তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৩

0
66

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

সুজানা শিহরিত তবে যুবরাজের সাথে কেন যেন সহজ হতে পারছে না। সে কারনে ওর বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললো,
“এমন একটা রোমান্টিক মুহুর্তে দুকাপ কফি হলে মন্দ হয় না।”
সুজানার কথায় যুবরাজ অবাক হয়ে বললো,
—-তুমি তো কফির গন্ধ সহ্য করতে পারো না। আজ হঠাৎ কফি খেতে চাইলে কেন? একসময় তোমাকে কতো জোর করেছি।কিন্তু কিছুতেই খাওনি।
যুবরাজের কথা শুনে সুজানা মনে মনে বললো,”বড্ড ভুল হয়ে গেল। আসলেই তো সানজানা দুধ চা খেতে পছন্দ করতো।”
পরিস্থিতি দ্রুত সামলাতে সুজানা বললো,
—-এখনও যে পছন্দ করি তা নয়। তোমার মন রক্ষার্থে বলেছি। তুমি খুশী হওনি।
—-কিন্তু তুমি তো কারো মন রক্ষার্থে কিছু বলো না। ভালো লাগুক কি খারাপ লাগুক অকপটে সব বলে দাও। তোমার এই আচরণটা আমার ভীষণ ভালো লাগে।
—আজ এই বিশেষ দিনে আমি তোমার খুশীর জন্য এটুকু করতেই পারি।
—-না,থাক কফি বানিয়ে কাজ নেই। তার চেয়ে আমরা দুজনা বসে চাঁদনী রাত উপভোগ করি।
সুজানা মনে মনে ভাবলো,ওকে আরো সতর্ক হতে হবে। তা,না হলে ধরা পড়ার ভয় আছে।
গল্প করতে করতে রাত গভীর হতে চললো। একসময় সুজানার চোখে ঘুম পরীরা নেমে আসতে শুরু করলো। যুবরাজ ওকে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে বললো। সুজানা চলে যাওয়ার পর যুবরাজ ভাবছে এই কয়দিনে মানুষের আচরণ এতো বদলে যেতে পারে? বিয়ের আগের সানজানার সাথে বিয়ের পরের সানজানার কোনো মিল ও খুঁজে পাচ্ছে না। ওর কাছে খুব অবাক লাগছে।

রাতে হঠাৎ সানজানার ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঘুম ভাঙ্গার সাথে সাথে প্রথমে একটু ধাক্কা খেলো। ও কোথায় বুঝতে পারছে না। মেন্টাল স্ট্রেস বেশী থাকার কারনে সব ক্যামন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। জানালা দিয়ে দৃষ্টি ওর বাইরে নিবদ্ধ হলো। এখন সবকিছু মনে পড়ছে। ওর শুধু টেনশন হচ্ছে সুজানা সব ঠিকঠাক মতো সামলাতে পারবে তো। এরাত নিয়ে ও আর যুবরাজ কতকিছু ভেবে রেখেছিলো।
মানুষ তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না নাকি যাকে অন্তরের সবটুকু আবেগ দিয়ে ভালোবাসে তাকে কখনও ভোলা যায় না। সানজানা ভাবছে ওকি কখনও যুবরাজকে ভুলতে পারবে? সানজানা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত তিনটা বাজে। পূর্ণশশীটা অস্তরাগে যেতে বসেছে। আবারও ও স্মৃতির আঙ্গিনায় হারিয়ে গেল।
সেদিন ছিলো পহেলা বৈশাখ। সানজানার কখনও নববর্ষ পালন করা হয়নি কিংবা ইচ্ছে করেই করেনি। কারণ ঐদিন সানজানার জন্মদিন। জন্মই যার আজন্ম পাপ তাই তাকে বরণ করার ইচ্ছে কোনোদিন সানজানার হয়নি। সেদিন ছুটির দিন থাকাতে সানজানা বাড়িতেই ছিলো। হঠাৎ সকাল এগারোটার দিকে যুবরাজের ফোন আসলো। রিসিভ করতেই আমাকে বললো,
—-হ্যালো সাঁজি, টিএসসি একটু আসতে পারবি?
—-কেন?
—-আসো তারপর বলছি। আজ একটু শাড়ি পরে আসবে?
—-না,ওসব শাড়ি টারি পরতে পারবো না। তাহলে আমি আসবো না।
—-আচ্ছা ঠিক আছে, তোমাকে পরতে হবে না। তুমি যেটাতে কমফোর্ট ফিল করো সেটা পরে আয়।
সানজানা জিন্স আর লম্বা ফতুয়া গলায় ওড়না পেঁচিয়ে মাথায় হেজাব পরে রওয়ানা দিলো। মনে মনে সানজানা প্রচন্ড বিরক্ত। কারণ রাস্তায় অসম্ভব ভীর থাকে আজকের দিনে। ধানমন্ডী সাতাশ নাম্বার থেকে গলির ভিতর দিয়ে আস্তে আস্তে চাঁদনিচকে পৌঁছালো। পরে সেখান থেকে অনেক কষ্টে টিএসসি পৌঁছালো। টিএসসি পৌঁছাতে ওর বিকেল হয়ে গেল। যুবরাজ ওকে নিয়ে নিরিবিলি একটা জায়গায় নিয়ে হাটু গেড়ে বসে সানজানার হাতে একটা বিশাল টকটকে লাল গোলাপ ফুলের তোড়া উপহার দিলো। সানজানা ওর আচরণে খুব অবাক হলো। ও নিজেকে খুব কন্ট্রোল করে রাখে। কারণ নদী যেমন সাগরের পানে ছুটে গিয়ে মিশে যেতে চায় তেমনি সানজানার কাছে যুবরাজ একটা সমুদ্রের মতন। সানজানা দেখতে সুন্দরী ছিলো বলে বড় হওয়ার পর থেকেই অনেকেই ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু ও জানতো ঐ পথ ওর জন্য নয়। তাই সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতো। কিন্তু আজ যেন যুবরাজের আহ্বানকে ও সরিয়ে দিতে পারছে না। ওর হৃদয় নদীতে প্রেমের জোয়ার উঠেছে। একুল ওকুল দুকুলই ভেসে যাচ্ছে। ওর হৃদয় নদীটা আজ যুবরাজ নামক এক মহাসাগরের অতলে মিশে যেতে চাইছে। ও যুবরাজের দিকে তাকিয়ে এসব আকাশ পাতাল ভেবে যাচ্ছে। যুবরাজ একসময় আঙ্গুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে ওকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছো কেন?
সানজানা বাস্তবে ফিরে আসলো। এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
—এসবের মানে কি?
—-কেবল তো শুরু, আরো চমক আছে।
এরপর যুবরাজ কেকের বক্সটা সানজানার সামনে মেলে ধরে বললো,
—-শুভ জন্মদিন।
সানজানার আচরণে যুবরাজ অবাক হয়ে গেল। কোথায় এই সারপ্রাইজে ও খুশী হবে সেটা না করে ওর চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগলো। ঘটনার আকস্মিকতায় যুবরাজ অবাক হয়ে বললো,
—-তুমি কি আমার কোনো আচরণে কষ্ট পেয়েছো?
চোখের পানি মুছে সানজানা ধরা গলায় বললো,
—আমার এসব পালন করতে ভালো লাগে না।
মনে মনে বললো,”আমার জন্ম তো আমাকে পূর্ণতা দেয়নি। হয়তো এটাই আমার জন্য মঙ্গল। কারণ মনে প্রাণে বিশ্বাস করি আল্লাহ তার বান্দার জন্য যা করেন সেটাতেই মঙ্গল লুকিয়ে থাকে।”
এরপর যুবরাজ সানজানাকে বললো,
—-আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি সাঁজি।তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিও না।
সানজানা চমকে উঠেছিলো। ও জানে এ ভালোবাসা মরিচিকার মতো। একে ছুঁতে গেলেই হারিয়ে যাবে। সেদিন সানজানা ওকে ফিরিয়ে না দিলেও নিজের দুর্বলতার কথা জানাতে পারেনি। মাঝে মাঝে সানজানা সাহসী হয়ে যুবরাজকে নিজের কথা বলতে চেয়েছিলো। ক্ষীণ আশার আলো দেখেছিলো। যদি যুবরাজ মেনে নেয়। পরক্ষণেই যুবরাজকে হারানোর ভয়ে সত্যিটা সানজানা বলে উঠতে পারেনি। পাঠকরা নিশ্চয় ভাবছেন সেই সত্যটা কি?
আসল সত্যটা হচ্ছে সানজানা দেখতে নারীর মতো হলেও ও পরিপূর্ণ নারী নয়। সেকারনেই ওর ভয়। যুবরাজ ওকে ক্রমাগত বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো। কিন্তু ওতো জানে বিয়ের পর যুবরাজের বায়োলজিক্যাল নিড ও মেটাতে পারবে না। ডাক্তারের শরনাপন্ন হয়ে যদি নিজেকে সারিয়ে তোলা যায় সেই ভরসায় সম্পর্কটাকে সানজানা এগিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে ওর শারীরিক কন্ডিশনে ডাক্তার জানিয়েছিলো অপারেশন করলেও ওর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ৫%। সে কারনে সানজানা মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙ্গে পড়ে। সানজানা তখন প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই করতে থাকে। নিজের সাথে নিজের টিকে থাকার লড়াই। যদিও সানজানা জানে ওর জন্মে কোনো লজ্জা নেই কিংবা এতে ওর কিংবা ওর বাবা মায়ের কারোরই দোষ নেই তবুও সমাজ কি ওদের ছেড়ে দিবে? সানজানার এই শারীরিক ত্রুটি জানাজানি হয়ে গেলে সমাজ ওকে নিয়ে কটুক্তি করতে ছাড়বে না। কিংবা বলবে ওর বাপ মায়ের পাপের ফল। এসব নানা প্রশ্নবানে ওদের পুরো পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে। এরকম হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই সানাজানার পরিবারের সদস্য ছাড়া ওদের আত্মীয়স্বজন কেউ সানজানার এই ত্রুটির কথা জানে না। আর দশটা মেয়ের মতো সানজানার হৃদয়ের আঙ্গিনায় ভালবাসার ফুলটা যুবরাজ নামক এক ভ্রমরের ছোঁয়ায় কেবলি তখন ফুটতে শুরু করেছে সেদিনও সানজানা নিজের আবেগকে কন্ট্রোল করেছে। কারণ ওর সত্যিটা ও যুবরাজকে বলার জন্য নিজেকে সেদিন প্রস্তুত করেছিলো। কিন্ত ও জানে সত্যিটা জানলে যুবরাজ ওকে ছেড়ে চিরদিনের মতো চলে যাবে।
একবার ছোটোবেলায় ওদের বাসায় হিজড়া এসে ওর খোঁজ করছিলো। কার কাছে ওরা কি শুনেছে কে জানে। কিন্তু ওর মা প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো। সেদিন ওকে হারানোর ভয়ে ওর মা ওকে বাথরুমে আটকে রাখে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে