তিক্ত প্রতিশোধ পর্ব-০১

0
1612

#তিক্ত_প্রতিশোধ
#Raiha_Zubair_Ripte

বিয়ের কবুল বলার পর বিদায়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে,শশুর বাড়ি যাবার জন্য গাড়িতে উঠতে নিলে হঠাৎ আমার মামি দৌড়ে এসে চিল্লিয়ে বলে উঠে আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মৃ’ত দেহ নাকি আমাদের স্টোর রুমে ঝুলে আছে ফ্যানের সাথে। কথাটা শোনা মাত্রই হইহট্টগোল শুরু হয়ে গেলো বিয়ে বাড়িতে। ” একটু আগেই তো মেয়েটা আমার পাশে ছিলো,ওয়াশরুমে যাবে বলে চলে গেলো।

মামির বলা কথাটা শোনা মাত্রই পাগলের মতো দৌড়ে চলে গেলাম আমাদের স্টোর রুমে,স্টোর রুমের দরজাটা খুলতেই দেখি রিয়ার দেহ টা ঝুলে আছে ফ্যানের সাথে,চারপাশে জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, দৌড়ে গিয়ে রিয়ার পা দুটো জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে বললাম,,

” মা বাবা,শুভ্র তাড়াতাড়ি ওকে নামাও না তোমরা, দেখো কতো কষ্ট পাচ্ছে আমার রিয়া,তোমরা চেয়ে চেয়ে কি দেখছো বলো তো।

শুভ্র আর অহনার বাবা মোশারফ এগিয়ে এসে রিয়ার দেহটা নামালো,অহনা রিয়ার পাশে বসে তার বাবাকে বলে,,

” বাবা তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকো না,দেখো রিয়ার গলাটা কিভাবে লালা হয়ে গেছে। রিয়াকে ঝাঁপটে ধরে চিল্লিয়ে বলে উঠে,,

এই রিয়া উঠ না দোস্ত, দেখ তোরে তো নামাইছি ওখান থেকে এবার তো চোখ খুল বোইন আমার,এই মা পানি দাও ও হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে,তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এই শুভ্র ধরে উঠাও না ওকে। বাবা তুমি চুপ হয়ে বসে আছো কেনো আরে তারাতাড়ি ডাকো না ডাক্তার।

শুভ্র অহনার পাশে বসে অহনাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। মাথায় হাত রেখে বলে,,

” অহনা শান্ত হও,রিয়া আর আমাদের মাঝে নেই।

কথাটা অহনার কর্ণকুহর হতেই শুভ্র কে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে দেয়,চেঁচিয়ে বলে উঠে,,

” এই তুমি কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলতেছো হ্যাঁ আমার রিয়া কেনো আমায় ছেড়ে চলে যাবে,ও তো কতো হৈ-হুল্লোড় মজা আনন্দ করলো আমার বিয়েতে তাহলে ও কেন সুইসাইড করবে,ওর তো কোনো দুঃখ নেই আর না ও কোনো রিলেশনে ছিলো তাহলে! তুমি তারাতাড়ি ডক্টর ডাকো।

কথাটা বলেই অহনা বসা থেকে উঠে আসে পাশে হন্নে হয়ে পানির গ্লাস খুঁজে, পানির গ্লাস না পাওয়ায় অহনা তার মা’কে বলে উঠে,,

” মা তোমায় সামান্য পানি আনতে বলেছি সেটা আনতে পারলে না সরো সামনে থেকে এতো ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে কেনো মানুষ।

কথাটা বলে স্টোর রুম থেকে বাহিরে এসে গ্লাস ভরে পানি নিয়ে রিয়ার চোখ মুখে ছিটিয়ে দেয়,গাল থাপড়ায়।

অহনার এমন পাগলামো দেখে শুভ্র জোরে কোষে একটা চ’ড় লাগায় অহনার গালে।

” এই তুমি কি পাগল হয়ে গেছো, আরে রিয়া আর নেই পৃথিবীতে তুমি বুঝতে চাইছো না কেনো,

সত্যিই তো রিয়া উঠছে না কেনো,ও তো শুয়ে থাকার মেয়ে না, ও কেনো রেসপন্স করছে না,কথাটা বলে রিয়ার নাকের কাছে হাত দিয়ে নিশ্বাস চেক করতে গেলে দেখে রিয়ার নিশ্বাস পড়ছে না,রিয়ার হাত টা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে এবার গলা ফেটে কান্না করে দেয় অহনা,এতোক্ষণ একটা ভ্রমে ছিলো অহনা,এমনিতে বিয়ের পর কান্নাকাটি করে অবস্থা প্রায় খারাপ,এবার অতিরিক্ত মাত্রায় কান্না করায় অজ্ঞান হয়ো যায় অহনা।

অহনা পড়ে যেতে নিলে শুভ্র ধরে ফেলে অহনাকে।
এই হচ্ছে শুভ্র যার সাথে অহনার বিয়ে হয়েছে কিছুক্ষণ আগে পারিবারিক ভাবে।
শুভ্র অহনাকে পাঁজা কোলে নিয়ে অহনার রুমে নিয়ে শুইয়ে দিছে।

অহনার বাবা মোশারফ হোসেন রিয়ার বাবা মা কে কল দিয়ে জানিয়ে দেয় রিয়ার ব্যাপার টা। শুভ্র এসে মোশারফ হোসেনের পাশে দাঁড়াতেই মোশারফ হোসেন বলে উঠে,,

” আমার মনে হয় না ও এমন টা করেছে, পুলিশ কে খবর দেওয়া উচিত। তার উপর খেয়াল করেছো তুমি ওর শরীরে জায়গায় জায়গায় কেমন ক্ষত,মনে হয় কিছু একটা ঘটেছে এখানে।

কথাটা বলে মোশারফ হোসেন পুলিশ কে ফোন দেয়।

রিয়ার মা বাবা তাদের একমাত্র মেয়ের মৃ’ত্যুর খবর শুনে পাগলের মতো ছুটে আসে। রিয়ার মা রুমি বেগমের অবস্থা প্রায় নাজেহাল,সে মেয়ের নিথর দেহটি ধরে কান্না করতে থাকে,কান্নার মাঝে বারবার বলে উঠে,,আমার মেয়ে কিছুতেই আত্ম’হত্যা করতে পারে না,আমার মেয়ের সাথে নিশ্চয়ই কিছু ঘটেছে,ও রিয়ার বাবা তুমি তো জানো আমাদের রিয়া কিছুতেই এ কাজ করতে পারে না।

এর মধ্যে পুলিশ চলে আসে পুরো ঘর টা সিল মেরে।দেয়,তরা রিয়ার মামিকে জিজ্ঞেস করে তিনি কিভাবে দেখলো এই লাশ টা,রিয়ার মামি বলে,,

“আসলে আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম পাশেই তো ওয়াশরুম, তো হঠাৎ দেখি এই দরজা খোলা কারন এই ঘরের দরজা সবসময় তালা লাগানো থাকে,দেখতেই তো পারছেন ধুলাবালি দিয়ে ভরা,তো আমি দরজার সাথে তালা ঝুলতে দেখে ভাবছি হয়তো কেউ ভুলে খুলে রেখে গেছে তাই তালাটা লাগাতেই চোখ যায় ফ্যানের দিকে,দেখামাত্রই ছুটে গিয়ে বাহিরে বললাম,এই টুকুই।

রিয়ার মামির কথা শুনে এক পুলিশ অফিসার রিয়ার লা’শ টা পর্যবেক্ষণ করে দেখে সায়েম নামের এক অফিসার কে বলে,,

” স্যার মনে হচ্ছে না এটা আত্ম’হত্যা কারন ভালো করে লক্ষ করলেই দেখতে পারবেন ওর সাথে কারো হাতাহাতি হয়েছে।

সায়েম নামের লোকটা রিয়ার বডির কাছে গিয়ে বলে,,

” হুম আমার ও সেটা মনে হচ্ছে, সে যাইহোক আমরা,আপাতদৃষ্টিতে এটাকে আত্ম’হত্যা ধরে নিচ্ছি,পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলে বাকিটা জানা যাবে।

রিয়ার মৃত দেহ পোস্টমর্টেমের জন্য নিতে চাইলে রিয়ার মা মেয়ের দেহ ধরে কান্না করতে থাকে সে কিছুতেই তার মেয়েকে দিবে না নিতে।

পুলিশ রিয়ার মা’কে ছাড়িয়ে রিয়ার বডি নিতে গেলে অহনা দৌড়ে আসে,রিয়ার মায়ের চেঁচামিচি তে অহনার জ্ঞান ফিরে আসে, রিয়ার দেহটা ধরে বলে,,

” এই আপনারা কই নিয়ে যাচ্ছেন আমার রিয়াকে ছেড়ে দিন বলছি,এই শুভ্র কই নিচ্ছে আমার রিয়াকে।

সায়েম নামের লোকটি বলে উঠে,,

” মিস্টার শুভ্র আপনি আপনার স্ত্রী কে সামলান, আমাদের কে আমাদের কাজ করতে দিন।

শুভ্র এগিয়ে এসে অহনাকে রিয়ার থেকে ছাড়িয়ে বলে,,

” রিয়ার বডি তারা পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাচ্ছে, নিতে দাও তাদের রিয়াকে।

শুভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আবার রিয়ার দেহটা শক্ত জড়িয়ে ধরে, যেনো না নিয়ে যেতে পারে রিয়াকে। রিয়াকে জড়িয়ে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে,,

” তোমার মাথা ঠিক আছে তো, পোস্টমর্টেম মানে বুঝো তুমি, তারা আমার রিয়ার বডি টাকে কাটা-কাটি করবে আমার রিয়া ব্যাথা পাবে আমি কিছুতেই তাদের সাথে আমি আমার রিয়াকে নিয়ে যেতে দিবো না।

পাশে থাকা রিয়ার মাকে বলে উঠে,,

” ও আন্টি দেখো না রিয়াকে ওরা নিতে চাইছে তুমি কিছু বলো না,ওরা আমার রিয়াকে আমার থেকে নিয়ে যাবে,আমার রিয়ার শরীর টা ওরা কে’টে ফেলতে চাইছে তুমি ওদের আটকাও না ও আন্টি।

কথাটা বলেই রিয়ার মায়ের হাতটা ধরতে গেলে রিয়ার মা জোড়ে কষিয়ে অহনার গালে চড় বসিয়ে দেয়,,

” খবরদার একদম আমায় আন্টি বলবি না,তোর জন্যই আজ আমার মেয়ের এই হাল,ও কেনো আমায় ছেড়ে চলে গেলো বলতে পারিস, তোর বিয়ের মধ্যে কেনো এ ঘটনা ঘটলো,তোর বিয়ে না হলে তো আমার মেয়ে আসতো না এ বাড়ি,আমাদের চোখের সামনেই থাকতো।

কথাটা বলে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে রিয়ার মা।

পাশ থেকে শুভ্র অহনাকে টেনে হিঁচড়ে ঘরে নিয়ে যায়। অহনা কিছুতেই যাবে না ঘরে, বারবার গলা ফাটিয়ে চিল্লিয়ে বলছে,,

” শুভ্র আমায় ছেড়ে দাও আমি আমার রিয়ার কাছে যাবো, ওরা রিয়াকে নিয়ে চলে যাবে, যেতে দাও না,তোমার পায়ে পড়ি ও শুভ্র ছেড়ে দাও না।

অহনার এমন পাগলামি আর সহ্য করতে না পেরে অহনাকে ঘরে এনে একটা ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে শুভ্র ।

ইনজেকশন পুশ করার পর ও বারবার বিরবির করে অহনা বলছিলো,,

” ও শুভ্র ওদের আটকাও না ওরা যেনো আমার রিয়াকে না নেয়,আমার রিয়া একা কোথাও যেতে চায় না আমায় ছাড়া,আমার রিয়া ভয় পাবে, আমি যাবো আমার রিয়ার সাথে।

শুভ্র একপলকে অহনার পানে চেয়ে থাকে মূহুর্তেই বিয়ে বাড়িটা কেমন শ্মশান ঘাটে পরিনত হলো। অহনার শাড়ি এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে বিছানায়,চুলগুলো পাগলের মতো হয়ে গেছে,সাজ লেপ্টে গেছে মুখে,পাগলের চাইতে কম কিছু লাগছে না অহনাকে,

কলিজার বেস্ট ফ্রেন্ডের মৃ’ত্যু হয়েছে নিজেকে ঠিক কিভাবে রাখবে,যাদের এক আত্মা এক প্রান, নিজের চাইতেও একে ওপর কে খুব ভালোবাসতো রিয়ার এই পরিনতি দেখে শুভ্র ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বেড়িয়ে যায় ঘর থেকে,পুলিশদের সাথেও তো আবার যেতে হবে।

শুভ্র ঘর থেকে বের হতে নিলে শুভ্রর বাবা আমজাদ হোসেন এসে বলে,,

” তোমরা কি ও বাড়ি যাবে না আজ।

শুভ্র আমজাদ হোসেনের দিকে চেয়ে বলে,,

” এই অবস্থায় কিভাবে যাওয়া যায় বলো তো আব্বা,আজ যাওয়া হবে না,কাল বা পরশু হয়তো বাসায় যাবো।

” লোকে কি বলবে,তাছড়া কাল তো তোমাদের রিসিপশন, সেটার কি হবে।

” ক্যান্সেল করে দাও ও বাড়ি যেয়ে নেই তার পর রিসিপশনের কথা ভাবা যাবে।

কথাটা বলে শুভ্র চলে গেলে আমজাদ হোসেন অহনার ঘরের চাপানো দরজা খুলে কিছু একটা দেখে চলে যায়।

শুভ্র ড্রয়িং রুমে আসতেই দেখে রিয়ার মা ও অজ্ঞান হয়ে গেছে এমনি তেই উনি হার্টের রোগী, অহনার মা কাঁপা কাঁপা হাতে রিয়ার মা রুমি বেগমের চোখ মুখে জল ছেটাতে থাকে। অহনার মা খুব ভীতু প্রকৃতির, এসব লা’শ ঘটনা দেখতে পারেন না,ফোবিয়া আছে তার।

শুভ্র খেয়াল করলো অহনার মা আস্তে আস্তে ঢলে যেতে নিলে শুভ্র ধরে ফেলে, শুভ্র চেঁচিয়ে মোশারফ হোসেন কে ডেকে অহনার মাকে ঘরে শুইয়ে দেয়। রিয়ার বাবা মোখলেস খান কে শুভ্র বলে উঠে,,

” আঙ্কেল আপনি আন্টি কে হসপিটালে এডমিট করান উনার তো এখনো জ্ঞান ফিরছে না।

মোখলেস খান কি করবে কোন দিকে যাবে, একদিকে স্ত্রী আর অন্য দিকে মেয়ে। শুভ্র খানিকটা মোখলেস খানের পরিস্থিতি আঁচ করে বলে উঠে ,,

” আঙ্কেল আপনি আন্টি কে নিয়ে যান হসপিটালে, আমি যাচ্ছি পুলিশদের সাথে,আমি এম্বুলেন্স ফোন করে দিয়েছি তারা আসলে আন্টিকে নিয়ে যান এদিকটা আমি সামলিয়ে নিবো।

কথাটা বলে শুভ্র পুলিশদের সাথে চলে যায় সাথে মোশাররফ হোসেন আর অহনার মামা সুমন যায়।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে