তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0
772

#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#মুসফিরাত_জান্নাত
#অন্তিম_পর্ব(প্রথমাংশ)

তায়্যেবকে হন্তদন্ত করে বাসা থেকে বের হতে দেখে ভড়কে গেলো জামেলা বানু সহ সকলে।এত রাত্রী বেলা কোথায় যাচ্ছে ছেলেটা?তাকে পিছু ডেকেও কোনো সাড়া পেলো না কেও।জামেলা বানু কেবলই হৈ হৈ করলেন।কি হলো টা কি তায়্যেবের সাথে?একটু আগেই তো তাকে প্রিয়তার বইগুলো একটু গুছিয়ে দিতে বললেন।সেগুলো বেশ স্বাভাবিক ভাবেই গোছাচ্ছিলো সে।তারপর হটাৎ সেই বইগুলো ওভাবে রেখে কোথায় গেলো ছেলেটা?কারো কিছু হয়নি তো?দুশ্চিন্তা হতে লাগলো তার।যতই হোক মায়ের মন বলে কথা।

এদিকে একটু আগে মায়ের আদেশ মতো প্রিয়তার বইগুলো পাঠানোর জন্য গোছাতে ব্যাস্ত হয়েছিলো তায়্যেব।তখন স্টাডি টেবিলের বিভিন্ন তাকে সাজিয়ে রাখা প্রিয়তার বইগুলো এক এক করে নামাতে নিতে তায়্যেবের চোখ আটকে গেলো নীল রঙা এক মোটা ডায়েরির দিকে।সে জানে এটা তার না এবং সে এটাও জানে অন্যের ডায়েরির পাতায় লুকানো গল্প গুলো অনুমতি বিহীন পড়া অনুচিত কাজ।তবুও নিজের কৌতুহলকে দমাতে পারলো না সে।প্রিয়তার দীর্ঘদিন ধরে যত্নে লেখা অনুভুতিগুলো মেলে নিলো চোখের সামনে।যেগুলো নিজের করা এক বিরাট ভুলের সংশোধনী হয়ে ধরা দিলো তার নিকট।এই ডায়েরির প্রত্যেকটা পাতার ভাজে ভাজে লুকিয়ে আছে প্রিয়তার মনের মাঝে তার প্রতি ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠা অনুভুতিগুলো।পৃষ্ঠাসংখ্যা যত এগুচ্ছে প্রিয়তার অনুভুতিগুলো তত গাঢ় হয়ে ধরা দিচ্ছে।আস্তে ধীরে প্রিয়তার তার প্রতি ভালোলাগা গুলো গাঢ় হয়ে ভালোবাসায় রুপ নেওয়ার চিত্রপট অঙ্কিত হয়েছে এতে।অপ্রত্যাশিত এক আকাঙ্খার নিভৃত পূরণের ব্যপারটি জানতেই শীতল হয়ে এলো হৃদয়। হাত পা অসার হয়ে এলো তার।দেহ জুরে সৃষ্টি হলো কম্পন।বুকের বা পাশ থরথর করে কাঁপতে লাগলো।চরম আগ্রহ ও উত্তেজনা নিয়ে প্রত্যেকটা শব্দ মস্তিষ্কে গেঁথে নিলো সে। অন্তরালে পড়ে থাকা কারো অতি যত্নে রচিত এক ভালোবাসাময় কাব্যগাঁধা নিমিষেই পড়তে লাগলো সে।এভাবে এক সময় প্রিয়তার লেখা গল্পের শেষ পৃষ্ঠাগুলোর উদয় হলো।যেটা কিনা তায়্যেবের আসার কয়েকদিন আগে থেকে লেখা।তায়্যেব আসার আনন্দঘন অপেক্ষার অনুভুতির প্রকাশ রয়েছে সেখানে।প্রিয়তা ঠিক শেষ পৃষ্ঠার আগের দিকের এক পৃষ্ঠায় লিখেছে,

মেঘরাজ, আপনি কি জানেন,
আপনার দূর দেশে গমনে পৃথিবীর কোথাও
এক চঞ্চল গাঙচিল বিষন্ন হয়ে তার ওড়ার গতি কমিয়ে দিয়েছিলো?আপনি কি জানেন,
ঝরে যেতে যেতে ব্যথিত হয়েছিলো কোনো এক
অরণ্যের প্রাণহীন পাতা?কোথাও যেনো কারো জীবনে বেশ কিছু কম পড়েছিলো আপনি নেই বলে।এসব কি আপনি জানেন?মাঝরাতে স্বপ্নে এসে কারো ঘুম ভাঙালেন বলে যে সে আর ঘুমিয়ে যাইনি,আপনার স্বপ্নকে মস্তিষ্কে গেঁথে রাখতে নির্ঘুম রাত্রি পাড়ি দিয়েছে,তা কি আপনি জানেন?
আপনি এসবের কিছুই জানেন না।আপনি জানেন না পথে হেঁটে যেতে যেতে সে কতবার দাঁড়িয়ে গিয়েছে খানিকক্ষণ, কোনো কাপলের যুগলবন্দী দেখে স্মৃতি স্মরণে আপনাকে জাগিয়েছে তার অবুঝ মন।আপনি এসবের কিছুই জানেন না।
তবে আপনি জানবেন এবার।স্বপ্নহীন এক অবুঝ বালিকার মেঘরাজকে নিয়ে ভালোবাসার প্রাসাদ সাজানোর গল্প জানবেন।আপনি কি একটু চমকাবেন তখন?

আর একদম শেষ পৃষ্ঠায় লেখা-

“মেঘরাজ,আজ আমি ঘুমাতে পারছি না।কেনো জানেন?কারণ আপনার আগমনের অপেক্ষার আনন্দ আমার ঘুম কেড়ে এক অজানা সিন্দুকে বন্দী করে রেখেছে।এক সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে।আমি এক অন্যরকম অনুভুতির সাগরে সাঁতার কাঁটছি আর প্রহর গুনছি কখন কাল হবে।কিন্তু সময় আর কাটছে না।জানেন মেঘরাজ,আমি আগে জানতাম না ভালোবাসার মানুষের আগমনের অপেক্ষা এত মধুর হয়।ইশ আপনি দূরে না গেলে এই অনুভুতি আমার পাওয়া হতো না।কত বড় লস হয়ে যেতো তাই না বলেন?আচ্ছা আপনি কি এই অনুভুতিগুলো কেমন হয় জানেন?

মেঘরাজ,আপনি চেয়েছিলেন কেউ আপনাকে ভীষন ভালোবাসুক,যার দুনিয়াতে আপনি ছাড়া আর কেও না থাকুক।কেউ আপনার চোখে তাকিয়ে সব দুঃখ ভুলুক,আপনার কাধে মাথা রেখে তার ভরসার স্থান খুঁজুক।আপনি সবসময় চেয়েছিলেন ঠিক যেমন একজন,আপনি এবার এসে দেখবেন এখন আমি পুরোটাই আপনার সেই ইচ্ছে মতন।এটা দেখে কতটা চমকে যাবেন তখন আমি ঠিক জানিনা।তবে এটা জানি এক নিদারুন মুহুর্ত হবে সেটা।আমি সেই মুহুর্তের অপেক্ষায় মেঘরাজ।আপনার চমকানোর অপেক্ষায়,আপনার থমকানোর অপেক্ষায়।আপনি বৃষ্টি হয়ে দ্রুত ঝড়ে পড়ুন আমার নিকট।চলে আসুন এই মনের রাজ্যে।আমি অপেক্ষা করছি।

~02:45 AM

টানা সময় ধরে এই ডায়েরীর পাতা শেষ করতেই বুকের বা পাশে এক শীতল দহন শুরু হলো তায়্যেবের।প্রাপ্তির আনন্দ ও ভুলের যন্ত্রণা একাকার হয়ে খানিক থমকে রইলো সে।তার অন্তরালে প্রিয়তা তাকে ভালোবেসেছিলো,তাকে নিয়ে স্বপ্নের প্রাসাদ সাজিয়ে অপেক্ষায় ছিলো,সে আসবে বলে অধীর আগ্রহে রাত জেগে কাটালো।আর সে কিনা ফিরে এসে সবটা বৃথা করে দিলো?মুহুর্তেই ধুলিস্যাৎ করে দিলো মেয়েটির সকল অনুভুতিকে।তার অপেক্ষাদের এভাবে খান খান করে কীভাবে ভাঙতে পারলো সে?

সে যখন প্রিয়তাকে অসম্ভব ভালোবাসতো প্রিয়তা তখন তাকে পাত্তা দিতো না।আর প্রিয়তা যখন একটু একটু করে তার জন্য ভালোবাসার মহল সাজালো তখনই কিনা সে অন্যত্র ঘর সাজাতে ব্যস্ত হলো!তীব্র এক অনুশোচনাবোধ ঘিরে ধরলো তাকে।মনস্তাপে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগলো।এসব কি করতে চলেছিলো সে?

