#তিনশত_পয়ষট্টি_পৃষ্ঠা
#মুসফিরাত_জান্নাত
#পর্বসংখ্যা_০৫
“আপনারা নিশ্চিত যে দুইজন বিচ্ছেদ চাইছেন?”
একজন আইনজীবীর সামনে বসে রয়েছে তায়্যেব ও প্রিয়তা।সাথে প্রান্তও উপস্থিত আছে।তারা ডিভোর্সের জন্য আইনজীবীর দ্বারস্থ হতেই প্রশ্নটা করলো সে।প্রিয়তা চোখ তুলে তাকালো।জাবাবে স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
“নিশ্চিত না হলে তো আর এখানে আসতাম না।”
প্রতিক্রিয়া স্বরুপ লোকটি গম্ভীর হয়ে গেলো।ধাতস্থ কণ্ঠে বললো,
“তবুও বলছি নিজেরা একবার আলোচনা করে দেখেন।এখন হয়তো হুটহাট একটা ঘোরের মাঝে সিদ্ধান্ত নিয়ে এখানে এসেছেন।কিন্তু ডিভোর্স একবার হয়ে গেলে তো আর কোন পথ থাকবে না ফেরার।ইসলাম শরিয়ত মোতাবেক নিজের ডিভোর্সী বউকে আবারও বিয়ে করা যায় না জানেন তো।এ জন্য সেই তালাক প্রাপ্তা বউকে আরেক স্থানে বৈবাহিক সম্পর্ক কাটিয়ে সেখানেও ডিভোর্স হলে তারপর বিয়ে করার সুযোগ থাকে।আর সেভাবে কখনো নিজের জীবনে তাকে পাওয়া হবেও না।তাই এখনই আরেকবার ভাবুন।বাসায় ফিরে যান,সময় নিন।একসাথে কিছুদিন থাকুন।তারপরও সব ঠিক না হলে তখন আসবেন।”
এবারও প্রিয়তা জাবাব দিলো,
“তার আর কোনো প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।আমরা ভেবেই এসেছি।”
কথাটা শুনে লোকটা তায়্যেবের দিকে তাকালো।সে একদম নিরব।তা দেখে আইনজীবী লোকটা বললো,
“আচ্ছা, তাহলে আপনারা এখন না হয় একটু আলোচনা করুন।আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি।”
নিজের কথার সমাপ্তি টেনে বেরিয়ে গেলো লোকটা।সাথে প্রান্তও বেরিয়ে গেলো।যাওয়ার আগে বোনের দিকে তাকিয়ে একটু আশার আলো খুঁজলো সে।যদি সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়।তায়্যেবের প্রতি প্রিয়তার অনুভুতির জন্ম হয়েছে এটা বুঝেও যদি তায়্যেব ফিরে আসে।এই আশা একটু একটু করে তার মনে গজিয়ে উঠলো।সে একবুক আশা নিয়ে বেরিয়ে গেলো আইনজীবীর সাথে।
অপরদিকে সেখানে পাথরের মতো নিরব হয়ে বসে রইলো দুজন।প্রিয়তা কোনো কথা বলছে না।এমনকি তায়্যেবের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।কিন্তু তায়্যেব দৃষ্টি দিলো মেয়েটির মুখে।গভীর সে চাহনি।কি মনে করে সে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু কি বলার আছে?”
তায়্যেবের গলাটা কেমন যেনো শোনালো।তার কথার ভঙ্গিতে থমকালো প্রিয়তা।এমন কণ্ঠ তো একমাত্র দুঃখ লুকাতে চাওয়া ব্যক্তির হয়।কিন্তু তার জানা মতে তায়্যেবের তো কোনো দুঃখ নেই।সে তো বেশ মজা করেই বিয়ে করতে যাচ্ছে।তবে তার গলা এমন শোনাচ্ছে কেনো!
প্রিয়তা একবার চোখ তুলে দেখতে চাইলো তাকে।আবার পরক্ষণেই কি মনে করে ফুঁসে উঠলো।যে পুরুষ তার মন ভেঙেছে, সে পুরুষের যদি কোনো গোপন ভাঙার গল্পও থাকে তাও সে শুনবে না।সে কেবল তিক্ত কণ্ঠে বললো,
“এই বিচ্ছেদ নিয়ে আমার নতুন করে বলার কিছু নেই।তবে একটা কথা না বলে পারছি না।উচ্চ শিক্ষা সব সময় মানুষকে শিক্ষিতই করে না, বরং মাঝে মাঝে মূর্খদের চেয়েও অধম করে তোলে।তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আপনি।”
কথাটা বলে বেরিয়ে আসে প্রিয়তা।তায়্যেব কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।বোঝার চেষ্টা করে মেয়েটি তাকে কতটা নিচু করে কথা বলে গেলো।এভাবে কথা বলাটা বেমানানও নয়।সে নিচুস্তরের কাজই করে চলেছে।বউকে ক্ষুদ্র কারণে ডিভোর্স দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইছে।এতটা নিচু কবে কীভাবে হলো সে!
_______
আইনজীবীর সাথে পাকা কথা শেষ করে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে তারা।যেহেতু বিচ্ছেদই সমাপ্তি হবে সেখানে সময় নিয়ে দেরী করে লাভ নেই।বরং যত দ্রুত কাজ হয় ততই ভালো।কিন্তু হুট করে বললেই তো আর একদিনে তালাক দেওয়া সম্ভব নয়।এর জন্য সময় দরকার।আইনজীবীকে কাগজ পত্র তৈরি করতে বলে বেরিয়ে আসে তারা।
যাত্রাপথে প্রান্ত কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ভিতরে কোনো মিমাংসা হলো না তোদের?তায়্যেব কিছু বলেনি?”
প্রিয়তা ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বললো,
“হু, জানতে চাইলো আমি কিছু বলতে চাই কিনা।”
কথাটা শুনে চোখমুখ চকচক করে উঠলো প্রান্তর।উজ্জ্বল মুখশ্রী নিয়ে সে বললো,
“তার মানে সে এই সম্পর্ককে আরেকটা সুযোগ দিতে চাইছিলো তাই তো!”
প্রিয়তার এবারও গা ছাড়া জবাব,
“জানি না!”
প্রিয়তার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারলো না প্রান্ত।সে তার কথা এড়িয়ে গিয়ে বললো,
“আচ্ছা তুই তায়্যেবকে জানালি না কেনো যে তুই তাকে ভালেবাসিস?এটা জানালে হয়তো সে ফিরতেও পারতো।সে তো কেবল তোদের সম্পর্কের ফাঁকা স্থানটাকে কেন্দ্র করেই এই বিচ্ছেদ চাইছে।”
প্রান্তর কথায় তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে প্রিয়তা।হেয়ালী করে বলে,
“তুমিও এটা বিশ্বাস করো ভাইয়া?”
প্রান্ত ধাতস্থ হলো এবার। বললো,
“বিশ্বাস না করার কি আছে?তোদের সম্পর্কের গ্যাপ তো সবারই জানা।তাছাড়া তায়্যেব সেদিন এটা সবার সামনে বললোও তো।”
ভাইয়ের এমন সহজ সরল কথায় তপ্ত শ্বাস ছাড়লো প্রিয়তা।গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“সম্পর্কের ফাঁকা স্থান তো বিয়ের শুরু থেকেই ছিলো।সেই একটা বছরে কিন্তু একবারও সে এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি।এটা ভেবেছো!”
বোনের প্রতিউত্তরে থতমত খেলো প্রান্ত।দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলতে চাইছিস তুই!”
“এটাই যে পরনারীর গন্ধ পেয়েছে সে।তৃতীয় ব্যক্তির আগমন না হলে কোনো বিচ্ছেদ তো দূরে থাক বিচ্ছেদের কথাও হতো না।সম্পর্কের ফাঁকা স্থান তো একটা বাহানা মাত্র।”
নিস্পৃহ কণ্ঠে জবাব তার।প্রান্ত এবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো।কথাটা ফেলনা নয়।তাদের মাঝে নীলির অনুপ্রবেশ না ঘটলে হয়তো তাদের বিচ্ছেদের কথা হতো না কখনো।কেননা তৃতীয় পক্ষের আগমন ব্যতীত যত্নহীন একটা সম্পর্ক বড়জোর পানসে হতে পারে,কিন্তু তিক্ত হয় না।দুজনের মধ্যবর্তী বন্ধন ঢিলা হতে পারে কিন্তু ছিঁড়ে যায় না।সম্পর্ক তীক্ত হতে, দুজনের বন্ধনকে ছিঁড়তে হলে তো অত্যাবশ্যকীয় ভাবে তৃতীয় ব্যক্তির প্রয়োজন।
তায়্যেব ও প্রিয়তার মাঝের সেই তৃতীয় সত্বা নীলি।সেই তৃতীয় সত্ত্বা এতোটাই ভয়ংকর যে এই দুজনের চলমান সম্পর্কে বিষ দিয়ে সুমিষ্ট মধুর নেশায় তায়্যেবকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছে।সেদিকে তায়্যেব যত আকৃষ্ট হয়েছে পিছনের সম্পর্কে তত ফাটল ধরেছে,যা একসময় স্থায়ীত্ব অর্জন করে বিচ্ছেদে গড়াচ্ছে।আলাদা হয়ে যাচ্ছে এতকাল একসাথে থাকা দু’টি সত্ত্বা।অথচ তারাও হাত ধরার সময় একসাথে সারাজীবন পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলো।
______
বাসায় এসে সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে দিলো প্রিয়তা।সময় মত নামায আদায় করার পাশাপাশি দীর্ঘ সময় কোরআন মজিদও তেলাওয়াত করলো।তাও যেনো সময় কাটছে না তার।ব্যস্তময় জীবনে হুট করে বিষাদ এসে কেমন অবসরে ফেলে দিয়েছে তাকে।আর এই অবসরের সুযোগে বিষাদগুলো মাথা চারা দিয়ে উঠছে।হুটহাট মনে পড়ছে তায়্যেবের কথা।লোকটার তখনের ভারাক্রান্ত কণ্ঠস্বর কানে বাজছে।যার আওয়াজ তার দৃঢ় সত্ত্বাকে একটু একটু করে ভাঙতে বসেছে।তার কেবলই মনে হচ্ছে সে কি একবার তায়্যেবকে নিজের মনে তার জন্য গজিয়ে ওঠা অনুভুতির কথা বলে দেখতো?যদি সে প্রত্যাখান করতো!ছোট হয়ে যেত সে।যেখানে তায়্যেব অন্য কাওকে বিয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন,সেখানে এই প্রস্তাব রাখাটাও বেমানান।সে সঠিক কাজ করেছে।নিজেকে বুঝ দিলো মনে।তবুও এই অবসরের য’ন্ত্রণায় এই দুই দিনেই যেনো হাঁপিয়ে উঠলো সে।এই ক্লান্তি ভাব তাকে বুঝিয়ে দিলো নিজ জীবনে নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন।কলেজ, পড়াশোনায় নিয়মিত হলে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে সে।কিন্তু তার সব বই, নোটস গুলো যে ওই বাড়ি।এখন সেসব নিয়ে আসবে কি করে?
সে জানে তার জন্য জামেলা বানুর কান্নাটা অনেকটা কুমিরের কান্নার ন্যায়।তারাও তো তায়্যেবকে দ্বিতীয় বিয়েতে পূর্ণ সমর্থন করেছে।তার সাথে লুকোচুরি খেলেছে।কিন্তু এই অবেলায় তার মনে হলো এই মানুষটাকেই শেষ বারের জন্য একটা কল দেওয়া দরকার।নিজ স্বার্থের জন্য হলেও দরকার।মানুষ তো স্বার্থের জন্য কত কিই না করে।সে না হয় একবার পেছনে ফেলে আসা শাশুড়ীকে একটা কল দিলো।
অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে জামেলার নাম্বারে কল দিলো সে।বার দুই রিং হতেই কল রিসিভ করলো কেও।সবেই সে সালাম দিবে তখন কানে বাজলো নীলির বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠ,
“কি ব্যাপার প্রিয়তা,হটাৎ এই নাম্বারে কল দিলে!সবার সামনে ঘর ভাঙার গান গেয়ে, গোপনে এসে শাশুড়ীকে পটাতে চাইছো নাকি?”
নীলির কণ্ঠ শুনে ক্রুদ্ধ হলো প্রিয়তা।এই মানুষগুলোকে যতই সে এড়িয়ে চলতে চায় ততই এদের সম্মুখীন হতে হয় তাকে।সে কাঠ কাঠ গলায় বললো,
“যার মনে যা লাফ দিয়ে ওঠে তা।অন্যকে পটিয়ে কোনো সম্পর্ক গড়া আপনার স্বভাব।তাই এসব ভাবছেন।এখন তো দেখছি অন্যের ব্যক্তিগত ফোনও রিসিভ করার অভ্যেস করেছেন।অবশ্য অন্যের জামাইকে নিজের দিকে আকর্ষিত করা যার স্বভাব সে এমনটা করতেই পারে।”
কথাটা শুনে রাগার কথা থাকলেও রাগলো না নীলি।বরং ব্যাঙ্গ করে বললো,
“অন্যের জামাইকে আমি আকর্ষিত করিনি।বরং সে নিজেই আমার কাছে এসে ধরা দিয়েছে।আসলে বউ দ্বারা সুখী না হলে পুরুষ মানুষ তো অন্যের কাছে সুখ খুঁজতে চাইবেই তাই না বলো!আমি তার সেই সুখের স্থান।আর তুমি দুঃখের নর্দমা।তাই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে তোমাকে।”
কথাটা বলে খিলখিল করে হাসে নীলি।সেই হাসিতে পুরো শরীর রি রি করে ওঠে প্রিয়তার।সে তাচ্ছিল্য করে বলে,
“তবুও ভুলে যাবেন না, আমি তার প্রথম চয়েস ছিলাম।আর আপনি তার কাছে অপশনাল।শুধুমাত্র শারীরিক সুখের জন্য আপনাকে খুঁজেছে।এমন সুখ তো আজকাল প’তিতারাও তার কাস্টমারকে দেয়।”
কথাটা শুনে রাগে গর্জে ওঠে নীলি।দাঁত কটমট করে সে বলে,
“কি বললে তুমি?তোমার সাহস তো কম নয়।আমাকে পতিতা বললে?”
“পতিতা বলিনি আপু।তাদের সাথে তুলনা করেছি মাত্র।তাদের আর আপনার মাঝের তফাৎ কোথায় জানেন?তারা যেকোনো ক্লায়েন্টকে টোপ হিসেবে নেয়।আর আপনি নির্দিষ্ট একজনক টোপ হিসেবে নিয়েছেন।এইতো!”
“আমি কি করছি না করছি তা আমার ব্যপার।এসব নিয়ে নাক গলাতে হনে না তোমাকে।কল দিয়েছো কেনো তাই বলো?ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে তাও ছ্যাচড়ার মতো এ বাড়ির সাথে যোগাযোগ করছো।লজ্জা করেনা!”
কথাটা শুনে রাগে গা জ্বলে উঠে প্রিয়তার।কড়া গলায় সে বলে,
“লজ্জা করার কথা তো আপনার।বিয়ের আগেই ওই বাড়িতে ছ্যাচড়ার মতো পড়ে রয়েছেন।আবার আসছেন আমাকে নিয়ে কথা বলতে!”
কথাটা বলে প্রিয়তা কল কাটতে যাবে ঠিক তখনই ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পায় তার শাশুড়ীর ক্ষীন কণ্ঠ। ঘরে প্রবেশ করতে করতে তিনি বললেন,
“কে ফোন করেছে?”
প্রতিউত্তরে সেদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় নীলি।নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বাঁকা হেসে বলে,
“আপনার ছেলের ছুঁড়ে ফেলা প্রাক্তন বউ।নিন কথা বলুন।”
চরম অবজ্ঞা মিশিয়ে কথাটা বলে জামেলার নিকট ফোন দিলো নীলি।জামেলা বানু বিষ্মিত হয়ে ফোন হাতে নিলো।আর তার পরই তার স্পষ্ট কণ্ঠে বললো,
“কেমন আছো মা?”
প্রিয়তা অনিচ্ছা সত্বেও বললো,
“জ্বী আলহামদুলিল্লাহ।আপনি?”
প্রতিউত্তরে জামেলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।কপট দুঃখ দেখিয়ে বললো,
“আল্লাহ যেমন রাখেন তেমন আছি।কিছু বলবে?”
“হুম, আমার বইগুলো ও বাড়িতে রেখে এসেছি।ওসব পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।”
#চলবে….