গল্পঃ তিথির প্রতিজ্ঞা।
লেখকঃ নিলয় আহমেদ।
মারিয়াকে উলঙ্গ করে হাত পা বেঁধে একটা উঁচু বেদীর উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে, স্রেফ একটা সাদা কাপড় দিয়ে মারিয়ার শরীর ঢাকা। রাজার হুকুম পেলেই সৈন্যরা কাপড় সরিয়ে শতশত প্রজাদের সামনে একের পরে একজন ধ*র্ষ*ণ করবে মরিয়াকে।
আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত মারিয়ার, চোখের জল গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারো ক্ষমতা নেই মারিয়াকে এই অত্যাচারী রাজা ফ্র্যাঙ্কের হাত থেকে রক্ষা করার।
রাজা ফ্র্যাঙ্ক চতুর্দিকে পরিচিত তার নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার জন্য। সৃষ্টিকর্তা যেন তাকে দয়ামায়ার ছিটেফোঁটাও দিয়ে সৃষ্টি করেননি, মানুষ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে রাজা ফ্র্যাঙ্ক তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ। জুলুম ও অত্যাচার করে দখল করে নিয়েছে অনেক রাজ্য, আর অনেক রাজ্যের রাজা নিজের ও পরিবারের প্রাণ রক্ষার্থে সিংহাসন ছেড়ে সেচ্ছায় বনবাস যাপনে। দিনদিন ক্ষমতার সাথে সাথে লোভও বেড়ে চলেছে রাজা ফ্র্যাঙ্কের। তার ইচ্ছে হলো শুধু মাত্র রাজ্য নয়, পুরো পৃথিবীতে অধিপত্য বিস্তার করা, পুরো পৃথিবীকে নিজের গোলাম করার বাসনায় দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছে রাজা ফ্র্যাঙ্ক। তার এবং দখলকৃত রাজ্যের প্রজারা বাধ্য হয়ে তার অনুগত্য হলেও রাজা ফ্র্যাঙ্কের প্রতি কারো মনে বিন্দুমাত্র দয়ামায়া নেই। ক্ষমতার দাপটে রাজা ফ্র্যাঙ্ক কোনদিন ভাবতেই পারেনি বা ভাবার প্রয়োজন মনে করেনি যে ভয় নয়, ভালোবাসা দিয়েও বিশ্ব জয় করা যায়।
বেদীর উপর অনড় হয়ে পড়ে আছে হাত পা বেঁধে রাখা মারিয়া, সামনে শতশত সৈন্যরা এবং তাদের পেছনে হাজার হাজার প্রজা উপস্থিত। রাজা ফ্র্যাঙ্কের হুকুম সবার উপস্থিত থাকতে হবে। সবাই এই করুন মর্মান্তিক দৃশ্য স্বচক্ষে দেখবে এবং যত বেশি লোকে দেখবে তত বেশি খবর ছড়িয়ে পড়বে দেশ বিদেশে যে রাজা ফ্র্যাঙ্ক কতটা ভয়ঙ্কর, এবং সবাই বুঝবে রাজা ফ্র্যাঙ্কের বিরোধিতা করলে তার পরিনাম কত ভয়ঙ্কর হতে পারে।
মনে মনে মারিয়া সৃষ্টিকর্তাকেই স্মরণ করছে প্রতিটি মুহূর্ত। একটা মেয়ের সবথেকে বড়ো সম্পদ তার ইজ্জত। সেই ইজ্জত নষ্ট হবার আগে মরে যাওয়া ভালো এটা যেকোনো মেয়েই চাইবে। মারিয়ার কোনো দুঃখ হতনা যদি তাকে হত্যা করা হতো। কিন্তু রাজা ফ্র্যাঙ্কের পরিকল্পনা বরাবরের মতোই ভয়ংকর ও নিষ্ঠুরতম। এভাবে হাজার লোকের সামনে উ*ল*ঙ্গ করে তারপর ধর্ষণ করা, তাও আবার রাজকন্যা মারিয়াকে, ইতিহাস থেকে এত সহজে যে মুছবে না। মৃত্যুর পরেও হয়তো হাজার বছর লোকমুখে রয়ে যাবে এই কাহিনি। এসব ভেবে ভেবে কষ্ট যন্ত্রণায় মারিয়ার বুকটা ফেটে যাবার উপক্রম। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা।
হঠাৎ সৈন্যরা তাদের হাতের অস্ত্র সমবেত ভাবে মাটিতে ঠুকে অদ্ভুত এক শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে তুললো। এরকমটা হয় তখন– রাজা ফ্র্যাঙ্ক তার রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসার আগ মুহূর্তে।
ঠিক তাই হলো–
রাজা ফ্র্যাঙ্ক রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসলো, তার পেছনে পেছনে ধীর গতিতে এগিয়ে আসছে তার পোষা ভয়ঙ্কর কালো চিতাবাঘ দুটো। এই চিতা দুটো ভীষণ ভয়ংকর, এদেরকে রাজা ফ্র্যাঙ্ক মানুষের র*ক্ত ও মাং*স খেতে দেয়। এরাই রাজা ফ্র্যাঙ্ককে বেশ কয়েকবার শত্রুপক্ষের হামলা থেকে প্রাণে বাঁচিয়ে এনেছে। এর জন্যই কালো চিতা দুটো রাজার ভীষণ প্রিয় ও বিশ্বস্ত।
রাজা ফ্র্যাঙ্কের আরেকটা ভয়ংকর বিষয় হলো কুমারী মেয়েদের দেহ ভোগ করে নিজেকে চির তরুণ রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। প্রায় প্রতিদিন একটা করে কুমারী মেয়ে তার শয্যায় চাই। দেহ ভোগের সময় যদি কোনো মেয়ে বাধা প্রদান করে তাহলে তার দেহ তো রাতভর ভোগ করবেই, এবং সকাল হতে হতে সেই মেয়েকে হত্যা করে প্রজাদের সামনে সেই মেয়ের বুকের দুটো স্তন কেটে দুটো চিতাকে খাওয়াবে।
এসব খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পরার পরে থেকে কোনো মেয়ে রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা নিশ্বাস ফেলারও সাহস পায়না। এবং রাজার এই অত্যাচার থেকে বাঁচতে অনেক মেয়ে আগেভাগেই পরিবার ছেড়ে গভীর অরণ্যে পালিয়ে গিয়ে আ*ত্ম*হ*ত্যা করে নিজের প্রাণ নিজে অকালে বিসর্জন দিয়েছে।
শুরুতে বলা হয়েছিল রাজকন্যা মারিয়া, হ্যাঁ মারিয়া একজন রাজকন্যা। কিন্তু তাহলে মারিয়ার এমন করুণ দশা কেন?
রাজা ফ্র্যাঙ্ক এর পাশের উত্তরের রাজ্যের রাজা মারিয়ার বাবা মহারাজ এসাম। চারিদিকে বেশ সুনাম রয়েছে তার। প্রজাদের যেমন সন্তানের সমতূল্য স্নেহ করেন ভালোবাসেন, প্রজারাও তেমন রাজা এসামের প্রতি নিবেদিত প্রাণ। আশেপাসের সমস্ত রাজ্য ততদিনে রাজা ফ্র্যাঙ্ক দখল করে নিয়েছে। রাজা এসাম ছিলেন এক কথার মানুষ এবং স্বাধীনচেতা, পরাধীনতার শেকল পরার মতো মানসিকতা না তার ছিল, না আছে, না থাকবে। বারবার নিজের সৈন্যদল নিয়ে নিজে ঝাপিয়ে পড়ে প্রতিহত করেছেন ফ্র্যাঙ্কের সৈন্যদের। আর রাজা ফ্র্যাঙ্ক হয়তো এই কারণেই এতদিন এতটা গুরুত্ব দেয়নি যে এসামের রাজ্য তো হাতের নাগালে, দখল করতে আর কতক্ষণ।
ফ্র্যাঙ্ক এবং মারিয়ার বাবার রাজ্যের সীমান্তে ঘন জঙ্গল। মারিয়া সেদিন ঘোড়ায় চড়ে কয়েকজন সৈন্য সঙ্গে নিয়ে জঙ্গলে এসেছিল ঘোরাঘুরি করতে। ঘুরতে ঘুরতে একসময় গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করে মারিয়া। এক স্থানে এসে থমকে দাড়ায় মারিয়া ও তার সৈন্যরা।
এখানে সম্পুর্ন অপরিচিত এক ধরনের ছোট গাছে থোকায় থোকায় সোনালী রঙের অদ্ভুত সুন্দর ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো এতটাই সুন্দর যে মারিয়া কিছুতেই ফুলগুলো ছুয়ে দেখার ইচ্ছা দমন করতে পারছে না।
ঘোড়ার পিঠ থেকে মারিয়া ও তার সৈন্যরা নামলো। মারিয়া কয়েকপা এগিয়ে গিয়ে ফুলগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই একটা ভীষণ সুন্দর প্রজাপতি উড়ে এসে মারিয়ার হাতে বসলো।
এদিকে প্রজারাও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ফুলগুলোর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ প্রজাপতিটা উড়ে ধীরে ধীরে জঙ্গলের গভীরের দিকে যেতে শুরু করলো। মারিয়াও কেমন সেই প্রজাতিরর পেছন পেছন এগিয়ে চললো নিজের অজান্তে।
সৈন্যরা তাকিয়েই আছে ফুলগুলোর দিকে, হঠাৎ একঝাঁক রঙ্গিন মউমাছি উড়ে এলো কোথেকে। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা। মউমাছিগুলো উড়ে উড়ে ফুলে না বসে সৈন্যদের হাতে বসলো। সৈন্যরা তো মাহা আনন্দে আত্মহারা। হঠাৎ সবগুলো রঙিন মউমাছি কালো রঙের হয়ে একসাথে সব সৈন্যদের হাতে হুল ফোটাতেই সৈন্যরা ছটফট করতে করতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। আর মউমাছিগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল।
মারিয়া যে প্রজাতির পেছনে পেছনে জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে এসেছে সেটা হঠাৎ বুঝতে পেরে মারিয়া থমকে দাড়ালো। প্রজাপতিটাও শূন্যে স্থির হয়ে রইলো।
মারিয়া ভাবছে এসব কি হচ্ছে। মারিয়ার ভাবনা শেষ হতে না হতেই চোখের পলকে সেই প্রজাপতি বিশাল এক ডানাঅলা দানবে পরিনত হয়ে খব করে মারিয়াকে ধরে উড়ে চললো।
এবং সেই দানব মারিয়াকে নিয়ে এসে রাজা ফ্র্যাঙ্কের হাতে তুলে দেয়। এভাবেই মারিয়া রাজা ফ্র্যাঙ্কের হাতে বন্দী হয়। কালো জাদুতে পারদর্শী রাজা ফ্র্যাঙ্ক এভাবেই এতটা শক্তিশালী। ফ্র্যাঙ্কের পরিকল্পনা হলো এসামের ছোট মেয়ে মারিয়াকে এই অবস্থা করলে সেটা শুনে হয়তো বড়ো মেয়ে তিথির জীবনের কথা ভেবে হলেও এসাম নত হয়ে সিংহাসন ছেড়ে দেবে। মারিয়ার এই অবস্থার কথা যেমন পৌছে গিয়েছিল চতুর্দিকে, তেমন পৌছে গিয়েছিল সুদূর চিন দেশে যেখানে মারিয়ার বড়োবোন তিথি রনকৌশল শিক্ষার জন্য গিয়েছে। রাজকুমারী তিথি বাবার মতোই নির্ভীক এবং স্বাধীনচেতা। একটা ছেলে নেই সেটা নিয়ে বাবাকে আফসোস করতে দেখেছে বহুবার। তাই রাজকুমারী তিথির ভাবনা নিজেকে একজন পরিপূর্ণ যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করে বাবার ভরসা হওয়া।
যা-ই হোক রাজা ফ্র্যাঙ্ক তার অত্যন্ত প্রিয় জনাকয়েক সৈন্যকে ডাকলেন বেদীর কাছে। মারিয়ার দুচোখের জল টলমল করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। রাজা ফ্র্যাঙ্ক একজন সৈন্যকে হুকুম দিলেন সাদা কাপড়টা টেনে সরিয়ে মারিয়াকে উলঙ্গ করতে। সৈন্যটা এগিয়ে গিয়ে সাদা কাপড়ের এক কোণা ধরে টান দিতেই…
চলবে…