#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী
সানজানা সেদিন বুঝতে না পারলেও বড় হওয়ার সাথে সাথে ঠিকই বুঝেছে কেন তাকে তার মা ছোটোবেলায় সেদিন বাথরুমে আটকে রেখেছিলো। আসলে সে যে একটা ত্রুটিযুক্ত মানুষ। এই সমাজ জানতে পারলে তাদেরকে একঘরে করে রাখবে। কিংবা ওকে অনেক কটুক্তি সইতে হবে।
জীবনটা আসলে একটা রঙ্গমঞ্চ। সানজানা যদিও জানতো প্রেম ভালোবাসা তার জন্য নয় তারপরও যুবরাজের প্রেমকে ও প্রত্যাখ্যান করতে পারেনি। কেন পারবে? মানুষ হিসাবে ওর তো ভালোবাসার অধিকার আছে। সেকারনে কি পাবে, কি পাবেনা সেসবের চিন্তা বিন্দুমাত্র না করে নিজের সবটা দিয়ে যুবরাজকে ভালোবেসে গিয়েছে। যদিও আজ এই মুহুর্তে সব অতীত। কিন্তু মানুষ কখনও তার অতীতকে ভুলে যেতে পারে না। সেকারনে সানজানার অতীতের প্রিয় স্মৃতিগুলো ওকে আজ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ওরও ইচ্ছে হচ্ছে সেই ফেলে আসা অতীত স্মৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। সকালের আলো ফুটতে না ফুটতে লঞ্চ ঘাটে ভিড়লো। সানজানা লঞ্চ থেকে নেমে ওর বাবার ভাড়া করা গাড়িতে কুয়াকাটার উদ্দেশ্যে ছুটে চললো।
খুব ভোরেই সুজানার ঘুম ভেঙ্গে গেল। শোয়া থেকে বিছানায় উঠে বসলো। পাশে যুবরাজ অঘোরে ঘুমাচ্ছে। মুখটা খুব শিশুর মতো লাগছে। ওকে যতই দেখছে সুজানার ভীষণ ভালো লাগছে। ওর প্রতি একধরণের মায়া অনুভব করছে। হঠাৎ সুজানার মনে হলো যদি কোনোদিন যুবরাজ জানতে পারে ও সানজানা নয় সুজানা সেদিন কি ওকে ফেলে রেখে ও চলে যাবে? সেদিন ওর কি হবে? এই ভাবনায় ওর চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। সুজানা ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসলো। এরপর ফজরের নামাজ আদায় করে ওর আর যুবরাজের জন্য মন খুলে আল্লাহপাকের কাছে প্রার্থনা করলো। নামাজ শেষ করার পর ওর ভিতরে এক ধরণের শান্তি অনুভব হলো। মনে হলো আল্লাহপাক ওর সাথে যুবরাজের রিজিক বেঁধে দিয়েছেন বলেই ওদের দুজনার বিয়ে হয়েছে। এরমাঝে যুবরাজের ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। ও সুজানাকে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। কারণ সানজানার এই রুপটা ওর কখনও দেখা হয়নি। সুজানা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
—-কি দেখছো এমন করে?
—-তোমাকে দেখছি। ভীষণ সুন্দর লাগছে। নিস্পাপ মুখচ্ছবি। তোমার এই রুপ তো আমার দেখা হয়নি।
সুজানা জায়নামাজ থেকে উঠে পড়লো। জায়নামাজ টা ভাঁজ করে ক্লসেটে তুলে রেখে যুবরাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-এখন যাও ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসো।
—-তুমি শাড়ি পরে রেডী হয়ে থাকো। নাস্তা করে দু’জনে একসাথে ঘুরতে বের হবো।
যুবরাজ ওয়াশরুমে চলে গেল। এদিকে সুজানা বিপদে পড়লো। ওতো শাড়ি পড়তেই পারে না। সানজানা ওকে সবসময় শাড়ি পরিয়ে দিতো। এখন ও কি করবে? সুজানা মনে মনে একটা ফন্দি আঁটলো। যুবরাজ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সুজানার দিকে তাকিয়ে বললো,
— বিয়ে করে কি তোমার ঘাড়ে দুমণ বোঝা চাপিয়েছি?
—-মানে কি? তোমার কথার কোনো অর্থ বুঝতে পারছি না?
—-মুখটা ওরকম প্যাঁচার মতো করে রেখেছো কেন?
—-তোমার জন্য।
—-আমি আবার কি করলাম?
—-শাড়ি পরতে বললে কেন?
—-কেন তুমি তো সুন্দর করে শাড়ি পরতে পারো।
—-আমাকে সুজানা পরিয়ে দিতো।
—-ঠিক আছে। আজ আমি তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দিবো।
সুজানার ভীষণ অস্বস্তি হতে শুরু করলো। পৌষের এই শীতের মাঝেও ওর শরীর যেন ঘামতে লাগলো। ওর দিকে তাকিয়ে যুবরাজ বললো,
—শুধু তো শাড়ি পরিয়ে দিতে চেয়েছি এতেই তোমার ঘামাঘামি শুরু হয়ে গেল। আর তো সব কাজ এখন বাকি রয়ে গিয়েছে। তুমি ওয়াশরুমে গিয়ে শাড়ি আর ব্লাউজটা পরে আসো। আমি তোমাকে শাড়িটা পরিয়ে দিচ্ছি।
সুজানা শাড়ি ব্লাউজ আর পেটিকোর্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। সুজানাকে শাড়ি নিয়ে ওয়াশরুমে যেতে দেখে যুবরাজ বললো,
—-শাড়ি নিয়ে যাচ্ছো কেন?
সুজানা চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো। কিন্তু শাড়ি তো কিছুতেই পড়তে পারছে না। কুচিগুলো কেমন ছড়িয়ে যাচ্ছে। এদিকে যুবরাজের ফোনটা বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওর মা বলে উঠলো,
—-কিরে তোরা নাস্তা খাবি না?
—-এখনি আসছি আম্মু।
ফোনটা রেখে যুবরাজ ওয়াশরুমের দরজা নক করে বলছে,
—- আধঘন্টা হয়ে গেল তুমি এখনও বের হচ্ছো না কেন? ওদিকে আম্মু নাস্তা করতে ডাকছে।
সুজানা শাড়িটা সামাল দিতে না পেরে কোনো রকমে শরীরে পেঁচিয়ে বের হয়ে আসলো। ওকে এ অবস্থায় দেখে যুবরাজ হাসতে হাসতে বললো,
—-গরীবের কথা বাসি হলে ফলে। কি পরিয়ে দিবো নাকি এভাবে আম্মুর সামনে যাবে?
সুজানা আর কিছু না বলে মাথা নীচু করে শাড়ির কুঁচিগুলো ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। যুবরাজ মৌনতা সম্মতির লক্ষণ বলে সুজানার কাছে গিয়ে শাড়ির কুঁচিগুলো গুছিয়ে ঠিকঠাক করে দিতেই ওর হাত সুজানার নাভি স্পর্শ করলো। সুজানা লজ্জায় আড়ষ্টতায় চোখ বন্ধ করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। যুবরাজেরও ভিতরে কাঁপন লাগলো। জীবনের প্রথম নারীর ছোঁয়া ওকে যেন শিহরিত করে দিলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো সানজানাকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরতে। এতোদিন ওর সাথে সম্পর্কে ছিলো অথচ সানজানা কোনোদিন ওকে ঘনিষ্ট হওয়ার সুযোগ দেয়নি। একারণে সানজানার প্রতি ভালোবাসার সাথে সাথে এক ধরণের শ্রদ্ধাবোধ ওর কাজ করতো। শাড়িটা পরানো শেষ হলে যুবরাজ ওকে আয়নার সামনে নিয়ে গিয়ে বললো,
—-লজ্জাবতী, এবার চোখটা খুলে দেখুন আপনাকে কেমন লাগছে?
সুজানা আয়নার পানে দৃষ্টি মেলে ধরতেই অবাক হয়ে গেল। যুবরাজ একজন পুরুষ মানুষ হয়ে ওকে কি সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছে! এরপর যুবরাজের দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি এতো সুন্দর করে শাড়ি পরানো কার কাছ থেকে শিখেছো?
—-আম্মুর কাছ থেকে। আমি ছোটোবেলা থেকেই আম্মুকে শাড়ি পরতে সাহায্য করতাম। সেই থেকে আস্তে আস্তে শিখে গিয়েছি।
এরপর ওরা দুজনে নাস্তার টেবিলে গিয়ে বসলো। যুবরাজের আম্মু রুটি পরোটা দুটোই তৈরী করেছে। সবজি ডালভুনা আর কলিজা ভুনাও করেছে। সাথে পায়েশ আর রসে ভেজানো চিতই পিঠা তৈরী করেছে। সুজানা রুটি আর সবজি আর ডাল নিয়ে খেতে বসলো। যুবরাজ অবাক হয়ে সুজানার খাওয়া দেখছিলো। খাওয়া শেষে সুজানা পিঠা আর পায়েশ দুটোই খেলো। ওর খাওয়া দেখে যুবরাজ বললো,
—-দুধের জিনিস খেলে তো গ্যাসের সমস্যা হয়। তোমার এতো খাওয়া ঠিক না।
যুবরাজের বাবা ওকে বাঁধা দিয়ে বললো,
—ও পছন্দ করে খাচ্ছে ; ওকে খেতে দে। তুই বাঁধা দিচ্ছিস কেন?
যুবরাজের মা বললো,
—-আমি ওর কথা ভেবেই এগুলো বানিয়েছি। তোমার মুখে তো বার্গার স্যান্ডউইচ সুশি আরো কত কি নাম মনে পড়ছে না ওগুলো ছাড়া চলে না।
—-আম্মু আগে তো ও এগুলো কিছুই খেতো না। ভার্সিটির ক্যান্টিনে ওর পছন্দের খাবার ছিলো পরোটা আর দুধ চা। একবার বন্ধুরা মিলে মাওয়া ঘাটে গেলাম।গরম গরম রসগোল্লা বানাচ্ছিলো। আমরা সবাই খেলাম।ও কিছুতেই খেলো না। আমার তো সন্দেহ হচ্ছে?
সুজানা চমকে উঠলো। ওর এই চমকে উঠা যুবরাজের দৃষ্টিতে এড়ালো না। সে কারণে সুজানাকে চমকে দিয়ে বললো,
—ও মনে হয় সানজানার ভূত।
—-কি সব আবোল তাবোল বকছিস?
—-না আম্মু আমি ঠিকই বলেছি। যুবরাজের কথা শুনে সুজানা যেন হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচলো। ও ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। এই বুঝি যুবরাজ বলে বসে তুমি সানজানা না সুজানা।
যুবরাজের বাবা ও বুঝতে পেরেছেন সুজানা একটু ঘাবড়ে গিয়েছে। সে কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যুবরাজকে বললো,
—-তুই ওকে নিয়ে রমনা পার্কটায় একটু ঘুরে আয়।
যুবরাজ মুখে কিছু না বললেও বিয়ের পরের সানজানার সাথে বিয়ের আগের সানজানার কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছে না। আবার সুজানা কেনইবা বিয়ের দিন উপস্থিত থাকলো না। যুবরাজ কৌতূহল দমন করতে না পেরে বললো,
—-সানজানা, সুজানা আমাদের বিয়ের দিন থাকতে পারলো না কেন?
—তোমাকে তো বলেছি ;ও ওর ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ সিরিয়াস।
—-তাই বলে বোনের বিয়েকে উপেক্ষা করে?
—-আমাদের এই সুন্দর মুহুর্তে তুমি কেন সুজানার কথা তুলছো। আমরা এখন নিজেদের মতো করে সময় কাটাবো।
যুবরাজও আর কথা বাড়ালো না। মনের কৌতূহল মনেই চেপে রাখলো। যুবরাজদের বাসা ইস্কাটনে। ওর বাবা বিজনেস করেন। ওখানেই বারো’শ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্লাট কিনেছেন। ওদের বাসা থেকে রমনা পার্কটা বেশ কাছে। পার্কে পৌছে যুবরাজ ওর সুজানার ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড করে। সাথে সাথে অনেক লাইক কমেন্ট পড়তে শুরু করেছে।
এদিকে সানজানা কুয়াকাটা পৌঁছে হোটেলে উঠে দ্রুত লাঞ্চটা করে নেয়। ওর খুব ঘুম পাচ্ছে। লঞ্চের কেবিনে ঘুমটা আসলে গাঢ় হয়নি। একটু টেনশন তো ছিলোই। রুমে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে ফেসবুকে ঢুকা মাত্রই যুবরাজ আর সুজানার কাপল ছবিটা চোখে পড়লো। সাথে সাথে ওর বুকের ভিতরে তীব্র ব্যথা হতে লাগলো। ও ফেসবুক থেকে বের হয়ে এসে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলো। সেই কান্নার স্রোতে ও ওর যন্ত্রণাগুলোকে ভাসিয়ে দিতে চাইলো।
চলবে