তিমিরে ফোটা গোলাপ পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
1007

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩২
Writer তানিয়া শেখ

ইসাবেলার পায়ের ক্ষত অনেকটা শুকিয়ে এসেছে। এখন ক্রাচে ভর করে একটু আকটু চলতে পারে ও। কিন্তু নিকোলাসের কড়া বারণ খুব বেশি হাঁটা যাবে না। ইসাবেলা সে কথা প্রায়ই অমান্য করে। আগের মতো দু’পায়ে জোর লাগিয়ে হাঁটতে চায় ও। এভাবে দিনরাত নিকোলাসের ঘাড়ে বসে সেবা শুশ্রূষা নিতে ওর আর ভালো লাগছে না। নিকোলাস পাশে শায়িত এই মুহূর্তে। ইসাবেলা উঠে বসল। সাবধানে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে ক্রাচে ভর করে দাঁড়ায়। এমন না যে ওর উঠে দাঁড়ানোর শব্দে নিকোলাসের ঘুম ভেঙে যাবে। তবুও এভাবেই উঠল। রোজ ওঠে। জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। আঙুলের ডগা দিয়ে পর্দার কোনাটা সামান্য সরিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। রৌদ্রময় সকাল। অদূরে গমের খেতের মাঝে উইন্ডমিলটা শ্লথ গতিতে ঘুরে যাচ্ছে। মাঠ জনমানবহীন। জানালার পাশে ও প্রায়ই বসে থাকে। তাকিয়ে দেখে দূরের দিগন্ত বিস্তৃত গম খেত। প্রথম প্রথম দু এক একজন লোক দেখা গেলেও ইদানীং একেবারে কাওকে দেখে না। আশেপাশে মানুষের সাড়াশব্দও তেমন নেই। কেবল মাঝে মাঝে গাড়ি চলার শব্দ আর ফায়ারিং শোনে। যুদ্ধ যে কবে শেষ হবে! এভাবে এখানে থাকতে ভয় যে করে না তা নয়। তবে সেই আগের মতো অতটাও নয়। তাছাড়া সাথে যখন নিকোলাস আছে ওর আর ভয় কীসের! ঘাড় ঘুরিয়ে নিকোলাসের নিদ্রিত মুখের দিকে তাকাল। সটান হয়ে শুয়ে আছে ও। বুকের ওপর হাত ভাঁজ করা। নিকোলাসের আপাদমস্তকে এক লহমায় চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর দৃষ্টি স্থির হলো মুখের ওপর। অনেকদিন সেভ না করাতে দাঁড়ি বেশ বড়ো হয়েছে। ইসাবেলার দাড়িওয়ালা লোক পছন্দ ছিল না। কিন্তু আজ ওর মনে হলো- দাড়িতেও আলাদা রকমের সৌন্দর্য বিরাজ করে। মৃদু মাথা ঝাঁকাল। ফের ঘুরে দাঁড়ায় জানালার বাইরে মুখ করে। সেদিনের ওমন রূঢ় ব্যবহারের পর নিকোলাসের সাথে তেমন কথা বলে না ও। হ্যাঁ, নাতেই জবাব দেয়। এর পরের দুদিন ও একাই পায়ের ক্ষতে ড্রেসিং করেছে। সকাল সকালই কাজটা করত যেন নিকোলাসের সাথে এ নিয়ে কথা না বলতে হয়। জেগে উঠে নিকোলাস একবার তাকিয়ে ছিল ওর পায়ের নতুন ব্যান্ডেজের দিকে। তারপর ওর মুখের দিকে। ইসাবেলা ভেবেছিলাম কিছু বলবে, কিন্তু কিছুই বলেনি। চুপচাপ বেরিয়ে গিয়েছিল বাইরে। কখন ফিরত ইসাবেলা জানে না। হয়তো ভোরে কিংবা আগেই। মাঝে মাঝে নিচের তলায় পায়ের শব্দ পেত। লিভিয়া চলে যাওয়ার পর এ বাড়িতে আর নতুন কেউ আসেনি। এমনকি ওই ডাক্তারও না। প্রথমে একটু ভয়ে পেয়েছিল লিভিয়ার সেই কথাগুলো মনে করে। কিন্তু না, খারাপ কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি। পরে আন্দাজ করে নিয়েছে ওটা হয়তো নিকোলাস হবে। ইসাবেলার সাথে একই ঘরে থাকতে ওর ভালো লাগছিল না বলেই আসেনি ওপরে৷ তবে ভোরে কেন আসে? তখনও না আসলেই পারে। ওইটুকু করুণা না করলেই কি নয়? নিজেকে আজ ওর কেবলই বোঝা মনে হয়। নিকোলাসের ওপর আর বোঝা হয়ে থাকতে চাইছে না। চোখ জ্বলছে কেন যেন। এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না৷ ক্রাচে ভর করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। শব্দহীনভাবে লক খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ছোট্ট কড়িডোরের এককোণে সিঁড়ির ধাপ। ওদের রুমের আগেও আরো একটা রুম আছে। সামনে এগোবে কি না ভাবল। পেছন ফিরে রুমের ভেতরে দেখল আরেকবার৷ নিকোলাসকে এখান থেকে ভালোভাবেই দেখা যাচ্ছে। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছে। কী ভাবছে ইসাবেলা ফের পালাবে? মনে মনে হাসল কথাটা ভেবে ইসাবেলা। দরজাটা ভিজিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোলো। সামনের রুমটা লক। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে ওর বেজায় কষ্ট হলো। পড়ে যাওয়ার একটা ভয় ছিল। সব ভয় ডর কাটিয়ে ও নিচে নামে। কাঠের এই বাড়িটি বেশ সাদামাটা। গ্রামের সাধারণ আর সকল ঘরের মতোই ছোট্ট কিচেন, ডাইনিং এর সাথে বসার ঘর আর দুটো রুম। সদর দরজা লক করে পর্দা টেনে দেওয়া।

এইটুকু নামতে ইসাবেলার ঘাম ছুটে গেছে। ব্যাটারি চালিত ফ্যানটা চালাবে বলে সুইচ টিপল। না, ঘুরছে না ফ্যান। ডাইনিংএর চেয়ার টেনে বসল। ক্রাচটা রাখল চেয়ারের একপাশে। চুলটা খোঁপা করে হাত বাড়িয়ে সামনের বোতল টেনে আনে। পানি ভেবে ছিপি খুলে মুখের কাছে আনতে বুঝতে পারে এতে পানি না ভদকা। তৃষ্ণা মিটাতে সেটা গটগট করে গলায় ঢাললো। অর্ধেকটা শেষ করে বোতলটা পুনরায় টেবিলের ওপর রেখে দেয়। ভদকার ঝাঁঝ এখনও গলায় টের পাচ্ছে ও। ভদকাতে ও অভ্যস্ত নয়। দ্রুত নেশা চড়ে যায়। তৃষ্ণা মিটতে পেটের ছুঁচোটা ছটফট শুরু করল। টেবিলে ভদকার বোতল আর কয়েকটা গ্লাস উলটানো ছাড়া কিছু নেই। ইসাবেলা ক্রাচে ভর করে আবার উঠল। নিকোলাস রোজকার মতো আজও হয়তো খাবার রেখেছিল রুমে। কিন্তু ইসাবেলা ওই খাবার খেতে ওপরে উঠবে না। সেই ধৈর্য, ইচ্ছে অথবা বল কোনোটাই নেই ওর মধ্যে এই মুহূর্তে। খিদে পেটে বসে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। বসার ঘরের জানালার পর্দাটা সামান্য সরিয়ে জানালা খুলতে মৃদু বাতাস এসে লাগল গায়ে। সকালের রোদ মেশানো বাতাসে প্রশান্তি না পেলেও এতক্ষণে হাসফাস ভাবটা খানিক কমে গেল। পিঠ লাগিয়ে বসল জানালার সাথের সোফাটাতে। এইটুকুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে ও। অনেকক্ষণ বসে রইল থম ধরে। তারপর জানালার দিকে বেঁকে বসল। পর্দা পুরোপুরি সরিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছে না। বন্ধ বাড়িতে ওকে কেউ দেখে ফেললে শেষে আরেক বিপদ। সোফার পেছনে বাহু রেখে মাথাটা এলালো তার ওপর। এভাবে বসে বেশ বাতাস লাগছে গায়ে। বসার ঘরটা দোতলার ওদের থাকার রুমের ঠিক নিচে। ওই যে গম খেতের সেই ঘুরতে থাকা উইন্ডমিল দেখতে পাচ্ছে এখানে বসে। আনমনে সেদিকে চেয়ে রইল। এই মুহূর্তের নিঃসঙ্গতা ওকে কত কী ভাবায়। খালি পেটে ভদকাটা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছে। যত আবেগ ছিল সব ঠেলে বের করে আনছে। জীবনের গত হওয়া সবটুকু যেন ভেসে ওঠে চোখের সামনে। বুক ভারী হয়ে উঠল হঠাৎ।

“ইসাবেলা”

চমকে তাকায় সামনে ইসাবেলা। আগাথা দাঁড়িয়ে বসার ঘরের মুখে।

“আগাথা!” সোজা হয়ে বসল ও। আগাথা এগিয়ে এলো। বসল ওর মুখোমুখি। ইসাবেলার টলমল চোখে চেয়ে শুধাল,

“ঠিক আছো তুমি?”

মাথা ঝাঁকাল,

“না, একদমই ঠিক নেই আমি আগাথা।” ওর চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল পড়ল। আগাথা দুবাহুতে জড়িয়ে ধরে ইসাবেলাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে চোখ মুছল ইসাবেলা। এভাবে কেঁদে ফেলা উচিত হয়নি ওর। কেন যে কাঁদল! নেশাটাই যত নষ্টের মূল।
লজ্জায় মুখ নুয়ে ফেলে। আগাথা হাঁপ ছেড়ে ওর মাথায় হাত রাখেন।

“কী হয়েছে?”

“কিছু না।”

“ইসাবেলা, তাকাও আমার দিকে।”

ইসাবেলা তাকাল আগাথার দিকে। আগাথা পরম মমতায় ওর গালে হাত রাখল। ওর বাদামী চোখে চেয়ে বলল,

“তোমার এই চোখ কারো কথা মনে করিয়ে দেয় আমাকে ইসাবেলা।”

“কার?”

আগাথা ম্লান হাসল। কিন্তু ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বলল,

“এখান থেকে রিগা বেশিদূর নয় ইসাবেলা। তোমার পা সেরে উঠতেই নিকোলাস তোমাকে সেখানে রেখে আসবে।”

“আমি জানি।” বিড়বিড় করে বলল ইসাবেলা।

“কিছু একটা করতে হবে আমাদের। যে করেই হোক তোমাকে আবার ফিরতে হবে নিকোলাসের প্রাসাদে।”

“এ অসম্ভব এখন।”

“এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে হবে তোমাকে ইসাবেলা। হাতে সময় কম আমাদের।”

“আমি পারব না আগাথা। আমার দ্বারা এ কাজ হবে না। আমাকে ক্ষমা করুন।”

চাহনি কঠিন হয় আগাথার।

“এত দুর্বল কেন তুমি?”

“কারণ আমি দুর্বল। দুর্বল আমি আগাথা। এই যে এক পায়ে গুলি খেয়ে বোঝা হয়ে আছি আপনার ছেলের ওপর। আমি সবার ওপর শুধু বোঝা হয়ে উঠি।”

অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল ইসাবেলা। আগাথার দৃষ্টি নরম হলো। কিছু বলবে তার পূর্বে দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলাম ঢং ঢং শব্দ করে জানান দেয় বারোটা বাজে। আগাথা হতাশ মুখ উঠে দাঁড়ায়।

“সুযোগ পেলে আবার আসব আমি ইসাবেলা। এর মধ্যে কিছু একটা ভেবে স্থির করে ফেলব। তারপর যা বলব তাই করবে তুমি। ভ্যালেরিয়ার কথা মনে রেখো। তোমার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছে ও। ওর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা তোমার কর্তব্য। ওর আত্মার শান্তির জন্য সেই কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করবে বলে আশা রাখি আমি। আর হ্যাঁ, ভদকা তোমার জন্য ঠিক না। আর খাবে না ওটা।”

ইসাবেলাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল আগাথা। ভ্যালেরিয়ার কথা স্মরণ করেও আজ ইসাবেলার দুর্বল মন কিছুতেই শক্ত হতে পারল না। কিছুতেই ফিরে এলো না প্রতিশোধস্পৃহা। প্রতিশোধের আগুন না জ্বললে কী করে নিকোলাসকে শেষ করবে? ওকে এবং ওর পরিবারকে শেষ করেই তো ভ্যালেরিয়ার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে হবে। মনটা এমন করছে কেন আজ? কেন জোর পাচ্ছে না প্রতিশোধের? দুর্বল মনটাকে তিরস্কারে তিরস্কারে জর্জরিত করে তুললো ও।

“বেলা?” বসার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে নিকোলাস। না, ইসাবেলার কোনো জবাব নেই। এমনকি ফিরে পর্যন্ত দেখল না ওকে। সেদিনে সেই রূঢ় ব্যবহারের পর থেকে এমন করছে ও নিকোলাসের সাথে। আগের মতো কথা বলে না, কথা বলতে গেলে না পেরে হ্যাঁ, নাতেই কোনোরকমে জবাব দেয়। ইসাবেলার এই আচরণ নিকোলাসকে রাগিয়ে দেয়। কিন্তু মেজাজ যথাসাধ্য শান্ত রাখে। ভাবে একদিক থেকে ভালোই হয়েছে ইসাবেলা এমন করায়। এতে ওর প্রতি জন্মানো মায়া খুব বেশি বাড়বে না। নিজেকে এবং নিজের অনুভূতিকে বশে রাখতে পারবে। তাই তো ও নিজেও দুরত্ব বাড়াচ্ছে।

“বেলা, তোমাকে আমি ডেকেছি।” রুক্ষ গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা একপ্রকার অবহেলিত গলায় বলল,

“শুনছি আমি।”

“তোমাকে রুম ছেড়ে বেরোতে নিষেধ করেছিলাম আমি। কেন নিচে নেমেছ?”

“দমবন্ধ হয়ে আসছিল আমার ওই রুমে।”

“আমার জাগা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারোনি?”

ইসাবেলা মুখ ফেরাল ওর দিকে। একটু আগের কান্নায় ওর নাক মুখ লাল হয়ে আছে। নিকোলাসের দিকে ক্ষুব্ধ চোখে চেয়ে গলা চড়িয়ে বলল,
“না, পারিনি। অনেক করুণা করেছেন আমার ওপর। আপনার করুণার চাপে দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। আর করুণা নিতে পারছি না। তাছাড়া সেদিন বলেছিলেন না, “সব ব্যাপারে এত পরনির্ভরশীল কেন তুমি, হ্যাঁ? কী ভাবো? আজীবন তোমাকে কোলে করে ঘুরে বেড়াব? এক পা আহত হয়েছে অন্য পা তো ঠিক আছে। চেষ্টা করো নিজে নিজে।” খুশি হন। সেটাই করছি আমি।”

দাঁতে দাঁত কামড়ে আগের মতো মুখ ঘুরিয়ে রইল ইসাবেলা। নিজের বলা কথা এখন ইসাবেলার মুখ থেকে শুনে মোটেও ভালো লাগল না নিকোলাসের। সেদিন কথাগুলো রাগের মাথায় বলে বসেছিল। ইসাবেলার ওর সাথে সহজ হয়ে উঠছে। এক মন দারুন খুশি তাতে। কিন্তু অন্য মন বেজার। নিকোলাস টের পাচ্ছিল ইসাবেলার দৃষ্টির পরিবর্তন। ঘৃণা নেই, রাগ নেই। নিকোলাসকে ও একটু একটু করে নিরাপদ আশ্রয় ভাবতে শুরু করেছিল। হয়তো এমন চললে একদিন ভালো লাগাটাও হয়ে যেত। কোনো একদিন নিকোলাস আশা করেছিল এই পরিবর্তন। এখানে আসার পর যখন ওর মধ্যে তেমনই লক্ষণ দেখতে পেল নিকোলাস মনে মনে দারুন আনন্দিত হয়েছিল। কিন্তু সেই আনন্দ ছিল ক্ষণিকের। ওর পৈশাচিক মন মনে করিয়ে দিলো ইসাবেলা আর ও কোনোদিন এক হতে পারবে না। ইসাবেলার এই পরিবর্তনকে প্রশ্রয় দেওয়া মানেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনা। নিজেকে ধ্বংস করতে এত ত্যাগ করেনি নিকোলাস। শত শত বছরের শ্রম সে এক মেয়ের জন্য নষ্ট করবে না। এই পৃথিবীতে একছত্র অধিপত্যে গড়ে তুলতে চায় ও। ওর আর ওর স্বপ্নের মাঝে কাওকে আসতে দেবে না, কাওকে না। থাক মুখ ঘুরিয়ে ইসাবেলা। এতে ওর ভালো, নিকোলাসের নিজেরও ভালো। কিন্তু কান্নায় লাল হওয়া ইসাবেলার নাক আর মুখ দেখে ওর মনের মধ্যে কাঁটা ফুটতে লাগল। কেন কাঁদছিল জানতে বড়ো ইচ্ছে হয়। কান্নার কারণ ও কি না এই ভেবে ভেবে অশান্তি শুরু হলো মনে৷ এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইসাবেলাকে এই অবস্থায় দেখতে পারছে না। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে সদর দরজার ফাঁক গলে বেরিয়ে যায় নিকোলাস।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৩
Writer তানিয়া শেখ

আজ একটা সন্দেহজনক ঘটনা ঘটল। আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত দুজন মানুষকে দেখেছে নিকোলাস। নৈশ তৃষ্ণা মিটিয়ে ফিরছিল লিভিয়ার বাড়ির দিকে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে সোভিয়েত সৈন্যদের গাড়ি যাচ্ছিল। নিকোলাস ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে দরজা গলে ঘরের ভেতরে ঢুকল। সৈন্যদের গাড়ির শব্দ যতক্ষণ শুনতে পেয়েছিল নিচতলাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। ওরা চলে যেতে ও বসার ঘরে গিয়ে বসল। আর তখনই শব্দটা কানে এলো। শব্দটা তীব্র নয়। সাধারণভাবে কারো কানেই লাগবে না হয়তো কিন্তু নিকোলাসের লাগল। সতর্ক হলো ও। উঠে দাঁড়ায় নিঃশব্দে। পর্দা সরিয়ে দেখা রিস্ক হবে। কারণ শব্দটা আসছে ঠিক ওদিক দিয়ে। ও হাওয়ায় মিশে গেল। উত্তরদিকের জানালার ফাঁক গলে বেরিয়ে এলো বাইরে। বাড়ির পেছনের গম খেতে দাঁড়িয়ে ছিল সেই আপাদমস্তক কালো কাপড়ে আবৃত মানুষ দুটো। নিকোলাস অদূরের উইন্ডমিলের কাছাকাছি নিজেকে আড়াল করে দাঁড়ায়। লোকদুটোর ভাবগতিক ও দেখতে চেয়েছিল। একদৃষ্টে ওরা ঘাড় তুলে তাকিয়ে ছিল দোতলার ওই ঘরটাতে যেখানে ও আর ইসাবেলা থাকে। হঠাৎ ইসাবেলার ছায়া পড়ে জানালায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে জানালার দিকে। একটানে সরিয়ে দিলো পর্দা। ফ্রেন্স জানালার কবাট খুব সাবধানে খুললো। একেবারে খুললো না। ওর হয়তো গরম লাগছিল বলে সামান্য একটু ফাঁকা করে দিলো জানালা। তারপর সরে গেল সেখান থেকে। মানুষ দুটো ওর ছায়া দেখে পরস্পরের দিকে চেয়ে মাথা নাড়ায়। ওদের এই আচরণ নিকোলাসকে চিন্তিত করে। সিদ্ধান্ত নেয় শেষ করে ফেলবে ওদের। শ্বদন্ত বেরিয়ে এসেছিল, চোখ দুটো পৈশাচিকতায় জ্বলজ্বল করছিল। ও ছুটে আসবে ঠিক তখনই ডান পাশের বাড়ির সামনে গুলাগুলি শুরু হলো। সৈন্যদের চিৎকার আর সাধারণ মানুষের আহাজারিতে একটু দৃষ্টি সরেছিল। ওই একটুখানি সময়েই বাড়ির পেছনের মানুষদুটোকে হারিয়ে ফেলে নিকোলাস। কোথাও আর খুঁজে পাওয়া গেল না। চিন্তিত মুখে ফিরে এলো। ভোর হলে ও মৃতের ন্যায় হবে। তখন যদি ওরা আক্রমণ করে? আগের মতো নিশ্চিন্তে ওপরে শুতে পারবে না আজ। এ বাড়ির সবটা নিকোলাস নখদর্পনে। বেসমেন্টের এককোণে ছোট্ট খুপরি মতো স্থান আছে। বড্ড নোংরা আর স্যাঁতসেঁতে। ইঁদুর, মাকড়শার অভাব নেই সেখানে। ঠিক করল আজ ওখানেই ইসাবেলার থাকার ব্যবস্থা করবে। নিজের জন্য অন্য চিন্তা করল। আজ আর এ বাড়িতে থাকবে না। ঝুঁকি নিতে নারাজ ও। বেসমেন্টের এই জায়গাটা যতদূর পারা যায় পরিস্কার করল। এখনও থাকার জন্য পুরোপুরি উপযোগী না। একটুখানি কাঠের ছিদ্র ছাড়া আর কোনো জায়গা নেই আলো বাতাস ঢোকার। কাঠের দেওয়ালের গায়ে গায়ে এখনও মাকড়শা, পোকামাকড় নির্ভয়ে হাঁটছে। নিকোলাসের হাতে সময় কম। বেসমেন্টের পুরোনো জিনিসের মধ্যে হাতুড়ি আর লোহার রড পেল ও। সেগুলো দিয়ে ঘিরে দেওয়া কাঠের তক্তার তিনটে আলাদা করে। এখান থেকে গম খেত খুব বেশি দূরে নয়। কাঠের তক্তা তিনটে আবার কোনোরকমে বসিয়ে দেয় আগের মতো। নিচের একটা ঘর থেকে একটা ম্যাট্রেস আর বালিশ এনে রাখল সেখানে। হ্যারিকেন জ্বালিয়ে একনজর দেখে নিলো। ইসাবেলার বোধহয় এখানে থাকতে সমস্যা হবে। যে গরম পড়েছে! এর মাঝে এই আলো-বাতাসহীন বদ্ধ জায়গায় থাকাটা কষ্টকর। ইসাবেলাকে সবটা বললে নিশ্চয়ই কষ্টটা ও করবে। এছাড়া উপায়ও নেই আর। নিকোলাস ওপরে উঠে এলো। ইসাবেলা বসেছিল বিছানায় পা ঝুলিয়ে জানালা মুখী হয়ে। নিকোলাস রুমে ঢুকতেও ফিরে দেখল না। কিন্তু ওর মনোযোগ সম্পূর্ণই নিকোলাসের উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে। ওর পাশের বিছানার ম্যাট্রেস বসে গেল। সোঁদা মাটির পরিচিত গন্ধটা এবার খুব কাছ থেকে পাচ্ছে ইসাবেলা। বিছানা শক্ত করে ধরল হাত দুটো। তাকাবে না তাকাবে করেও তাকাল পাশে। শ্যেনদৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওর দিকে নিকোলাস। চোখ সরিয়ে নিলো ইসাবেলা। টের পাচ্ছে বুকের ভেতরের ঢিপঢিপানির শব্দটা ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। ওর আজকাল মনে হয় অল্প বয়সেই হার্টের অসুখে ধরবে। তারপর একসময় হার্ট ফেল করে মরে যাবে।

“তোমাকে আমি নিষেধ করেছিলাম জানালার কাছে না যেতে।”

ইসাবেলার জিহ্বা ভার হয়ে আছে। কোলের ওপর রাখা হাতদুটো অস্থির। নিকোলাস ভেবে এসেছিল এই মেয়ের সাথে কথা কাটাকাটি এড়িয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে? নিকোলাস অবাধ্যতা, অসম্মান একদম সহ্য করতে পারে না। এই মেয়ে সেটাই করবে। আবার এখন কথার জবাব দিচ্ছে না।

“বেলা?”

“উম,, আমার গরম লাগছিল।” মিনমিনে গলায় বলল ও। নিকোলাস কপাল চুলকে বলে,

“হাত পাখা কী করেছ? গরমের জন্য ওটা ছিল তো?”

ইসাবেলা এই জীবন্মৃত পিশাচকে কী করে বুঝাবে সারাদিন একটানা পাখা ঘুরাতে কত কষ্ট হয়। নিকোলাসের ব্যথাবোধ না থাকলেও ইসাবেলার আছে। সারাদিন হাতপাখা ঘুরাতে ঘুরাতে হাতটাই ব্যথা হয়ে গেছে। কপট রাগে মুখ ফুলিয়ে রইল।

“কতবার বলেছি কথা জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকবে না। আজ তোমার এই ভুলের জন্য কী হয়েছে জানো?”

“কী হয়েছে?” চকিতে তাকাল নিকোলাসের দিকে।

নিকোলাস সব ঘটনা খুলে বলতে আতঙ্কিত হয়ে উঠল ইসাবেলা।

“তাহলে লিভিয়া ঠিকই ছিলেন। আমার মন বলছিল লিভিয়ার কথা ফলবে। এখন কী হবে? লোকগুলো কী মতলবে এসেছিল ঈশ্বর জানে। আমার ভয় করছে নিকোলাস।”

নিকোলাসের দিকে ফিরে বসল ও। ওর বিপন্ন মুখে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল নিকোলাস। রাগটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। অনেকদিন এভাবে পাশাপাশি বসে না দুজন। অনেকদিন এভাবে কথা বলেনি। আজ নিকোলাসের মনে হলো- ভীষণ মিস করছিল ইসাবেলা কণ্ঠে নিকোলাস ডাকটা। ভীষণ মিস করছিল ইসাবেলার ওই ডাগর নয়নের চাহনি।

“নিকোলাস!”

দৃষ্টি সরিয়ে নিলো নিকোলাস। উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

“আপাতত নিচে একটা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান পেয়েছি। চলো দেখাচ্ছি।”

ইসাবেলা ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। নিকোলাস বিছানা থেকে ওর হাত পাখা আর ব্যান্ডেজ নিলো এক হাতে অন্য হাতে হ্যারিকেন। ইসাবেলা ক্রাচে ভর করে ঠুক ঠুক করে ওর পিছু পিছু হাঁটছে। দরজা খুলে ওরা করিডোর পেরিয়ে সিঁড়ির মাথায় এলো। সেদিন সিঁড়ি বেয়ে উঠতে নামতে গিয়ে ইসাবেলার বেহাল অবস্থা হয়েছিল। আজ তাই সিঁড়ি দেখে থমকে দাঁড়ায়। তার ওপর আজ রাত। নিকোলাসের হাতের হ্যারিকেনের সলতে কমিয়ে রাখা হয়েছে। ওইটুকু আলোতে ক্রাচের সাহায্যে সিঁড়ি পার হওয়া কম ভীতির নয়।
নিকোলাস দু সিঁড়ি নেমে ওর থেমে যাওয়াতে ঘুরে জিজ্ঞেস করল,

“সমস্যা?”

“না।”

নিকোলাস জানে ইসাবেলা মিথ্যা বলছে। তবুও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ইসাবেলা লম্বা শ্বাস নিয়ে সিঁড়িতে এক পা রাখে। পায়ে খুব চাপ লাগে এই সময়। ঠোঁট দু’টো শক্ত করে ভয়ে ভয়ে সাবধানে এক পা এক পা করে নামছিল। ওকে দেখে নিকোলাসের খারাপ লাগল। সেদিনের ওই ব্যবহারে মনে মনে অনুতপ্ত কম হয়নি। কিন্তু ইগো বজায় রাখতে এড়িয়ে গেছে ইসাবেলাকে। এখন আর তা পারল না। হাতের জিনিস সিঁড়ির নিচে রেখে ওর দিকে উঠে এলো। ইসাবেলাকে কিছু ভাবার অবসর না দিয়ে কোলে তুলে নেয়। চমকে নিকোলাসের গলা জড়িয়ে ধরে ইসাবেলা। সশব্দে নিচে পড়ে যায় ক্রাচটা। হতবুদ্ধি হয়ে ইসাবেলা বলল,

“কী করছেন?”

“সাহায্য।”

“আমি সাহায্য চাইনি। আমার এক পা এখনও ঠিক আছে। সেদিন একাই নেমেছিলাম আজও পারব। নামান।”

নিকোলাস ওর কথা উপেক্ষা করে কোলে তুলে নামতে লাগল। ইসাবেলা রেগে যায়।

“নামাতে বলেছি আপনাকে নিকোলাস। নামান বলছি।”

“চুপচাপ কোলে থাকো নয়তো ছুঁড়ে ফেলে দেবো নিচে।”

“তাই দেন তবুও ভালো।”

নিকোলাসের এই স্বেচ্ছাচারিতাকে অপছন্দ করে ইসাবেলা। ইচ্ছে হলো সাহায্য করল, ইচ্ছে হলো তিক্ত কথা শুনিয়ে দিলো। কেন এমন করবে?

“আ’ম সরি।”

“হুঁ?” অবিশ্বাস্য চোখে নিকোলাসের মুখের দিকে তাকাল ইসাবেলা। নিকোলাস বিরক্ত হওয়ার ভান ধরে বলল,

“কানে খাটো তুমি?”

“হ্যাঁ, আরেকবার বলেন।”

“মেজাজ খারাপ করবে না। আমি জানি তুমি শুনেছ।”

“না, শুনিনি। আবার বলেন সরি।”

নিকোলাস সিঁড়ির নিচে নেমে এসে থামল। ইসাবেলার নিষ্পাপ ভাব ধরে থাকা মুখটার দিকে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,

“তুমি সত্যি একটা নির্বোধ।”

“হুম, এখন বলেন কী বলছিলেন। একটু একটু শুনেছি সসস __?”

“আ’ম সরি, বেলা। আ’ম রিয়েলি সরি। আমার ওভাবে বলা উচিত হয়নি। শুনেছ এবার। আবার বলব?”

ইসাবেলা মাথা নাড়ায় সামনে পেছনে। সে শত, সহস্র বার শুনতে চায় নিকোলাসের সরি। নিকোলাসের রুক্ষ আচরণে এতদিন যে অভিমানের পাহাড় জমিয়ে তুলেছিল আজ সব ধসে গেল। এত আনন্দ হচ্ছে ওর যে ঠোঁট দুটো হাসবে বলে প্রসস্থ হতে চায়। ঠোঁট শক্ত করে হাসি চেপে আছে। নিকোলাস ঝুঁকে আসতে হাসিটা স্তব্ধ হয়ে গেল। ওদের মুখটা এখন খুব কাছে। শুকনো ঢোক গিলে আমতা আমতা করে ইসাবেলা বলল,

“লাগবে না। শুনেছি।”

“কেন আরেকবার শোনো, তারপর আরেকবার এভাবে অনেকবার। আজ না হয় ভোর পর্যন্ত আমি তোমাকে সরি বলব। এটা আমার শাস্তি হোক। তোমার মনে কষ্ট দেওয়ার শাস্তি হোক আমার।”

মুখ ওর ঠোঁটের কাছে এনে চাপা সম্মোহনী গলায় বলল নিকোলাস। ইসাবেলা টের পাচ্ছে নিকোলাসের ভারী শ্বাস পড়ছে ওর ঠোঁটের ওপর। ইসাবেলার হাত দুটোর বাঁধন আরও শক্ত হলো ওর গলায়। নিকোলাস ওর ঠোঁটে কোণে চুমু দিতে গিয়ে থেমে যায়। কী করতে যাচ্ছিল এসব? মুখ সরিয়ে নেয়। ঠোঁটের কোণের দুষ্টুমি মিলিয়ে গিয়ে সেখানে জেগে ওঠে গম্ভীরতা। ইসাবেলাও বিব্রত, লজ্জিত। গলা থেকে হাত ছাড়িয়ে কাঁধে হাত রেখে মুখ নুয়ে রইল। ওর কাছে মনে হলো আজও নিকোলাস অন্যবারের মতো ওকে বিব্রত করতে মজা করেছে। কপট রাগে দাঁত কামড়ে বলল,

“আমাকে নামান।”

“চুপচাপ থাকো বেলা। যখন নামানোর নামিয়ে দেবো।”

“আমাকে বারবার লজ্জা দিয়ে খুব আনন্দ হয় তাই না? আমারও দিন আসবে। এর শোধ আমিও নেবো।”

মুখ ঘুরিয়ে নিলো ইসাবেলা। কান্না পাচ্ছে এখন ওর। নিকোলাস কোনো কথা বলল না। নিজেকে বরাবরই কন্ট্রোলে রেখেছে ও। কিন্তু ইদানীং ইসাবেলার কাছে এলে সেই কন্ট্রোল হারিয়ে বসে। হ্যাঁ, এটা সত্য আগে যতবার ইসাবেলার কাছে এসেছিল সবটা মজাচ্ছলে। ইসাবেলাকে দুর্বল বলে প্রমাণ করতে। কিন্তু আজ যা করেছে তাতে কোনো মজা ছিল না। দুর্বলতা একা ইসাবেলার নয় ওরও প্রকাশ পেয়েছে। এসব কারণে দুরত্ব বাড়িয়েছিল। ইসাবেলার ওপর অকারণে রাগ দেখিয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ সব ভেস্তে গেল। নিকোলাসকে মানতে হলোই ও দুর্বল ইসাবেলা প্রতি। ওর দু ঠোঁটের নেশা ওকে রক্তের নেশার থেকেও বেশি কাবু করে। ইসাবেলার সান্নিধ্যে এলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে। একে কী বলে? নিছক শারীরিক আকর্ষণ, না আরও কিছু? যাই হোক নিকোলাস এই আকর্ষণ কাটিয়ে উঠবে, উঠতেই হবে ওকে।

বেসমেন্টে এসে ইসাবেলাকে নামিয়ে দিলো নিকোলাস। ম্যাট্রেস দেখিয়ে বলল,

“এখানে বসো আমি আসছি।”

নিকোলাস চলে যেতে সংকীর্ণ জায়গাটাতে ভালো করে নজর বুলিয়ে নিলো ইসাবেলা। ভ্যাপসা বিশ্রী গন্ধে নাক কুঁচকায়। ম্যাট্রেসের মাথার দিকের দু হাত দূরের মোমটা পুড়ে অর্ধেক হয়েছে। মোমের আলোতে ভূতুড়ে লাগছে আশপাশটা। খচখচ করে ইঁদুর দৌড়ে গেল এখান থেকে ওখানে। নিজেদের এতদিনের বসতিতে মানুষের উৎপাত পছন্দ হলো না বোধহয়। কিচকিচ করে ডাক ছেড়ে তাই যেন জানান দিচ্ছে। নিকোলাসের ওই পরিত্যক্ত পুরোনো প্রাসাদ, গুহা আর জঙ্গলের অভিজ্ঞতার দরুন ইসাবেলার আজ আর ভয় করছে না। গুহার ভেতর সাপও দেখেছিল। আর জঙ্গলে সেই জোঁকের কথা স্মরণ করতে ওর শরীর কাঁপুনি দিয়ে ওঠে। এখানে নিশ্চয়ই ওসব থাকবে না। পা তুলে ম্যাট্রেসে বসল।

“দুপুর পর্যন্ত এখানে থাকতে পারবে?”

হাতে দুটো প্যাকেট নিয়ে ঢুকল নিকোলাস। খুপরির মুখটা ভারী লম্বা দুটো কাঠ দিয়ে বন্ধ করে দিলো। প্যাকেট রেখে আবারও জিজ্ঞেস করল,

“পারবে?”

মাথা নাড়াল ইসাবেলা। সে বেশ পারবে। তাছাড়া নিকোলাস পাশে থাকতে ভয় কীসের!
একটু আগে দুজনের মধ্যে যা হয়েছিল নিকোলাস তা ভুলে সহজ হতে চাইছে। কিন্তু ইসাবেলা সহজ হলে তো! কেমন মুখ ফুলিয়ে আছে। গলা ঝেড়ে নিকোলাস মাথার দিকের দেওয়ালের কাঠ দেখিয়ে বলল,

“এই যে দেখছ কাঠের তক্তা তিনটে, এটা আমি খুলে কোনোরকমে লাগিয়ে রেখেছি। দুপুরের আগে যদি ওরা এখানে আসে এবং বেসমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দেয় তাহলে এখান দিয়ে বেরিয়ে যাবে। সামনের গম খেতের পূর্ব দিকে গেলে জঙ্গল পাবে। সেখানেই থেকো আমি খুঁজে নেবো।”

“আপনি এখানে থাকবেন না?”

“আমি অন্য কোথাও থাকব।”

“কোথায়?”

নিকোলাস সে কথার জবাব না দিয়ে প্যাকেট দেখিয়ে বলল,

“এখানে খাবার আর পানীয় আছে। খিদে পেলে খেয়ে নিয়ো। নিরাপদে থেকো বেলা।”

ইসাবেলার স্থির দৃষ্টি এড়িয়ে নিকোলাস হ্যারিকেন নিভিয়ে দিলো।

“কোনো রকমের আলো জ্বালাবে না।”

মোমবাতির আলো ফু দিয়ে নিভাতে বেসমেন্টের এই খুপরি ঘরে ঘুটঘুটে আঁধারে ঢেকে যায়। কিছুক্ষণ ইসাবেলা নিকষ কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখল না চোখের সামনে। আস্তে আস্তে চাঁদের আলো এসে ঢুকল কাঠের ফাঁকফোকর গলে। সেই আলোতে নিকোলাসকে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যেতে দেখল আলোর ভেতর দিয়ে। সেদিক একদৃষ্টে চেয়ে রইল ও। বিষণ্ণ মুখখানা আরও করুণ হয়ে ওঠে। চোখ দুটো করে টলমল।

চলবে,,,

#তিমিরে_ফোটা_গোলাপ
পর্ব–৩৪
Writer তানিয়া শেখ

গুমোট এই খুপরির মধ্যে ইসাবেলার খুব কষ্ট হচ্ছিল। গরমে ওর গায়ের মেরুন রঙা ফ্রকটা ভিজে সেঁটে আছে চামড়ার সাথে। অসহ্য লাগল একপর্যায়ে। তার ওপর ইঁদুর আর পোকামাকড়ের উপদ্রব। রাতে দুচোখের পাতা কিছুতেই এক করতে পারল না। বেলা বাড়তে গুমোট ভাবের সাথে যুক্ত হলো সূর্যের তাপ। হাতপাখা চালাতে চালাতে ওর হাত ধরে এলো। অতিরিক্ত ঘামে শরীর দুর্বল। ও যেন নিজে থেকে একটু জোর করল ঘুমানোর জন্য। সারারাত একটু আতঙ্কে ছিল এই বুঝি নিকোলাসের বলা ওই লোকগুলো এলো। কিন্তু না, এখনও তাদের নামগন্ধ নেই। আর আসবে বলে মনে হলো না। সুতরাং ইসাবেলা এই অসহ্য পরিস্থিতি কাটাতে ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। দুপুর পর্যন্ত ঘুমালেই হবে। তারপর তো নিকোলাস আসবে। তখন নিশ্চয়ই এখানে আর থাকতে হবে না। পরিস্থিতি মানুষকে কত কিছু মানিয়ে নিতে শেখায়। ইসাবেলাও তেমনই মানিয়ে নিলো। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ঘুমিয়ে পড়ল ও। ঘুমের মধ্যে আজ একটা নতুন স্বপ্ন দেখল। পাহাড়ের ওপর সবুজ ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ও। দু’হাত পেটের ওপর। ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি। একটা পরিচিত পুরুষালি হাত এসে থামল ওর গালের একপাশে। লজ্জায় লাল হলো ও। মানুষটা সরে এলো। কাঁধে চুমু দিতে লাগল। ইসাবেলা দুচোখ বন্ধ করে তার উষ্ণতা অনুভব করে। গালে রাখা হাতটা ওর মুখটাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে নেয় মানুষটার কাছে। গভীর চুম্বন দেয় ঠোঁটে। ইসাবেলা আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় মানুষটার চোখে। চমকে ওঠে সাথে সাথে। কিন্তু পরক্ষণেই শান্ত হয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গলা। টেনে আনে নিবিড় আলিঙ্গনে। ঠোঁটের কোণে মানুষটার মুচকি হাসি টের পায়। দুচোখ আবার বন্ধ করে ও। একই ছন্দে নড়ে দু’জোড়া ঠোঁট, দুটো জিহ্বা। হঠাৎ একটা শব্দে স্বপ্নটা ভেঙে গেল। ইসাবেলা চোখ মেললেও নড়েচড়ে না। ওর সমস্ত শরীর যেন জমে গেছে। কী দেখল ও? ওর মনে হচ্ছে এখনও ঠোঁটের ওপর, মুখের ভেতর সেই উষ্ণতা টের পাচ্ছে। নিকোলাসের চুম্বনের উষ্ণতা। বেশ বড়োসড়ো ঢোক গিললো। লজ্জায় কান গরম হয়ে গেল। হৃৎস্পন্দন তীব্র হলো। এমন স্বপ্ন কেন দেখল তাই ভেবে দিশেহারা হয়। মাথার ওপর থেকে আবার শব্দটা এলো। সজাগ হয় ইসাবেলা। স্বপ্নের রেশের আবেশ ঠেলে সরিয়ে উঠে বসল। কেউ হাঁটছে বাড়ির ভেতর। বেসমেন্টে বসে ও স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে সেই শব্দ। গলা শুকিয়ে এলো। নিকোলাসের দেখিয়ে দেওয়া তক্তার দিকে চোখ গেল। এখনই কি বেরিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? না আরেকটু দেখবে? হয়তো ওরা বেসমেন্ট পর্যন্ত আসবে না। ইসাবেলা ভাবতে ভাবতে সতর্কে ওপর থেকে আসা সেই পায়ের শব্দ শুনছে। কিছুক্ষণ শব্দটা থেমে গেল। বোধহয় দোতলায় উঠেছে ওরা। ইসাবেলা ক্রাচটা খোঁজে। বলা তো যায় না যদি নিচে নেমে আসে ওরা? বা’পাশেই ক্রাচটা পড়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ওটা নিতে ওর শরীর হিম হয়ে এলো। একটা পায়ের শব্দ সিঁড়ি ধরে বেসমেন্টে নেমে আসছে! কোনো কিছু না ভেবে ক্রাচে ভর করে উঠে দাঁড়ায়। তক্তা তিনটে নিঃশব্দে আলগা করার চেষ্টা বৃথা যায়। শব্দ হলো তক্তা সরাতে গিয়ে। ও শুনল পায়ের শব্দটাও থেমে গেল তখনই। ভয়ে তাড়াতাড়ি কাঠ সরিয়ে বেরিয়ে আসতে গিয়ে হাতে পায়ে কাঠের সাথে লাগা লোহায় খোঁচা খায়। তবুও থামে না। ক্রাচে ভর করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর যত দ্রুত পারে গম খেতের দিকে যেতে লাগল। সূর্যটা আস্তে আস্তে মাথার ওপর সরে আসছে। আশেপাশে জনমানব নেই। বাড়িটা গম খেত থেকে একটুখানি উঁচুতে ছিল। ইসাবেলা খেতে নামতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে। কোনোমতে উঠে দাঁড়ায় আবার। ক্রাচটা তুলে নেয়। গম পেকে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। গমের শস্যদানার সাথে থাকা সুচের মতো সুরু ধারালো বস্তু আর পাতার ধারালো কোণা ইসাবেলার হাতে, পায়ে একটার পর একটা আঘাত করতে লাগল। সব উপেক্ষা করে ইসাবেলা এগোচ্ছে। খেতের প্রায় মাঝামাঝি এসে ও একটু দম নিলো। পেছন ফিরে তাকাল একবার। অনেকদূর চলে এসেছে ও। লিভিয়ার বাড়িটা খুব বেশি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। রোদের চোটে চোখের সামনেটা ঝাপসা বলে বোধহয় এমন হলো। তবুও একটা জিনিস চোখে পড়ল। ওরা যেই ঘরে ছিল সেখানকার জানালাটা খোলা। এক অস্পষ্ট মুখ দেখা যাচ্ছে জানালার কাছে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখ মুছে ফের তাকাল। এবার একটু স্পষ্ট হলো সামনের দৃশ্য। বুকটা যেন ধ্বক করে ওঠে। ক্রুর হাসি ঠোঁটে তাকিয়ে আছে লোকটা। ইসাবেলার মনে হলো এই হাসি এবং মুখটা ওর চেনা। কিন্তু মনে করতে পারল না। ভয়ে বসে পড়ল সেখানে। দাঁড়িয়ে গেলে লোকটা ওর পথ চিনে যাবে। এতে নিকোলাস পর্যন্ত পৌঁছাতে ওদের সুবিধা হবে। ইসাবেলা চায় না ওরা নিকোলাসের ক্ষতি করুক। অথচ, ওই একদিন মারতে চেয়েছিল, চেয়েছিল নিকোলাস শেষ হোক। তাহলে আজ কী হলো ওর?

“ও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। উপকারীর অপকার করার শিক্ষা আমার মা দেয়নি।”

আপনমনেই জবাব দিলো ইসাবেলা। ওর মন জানে এই কথাগুলো পুরোপুরি সত্য নয়। এরপরেও কিছু কথা আছে। কিছু কথা মানুষ মনে রাখলেও মুখে আনতে চায় না।
হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে লাগল ও। কয়েকদিনের অনাবৃষ্টিতে মাটি লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। শক্ত মাটির ওপর হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগোতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। জীবনের এই পর্যায়ে এসে বুঝেছে টিকে থাকার সংগ্রাম সহজ না। পরিবারের সাথে থাকা ওই জীবন আর এই জীবনে আকাশ পাতাল তফাত। তাতিয়ানার কথাটা আজ ভীষণ মনে পড়ল। ওই যে বলেছিল,

“বড্ড নিষ্পাপ তুই ইসাবেল। পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা থেকে মা তোকে আড়াল করে রেখেছে। একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছিস তুই। আমি এখন মনেপ্রাণে চাই ঘোরটা তোর না কাটুক। কারণ, তোর মতো সকলে নিষ্পাপ না রে। ভয়টা এখানেই আমার।”

ইসাবেলার ঘোর এখন বুঝি কেটে গেছে। তাতিয়ানার ভয় সত্যিতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে ও। বুঝেছে জীবন মায়ের ক্রোড়ের সেই কোমলতা নয়। সতেরো বছরের সুখী জীবন এখন কেবল অতীত। আঠারো বছরের বর্তমানের প্রতি মুহূর্ত ভয় আর আতঙ্কে ঘেরা। মৃত্যু ছায়া হয়ে ওরই সাথে হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছে। সুযোগ পেলে হামলে পড়বে ওর ওপর। টেনে বের করে নেবে প্রাণপাখিটা। ইসাবেলা মরতে চায় না। এই পৃথিবীর রূঢ় বাস্তবতা সত্ত্বেও কিছু সৌন্দর্য তো আছে। ইসাবেলা তাই উপভোগ করতে চায়। স্বপ্নটার কথা আবার মনে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। মাথা নাড়িয়ে বিড়বিড় করে,

“স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। স্বপ্ন কখনও সত্যি হয় না। স্বপ্ন ভ্রম। মনের ভুল। আমি এবং আমার মন কেবল পিটারের।”

জঙ্গলটা কোনদিকে দেখার জন্য সামান্য মাথা তুললো। ঠিক পথেই এগোচ্ছে ও। আর বেশি দূরেও নেই জঙ্গল। হামাগুড়ি দিয়ে খেতের শেষ এসে থামল। হাতের তালু, হাঁটুর চামড়া ছিঁড়ে গেছে। অল্প অল্প রক্ত পড়ছে। ফ্রকের নিচটা দিয়ে রক্ত মুছতে গিয়ে ব্যথায় ককিয়ে উঠল। মাটি, খরকুটো লেগে লেপ্টে আছে রক্তের সাথে। সবটা পরিষ্কার করার ধৈর্য নেই। ওভাবেই উঠে দাঁড়ায়। মনে পড়ল ক্রাচটা ভুলে রেখে এসেছে। এখন উপায়? আশেপাশে তাকিয়ে একটা মোটা ডাল পেল। ওটাতে ভর করে জঙ্গলে প্রবেশ করে ইসাবেলা। কোনদিকে যাবে স্থির করতে না পেরে কাছাকাছি একটা মোটা গাছের ছায়ায় বসল। ক্লান্ত লাগছে খুব। নিকোলাস বলেছিল জঙ্গলে থাকলেই খুঁজে নেবে। ইসাবেলার আর এগোনোর শক্তি নেই। ও ঠিক করল এখানেই অপেক্ষা করবে। পা মেলতে হাঁটুর ব্যথা সমস্ত শরীরের রগে রগে ঝিলিক দিয়ে উঠল। দাঁত কামড়ে হাত দিয়ে সোজা করে মেলে দিলো পা দুটো। এইটুকুতেই হাঁপিয়ে ওঠে। শরীর ছেড়ে দেয় গাছের গায়ে। বেশ বাতাস বইছে। ছায়াতরুর তলে বসে চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসে। ভাবনাজুড়ে তখন একটা ব্যাপারই ঘুরপাক খায়-কে ছিল ওই লোক? কেন চেনা লাগল ওই মুখ? স্মৃতি হাতরেও এর জবাব ও পায় না। কেমন ধোঁয়াশা হয়ে জড়িয়ে আছে যেন লোকটার মুখ। ধোঁয়াশা কাটানোর চেষ্টা করতে করতে খানিক পরেই ঘুমিয়ে পড়ল ইসাবেলা।

একটা পরিত্যক্ত বাড়ির বেসমেন্টে দুপুর পর্যন্ত ছিল নিকোলাস। জেগে উঠে রওনা হলো লিভিয়ার বাড়ির দিকে। মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিল না ইসাবেলাকে একা রেখে এসে। ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়ে বাড়ির কাছাকাছি আসতে থেমে যায়। তিনটে পুরুষলোক বেরিয়ে এলো সদর দরজা দিয়ে। কালো আলখেল্লা পরা। দুজনকে ও গতকালই দেখেছে। কিন্তু চেনেনি। তৃতীয়জনকে সাথে সাথে চিনে ফেলল। নিকোলাস পিছিয়ে গেল। এমন না ও ভয় পায় তৃতীয় ব্যক্তিকে। কিন্তু সময় এবং স্থান ওর অনুকূলে না। বোকা নয় নিকোলাস। ঝোঁকের বসে ভুল পদক্ষেপ কিছুতেই নেবে না। ইসাবেলার জন্য চিন্তা হলো ওর। ও কি ঠিক আছে? এরা নিকোলাসের এখানে থাকার কথা জানলো কী করে সেটাই ভেবে পেল না ও। এত সহজ নয় নিকোলাস পর্যন্ত পৌঁছানো। তবে কী করে এখানে এলো এরা? তৃতীয় ব্যক্তিটি মাথায় হুডি তুলে গাড়িতে বসল। বাকি দুজন বসল সামনে। গাড়ি চলে যেতে নিকোলাস বাড়ির পেছন দিকে যায়। তক্তা খোলা। অর্থাৎ ইসাবেলা পালিয়েছে। নিকোলাস জঙ্গলে মুখ করে ফের হাওয়ায় মিশে যায়। বাতাসে ইসাবেলার ঘ্রাণ খুঁজতে খুঁজতে ওকে পেয়ে গেল জঙ্গলের বড়ো গাছটার নিচে। স্বস্তি পেল নিকোলাস। নিঃশব্দে ওর কাছে এসে এক হাঁটু ভেঙে বসল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ইসাবেলা। ওর হাত আর পায়ের ক্ষত চোখে পড়তে বিমর্ষ হয়ে গেল নিকোলাসের মুখ। আস্তে করে একটা হাত তুলে নিলো হাতে। তালুর ক্ষততে রক্ত জমে ময়লা লেপ্টে আছে। হাঁটুর অবস্থাও একই রকম। হাতের তালুর দিকে চেয়ে বলল,

“তোমার সকল কষ্টের কারণ আমি তাই না, বেলা? আমি তোমার জীবনে না এলে আজ হয়তো এইদিন দেখতে হতো না তোমাকে। ঘৃণিত পিশাচ আমি। অভিশপ্ত আমার জীবন। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি এই অভিশপ্ত জীবন থেকে তোমাকে বিচ্ছিন্ন করে দেবো বেলা। আবার সুখী হবে তুমি। আবার আগের মতো হাসি খুশি হবে তোমার জীবন।”

ইসাবেলার হাতটাতে চুম্বন করতে যাবে কিন্তু ঘুমের ঘোরে নড়ে ওঠে ইসাবেলা। হাতটা সরিয়ে নেয় নিকোলাসের হাত থেকে। শূন্য হাতের দিকে চেয়ে রইল নিকোলাস। এই যেন ওর ভবিষ্যৎ। শূন্যতা আর শূন্যতা।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে