গল্পঃ তিথির প্রতিজ্ঞা ( চতুর্থ পর্ব )
বাঘটা তিথির ওপর পড়তে একটু বাকি এমন সময় দূরে ঝোপের আড়াল থেকে কেউ তার পায়ের কাছে থাকা ছোট্ট একটা ব্যঙকে লাথি মারলো বাঘটা লক্ষ করে, ব্যাঙটা বিদ্যুৎ গতিতে উড়ে যেতে যেতে বিশালাকৃতি ধারণ করলো।
বাঘটা তিথির ওপর পড়বে এমন সময় ব্যঙটা এসে বাঘের মুখের ওপর সজোরে পড়লো। বাঘটা ছিটকে গিয়ে বড়ো একটা গাছের শেকড়ের ওপর পরে অজ্ঞান। আর ব্যাঙটা গিয়ে পড়লো বাঘের ওপর।
এবার ব্যঙটা বাঘের লেজ কামড়ে ধরে বাঘটাকে টানতে টানতে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে দূরে নিয়ে যেতে লাগলো।
তিথি অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে, কি হচ্ছে এসব কিছুই বুঝতে পারছেনা সে।
তবে এটুকু বুঝলো যে আসেপাশে কেউ আছে এবং এ যাত্রায় তিথিকে সেই রক্ষা করেছে। সে যে-ই হোক তিথি মনে মনে তাকে ধন্যবাদ জানাতে ভুললো না।
এবার পেছনের দিক থেকে ভেসে আসা মানুষের কণ্ঠস্বর– গহীন বনে স্বাগতম প্রিয় অচেনা সুন্দরী– শুনে বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়াতেই আবারও আরেক বিপদে তিথি। হাওয়ায় ভেসে বিজলির মতো চমকাতে চমকাতে একটা তীর তিথির মাথা বরাবর এসেগেছে প্রায়। তিথি কিছু বুঝে ওঠার আগেই তীরটা তিথির কপাল বরাবর এসে থেমে গিয়ে একটা ফুলের তোড়ায় পরিনত হলো। অন্য একটা তীর ছুটে এসে সেই ফুলের তোড়ায় আঘাত করতেই ফুলের পাপড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিথির ওপর পড়লো।
আবার সেই অদৃশ্য ব্যক্তির কণ্ঠস্বর– কি স্বাগতম জানানোর ধরনটা কেমন সুন্দরী?
তিথি বললো– কে তুমি? আর সামনে কেন আসছো না।
সেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর বললো– ঠিক বুঝতে পারছিনা এই গভীর জঙ্গলে এমন অপুর্ব রূপবতী আপনি মানুষ নাকি অন্য কিছু।
– আমি একদম রক্ত মাংসের গড়া মানুষ, আপনি যে-ই হন এটা নিশ্চিত হতে পারেন।
সেই ব্যঙটা লাফাতে লাফাতে এসে তিথির সামনে দিয়ে কিছুদূর গিয়ে থামলো।
তারপর ব্যাঙের মাথার ওপর একটা পালক দৃশ্যমান হয়ে এমন ভাবে দুলতে লাগলো যেন কেউ পালকটা ব্যাঙের মাথায় আদর করে বুলিয়ে দিচ্ছে।
এবার সেখান থেকেই অদৃশ্য কণ্ঠস্বর শোনা গেল– সাব্বাস ছোটু, অনেক বাহাদুরি দেখিয়েছো, এবার বিশ্রাম নাও।
ব্যঙটা চোখের সামনে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
এবার ধীরে ধীরে পালকটি ধরা অবস্থায় একটা হাত দৃশ্যমান হতে হতে সম্পুর্ন এক যুবক দৃশ্যমান হলো। সুঠাম দেহ, গায়ের রং ফর্সা তবে অযত্নে কালছে ফ্যাকাসে বর্ন ধারণ করেছে তার। চোখের মনি ইষত নীল। মনে হচ্ছে এই জঙ্গলেই তার বসবাস।
তিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে দেখে যুবক বললো– এই যে অপরিচিতা সুন্দরী, আমি ভিন্ন গ্রহ থেকে আসা কোনো এলিয়েন নই যে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে। আমিও মানুষ।
তিথি অবাক হয়ে বললো– কিন্তু তোমার এই অদ্ভুত জাদুকরী ক্ষমতা সে কিকরে সম্ভব!
পালকটি শুন্যে ভাসিয়ে নিলয় পালকে ফু দিতেই খাবারে ভর্তি একটি প্লেট দৃশ্যমান হয়ে শূন্যে ভেসে রইলো।
প্লেটটা তিথির দিকে ঠেলে দিতেই হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে প্লেটটা তিথির দিকে যেতে লাগলো। নিলয় বললো– পরিচয় পর্ব পরে হোক, আগে কিছু খেয়ে নিন, দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত আপনি।
তিথি প্লেটটা আবার নিলয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো– ধন্যবাদ অশেষ, যাত্রা পথে অতিরিক্ত আহার ঠিক নয় মোটেই।
প্লেটটা হাওয়ায় ভেসে নিলয়ের সামনে যেতেই নিলয় প্লেটে সেই পালক স্পর্শ করতেই প্লেটটা গায়েব হয়ে গেল।
পালকটা দেখে তিথির মনে বারবার সন্দেহ হচ্ছিল এই কি সেই ছেলে যে জ্বীনদের পালক চুরি করেছিল, এই সেই কারণে তিথির বাবা ওদের রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেছিল!
নিলয় ছোটু বলে ডাকতেই সেই ছোট্ট ব্যঙটা দৃশ্যমান হয়ে নিলয়ের কাঁধে বসলো।
নিলয় তিথিকে বলতে শুরু করলো– তা এরকম সুন্দরী এক মেয়ের ভয়ঙ্কর জঙ্গল পাড়ি দেবার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো বড়সড় রহস্য লুকিয়ে আছে!
নিলয়ের কথা শেষ হতে না হতে ব্যাঙটা নিলয়ের কানের ওপর একটা চড় মারলো।
নিলয় ব্যাঙের দিকে তাকিয়ে দাঁত কটমট করে বললো– ছোটু শক্তি ফল পেড়ে দেবার জন্য ডেকেছি।
ব্যঙটা চোখের পলকে জিভটা লম্বা করে ছুড়ে মেরে পাশের একটা গাছের ডালে ঝুলন্ত আঙুল ফলের মতো এক ধরনের ফলের একটা থোকা জিভ দিয়ে পেচিয়ে টেনে ছিড়ে নিলয়ের কাঁধে এনে ফেললো।
– ঠিক আছে ছোটু এবার তুমি যেতে পারো– বলতেই ব্যঙটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
একটা ফল ছিড়ে নিলয় মুখে দিয়ে তিথিকে বললো– আসলে ছোটুকে ডেকে বসিয়ে রাখলে ওর মেজাজ গরম হয়ে যায়। ওকে কাজ দিতে হয় ডাকলে। সে যা-ই হোক বলুন আপনার এই জঙ্গল যাত্রার উদ্দেশ্য মিস অপরিচিতা।
তিথি ভ্রু কুঁচকে বললো– তার আগে বলো তোমার ঐ পালকের রহস্য, এটাই কি সেই জ্বীনদের পালক?
নিলয় লাফিয়ে একটা গাছের ডালে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে বললো– হ্যা কিন্তু আপনি কি করে জানেন মিস অপরিচিতা?
তিথি বললো– তাহলে তুমিই সেই পালক চুরি করা ছেলেটা মানে আব্রাহাম?
নিলয় লাফিয়ে গাছের ওপর থেকে নেমে তিথির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বললো– বাহ! অপরিচিতা তাহলে পরিচিত দেখছি, যাই হোক আমি আর আব্রাহাম নই, আমি নিলয়।
–ছদ্মনাম কেন মিস্টার আব্রাহাম, নাম পাল্টালেই কি পাপ মোচন হয়ে যাবে?– বললো তিথি।
নিলয় বললো– আমার পূর্বপুরুষ এ রাজ্যে এসেছিল সুদূর বঙ্গদেশ থেকে, আমার দাদা এই নাম রেখেছিলেন আমার চোখের মনি নীল দেখে। আমার জন্ম এ দেশে হয়েছিল বলে আমার নাম রাখা হয়েছিল আব্রাহাম। আমার পরিবার এদেশ থেকে বিতারিত হবার সাথে সাথে আমিও আব্রাহাম নামটা বাদ দিয়ে দিয়েছি মিস। এখন শুধু প্রতিশোধের পালা। যা-ই হোক আপনার নামটা যদি বলতেন।
তিথি বললো– আমি রাজকন্যা তিথি।
নিলয় ভ্রু কুঁচকে বললো– ও হো, তারমানে রাজা এসামের বড়ো কন্যা, সম্পুর্ন নাম মীরা তিথি, ছোটবোন মারিয়া তিথি?!
তিথি বললো– একদমই তাই মিস্টার আব্রাহাম নিলয়।
নিলয় গাছের সাথে মাথা ঠুকতে শুরু করলো, তাই দেখে তিথি বললো– এসব কি হচ্ছে?
নিলয় ঘুরে দাড়িয়ে কোমরের খাঁজে রাখা তলোয়ার টেনে বের করে বললো– ভুল তাও এতবড় ভুল, শত্রুকেই কিনা বাঘের হাত থেকে বাঁচালাম, রাজা এসামের পরিবার ধ্বংস করেই এ রাজ্য ছাড়বো এই প্রতিক্ষায় বসে আছি আজ পর্যন্ত। এবার তোমাকে দিয়ে শুরু করবো। সমস্যা নেই বাঘের হাত থেকে বাঁচিয়ে এবার নিজের হাতে মারবো।
কথা শেষ করেই নিলয় বিদ্যুৎ গতিতে তিথির বুকের মাঝখান বরাবর তলোয়ার চালালো…
চলবে…
লেখকঃ নিলয় আহমেদ।