তার ভুলটা সম্পূর্ণ রুপে সংঘটিত হওয়ার আগেই তা চোখে পড়েছে।আর এই ভুলের সংশোধনপত্র নিয়েই সে ওইরকম ব্যস্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।উদ্দেশ্য তার অর্ধাঙ্গিনী প্রিয়তা।
_______
বিষাদময় অবসরের মরুভূমির বালুচরে একেকটা প্রহর গুনছে প্রিয়তা।রাতের ঘুমও যেনো চিরতরে বিদায় নিয়েছে।যেখানে পুরো জীবনেই অশান্তির বিচরণ সেখানে প্রশান্তির ঘুম তার চোখে নামবে কীভাবে?যতই সে দুঃখ ভুলতে চায় দুঃখ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।এই দুঃখ গুলোকে খানিক সময়ের জন্য হলেও বিদায় দিতে একটু মুক্ত হাওয়ার মাঝে পদার্পণ করলো সে।একটু সাহস দেখিয়ে রাতের ঢাকার কৃত্রিম আলোকসজ্জিত চলন্ত গাড়িময় পথ দেখতে লাগলো ছাদে দাঁড়িয়ে।এসময়টায় কেও ছাদে আসে না বলে ছাদ এখন নির্জন।এই নির্জনতাকে ঠেলে সেখানে প্রবেশ করলো কেও।কারো আগমনের শব্দ পেয়ে আঁতকে উঠল প্রিয়তা। অজানা আশঙ্কায় শরীরে কাঁ’টা দিয়ে উঠলো তার।ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সে।এই অসময়ে তার পিছনে তায়্যেবকে দেখে বিষ্মিত হতে বাধ্য হলো সে।তার এই চমকানো অনুভুতিকে আরও খানিকটা চমকে দিতে আচমকা এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো তায়্যেব।আকষ্মিক ঘটনায় কিংকর্তব্য বিমূঢ় হলো প্রিয়তা।সে নিজেকে ধাতস্থ করে নেওয়ার আগেই তায়্যেব কাঁপা গলায় বললো,

“যদি আগে একবার আমি জানতাম আমাকে ভালোবেসেছিলে তুমি,বিশ্বাস করো অন্য মেয়েকে জীবনে জড়ানো তো দূর তাদের দিকে তাকানোর স্পর্ধাও করতাম না আমি।”

কথাটা শুনে আশ্চর্যের উর্ধ্ব সীমায় পৌছে গেলো প্রিয়তা।তায়্যেবের হটাৎ এমন পরিবর্তনে মুখের খেই হারিয়ে রইলো কিছুক্ষণ।সব বুঝে উঠতে অক্ষম হলো প্রিয়তা।সে যে তায়্যেবকে ভালোবাসে তা লোকটা জানলো কি করে?পরিবেশের সাথে নিজেকে ধাতস্থ করে নিতেই সে স্পষ্ট দেখতে পায় তায়্যেবের হাতে তার লেখা সেই নীল ডায়েরিটা।এবার সব কিছু স্পষ্ট হয় তার নিকট।কিছুক্ষন প্রতিক্রিয়া শূন্য থেকে সে এবার তার থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখতে থাকে তায়্যেবকে।তাকে এভাবে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাথা নুইয়ে ফেললো তায়্যেব। অনুতপ্ত গলায় আবারও বললো,

“নিজের অজান্তে ভুল করেছি আমি।তুমি থাকা কালীন অন্য কাওকে জীবনে জড়িয়েছি।এ ভুলের কি ক্ষমা হবে?”

প্রিয়তা এবার নিজেকে পুরোদমে ধাতস্থ করে নিলো।মাঝের কয়দিনে মনে জ্বলা আগুন আবারও দাউ দাউ করে জ্ব’ললো।সেই আ’গুন নেভাতে সে তাচ্ছিল্য ভরে হাসলো আনমনে।তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

“এটা ভুল নয় এটা অ’ন্যায়।আর অ’ন্যায়ের কি কোনো ক্ষমা হয়?”

প্রিয়তার প্রশ্নে থমকে গেলো তায়্যেব।প্রশ্নটা তার শিকড় নাড়িয়ে দিলো।সত্যি সে অ’ন্যায় করেছে মেয়েটির সাথে।তার হক নষ্ট করেছে।এমন নিচু কাজের ক্ষমা কি এতো সহজেই প্রাপ্য তার?সে কিছুটা সময় নিয়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললো,

“প্রায়শ্চিত্ত তো হয়!”

প্রিয়তা কাঠ কাঠ কণ্ঠে বললো,

“প্রায়শ্চিত্ত ও ভুলের প্রাপ্য।অন্যায়ের প্রাপ্য তো একমাত্র শাস্তি।”

“তবে তুমি শাস্তিই দাও।তোমার দেওয়া সব শাস্তি আমি মাথা পেতে নিবো।তোমাকে রেখে অন্য কাওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা আমার জন্য যতটা কষ্টের ছিলো, তার চেয়ে তোমার বেধে দেওয়া অতি কঠোর শাস্তিও সহ্য করা সহজ লাগবে আমার।তুমি যা খুশি দণ্ড দাও আমায়।তোমাকে আরও একটিবার জীবনে পেতে সব দণ্ড সয়ে যাবো আমি।”

কোনো রুপ বিলম্ব না করে জবাব দিলো তায়্যেব।
অতপর কিছু সময় নিশ্চুপ থেকে সে মাথা নুইয়ে বললো,

“ভালোবাসি প্রিয়, ভীষণ ভালোবাসি তোমায়!”

প্রতিউত্তরে প্রিয়তা সরু চোখে তাকিয়ে বললো,

“আপনার ভালোবাসা বিষাক্ত! এমন ভালোবাসা চাইনা আমার।আপনার ভালোবাসা কেবল শরীর বোঝে, কিন্তু মন বোঝে না।কেবল মাত্র দৈ’হিক স’ম্পর্কের জন্য যে ভালোবাসা তার ব্যক্তিগত মানুষকে দূরে ঠেলে অন্য কাওকে নিজের জীবনে গ্রহন করে,যে ভালোবাসায় দৈ’হিক বিনিময় খোঁজে, সেটা কখনো স্বচ্ছ ভালোবাসা হতে পারে না।আর ছেড়ে দেন আমাকে আপনার জীবনে ফিরে পাওয়ার আশা।কোন ভরসায় আপনার কাছে ফিরবো আমি?যে তার বউয়ের অপূর্ণতায় নিজেকে সংযত রাখতে পারে না,শুধুমাত্র শা’রী’রিক স্পর্শের চা’হিদায় পরকীয়ায় জরায়,সে যে বিয়ের আগে নিজের চরিত্র হেফাজত রেখেছে, এটাই বা বিশ্বাস করবে কে?আর যে ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে এত সংশয় তার সাথে আর যাই হোক, সুখে সংসার হয় না।”

নির্লিপ্ত গলায় বাক্যগুলো পূর্ণ করে নিজের ডায়েরি খানা তায়্যেবের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলো সে।যার মাঝে বিগত এক বছর ধরে প্রতিদিন এক পৃষ্ঠা এক পৃষ্ঠা করে নিজের অনুভুতি ঠেসে দিয়েছিলো সে।সেগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা তপ্ত শ্বাস ছাড়লো প্রিয়তা।তারপর বিবশ কণ্ঠে বললো,

“এসব আগের সৃষ্ট অনুভূতি।যার অস্তিত্ব আমার নিকট এখন মৃ’ত।আর মৃ’ত অনুভুতিকে স্মৃতি রুপে জিইয়ে রেখে লাভ নেই।”

কথাগুলো বলে আচমকা সে সব গুলো পৃষ্ঠা ছিঁ’ড়ে ফেললো।তারপর সেগুলো উড়িয়ে দিলো রাতের এই কালো বাতাসে।সেদিকে অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো তায়্যেব।আবছা কালো অন্ধকারে প্রিয়তার লেখা সেই শুভ্র রঙা তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা জুড়ে সাজানো ভালোবাসাময় অনুভুতিগুলো ঘুরপাক খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো চরম অবলীলায়।

#চলবে….

#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#মুসফিরাত_জান্নাত
#অন্তিম_পর্ব(শেষাংশ)

“স্মৃতি বস্তুতে জিইয়ে থাকে না প্রিয়তা।স্মৃতি জিইয়ে থাকে মনে।তুমি এসব ছুঁড়ে ফেললেও কি আদৌ মন থেকে সেই অনুভুতিগুলোর স্মৃতি মুছতে পারবে?”

ভারী নেত্রপল্লব তুলে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে প্রশ্নটা করলো তায়্যেব।প্রতিউত্তরে প্রিয়তা ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,

“স্মৃতির ধারক মন হলেও, বস্তু স্মৃতিতে বেগ দিতে সক্ষম।যেখানে স্মৃতির সন্ধান মেলে তা মুছে ফেলা মানে স্মৃতিকেও মে’রে ফেলা।আর মৃ’ত স্মৃতি মনে থাকা না থাকা এক।”

প্রিয়তার গা ছাড়া অভিব্যক্তিময় উত্তরে রুষ্ট হলো তায়্যেব।অপ্রকৃতিস্থ কণ্ঠে বললো,

“তুমি যতই স্মৃতিকে মুছে ফেলো, এই আমিকে মন থেকে মুছতে পারবে?আমি তোমার তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠার সেই অধ্যায়, যে তোমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলো,তোমার একপাক্ষিক স’ঙ্গী হয়েছিলো,নিভৃতে যতনে তোমাকে আগলে রেখেছিলো।সেই আমিকে কি কখনো ভুলতে পারবে?আমি মানছি তোমার অভ্যন্তরে সৃষ্ট এই অনুভুতিগুলোতে আমি আ’ঘাত করেছি।কিন্তু তাই বলে তুমি যা অভিযোগ করছো তা আসলেই কি ঠিক?একটু ভেবে দেখো তো সব।অন্ধের মতো কথা না বলে একটু বিচক্ষনের ন্যায় ভাবো একটু।
আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে আরও একটিবার ভেবে দেখো সব।কেনো তোমাকে বিয়ে করেছিলাম বলো?তোমাকে বৈধ ভাবে নিজের করতে নয় কি?তাহলে অবৈধ সম্পর্কে জড়াবো কখনো তা ভাবলে কি করে?তোমাকে যখন আমি বিয়ে করেছি তখন তোমার বয়স কম ছিলো।আমাকে ভ’য় পেতে তুমি।এজন্য কি তোমাকে আমি সময় দেই নি?হ্যাঁ আমি মানছি ভুল করে প্রথম দিন তোমাকে এপ্রোচ করার ট্রাই করেছিলাম।কিন্তু তারপরে কি আর কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে গিয়েছি?তুমি যখন সেদিন আমাকে তোমার কাছাকাছি যাওয়া নিয়ে সবার সামনে লজ্জায় ফেলেছিলো তখনও কিন্তু আমি কিছু বলিনি।আমি কেবল তোমার বড় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।আর এর মাঝের সময়ে তোমার মানসিক সাপোর্ট চেয়েছিলাম।তোমার সংযত স’ঙ্গ চেয়েছিলাম।এসবও তুমি দাও নি।এর জন্য আমি কোনো অভিযোগও করিনি।তোমার বয়স কম বলে সব মেনে নিয়েছি কেবল।তোমাকে স্বামী স্ত্রীর মর্ম বোঝাতে চেয়েছি সবসময়।আমি ভেবেছি একসময় তুমি বুঝবে।অথচ দেশে থাকাকালীন তা কখনো সম্ভব তো হয়ইনি বরং দেশের বাইরে গিয়েও তা হয়নি।আমি অনেক চাইলেও বিদেশ থাকাকালীন একটা দিন তুমি আমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলোনি।অডিও কলে কথা বললেও হু হ্যাঁ মূলক জবাব ছাড়া বাড়তি কোনো কথা বলতে না।তোমার ব্যক্তিগত ফোন থাকা সত্বেও আমাকে নিজে থেকে কখনো কল দিতে না।আমি দিলেও তেমন কথা বলতে না।এজন্য তো এক সময় আমাদের কথা বলাই টোটালি অফ হয়ে গেলো।তাহলে আমি কোন ভরসায় বিশ্বাস করতাম আমাকে তুমি চাও?যখন সবক্ষেত্রে তুমি আমাকে এড়িয়ে চলতে, আমাদের সম্পর্কটা দোদুল্যমান তখন এমন অবস্থায় আরেকজনকে বিয়ে করতে চাওয়াটা কি আমার অন্যায়?তুমি বলেছো আমার ভালোবাসা মন বোঝে না শ’রীর বোঝে।যদি এমনটাই হতো তবে বিয়ের পর তোমার ভ”য় পাওয়াটাকে কি আমি কখনো প্রাধান্য দিতাম?আমি যদি শ’রীরই বুঝতাম, একটা বছর এক বিছানায় আমার পাশে থাকারও পরও তুমি এভাবে ভা’র্জিন থাকতে?তাছাড়া এখন তো তুমি প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছো।এখন তো তুমি শা’রী’রিক ভাবে সম্পূর্ণ, তবুও কি শা’রী’রি’ক চা’হিদার জন্য আরেকটা বিয়ে করতে চাইতাম?একটু বুদ্ধি খাটিয়ে ভেবে দেখো তো সব।তুমি এ অব্ধি যা যা বলেছো আসলেই কি সব তাই কিনা?”

একটানা কথাগুলো বলে থামলো তায়্যেব।ব্যগ্রতার দরুন ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে তার।সে কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।তারপর আবারও বললো,

“এখন তুমি প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্ত মনস্ক হয়েছো।আমি চাইলে এখন তোমার সাথে সাংসা’রিক কা’র্যে লি’প্ত হতে পারতাম।কিন্তু আমি ভাবতাম আমাকে তুমি মন থেকে মেনে নিতে পারো নি এখনো।আর মন বিহীন বৈবাহিক জীবন আমি বৈধ ধ”র্ষণ ভিন্ন অন্য কিছু ভাবতে পারিনি।একে অপরকে ভালোবেসে দুজনের একত্রিত হওয়া হলো প্রেম।আর যেকোনো একজনের অনিচ্ছায় একত্রিত হওয়া হলো কা” ম।কা’ মসাধননা আমার চাই না।মন বিহীন দে’হও আমার চাই না।তাই তোমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম।আমি চেয়েছিলাম যেখানে তুমি মন থেকে সুখী থাকতে পারো সেখানে যাও।তোমাকে ভালোবাসি তাই তোমার ভালো থাকাটাই মুখ্য ছিলো আমার নিকট।অথচ তুমি এসব যা নয় তাই বললে।তুমি তখন কোর্টেও আমার সাথে মিস বিহেভ করেছো।আমি কিছু বলিনি।তোমার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভেবেছি।তুমিও তেমন একবার তোমাকে আমার জায়গায় বসিয়ে দেখো।আশা করছি বুঝতে পারবে এটা আসলেই অন্যায় নাকি ভুল!”

প্রিয়তা এবার স্তব্ধ হয়ে গেলো।তায়্যেবের কথাগুলো তার মস্তিষ্কে বাজতে লাগলো।নিজের চোখের সামনে যেনো ভেসে উঠলো সবটা।তায়্যেবের একটা কথাও মিথ্যা নয়।সে সবসময় এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছে তায়্যেবকে।বিয়ের প্রথম দিনের ঘটনাটা ভ’য় পাইয়ে দিয়েছিলো তাকে।তারপর থেকে ভ’য়ে এড়িয়ে চললেও পরবর্তীতে অস্বস্তির দরুন এড়িয়ে চলতো।আস্তে ধীরে সেটা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো।আর ফোনকলে তার সাথে কথা বলতো না জড়তার দরুন।ভিডিও কলেও আসতে লজ্জা পেতো।কিন্তু এসব যে ঐকান্তিক ব্যাপার হবে তা সে জানতো না।

হুট করেই লজ্জা পেয়ে গেলো সে।একপাক্ষিক নিজের দিকটা ভেবে অন্যের উপর দোষারোপ করাটাও চরম অন্যায়।শক্ত পাথরের ন্যায় মনের আড়ালে সৃষ্টি হওয়ার অনুশোচনায় চাপা পড়ে গেলো সে।অনুতাপে পু’ড়তে লাগলো কেবল।তায়্যেবের অনুতপ্তের সুর এবার তার কণ্ঠে এলো।সে কাঁপা গলায় বললো,

“আপনি যা করেছেন তাকে যদি আমি অন্যায় বলে থাকি, তবে আমি আপনাকে যা অপবাদ দিয়েছি তা ঘোর অন্যায়!আপনার চেয়ে বড় শাস্তি আমি ডিজার্ভ করি।”

কথাটা বলে মাথা নত করে ফেললো সে।প্রেয়সীনির মুখশ্রী পাণে তাকিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়লো তায়্যেব।ধাতস্থ কণ্ঠে বললো,

“জেনে বুঝে করা দোষ অন্যায়, কিন্তু অজান্তে করা দোষ অন্যায় নয়, বরং ভুল।তুমি জানাতে বা অজানাতে কোনো বাছ বিচার না করে, নিজের ইগো যা বলেছে,নিজের একপাক্ষিক দিকটা ভেবে এসব বলেছো।আমিও নিজে থেকেই যা ভেবে নিয়েছি তাই ধরে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমরা মিউচুয়াল সিদ্ধান্তে না গিয়ে দুজনেই নিজেদের মতো একক সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমাদের দু’জনের দোষটা এখানেই।কিন্তু এটাকে অন্যায় বলতে পারি না।এটা ভুল। পরিস্থিতিটাই হয়তো এমন ছিলো যে এই ভুল করতে বাধ্য হয়েছি আমরা।কিন্তু এই ভুল এখনো সংশোধনযোগ্য।তার জন্য অবশ্যই দুজনের সঠিক বুঝ দরকার।”

কথাগুলো নিরব হয়ে শুনলো প্রিয়তা।বেশ কিছু সময় ধরে কিছু ভাবলো সে।তারপর দ্বিধান্বিত কণ্ঠে বললো,

“কিন্তু নীলি আপুর ব্যাপারটা!”

তায়্যেব একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো।মলিন কণ্ঠে বললো,

“আমার আর নীলির মাঝে এমন কোনো সম্পর্ক নেই যেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।বিয়ের ডেটও ফিক্স হয়নি।তাই ওটা কোনো বিষয়ই নয়।সে আমার ছোটোবেলার বান্ধবী ছিলো।সব ক্লাসে একসাথে পড়েছি আমরা।আমাকে সে আগে থেকেই পছন্দ করতো।আমাদের দোদুল্যমান সংসারে যখন তোমার কোনো মানসিক সাপোর্ট পাইনি তখন আমাকে সাপোর্ট দিয়ে এসেছে সে।আমার ইউকে থাকাকালীন অসুস্থতার সময়টায় যখন তুমি জানতেও না তখন আমার খেয়াল রেখেছে সে।আমার বিপদ আপদে যখন তোমাকে পাশে পাওয়ার কথা ছিলো তখন নীলি পাশে থেকেছে।আর সে যখন আমার সম পর্যায়েই থেকেছে সবসময় তাই এখানে ভালোবাসা ছাড়া অন্য কোনো স্বার্থও নেই।আমার চেয়ে বেটার ছেলে ডিজার্ভ করে সে।তাও আমার সঙ্গী হতে চেয়েছে।সবটা বিবেচনায় আমি ভেবেছিলাম যখন আরেকজনের সাথে ইনভলভ হতেই হবে তখন হোয়াই নট নীলি।তাই ওকেই প্রথম বিয়ের প্রস্তাবটা দেই আমি।সে রাজি হওয়াতে বাসায় জানাই যে দেশে ফিরে ওকে বিয়ে করবো।ওর আমাকে বিয়ে করতে আপত্তি না থাকলেও সতীনের সংসার করাটা তার রেপুটেশনে লাগতো।তাই তোমাকে ডিভোর্স দিতে বলে।বাকিটা তো তোমার জানাই।”

কথাগুলো শুনে কেমন বিষন্ন সুন্দর অনুভূতি হলো প্রিয়তার।তায়্যেবের কোনো পরকীয়া ছিলো না।সে কেবল ভালোবাসার অভাবে পু’ড়ে আরেকটা বৈধ জীবনে পদার্পণ করতে চেয়েছিলো মাত্র।তার পুরুষ এখনো শুদ্ধ, সৎচরিত্র সে।অথচ সে কি না কি ভেবে মনে কষ্ট পুষলো!ব্যাপারটা ভাবতেই দু চোখ ভিজে গেলো তার।তায়্যেবের দিকে দৃষ্টি দিলো প্রিয়তা।লোকটা পবিত্র ভাবেই তার জীবনে এভাবে ফিরে এসেছে ব্যাপারটা আনন্দঘন মুহুর্ত হলেও ভুলগুলো কেমন পীড়া দিলো।তাই খুশি হয়েও খুশি হতে পারলো না সে।আবার মনে ঘৃণাও ঠাই দিতে পারলো না আর।সে শেষবারের মতো ইতস্তত কণ্ঠে বললো,

“কিন্তু নীলি আপু তো আপনার আর তার বিয়ের অপেক্ষায়!আপনি আমার জীবনে ফিরলে তার নিকট ভিলেন হয়ে যাবেন না!”

কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালো তায়্যেব।তারপর নিস্পৃহ কণ্ঠে বললো,

“নিজের প্রেয়সীনির জীবনেই যদি ভিলেন হয়ে বাঁচি, প্রেয়সীনির জীবন গল্পের ভিলেনের নিকট হিরো হয়ে কী লাভ!”

কথাটা বলে লম্বা শ্বাস নিলো সে।প্রতিউত্তরে স্মিত হাসলো প্রিয়তা।তারপর উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ালো।কিছুক্ষণ দুজনের মাঝে নিরবতা চললো।নিজেরা কিছুটা সময় দিলো নিজেদের।সেই সময়ের স্রোতের টানে অনুশোচনার পানিতে নিজেদের মনে সৃষ্ট পূর্ব অনুভুতিগুলো ধুয়ে এখন একই অনুভুতির সৃষ্টি হলো।নিভৃতেই সেই অনুভুতিকে উপভোগ করলো তারা।রাত্রী গাঢ় হলো, রাতের হাওয়া বৃদ্ধি পেলো।সেই হাওয়ায় চুলগুলো উড়তে লাগলো প্রিয়তার।যেগুলোর কিছু অবাধ্য অংশ তায়্যেবের শ’রীর ছুঁয়ে দিলো।খানিকক্ষণ আবছা আঁধারের মাঝে তাকে দেখে গেলো তায়্যেব।অতপর রাশভারি কণ্ঠে বললো,

“কি করবে এখন?”

প্রিয়তা ইতস্তত করে বললো,

“ভালোবাসায় সৃষ্ট ক্ষ’তে মলম লেগেছে, ক্ষ’ত না সারিয়ে উপায় আছে!”

কথাটা শুনে স্মিত হাসলো তায়্যেব।বুকের বা পাশে শীতল এক শিহরণ বইলো।সেই শিহরণ ছুঁয়ে দিলো প্রিয়তাকেও।বুক ভরে শ্বাস নিলো সে।তারপর তায়্যেবের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেলো।তায়্যেব তার আগমনের অর্থ বুঝলো।স্মিত হাসলো সে।তারপর তার দুই হাত দিয়ে প্রিয়তার দুই বাহু আঁকড়ে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,

“ভালোবাসা ভালোবাসে শুধুই তাকে।ভালোবেসে ভালোবাসা বেঁধে যে রাখে!”

কথাটা শুনে লজ্জালু হাসি দিলো প্রিয়তা।তারপর আস্তে ধীরে তায়্যেবের গায়ের সাথে লেপ্টে গেলো।তায়্যেবও জড়িয়ে নিলো তাকে।প্রিয়তা নিচু কণ্ঠে বললো,

“হৃদয়মাঝে বেঁধে রাখবো আপনাকে, খুব খেয়ালে নিভৃতে যতনে।”

কথাটা বলে লজ্জা পেলো নিজেই।মুখ গুঁজে ফেললো মেঘরাজের বুকের মাঝে।তার লজ্জায় স্মিত হাসির রেখা ফুটলো তায়্যেবের অধরে।সে আরও খানিকটা নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো প্রেয়সীনিকে।তারপর তার কপালে অধর ছুইয়ে বললো,

“ভালোবাসি প্রিয়!”

মাত্র দু’শব্দের বাক্যটিতে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা।এক অন্য রকম মুগ্ধতার সাক্ষাৎ পেলো সে।সে মনে মনে ভাবলো, ভাগ্যিস সে সেই তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠার অনুভুতি লিখেছিলো।তা না হলে এই মানুষটাকে তার পাওয়া হতো না। এত মধুর স্বরে মধুমাখা শব্দ দুটিও শোনা হতো না তার।সার্থক তার কাব্যগাধা, সার্থক তার তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা।যে পৃষ্ঠার বান্ডিল নিজ হাতে ছিন্ন করলেও একত্রিত করে দিয়েছে তাদের।এখন থেকে এমন হাজারো তিনশত পয়ষট্টি পৃষ্ঠা লিখিতো হবে তাদের জীবনের অভিধানে,হয়তো দৃশ্যমান কালির শব্দে অথবা মনের মাধুর্যময় কালির নৈঃশব্দ্যে।কিন্তু এই ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো আজীবন মনে গাঁথা থাকবে তাদের।তাদের প্রণয়কাব্যের সুচনা বিন্দু হয়ে।

~সমাপ্ত~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে