গল্পঃ #তিথির_প্রতিজ্ঞা ( তৃতীয় পর্ব )
নিলয়কে মারিয়ার পাশ দিয়েই নিয়ে যাচ্ছে সৈন্যরা, সেদিকে তাকিয়ে নিলয়ের গলায় মারিয়া এমন একটা জিনিস দেখলো যে মারিয়া হতভম্ব, বিস্মিত, এটা কীভাবে সম্ভব?!
রাজ পরিচারিকারা এসে মারিয়ার চারপাশে ঘিরে দাড়িয়ে একটা লম্বা কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে তার ভেতর দুজন ঢুকে মারিয়াকে পোশাক পড়িয়ে নিয়ে গিয়ে অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করলো।
নিলয়ের গলায় সেই জিনিস দেখার পরে থেকে মারিয়ার মনে আর কোনো ভয় নেই, সেই জিনিসটা যেন একটা ভরসা। সেটা একটা বার্তা যে মারিয়া তোমার ভয় নেই, আমি তোমাকে মুক্ত করে নিয়ে যেতে আসতেছি, আমি তোমার সঙ্গে আছি।
রাত গভীর, গুপ্তচর নিলয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এসে রাজা ফ্র্যাঙ্কের সামনে উপস্থিত। ফ্র্যাঙ্ক বললো কী তথ্য পেলে?
গুপ্তচর বললো– মহারাজ ছেলেটা সত্যি বলেছে। রাজা এসামের বাবা মানে মারিয়ার দাদা রাজ সিংহাসনে থাকা অবস্থায় রাজ্যের বন জঙ্গলে ঘেরা একটা অংশে লোকজনের যাওয়া সম্পুর্ন নিষেধ করেছিলেন। কারণ ওটা তিনি জ্বীনদের বসবাস করার জন্য দিয়েছিলেন। মারিয়ার দাদা খুব ধার্মিক ও দয়ালু ছিলেন বলেই জ্বীনদের সাথে সখ্যতা ছিল ভীষণ। জ্বীনরাই মারিয়ার দাদাকে বেশ আলৌকিক শক্তি দিয়েছিলেন উপহার স্বরূপ। মারিয়ার দাদা আবার সেসব মারিয়ার বাবা ও মারিয়ার বড়ো বোন তিথিকে দিয়ে গেছেন। যাই হোক সেই নিষিদ্ধ জঙ্গলে প্রবেশ করে জ্বিনদের জাদুর পালক চুরি করেছিল ঐ নিলয়। অনেক মারধর করার পরেও নিলয় যখন অস্বীকার করে তখন নিলয়ের পরিবারকে দেশ ছাড়া করা হয়, কিন্তু নিলয় পালিয়ে থেকে যায় জঙ্গলে প্রতিশোধের নেশায়।
রাজা ফ্র্যাঙ্ক উঠে দাড়িয়ে বললো– বাহ! এসামের আরও একজন শত্রু পাওয়া গেল। যেহেতু অস্বীকার করেছিল তার মানে জাদুর পালক এখনও ওর কাছেই আছে। ভালোই হলো, ছেলেটা যেমন চতুর তেমন তরোয়ালবাজ।
রাজা ফ্র্যাঙ্ক সৈন্য ঢেকে হুকুম দিলেন বন্দিশালা থেকে নিলয়কে মুক্ত করে তার কক্ষে নিয়ে আসতে।
নিলয়কে নিয়ে আশা হলো রাজা ফ্র্যাঙ্কের কক্ষে। আসন ছেড়ে উঠে গিয়ে রাজা ফ্র্যাঙ্ক একটা বিশেষ তলোয়ার নিলয়ের হাতে দিয়ে বললো– আজ থেকে তুমি আমার বিশেষ সৈন্যদলের সেনাপতি নিলয়।
নিলয় হাসিমুখে রাজাকে কুর্নিশ করলো।
এদিকে অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী মারিয়ার মুখে আনন্দের হাসি, এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিও কারো মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারেনা যখন প্রিয়জন পাশে এসে দাড়ায় বা ভরসা দেয়।
নিলয়ের গলায় মারিয়া যা দেখেছিল সেটা হলো ছোটবেলায় বাবার দেয়া দুই বোনকে উপহার দুটি মুক্তার মালা।
একটি মারিয়ার গলায় আছে এবং অন্যটি তিথির গলায় থাকার কথা। কিন্তু তিথিরটা নিলয়ের গলায় আসলো কীভাবে! তাহলে কি নিলয়কে মালাটা দিয়ে তিথিই এখানে পাঠিয়েছে যেন এটা দেখে মারিয়া ভরসা পায়? যদি তাই হয় তবে তিথি নিলয়কে চেনে কীভাবে বা খুঁজে পেলো কোথায়? তিথি নিজেই বা কোথায়?
চিন দেশে তিথির কানে যখনই খবর পৌঁছায় যে রাজা ফ্র্যাঙ্ক মারিয়াকে বন্দী করেছে, তারপরই তিথি চলে আসে। এক কন্যা হারানোর যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়া বৃদ্ধ বাবার অসহায় চাহনি তিথির মনে দৃড় সংকল্পের জন্ম দেয়, বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে তিথি প্রতিজ্ঞা করে যেভাবেই হোক ছোট বোন মারিয়াকে তো ফিরিয়ে আনবেই সেই সাথে রাজা ফ্র্যাঙ্ককে চিরতরে দমন করবে।
রাজ প্রাসাদ থেকে বেড়িয়ে পড়লো তিথি সঙ্গে নিয়ে তার দাদার দেয়া জাদুকরী তরোয়াল ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে। হাতের তরোয়ালটা শূন্যে ছুড়ে মেরে তুড়ি বাজাতেই তরোয়ালটা একটা ফুল হয়ে তিথির হাতে এসে পড়লো, ফুলটা খোঁপায় গুঁজে তিথি এগিয়ে চললো।
দুই রাজ্যের মধ্যিখানের জঙ্গল পর্যন্ত এসে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। জঙ্গলের ভেতর ধীরে ধীরে অন্ধকার এতটাই গভীর হচ্ছে যে চলা অসম্ভব।
এক যায়গায় স্থির হয়ে দাড়িয়ে কোমরের ছোট্ট থলি থেকে ছোট ছোট কয়েকটি কুমড়োর বীজের মতো কিছু ডান হাতের তালুতে রেখে হাতটা সামনে প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে কিছু একটা উচ্চারণ করতেই সেই কুমড়ো বীজের মতো দেখতে বস্তুগুলো জীবন্ত জোনাকি পোকা হয়ে আলো জ্বালতে লাগলো।
জোনাকি পোকা আলো জ্বেলে সামনে উড়ে যাচ্ছে আর তাদের আলোতে তিথি পথ চলছে।
অনেকদূর যাবার পরে দূর থেকে শেয়ালের ডাক ভেসে আসতেই জোনাকি গুলো দপ করে নিভে গেল। তিথি থমকে দাড়ালো। রাত অনেক হলো, আর সামনে না এগোলেই ভালো হবে।
বিশাল একটা গাছে চড়ে দুই ডালের মাঝখানে শুয়ে পড়লো তিথি।
শেষ রাতে হঠাৎ তিথির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলতেই বুকটা দুম করে উঠলো। বিশাল এক সাপ জড়িয়ে আছে তিথির গায়ে, ফনা তুলে তিথির কপাল বরাবর ছোবল মারতে বাকি মাত্র।
তিথি মুখে শিস বাজাতেই কয়েকটা কালো রঙের মাকড়সা দৃশ্যমান হয়ে চোখের পলকে সাপটার মুখ পেচিয়ে ফেললো। অবস্থা বেগতিক দেখে তিথিকে ছেড়ে ভয়ে সাপটা ভয়ে কেটে পড়লো।
ধীরে ধীরে ভোরের আলো জঙ্গলের অন্ধকার তাড়িয়ে নিজের স্থান দখল করলো।
গাছ থেকে নেমে একটা ছোট্ট ঝোপের ভেতর থেকে একটা মৌমাছির বাসা ভেঙে সেটা থেকে মধু খেলো তিথি। তারপর খোপায় গোঁজা ফুলটা শূন্যে ছুড়ে তুড়ি বাজাতেই ফুলটা তলোয়ারে পরিনত হয়ে তিথির হাতে পড়লো।
তলোয়ার দিয়ে বাঁশঝাড়ে কেবল গজিয়ে উঠা একটা কচি বাঁশ গোড়া থেকে কেটে বাঁশটার একটা গাটের উপর দিক থেকে কেটে ভেতরে জমা পানি পান করলো তিথি।
এরপর পুনরায় তলোয়ারটা শূন্যে ছুড়ে তুড়ি বাজাতেই তলোয়ার ফুল হয়ে হাতে পড়লো, ফুলটা খোঁপায় গুঁজে তিথি এগিয়ে চললো। জঙ্গলের একেবারে গভীর এসে পড়েছে তিথি।
হঠাৎ পেছনের দিক থেকে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বণি কানে আসতেই তিথি বিদ্যুৎ গতিতে ঘুরে পেছনে তাকাতেই হৃৎস্পন্দন বন্ধ হবার উপক্রম। ভয়ে তিথির শরীর অবশ হয়ে এসেছে যেন। বিশালাকৃতির একটা কালো বাখ ওঁত পেতে আছে এক্ষুনি তিথির ওপর ঝাপিয়ে পড়বে।
চোখের পলকে বাঘটা তিথিকে লক্ষ করে লাভ দিয়ে শূন্যে ভেসে তিথির দিকে আসতে লাগলো।
এইটুকু মূহুর্তে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে তিথি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো।
বাঘটা তিথির ওপর পড়তে একটু বাকি…
চলবে…
লেখকঃ নিলয় আহমেদ।