#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্ব-৮
তনু সকাল সকাল রূপকে না জানিয়েই একা একা বাড়ি ফিরে আসে।মনে তার একরাশ অভিমান জমে রয়েছে।রূপ তখন ঘুমিয়েই ছিলো।তনু কিছুক্ষণ রূপের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর হুর মুর করেই সেখান থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফিরে আসে।
বাড়ি এসে ফ্রেস হয়ে নেয়।তারপর রওনা হয় ভার্সিটির উদ্দেশ্য।
তনু বাড়ি থেকে বার হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আগমন ঘটে আন্জুআড়া বানু সহ পরিবারের সবার।
তনু মা কে দেখে একরকম চমকে যায়।
তিনি তনুকে দেখে একরকম রাগী চোখে তাকান তনুর দিকে।
কপালে তার চিন্তার ভাজ…
-এতোসকালে বাড়িতে কি করছো?তুমি বন্ধুর বাড়ি যাও নি?রাতে কোথায় ছিলে?রূপ কোথায়?
তনু একটা দীর্ঘ নিশ্বাস নেয়।তারপর মাকে শান্ত গলায় বলে,
-রাতে বাড়িতে ছিলাম না।কিছুক্ষণ আগে ফিরেছি।রূপ বাড়িতে নেই।
আন্জুআড়া বানু একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,
-আসলে রাতে রূপকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখেছি তাই ভোর হতে না হতেই রওনা হয়ে গিয়েছি।
আন্জুআড়া বানু কথার মাঝে শেফালী বেগম ফোঁড়ন কেটে বলে
-ননদিনী ঐটাকে ভোর বলে না মাঝরাত বলে।মাঝরাতে সবাইকে ডেকে নিয়ে বাড়ি এসেছো।তোমার যেন তরই সয়না।বাপরে বাপ
তনু আর কথা বাড়ায় না,
রওনা হয়ে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। তনুর মুখটা কেমন থমথমে হয়ে আছে।ব্যাপ্যারটার দিকে সবাই খেয়াল না করলেও আন্জুআড়া বানু ঠিকই খেয়াল করেছে।তবে কি রূপের সাথে কিছু হয়েছে!
******
রূপ ঘুম থেকে উঠে বার কয়েক তনুর নাম ধরে ডাকা ডাকি করে।তনুর কোনো সাড়া নেই।রূপ কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থাকে।হয়তো তনু ওয়াশরুমে আছে।সাওয়ার নিচ্ছে।কিন্তু
অনেকক্ষণ তনুর কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে রূপ বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে উঁকি দেয়।তনু তো সেখানে নেই।
বারান্দায় গিয়ে উকি দিলে দেখতে পায় সেখানেও তনু নেই।
এবার রূপের টেনশন হতে থাকে।তনুকি তবে রাগ করেছে।
রূপ তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে।রিসিপশনে গিয়ে চেকআউট করে নেয়।রিসিপশন থেকে শুনতে পায় তনু বাড়ি ফিরে গেছে।কথাটা তনুই রিসিপশনে বলে গিয়েছিলো।তারা যেন রূপকে জানিয়ে দেয়।
রূপ দ্রুত বাড়ি চলে আসে।বাড়ি ফিরেই সবাইকে দেখে একরকম ধাক্কা খায়।তাদের তো রাতে ফেরার কথা ছিলো।এতোসকালে কি করছে!!
তাদের অনাকাঙ্ক্ষিত ফিরে আসা রূপের ভালো না লাগলোও মুখে একটা কৃত্রিম হাসি এনে,মামনীকে জরিয়ে ধরে
-এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এলে যে
-তুমি ঠিক আছো আব্বা?
-হুম ঠিক আছি।তুমি এতো সকালে ফিরে এলে যে,
-তোমাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি। ওখানে বসে চিন্তা করার থেকে ভাবলাম বাড়ি ফিরে আসি।
রূপ এদিক সেদিক তাকায়।তনু কোথায়।
পাশ থেকে রূপের ছোটচাচী রূপকে বলে
-তনু পরীক্ষা দিতে গিয়েছে।আজ তো ওর পরীক্ষা।
-তনু খেয়েছে?
-কি জানি আমরা বাড়ি ফিরতেই তো দেখলাম ও রেডি হয়ে বের হচ্ছিলো।খেয়েছে কিনা তা তো জানি না।
রূপের হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পরীক্ষা শুরু হতে এখনো ঘন্টা খানিক দেরী আছে।
রূপ আর কথা না বাড়িয়ে বাহিরে বেরিয়ে পড়ে।
আন্জুআড়া বানু রূপকে বাধা দিয়ে বলে উঠে,
-এখন যাস না। তুই যেতে যেতে তনু পরীক্ষা হলে ঢুকে পড়বে।খেতে পারবে না।
রূপ মামনীর কথায় মাথা নিচু করে নেয়।মামনী কিভাবে যেন তার মনের সব কথা বুঝে নেয়!!
-আমি তনুর কাছে যাবো না।একটু কাজ ছিলো তাই।
আন্জুআড়া বানু আর কিছু বলেন না। ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকেন রূপের দিকে।
রূপ মামনীর দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে যায়।
***
ক্যান্টিনে তনু একা একা বসে আছে।আজ তনু বেশ তাড়াতাড়ি ক্যাম্পাসে চলে এসেছে।কিছু খাওয়াও হয়নি তার।কিছু খেতেও ইচ্ছে করছে না।তনু না খেয়েই পরীক্ষা হলে ঢুকে পরে।কাল রূপের সাথে বেশ খানিকটা সময় কাটানো হয়েছে।তেমন একটা পড়াশোনা করাও হয় নি।
তনু পরীক্ষা শেষ করে বার হতেই দেখে রূপ দাড়িয়ে আছে।তনু রূপের কাছে গিয়ে দাড়ায়,
-কেন এসেছো?
-তোমাকে নিতে
তনু রূপের মুখে তুমি ডাকটা শুনে বেশ অবাক হয়,
-হটাৎ তুমি
-আমাদের তো বিয়ে হয়েছে
-বিয়ে হলেই তুমি ডাকতে হবে!
রূপ আর কিছু বলে না।
তনুকে টেনে গাড়িতে তুলে নেয়,
তনু কিছু বলছে না।চুপচাপ বসে আছে।রূপ নিজে থেকেই বলে উঠে
-রেগে আছিস তনু?সকাল থেকে তো কিছুই খাস নি শরীর খারাপ করবে তো!
-(…)
-আই আম সরি
-সরি কেন বলছো
-কাল নিজেকে সামলাতে পারি নি।আফটার অল উই আর হাসবেন্ড উয়াইফ।এখানে রাগ করার কিছু নেই
-আমি রাগ করিনি
-আমরা তোর হাসবেন্ড তনু
-কেউ জানে না!
-সো হোয়াট? কেউ না জানলে কি সব মিথ্যে হয়ে যাবে।
-তুমি ভালোবাসো না আমায়
-কে বলেছে?
-বাসো?কোই কাল বার বার বলতে বললাম বললে না তো।
-বলবো না!
-মানে বাসো না?
-তনয়া প্লীজ!সব কথা কি মুখে বলতে হয়?
-বাদ দাও।মাকে কবে বলবে সবটা?বাচ্চা হওয়ার পর?
-তুই বললে আজই বলে দিই?
তনু আর কিছু বলে না।
রূপ আর তনু একসাথে বাসায় ফিরে। সারা দিনে বহুবার রূপ তনু মুখোমুখি হয়।রূপ তনুর সাথে কথা বলতে চাইছে কিন্তু তনু বলছে না।বার বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
*****
রাতে খাবার টেবিলে আন্জুআড়া বানু সবাইকে একসাথে ডেকে পাঠান সচরাচর তনু আর শেফালী বেগম পরে খায়।
আজ আন্জুআড়া বানুর ডাকে সবাই একসাথে বসেছে।
আন্জুআড়া বানু কোনো ভণিতা ছাড়াই বলে উঠেন,
-আমি গ্রামে গিয়ে মেয়ে দেখে এসেছি।রূপের বিয়ে দেবো।রূপের বাবার বন্ধুর মেয়ে।ছোট বেলাতেই রূপের বাবা কথা দিয়ে রেখেছিলো তার বন্ধুকে।
আমি শুধু রূপের বাবার দেওয়া কথা রাখতে চাইছি।রূপের বিয়েটা দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাই।
কেউ কিছু বলছে না। তনু কথাটা শুনেই দুম করে খাওয়ার টেবিট থেকে উঠে যায়।রূপ একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে,
“মামনী কেন যে মানছে না”
রূপও খাবার খায় না।উঠে চলে যায়।খাবার টেবিলে সাফায়েত সাহেব উপস্থিত ছিলেন না।তিনি শ্বশুর বাড়ি গিয়েছেন।
তনু বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাদঁছে।তার জীবনে র সবচেয়ে বড় দুঃখ মা তাকে ভালোবাসে। আজকাল তনুর মনে হয় রূপও তাকে ভালোবাসে না।
তনু শুয়ে শুয়ে এই সব ভাবছে আর রূপ একনাগাড়ে তনুকে কল করেই যাচ্ছে।
তনু ফোন তুলছে না।রূপ তনুকে মেসেজ করছে
ছাদে সে অপেক্ষা করছে তনুর জন্য,
তনু হাজার অভিমানের পাহাড়কে ঠেলে সড়িয়ে দিয়ে হাটা ধরে ছাদের দিকে।রূপের ডাককে অস্বীকার করার।
তনু ছাদে পা দিতেই কেউ একজন পেছন থেকে তনুর চোখ দুটো চেপে ধরে।তনু বেশ বুঝতে পারছে এটা রূপ
-ছাড়ে আমি দেখতে পাচ্ছি না
-যাতে দেখতে না পাস তাইতো ধরলাম?এবার চল
-কোথায় যাবো?
-যেখানে নিয়ে যাবো!
-কোথায় নিয়ে যাবে?এভাবে নিয়ে গিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবে নাকি?আমায় মেরে ফেলে মামনীর কথা মতো বিয়ে করে ঘরে নতুন বউ আনবে
-কি সব বলিস
-ঠিকিই বলি..না থাকবে বাঁশ না বাজবে বাঁশি
রূপ কিছু বলে না।
সে হাসছে তনুর কথায়।রাতের রাগটা তার এখনো রয়ে গেছে।
রূপ তনয়াকে ছাদের অপর পাশে নিয়ে গিয়ে দাড় করিয়ে দেয়।চোখের চোখের উপর থেকে হাত সরাতেই তনু অবাক হয়ে যায়।সেখানে ফুল দিয়ে সুন্দর করে লিখা “আই লাভ ইউ”
রূপ তনুর কানের কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে করে বলে
-ভালোবাসি তনয়া,আমি তোকে খুব ভালোবাসি।
তনু অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রূপের দিকে
-কি বললে আবার বলো?
রূপ হাসতে হাসতে সেখানে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। তনুর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়,
মৃদু স্বরে আবারও বলে উঠে
-আমি তোমাকে ভালোবাসি তনয়া।
রূপ পকেট থেকে একটা রিং বার করে তনুর হাতে পড়িয়ে দেয়।তারপর তনুর হাতে পড়ে দেয়।
মাথা নিচু করে বলে উঠে
“কাল রাতেই দিতে চেয়েছিলাম।ফার্স্ট নাইট ফার্স্ট গিফট,কিন্তু মনে ছিলো না”
তনু রূপের কথায় হেসে দেয়।রূপ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয়।
চলবে….