তীরভাঙ্গা ঢেউ পর্ব-০৫

0
6

#ধারাবাহিক গল্প
#তীরভাঙ্গা ঢেউ
পর্ব-পাঁচ
মাহবুবা বিথী

নিজের আজকের এই অবস্থার জন্য ও কাউকে দোষারোপ করে না। কারণ যদি দোষারোপ করতেই হয় তাহলে সবার আগে ওর নিজেকে দোষারোপ করা উচিত। এই প্রেম ওর বোকামীর ফসল। প্রেমে পড়লে মানুষ বোকা হয়ে যায় সানজানা যেন নিজের ক্ষেত্রে তাই অনুভব করলো।
রুমের লাগোয়া বারান্দায় এসে সানজানা গার্ডেন চেয়ারটায় বসে দূরে সাগরের ঢেউগুলো দেখতে লাগলো। আর মনে হতে লাগলো, প্রেম ভালোবাসা অনেকটা গাছের মতন। বীজ থেকে প্রথম গাছ হয়। তারপর সেই গাছটা বৃদ্ধি পেয়ে শাখা প্রশাখায় বিস্তার লাভ করে। তারপর সেই গাছ ফলে ফুলে শোভিত হয়। যদি মাঝপথে গাছটার অকাল মৃত্যু ঘটে তাহলে এসবের কিছুই হয় না। ভালোবাসাও তেমনি। দুটো মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসে তারপর তারা বিয়ে করে সংসার সাজায়, সেখানে তাদের সন্তান হয় ভালোবাসাও আস্তে আস্তে বিস্তার লাভ ঘটে। কিছু মাঝপথে ভালেবাসাটার মৃত্যু ঘটলে সব কিছু থেমে যায়।
সানজানার কিছুই ভালো লাগছে না। ভাবনার জগতে বিচরণ করতে গিয়ে কতোটা সময় পার হয়ে গিয়েছে ওর সেদিকে খেয়াল নেই। রুমের ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে বেলা তিনটা বাজে। ও লাঞ্চ করেনি কিংবা করতে ইচ্ছা হয়নি। ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে যোহর আর আসরের কসর নামাজ আদায় করে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে বীচের দিকে হাঁটতে লাগলো। সাগরের বিশুদ্ধ বাতাস, উত্তাল ঢেউয়ের সৌন্দর্য যদি ওর মনটাকে ভালো করে দিতে পারে? ও আস্তে আস্তে হেঁটে গিয়ে পানিতে নেমে পড়ে। কতদূর হেঁটে গিয়েছে ওর মনে নেই। পানিতে নেমে মনে হতে লাগলো একটা ঢেউ এসে যদি ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতো তাহলে অন্তর্দহনের জ্বালা থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারতো। এমনসময় একটা ঢেউ এসে ওকে ধাক্কা দিলো। প্রায় পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে পরক্ষণেই মনে হলো, এ ও কি ভাবছে? এরকম চিন্তা করা পাপ। ও তাড়াতাড়ি পানি থেকে উপরে উঠে আসলো। ওর মনে হলো যত দ্রুত ও দেশের বাইরে চলে যাবে ততই ওর জন্য মঙ্গল হবে। আজ রাতে সুজানা আর যুবরাজ ওদের বাসায় আসবে। কাল ওরা হানিমুনের উদ্দেশ্য থাইল্যান্ডে যাবে। সানজানা আগামীকাল রাতের বাসে ঢাকায় ফিরবে। এরপর একসপ্তাহের মধ্যে ইউকে তে পাড়ি জমাবে। ওর মনে হলো দূরে গেলেই ও একমাত্র যুবরাজকে ভুলে থাকতে পারবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকাল হলো। যুবরাজ ওর বউকে রেডী হতে বললো। আজকের রাতটা যুবরাজ শ্বশুরবাড়িতে কাটিয়ে কাল সকাল দশটার ফ্লাইটে হানিমুনের উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ডের পথে রওয়ানা দিবে। রাতটা থেকেই খুব ভোরে যুবরাজ বউকে নিয়ে বাসায় ফিরতে হবে। বাবা মায়ের সাথে দেখা করে এয়ারপোর্টে চলে যাবে। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় যুবরাজের বাবা ওকে মিষ্টি কিনে শ্বশুরবাড়িতে যেতে বললেন। যুবরাজ নীচে নেমে গ্যারেজ থেকে ওর বাইকটা বের করলো। হেলমেট পরে নিয়ে আর একটা হেলমেট সুজানার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
—-এটা পড়ে নাও।
বাইক দেখে সুজানা চমকে উঠে বলে,
—-,আমি বাইকে চড়বো না।
—-কেন?
—-আমি কখনও বাইকে চড়ি নাই।
—-আমার সাথে পুরোটা সময় প্রেম করলে বাইকে চড়ে আর এখন বলছো তুমি কখনও বাইকে চড়ো নাই?
সুজানা যুবরাজের কথায় হোঁচট খেলো। আসলে ওতো এখানে সুজানা নয় ওতো সানজানা। পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললো,
— আমি বলতে চেয়েছিলাম, শাড়ি পরে আমি কখনও বাইকে চড়ি নাই।
—-কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তুমি দু,একবার শাড়ি পরে আমার বাইকে উঠেছো।
—-আমার মনে নেই। তবে এখন আমি চড়তে পারবো না। বাইকটা রেখে চলো আমরা রিকশা করে যাই। আমার রিকশায় ঘুরতে খুব ভালো লাগে।
—তাতো জানি,কিন্তু অনেকটা পথ যেতে হবে।
—-ইস্কাটন থেকে মোহাম্মদপুর খুব একটা দূর নয়।
সুজানার তাগাদায় যুবরাজ গ্যারেজে বাইকটা রেখে দিলো। এরপর সুজানাকে নিয়ে রিকশা করে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পথ থেকে যুবরাজ পাঁচকেজি মিষ্টি কিনে নিলো। শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছানোর পর সুজানার বাবা মা যুবরাজকে সুজানার সাথে স্বাভাবিক আচরণ করতে দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। কিন্তু সুজানার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ দেখে ওর মা জিজ্ঞাসা করলেন,
—-সব ঠিক আছে তো মা।
—-আছে কিন্ত আমি তো ঠিক থাকতে পারছি না। প্রতিমুহুর্তে ধরা পড়ার ভয় আমাকে তাড়িত করছে। ওর সাথে তোমাদের কথা হয়েছে? ওখানে সব ঠিকঠাক আছে তো?
—-আছে,তোরা থাইল্যান্ডে রওয়ানা দিলে ও ঢাকায় ফিরে আসবে।
রাতে খাবার টেবিলে যুবরাজ ওর শ্বশুরকে বললো,
—-বাবা,সুজানা কবে ফিরবে?
সুজানার কথা বলাতে উনি সামনে বসা সুজানার দিকে তাকালেন। পরিস্থিতি সামলাতে সুজানার মা বললো,
—-তুমি তো সানজানার কাছে শুনেছো ও কতোটা ক্যারিয়ারিস্ট। আসলে চাকরিটা একটা বিদেশী সংস্থায় হয়েছে। দুদিন ট্রেনিং হবে। এরপর হয়তো পোস্টিং দেশের বাইরে হবে।
—তাহলে কি ওর সাথে আমার দেখা হবে না?
—-কেন হবে না? এ বাড়ির জামাই যখন হয়েছো তখন আজ না হোক কাল অবশ্যই দেখা হবে।

পরদিন খুব ভোরে যুবরাজ আর সুজানা ইস্কাটনে ফিরে আসলো। এরপর লাগেজপত্র নিয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেল। এয়ারপোর্টের সব আনুষ্টানিকতা শেষ করে ওরা লাউঞ্জে প্লেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। নিদিষ্ট সময়ে বিমানে উঠে পড়লো। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ওরা ব্যাংককে পৌঁছে গেল।
সুবর্ণভূমি বিমান বন্দরে নেমে একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ওরা পাতায়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। পথে একটা বাঙ্গালি রেস্টুরেন্টে শাক ডাল ভর্তা আর ডিমভুনা দিয়ে ভাত খেয়ে নিলো। হোটেলে পৌঁছে যুবরাজ ওয়াশরুমে ঢুকলো। গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে রুমে এসে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে নিলো। মিররের সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনী করার সময় সুজানার দিকে চোখ পড়লো। সুজানা একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যুবরাজ সেদিকে তাকিয়ে বললো,
—-এভাবে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে কি দেখছো?
—-না তেমন কিছু না
—তা বললে তো হবে না। তোমাকে বলতেই হবে কি ভাবছো?
–তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে।
—তুমি আমার পুরো শরীরের অলিগলি দেখে নিতে পারো। চাইলে খুলে দেখাতে পারি। আমি পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো মানুষটাই সুন্দর।
—ছিঃ এসব নোংরা কথা বলতে তোমার মুখে আটকায় না?
—-,গাঙ পাড়ার কারো সাথে তো বলছি না। নিজের বিয়ে করা বউয়ের সাথে বলছি।
যুবরাজের ভাবসাব সুজানার কাছে কেমন যেন লাগছে। সেকারনে সে সোফা থেকে উঠে নিজের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতেই যুবরাজ হ্যাঁচকা টানে নিজের বুকের কাছে টেনে আনলো। তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
—বিয়ে নিয়ে আমার কতকিছু কল্পনা ছিলো। আর বিয়ের পর থেকেই তুমি কেমন যেন দূরে দূরে থাকছো। এখানে কিন্তু আমি সবকিছু উসুল করে নিবো।
সুজানা যুবরাজকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।

সানজানা রাতের বাসে ঢাকায় ফিরে আসলো। ওর জীবনের একটা অধ্যায় সাঙ্গ হলো। আর একটা অধ্যায়ের সুচনা হলো। ওর জীবনে যা ঘটে গেল তাকে এখন ওর মেনে নিতে হবে। অবশ্য ওর সিদ্ধান্তেই এই অধ্যায়ের সুচনা হয়েছে। সানজানা ভাবছে ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় বটে। তবে তা ঠিক না ভুল তা শুধু সময়ই বলে দিতে পারে। আজ ওর কেন যেন মনে হচ্ছে,যুবরাজকে ভালোবাসার সিদ্ধান্তটা হটকারী সিদ্ধান্ত ছিলো। বরং এখন ওর জীবন থেকে যুবরাজকে সরিয়ে দিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে সানজানা মাস্টার্স প্রোগ্রামে ইউকে তে পাড়ি জমালো। কিম্তু যে কারনে এতো দূরে চলে আসলো বাস্তবিক অর্থে সেই মানুষটাকে কি ও ভুলতে পেরেছে? পারেনিতো। দূরে যাওয়া মানে শুধুই দূরে যাওয়া ভুলে যাওয়া নয়। মানুষ মাঝে মাঝে এমন অনেক কাজ করে যা সে করতে চায়নি। কোনো মানুষ কি পারে তার ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যে হাতে তুলে দিতে? পারে না। কিন্তু সানজানাকে পারতে হয়েছে। কারণ সানজানা চায়নি যুবরাজ ওকে নিয়ে অসুখী থাকুক।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে