তীর ভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০১

0
12

#ধারাবাহিক গল্প
#তীর ভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

বিয়ের আগের দিন বিয়ের কনে পালিয়ে গিয়েছে। তবে প্রেমিকের হাত ধরে নয়। বরং নিজের প্রেমিককে জমজ বোনের হাতে সঁপে দিয়ে পালিয়েছে। এটাকে এক অর্থে পালানো বলা যায় না। কেননা সানজানার চলে যাওয়াটা ওর পরিবারের সবাই জানে। তবে ওর মনে হচ্ছে নিজের কাছ থেকে ও পালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া যে আর কোনো কোনো অপশন সানজানার হাতে ছিলো না। পরিবারের সম্মান বাঁচাতে আজ ওকে এই কাজটা করতে হয়েছে। যুবরাজ ওর বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। সানজানাকে উনাদের ভীষণ পছন্দ। এরকম একটা কেয়ারিং পুত্রবধু নিজের ছেলের জন্য পেয়ে ওরাই বিয়ের জন্য তড়িঘড়ি শুরু করে। ওদের কেন যেন সানজানাকে হারানোর ভয় ছিলো।
সৎ পাত্রে কন্যা দান করতে পেরে যেখানে বাবা মা নিজেদের অনেক হালকা অনুভব করে সেখানে সানজানার পরিবারে উল্টা মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে। অর্থাৎ ওর বিয়ে ঠিক হওয়াতে বাবা মায়ের দুজনের অবস্থা ক্রিটিক্যালের পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। বাবার প্রেসার সিস্টেলিক ১৮০ আর ডায়াস্টোলিক ১১০। আর ওর মায়ের সুগার বেড়ে গিয়েছে। ও যদি যুবরাজকে বিয়ে করতো তাতেও ওদের পরিবারের এতোদিনের সম্মান ধুলায় মিশে যেতো। পরিবারের গোপন বিষয় প্রকাশ হয়ে যেতো। আর যদি বিয়ে না করে পালিয়ে যেতো তাতেও সম্মানহানি ঘটতো। সবাই ভাবতো ও হয়তো দ্বিচারিনী। যাক অসম্মানের হাত থেকে ওদের পরিবারটিকে বাঁচাতে সুজানা এগিয়ে এসেছে। এজন্য ও চিরকাল সুজানার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। অবশ্য যুবরাজের মতো ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বুয়েটে মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টে যুবরাজ ফাস্ট বয়। সামনের মাসে বুয়েটে টিচার হিসাবে জয়েন করবে। সানজানাও একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে। তবে ওর রেজাল্ট যুবরাজের মতো নয়। তবে একদম খারাপও না। এভারেজের একটু উপরে। যুবরাজকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে সুজানা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। যদিও সুজানা আর সানজানা দেখতে হুবহু এক তারপরও সুজানার টেনশন হচ্ছে। যদি কখনও যুবরাজের কাছে ধরা পড়ে যায় তখন ও কি করবে? সানজানা বলেছে পরের কথা পরে ভাবা যাবে। তবে এই মুহুর্তেটাকে আগে সামলে নিতে হবে।
সানজানা ব্যাগটা চেক করে আবারো দেখে নিলো পাসপোর্ট আর আইডি কার্ড নিয়েছে কিনা? কারণ এক সপ্তাহ পর ও লন্ডনের পথে পাড়ি জমাবে। ওখানে কিংস ইউনিভার্সিটিতে ও মাস্টার্সের প্রোগ্রামে ভর্তি হবে। মোটামুটি একটা প্রিপারেশন নিয়ে রেখেছিলো। ও মনে মনে এটাই ভেবে নিয়েছিলো । তবে ভয় ছিলো যুবরাজ যদি কোনো অঘটন ঘটায়? খুব নরম মনের মানুষ যুবরাজ।সানাজানা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না।
কারণ ওতো যুবরাজকে নিজের পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছে। তাই ও চায়নি বিয়ের পরে যুবরাজ ওকে নিয়ে মানসিক কষ্টে থাকুক। তবে যুবরাজের জন্য চিন্তা হচ্ছিলো। বেশ কিছুদিন থেকে এই বিষয়টা ওকে ভাবিয়ে তুলছিলো। সুজানার কাছে শেয়ার করাতে প্রথমে সুজানা রাজী হয়নি। পরে যখন সানজানা ওকে বললো,ওর পক্ষে যুবরাজকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তবে একথা যুবরাজকে জানালে ও একটা অঘটন ঘটাতে পারে। ওর আগে একটা ব্রেকআপ হয়েছিলো। তখন ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলো। সে সময় সানজানা ওর পাশে ছায়ার মতো থেকেছে। অবশেষে বিয়ের আগেরদিন সুজানা যুবরাজকে বিয়ে করার ব্যাপারে মত দেয়।
আসরের নামাজ পড়ে সানজানা আর সুজানা পারলারে যায়। সেখানে ঘন্টা দুয়েক বসে থাকে। সানজানার বুকের পাঁজরটা ভেঙ্গে যাচ্ছে। কিন্তু বাইরে থেকে তা বোঝার উপায় নেই। নিজেকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। সুজানার সাজানো কমপ্লিট হলে সানজানা পারলার থেকে বেরিয়ে আসে। লিফট দিয়ে নামার সাথে সাথে হিমেল বাতাসের ধাক্কা শরীরে এসে লাগে। সন্ধার আবীর তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। সানজানা একটা সিএনজি ভাড়া করে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সেখান থেকে আপাতত সুন্দরবন লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে করে বরিশালের পথে রওয়ানা দিবে বলে ঠিক করেছে। তারপর সড়ক পথে কুয়াকাটা যাবে।
আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে যত সহজ ভাবা যাচ্ছে সানজানার কাছে বিষয়টা অত সহজ ছিলো না। সানজানা যদিও জানতো ওর আর যুবরাজের ভালোবাসাটা কোনোদিন সফলতা পাবে না। তারপরও যুবরাজকে হারানোর ভয়ে ও ছেড়ে যেতে পারেনি। কারণ যুবরাজের সাথে যখন ওর প্রেমিকের ব্রেকআপ হয় তখন ও চরম ডিপ্রেশনে চলে যায়। সেসময় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে সানজানা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। তখন খুব কাছ থেকে যুবরাজের কষ্টগুলো অনুভব করেছে। তবে সানজানার বন্ধুত্ব কখন যে ভালোবাসায় পরিনত হয়েছে তা ও নিজেও জানে না।

পৌষের কুয়াশা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সিএনজির সাথে পাল্লা দিয়ে সানজানার চোখের পানি অঝোরে গড়িয়ে পড়ছে। ওর বাবা মা ওকে এভাবে একা বরিশাল যেতে দিতে প্রথমে রাজী হয়নি। কিন্তু সানজানাই জোর করে রাজী করিয়েছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সন্ধা সাড়ে ছ,টা বাজে। সুজানা নিশ্চয় এতোক্ষনে বিয়ের আসরে পৌঁছে গিয়েছে। সানজানা ওর মোবাইলটাও সুজানাকে দিয়ে এসেছে। আর ও সাথে করে একটা নতুন মোবাইল এনেছে। ও ভাবছে, যুবরাজকে নওশা সাজে নিশ্চয় খুব সুন্দর লাগছে। ওদের দুজনকে বেশ মানাবে।
এই পৃথিবীতে সবার জীবন একসুত্রে গাঁথা হয় না। যেমন ছোটোবেলা থেকে শুনে এসেছে ও পরীর মতো সুন্দর। অথচ ওর কপালে ঘরবর কিছুই জুটলো না। অথচ ওর সংসার করতে ভালো লাগে। হয়তো এই জীবনে সংসার নামক বন্ধন ওকে জড়িয়ে রাখবে না। যুবরাজকে নিয়ে সানজানা কতো স্বপ্নের জাল একসময় বুনেছে। অপ্রাপ্তির অনলে সেই স্বপ্নগুলো ওকে বাঁচিয়ে রাখার সাহস যোগাতো। আজ এগুলো সব মিথ্যা মনে হলেও এগুলোই একসময় ওর জীবনটাকে পরম আনন্দে ভরে রেখেছিলো। যেখানে আজ ওর থাকার কথা সেখানে আজ অন্যজন।
সব কিছু শেষ হলেও কোথাও না কোথাও এর রেশটুকু ঠিক থেকে যায়। তাই আজ আজন্ম লালিত বেদনাগুলো সানজানা চোখের জলের মাধ্যমে লাঘব করার চেষ্টা করছে।
গাড়ি সদরঘাট পৌঁছে গেল।সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে সানজানা আস্তে আস্তে লঞ্চে উঠে নিজের কেবিনে গিয়ে বসলো। দরজাটা লক করে দিলো।
সানজানারা আর্থিক দিক থেকে অনেক রিচ। ওর বাবার শিপিং এর বিজনেস আছে। এই লঞ্চের মালিক ওর বাবার বন্ধু। সে কারনে অতটা টেনশন লাগছে না। লঞ্চ ছাড়ার সাইরেন শোনা যাচ্ছে। মনে হয় একটু পরেই লঞ্চটা ছেড়ে দিবে। জানালা দিয়ে নদীর ঢেউগুলো দেখছে। আর ওর চোখের পানিগুলো নদীর মতো এঁকে বেঁকে ওর গাল দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত সাড়ে আটটা বাজে। এতোক্ষণে মনে হয় কবুল বলা হয়ে গেছে। কবুল বলার সাথে সাথে যুবরাজের উপর থেকে ওর সব অধিকারবোধগুলো হারিয়ে গেছে। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীরের সমস্ত হাড়গুলো যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভাঙ্গছে।
তারিখটা ঠিক মনে হয়। তবে সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস তখন শুরু হয়েছে। সেদিন ক্লাসরুমে কেউ ছিলো না। যুবরাজের সব বন্ধুরা ক্লাস থেকে বের হয়ে গেছে। সানজানা বের হতে যাবে এমন সময় যুবরাজের দিকে চোখ পড়লো। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো। একটা পরিনত বয়সের ছেলের চোখে জল। ও আস্তে আস্তে যুবরাজের দিকে এগিয়ে গেল। পাশে গিয়ে বসে সানজানা টিস্যু দিয়ে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
—-তুমি কাঁদছো কেন? তোমার মতো ব্রিলিয়ান্ট ছেলের চোখে পানি মানায় না।
যুবরাজ চোখের পানি মুছে শুকনো হাসি হেসে বললো,
—-তোমার কি ধারণা পুরুষের অন্তর পাথর দিয়ে গড়া।
—-না আমি সে কথা মিন করে বলিনি।
সানজানা তখনও ভাবেনি এই যুবরাজকে ও একদিন ভালোবেসে ফেলবে। তবে ওরা খুব ভালো বন্ধু ছিলো। হয়তো প্রথম দিন থেকে সানজানা যুবরাজের কাছ থেকে বন্ধুত্বের বিশ্বাসটা অর্জন করতে পেরেছিলো। তাই সেদিন যুবরাজ ওর একান্ত ব্যাক্তিগত কথাগুলো সানজানার কাছে খুলে বলতে পেরেছিলো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে