকল। ছেলেটাকে জব্দ করতে পেরে সে এদিকে তাকালও না। পাশ ফিরে সিটে মাথা দিয়ে
চোখ বুজে নিলো। ছেলেটার মুখ দেখে ভীষণ হাসি পাচ্ছে। ঠোঁট টিপে নীরবে হাসলও সে। কিন্তু কথায় বলে না কোনো শত্রুকে দূর্বল ভাবতে নেই। পাছে নিজেরই ক্ষতি হয়।এখানে ঠিক তাই ঘটল। ছেলেটাকে জব্দ করেছে ভেবে সে নিশ্চিন্তে
ঘুমিয়ে গেল৷ ঘুম গাঢ় হলো। সজাগ থাকার আর প্রয়োজনই বোধ করল না। কিন্তু সজাগ থাকা উচিত ছিল। যদি সজাগ থাকত তাহলে টের পেতো, তার শখের চুলে ছেলেটা খুব যত্ন করে চুইংগাম লাগিয়ে দিচ্ছে। একটা নয়, দুটো নয়, তিনটে চুইংগাম। তার এই কাজে কেউ দেখল না, জানল না, সাক্ষী রইল না। তাই কাজ সেরে ছেলেটা হাত ঝেড়ে বিরবির করে বলল,
-‘পূর্ণের একটা কাজ করলাম, থাক ধন্যবাদ দিতে হবে না।’
To be continue……..!