#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-১১
রূপ রাতে বাড়ি ফেরা মাত্র রূপের মা তাকে জানায়, আন্জুআড়া বানু তার জন্য অপেক্ষা করছে,
রূপ তার মাকে প্রশ্ন করে,
-মা আমার কাজে কি তুমি কষ্ট পেয়েছো?
শেফালী বেগম একটু সময় নিয়ে উওর দেয়
-তোমার বাবা তনুকে পছন্দ করতো না।তবে আমার তনুকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।তবে কষ্ট আমি পেয়েছি এটা জেনে যে োআমার ছেলে আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে।ছেলের বিয়ে নিয়ে মায়ের অনেক ইচ্ছে থাকে স্বপ্ন থাকে।
-সরি মা!
-তনুকে ছেলের বউ হিসেবে আমার মানতে সত্যিই কোনো সমস্যা নেই।তবে তুই অন্যায় করেছিস রূপ।এভাবে কাওকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলা ঠিক হয়নি!!
রূপ মাকে জরিয়ে ধরে…
-সরি মা আসলে মামনীকে যে কিছুতেই রাজি করাতে পারছিলাম না।প্লিজ তুমি কষ্ট পেয়ো না।
শেফালী বেগম রূপের গালে মুখে হাত বুলিয়ে আদর করে দেয়।
রূপ এবার গুটি গুটি পায়ে মামনীর কাছে যায়।
আন্জুআড়া বানু রূপকে কাছে ডেকে বসিয়ে দেয়।
-কোথায় ছিলে বাবা?
-একটু কাজ ছিলো!তুমি আমার উপর রেগে আছো মামনী?
-জানি না।তুমি কি জানো তনু আমার নিজের মেয়ে না?
রূপ মাথা নিচু করে আছে।আন্জুআড়া বানু আশা করেছিলো রূপ হয়তে চমকাবে,হয়তো অবাক হয়ে রিয়াক্ট করবে।কিন্তু রূপ কোনো রিয়াক্ট করে না।চুপ চাপ আছে।
আন্জুআড়া বানু রূপকে কাছে ডাকে।
-আমার কাছে বসো।কথা আছে,
-তনু আমার মেয়ে না রূপ,আমার জীবনে ভালোবাসা নিয়ে এক্সপেরিয়েন্স অনেক ভয়ংকর।আমি ভালোবাসায় ভয় পাই।তুমি হয়তো আমাকে তনুর খারাপ মা হিসেবে জানো কিন্তু দিন শেষে আমিই তনুর মা।
-আমি জানি
-কিছু জানো না তুমি।তনু আমার সতীনের মেয়ে।তোমার বাবা কখনো তনুকে চায় নি।আজ যদি তোমার বাবা বেঁচে থাকতো তাহলে কি করতো জানো?তনুকে হয়তো মেরেই ফেলতো!
-আমিও মরে যেতাম।
-কি সব বলো!রূপ তোমার কি মনে হয় না তুমি তোমার বাবার ইচ্ছেকে,পছন্দ অপছন্দকে অপমান করলে??
রূপ একটা লম্বা নিঃশ্বাস নেয়
-মামনী তোমার জীবনে যা কিছু হয়েছে তাতে তনুর কি দোষ?
-তুমি জানো না রূপ(চেচিয়ে)
-জানি,শুরু থেকে শেষ অব্দি জানি আর হয়তো জানি বলেই তনুর প্রতি আবার এমন মায়া কাজ করে!
-ওহ্ তাহলে সবি দয়া মায়া সিম্পাথি?
-জানি না আমি হয়তো তনুর মায়ায় পড়েই তনুকে ভালোবাসি নয়তো তনুকে ভালোবেসেই তনুর মায়ায় পড়েছি।
আন্জুআড়া বানু রূপকে ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেন না।
-বাবা বেঁচে থাকলে আমি হয়তো বাবাকেও মানিয়ে নিতাম।নয়তো তনুকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম তবুও তনুকে ছাড়তাম না
রূপের এমন উওরে তিনি রূপকে কি বলবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
আন্জুআড়া বানু রূপকে বার বার তনুর ব্যাপ্যারে কিছু একটা বলতে চান কিন্তু রূপ প্রত্যেকবারই তাকে থামিয়ে দেয়।
রূপ মামনী কেও বারণ করে দেয় যেন তনু অতীতের ব্যপ্যারে কিছুই না জানে।আন্জুআড়া বানু তনুকে জানাতে চাইলেও কিছু একটা ভেবে আর জানায় না।হয়তো তিনি চান না তনু তাকে সৎ মা হিসেবে চিনুক।তিনি তনুর নিজের মা হয়েই থাকতে চান।খারাপ মা হোক বা ভালো মা দিন শেষে তিনি তনুর মা।
বাড়ির পরিবেশটা কেমন একটা হয়ে আছে।তনু সেই দুপুরের পর থেকে আর ঘর থেকেই বার হয় নি।তনুর কেমন যেন লাগছে।শেফালী বেগম বার কয়েক তনুর ঘরে আসলেও তনু তেমন একটা কথা বলেনি।শুধু প্রশ্নের উওর দিয়েছে মাত্র। শেফালী বেগম ও বেশ বুঝতে পারছে তনুর অস্বস্তি হচ্ছে।
রাতে তনুকে খাবার জন্য ডাকা হয়।তনু জানিয়ে দেয় সে পরে খাবে।সবাই খেয়ে নিক।তনুর মধ্যে কেমন একটা সংকোচ কাজ করছে।সবার সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না
রূপ খাবার খেয়ে হাটা ধরে তনুর ঘরের দিকে।এবার আর আন্জুআড়া বানু রূপকে কিছু বলে না।চুপ চাপ নিজের ঘরে চলে যায়।
তনু বিছানায় উবু হয়ে বই পড়ছিলো।রূপ কিছু না বলেই দুম করে বিছানায় গিয়ে তনুর পাশে শুয়ে পড়ে।তনুর তো ভয়ে দম যায় যায় অবস্থা।
তনু উঠে বসে,
-কি করছো?কেউ দেখে ফেললে?
-দেখে ফেললে মানে?সবাই তো দেখলো আমি তোর ঘরে আসলাম।
তনু চমকে যায়
-দেখেছে মানে?মা দেখেছে?
-হু
-কি বলো?বকলো না তোমাকে?
রূপ তনুকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে
-বকবে মানে কেন বকবে?বর বউয়ের ঘরে গেলে শ্বাশুড়িরা বকা দেয় জানি না তো
-ধ্যাত
-তনয়া কাল রেডি থাকিস
-কেন?আবার ডিনার ডেটে নিয়ে যাবে?সেদিনের মতো?
রূপ লজ্জা পেয়।তনুকে একটা চোখ মেরে বলে,
-কেন আবার যেতে মন চাইছে নাকি?ক্যান্ডেল নাইট ডিনার।সমস্যা নেই এখন তুই চাইলে আমরা নিজের রূমেই করতে পারি না মানে ক্যান্ডেল নাইট ডিনার!
এবার তনু লজ্জা পেয়ে যায়।
-সত্যি করে বলো কোথায়৷ নিয়ে যাবে?
-কাল অন্তরের বিয়ের রিসেপশনে
-অন্তর আবার ভাইয়া কবে বিয়ে করলো?
-আজই।
-কি বলো!
-হু,আচ্ছা আমার না হওয়া সতীন কি অন্তর ভাইয়ার সাথেই পালিয়েছে?
রূপ জোরে জোরে হাসে।
-আমার বন্ধু আসলেই গ্রেট।
সেদিন রূপ তনুকে বার বার নিজের ঘরে থাকার জন্য বললেও তনু যেতে নারাজ।সে তো ভয়ে দরজা বন্ধ করে রেখেছে যাতে রূপ না আসতে পারে ঘরে!কেমন একটা লজ্জা লাগছে।সবার সামনে দিয়ে রূপের ঘরে ঢুকবে!বাড়ির সবাই দেখে ফেলবে তো!! ছি ছি কেমন লাগবে বিষয়টা!
****
কেটে যায় বেশ কিছু সময়।পরিবারের সবাই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়েছে রূপ আর তনুর সম্পর্কটা।
তবে আন্জুআরা বানুর কোথাও একটা যেন সংকোচ রয়েই গেছে তনুকে নিয়ে।
তিনি মাঝে মাঝে তনুকে প্রশ্ন করেন
– তনু তুমিকি আদোও রূপের সাথে ভালো থাকতে পারবে শেষ অব্দি?
তনু মায়ের প্রশ্নে অবাক হয়।
-সব মায়েরাই তো চায় মেয়েরা সুখে থাকুক।তুমি কি চাওনা আমি সুখে থাকি?
আন্জুআড়া বানু একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
-আমি সত্যিই চাইনা তোমার ভাগ্য আমার মত হোক।আমার ভয় হয় তনু তোমাকে নিয়ে।রূপও তো পুরুষ মানুষই।পুরুষমানুষের ভালোবাসায় আমি বিশ্বাস করি না।ভালোবাসা রূপ বদলায়
তনু মায়ের এমন কথায় অবাক হয় মা কি বলছে তার কিছুই তার বোধকাম্য নয়।রূপ আর তনুর বিবাহিত জীবন বেশ ভালোই কাটছিলো। তবে ঐ যে বাঙ্গালি পরিবারের নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত একটা সময়ের পর বাচ্চা নিতেই হবে।তনুও তার বাহিরে নয়।
দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ খানিকটা বছর।তনুও সমাজের ধারাবাহিকতা মেনে একটা বাচ্চা নিতে চাইছে।
কিন্তু রূপ চাইছে না।শেফালী বেগমও তনুর কাছে আবদার নিয়ে বসে আছে বাচ্চা তার লাগবেই।শেষ বয়সে নাতি নাতনীর সাথে খেলবে এটাই তো নিয়ম।
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা বছর কেটে গেলো।কিন্তু রূপ তনয়ার সংসারে এখনো কোনো বাচ্চা এলো না।যেই শেফালী বেগম একসময় তনুকে আন্জুআড়া বানুর চেয়ে বেশি ভালোবাসতো সেই শেফালী বেগমই এখন যেন তনুকে দেখতে পারে না।তার ধারনা তনুরই হয়তো কোনো প্রবলেম আছে নয়তো তনু আজকাল কার মেয়েদের মতো বাচ্চা নিতে চাইছে না, তাই তো বাচ্চা হচ্ছে না।আজকাল শেফালী বেগম তনুকে কথা শোনায়।তনু কষ্ট পায় তার আচরণে।তবে এখন তো শেফালী বেগম তার শ্বাশুড়ি একটু বকলে দোষ কি!
আন্জুআড়া বানু শুধু দেখতে থাকে।সে তো এই দিনেরই ভয় পাচ্ছিলো তাহলে কি তনুর ভাগ্যও তার মতই হবে?
কিন্তু কোনো কিছু কি সত্যিই করার নেই।আন্জুআড়া বানু নিজের বেলায় কিছু করতে পারে নি তবে এখন প্রশ্নটা তার মেয়েকে নিয়ে!!
রূপকে ডেকে পাঠানো হয়,রূপ মামনীর ঘরে আসে,
-কিছু বলবে মামনী?
-রূপ তোমার মা বাচ্চা নিতে বলছে
-হুম্ম বলছে তো
-এই বিষয়ে তোমার কি মতামত?
-সন্তান আল্লাহর দান মামনী যখন হবার হবে।তুমি এতো চিন্তা করো না।
আন্জুআড়া বানুর চোখ ছল ছল করছে।তাদের কথার মাঝেই আগমন ঘটে শেফালী বেগমের।তিনি কথার মাঝে ফোঁড়ন কেটে বলে উঠেন,
-আল্লাহর দান ঠিকই আছে তবে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যদি কারো কোনো সমস্যা থাকে তাহলে কি করে সন্তান হবে শুনি?তনুকে ডাক্তার দেখা।আমি দুদিন পর মরে যাবো নাতি নাতনীর মুখ না দেখেই কি আমাকে মরতে হবে আমাকে?
আন্জআড়া বানু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে!
রূপ মায়ের কথায় অবাক হয়,
-মা তুমি না তনুকে ভালোবাসো?
-বাসি তবে তনুর চেয়ে বেশি জরুরি আমার বংশের প্রদিপ।কালই তনুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও।যা করার করো একটা বাচ্চা চাই ব্যাস।
-মা এসব কেন বলছো
-তোদের পরে শ্রেয়ার(ছোট চাচার মেয়ে) বিয়ে হয়ে এখন তার দুইটা বাচ্চা হয়ে গেলো অথচ তোদের কোল এখনো খালি।আমি কিছু জানি না রূপ।
কথাগুলো বলে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান।আন্জুআড়া বানু কাঁদছে।তবে কি মেয়ের সংসারটাও তার মতো করেই ভেঙ্গে যাবে?
রূপ মামনীর দিকে তাকায়।
-কি হয়েছে মামনী চিন্তা করছো কেন?
-আমার তোমায় কিছু বলার আছে রূপ
-কাল আমি তনুকে নিয়ে যাবো ডাক্তারের কাছে তুমি চিন্তা করো না।ঘুমিয়ে পড়ো মামনী
রূপ আন্জুআড়া বানুর কথা না শুনেই নিজের ঘরে চলে আসে।
ঘরে তনু বসে বসে কান্না করছে।রূপ তনুর কাছে যায়,তনু আড়াল থেকে শেফালি বেগমের কথা শুনে ফেলেছে
-কষ্ট পেয়েছো তনয়া?
-আচ্ছা ধরো আমার সত্যিই কোনো প্রবলেম থাকলো তখন তুমি কি আবার বিয়ে করবে নাকি?
রূপ হাসে,
-আচ্ছা ধর প্রবলেমটা আমারই হলো তুই কি আবার বিয়ে করার প্লান করে বসে আছিস নাকি?দেখ আমি কিন্তু আমার বউয়ের বিয়ে দেখতে পারবো না বলে দিলাম
তনু হেসে দেয়…..
-তনু বাচ্চা কাচ্চা একটা পরিবারের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ।তুই চিন্তা করিস না।
তনুর ভয় করতে থাকে!
চলবে…