তাসের ঘর পর্ব-০১

0
4922

#তাসের_ঘর
#নীরা_আক্তার
#পর্বঃ১

“চলোনা তোমার বাড়ির সবাইকে বলে দিই আমারা বিয়ে করে ফেলেছি। আর কতোদিন এভাবে লুকিয়ে রখবো?আর যে পারিনা”

কথাটা বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দেয় তনু।পাশেই ঠ্যাই হয়ে দাড়িয়ে আছে রূপ।এই মুহূর্তে
তনুকে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না সে।
আজ দিয়ে তাদের বিয়ের ৯৩ তম দিন পূর্ণ হলো

-তনু আমি বলবো কিন্তু তারপর….
কথাটা শেষ করার আগেই হটাৎ সিড়ি দিয়ে কারো উপরে আসার শব্দ পেয়ে তনু চোখ মুছে রূপের পাশ থেকে সরে গিয়ে ছাদের অপর পাশে চলে যায়।উদ্দেশ্য হাতে করে আনা কাপড়গুলো মেলতে হবে।এদিকে রূপ সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে আছে।

একটু পরেই ছাদে প্রবেশ করে রূপের বড় ফুপি আন্জুআরা বানু।রূপকে এই ভর দুপুরে ছাদে দেখে একটু মুচকি হাসেন তিনি।তখন বোধয় বেলা ২ টা বেজে ৪৫ মিনিট। আন্জুআরা বানু রূপের কাছে গেয়ে গালে মুখে হাত বুলিয়ে জিঙ্গেস করে..
-কি রে রূপূ একটু আগেই না তুই খাবার খেলি এখন আরাম না করে এই ভর দুপুরে ছাদে কি করছিস।এতো রোদে তো তোর শরীর খারাপ করবে!
কথাটা বলেই পাশে তাকাতে দেখে মেলানো কাপড়রের আড়াল থেকে তনু বেড়িয়ে আসে ভেজা সপসপে গায়।তনুকে দেখেই তার যেন মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো,
-হ্যারে তনু সামান্য কটা কাপড় কাঁচে এতো সময় লাগে বেলা তো গড়িয়ে গেলো!
তনু ছোট্ট করে উওর দেয় এইতো হয়ে গেছে মা
আন্জুআরা আর কোনো কথা বলে না রূপ কে নিয়ে নিচে চলে যায়।
রূপ যাবার আগে অবশ্য তনুকে বলে গেছে তারাতাড়ি গোসল করে নিতে এভাবে ভেজা গায়ে বেশি সময় থাকলে শরীর খারাপ করবে।

রূপ আর আন্জুআড়া চলে যেতেই তনু সেখানে দাড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়….
ঘন কালো মেঘ তখন সূর্যটাকে একটু একটু করে গ্রাস করছে….সারা আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।বোধয় এবার বৃষ্টি নামবে।

অতীতে ডুব দেয় তনু
তনুর ভালো নাম তনয়া মির্যা।তবে এটা তার বাবার বাড়ি না নানা বাড়ি।আন্জুআড়া বানু তার মা।আর রূপ তার বাড় মামার একমাত্র ছেলে।আন্জুআরা বানুরা তিন ভাই বোন….সে মেজো আর রূপের বাবা সবার বড়।ছোট এক ভাইআছে, তবে সে প্রবাসি।তবে তার বউ আর দুই মেয়ে মেঘা আর মিশু এই বাড়িতেই থাকে।বড় মেয়ে মেঘা কলেজ হোস্টেলে আছে।আর তনুর ছোট মামী ছোটমেয়ে মিশুকে নিয়ে বাপেরবাড়ি গিয়েছে।

এই বাড়ির বর্তমান হর্তা কর্তা আন্জুআড়া বেগম।তাকে সবাই মোটামুটি ভয় পেয়ে চলে।রূপের বাবা রওশান চৌধূরী অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছে একটা এক্সিডেন্টে। আন্জু বলতেই তিনি এক গাল ভাত বেশি খেতেন।বোনের উপর তার ছিলো অগাধ বিশ্বাস আর অসীম ভালোবাসা।তাই ব্যবসা আর পরিবার সব দায়িত্ব তাকেই দিয়ে গিয়েছে।
রওশান চৌধূরী মারা যাওয়ার পর ব্যবসার সব দায়িত্ব সাথে গোটা পরিবারের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে তুলে নেন।একা হাতে সামলে নেন এই গোটা পরিবারটা কেই।

খুব ছোট বেলায় তনুর বাবা ও মারা যায়। তনুর তো ঠিক মনেও নেই কি হয়েছিলো তার বাবার।মা ও তাকে কিছু বলে নি। তবে জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই সে এখানেই মানুষ।তবে কোনো এক কারনে তার মা তাকে ভালোবাসে না একদম ভালোবাসে না।এইসব কথা ভাবতে ভাবতেই চোখদিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে মনের অজান্তেই। আজকাল বড্ড কষ্ট হয় তার।এইসব ভাবতে ভাবতেই গোসল শেষ করে বেড়িয়ে আসে।এখন গন্তব্য ড্রইংরুম।দুপুর তখন ৩টা বেজে ২৫ মিনিট।দুপুর খাবারটা খেতে হবে।

ডাইনিং রুমে যাওয়ার পথেই মায়ের ঘরটা পরে।তনু মায়ের ঘরটা পার করার সময় কানে ভেষে আসে মায়ের উত্তেজিত কন্ঠ।কাউকে যেন বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে উপদেশ দিচ্ছে..

-যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব আমার একটা মেয়ে চাই।চৌধুরী বাড়ির জন্য মানানসই মেয়ে।একদম রূপকথার রাজকুমারীর মতো মেয়ে চাই..

তনু আর সেখানে দাড়ালো না কিছু একটা মনে করে সেখান থেকে চলে এলো।মা ঠিক কি চাইছে সে খুব বুঝতে পারছে।তবে সে আজো বুঝে উঠতে পারলো না মা কেন তাকে ভালোবাসে না।এইসব ভাবতে ভাবতে সে কখন চলে এলো টেরই পায় নি।

বেশ কিছু সময় অন্য মনস্ক থাকার পর হটাৎ তার হুস ফিরে এলো কারো ছোঁয়ায়।তনু অনুভব করে কেউ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে।তনু ঠিক বুঝতে পেরেছে এটা রূপ।
রূপ তনুকে নিজের দিকে ঘুরে নেয়।বেশ আদুরে গলায় বলে উঠে
-চুলটা মুছে নে। এভাবে ভেজা চুলে টাওয়াল পেঁচিয়ে রাখলে তো ঠান্ডা লেগে যাবে।আমাকেই তো আবার সারা রাত জেগে তোর সেবা যত্ন করতে হবে।আফটার অল ১০ টা ৫ টা না একটা মাত্র বউ।
কথাটা বলেই রূপ হাসে দেয়।তনুও হাসে।কিন্তু কিছু বলে না।
-দুপুরের খাবারও তো খাসনি তনয়া!এবার তো শরীর খারাপ করবে!

তনু কিছু বলে না।অনেক কিছু বলার ইচ্ছে ছিলো তবে রূপের মুখে তনয়া কথাটা শুনেই সব রাগ যেন পানি হয়ে গেছে।

সে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় খাবার টেবিলের দিকে যেতে যেতে একবার মুখ ফিরিয়ে তাকায় রূপের দিকে…
-আচ্ছা রূপ তুমি কি জানো মা কেন আমায় ভালো বাসে না?আমি কি করেছি বলো তো?

রূপ কি বলবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না।
তনু আর কোনো কথা না বলেই চলে এসে ধপ করে বসে পড়ে খাবার টেবিলে।টেবিলে সব খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা।সে একটা একটা করে খুলে দেখে। নাহ্, তার এখন কিছু খেতে মন চাইছে না।সে আবার সব ঢাকা দিয়ে উঠে যেতে নিলে পেছন থেকে কেউ এসে আবার বসিয়ে দেয়।
তনু পেছনে তাকিয়ে দেখে শেফালি বেগম,
রূপের মা,

-তুইকি আমাকে না খাইয়ে মারবি বলে ঠিক করেছিস?কখন থেকে তোর জন্য খাবার নিয়ে বসে আছি বলতো।তুই খাসনি বলে আমিও খেতে পারছিনা।আয় একসাথে খাবো।

তনু একটু মুচকি হেসে এবার খাবার বাড়তে শুরু করে।
দুজনে একসাথে খেয়ে নেয়।এই গোটা বাড়িতে শেফালি বেগম একমাত্র মানুষ যে তনুকে ভালোবাসে।ভালোবেসে যত্ন নেয়।
তনু খাবার খেয়ে তার মামানির গালে ছোট্ট করে চুমু খায়।তারপর হেসে ঘরে চলে যায়।

এদিকে আন্জুআরা বানু বিছায় বেশ গুটি শুটি হয়ে বসে আছে।সে বেশ বুছতে পারছে তনুর প্রতি রূপের টানটা দিন দিন বাড়ছে।
একদিন তো এই টানের জন্যই রূপকে বিদেশ পাঠিয়েছিলো ।কিন্তু এতো বছর পরও সেই টান যেন এতোটুকুও কমে নি বরং বেড়েই চলেছে।তবে ভাইকে দেওয়া কথা তো তার রাখতেই হবে….

বেশ ভাবনা চিন্তা করে আন্জুআড়া বেগম রূপের মা কে ঘরে ডেকে পাঠান।
শেফালি বেগম ঘরে আসতেই তার হাতে একটা মেয়ের ছবি হাতে ধরীয়ে দেন….
-এটা ভাইজানের বন্ধু সেলিম শিকদারের একমাত্র মেয়ে ঝুমার ছবি।মেয়ে বেশ সুন্দরী তাই না ভাবি?
শেফালি বেগম বেশ কৌতূহল নিয়ে তাকায় আন্জুআরার দিকে
-মেয়ের ছবি কেন দেখাচ্ছ বলো তো ননদিনী।
আন্জুআরা বানু ছোট্ট হাসি দিয়ে উওর দেয়,
-আমাদের রূপের সাথে বেশ মানাবে তাই না বলো?
শেফালী বেশ থতমত খেয়ে যান..
-রূপ কি মানবে?
-কেন মানবে না।না মানলে আমি মানিয়ে নেবো।
শেফালী বেগম আর কিছু বলে না ছোট্ট হাসি দিয়ে উওর দিয়ে চলে যায়
-তুমি যা ভালো মনে করো।
-আমি নই ভাবি,ভাইজান।আমি শুধু ভাইজানকে দেওয়া কথা রাখতে চাইছি।

****
আজ তনুর ঘুম থেকে উঠতে বেশ দেরী হয়ে গিয়েছে।তারাহুরো করে না খেয়েই বেড়িয়ে আসে বাড়ি থেকে উদ্দেশ্য যতো দ্রুত সম্ভব ভার্সিটিতে যেতে হবে।আজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ এস্যাইনমেন্ট জমা দিতে হবে।রূপ একবার ভাবে সে গাড়ি দিয়ে তনুকে পৌঁছে দিবে তবে পরক্ষণেই কি একটা ভেবে খাবার টেবিল ছেড়ে আর উঠে না।সেখানেই বসে থাকে।

এদিকে তনু দ্রুত এসে একটা সি এনজি ডেকে নেয়।কিন্তু কি বিপদ এই সি এনজি তো অর্ধেক রাস্তায় এসে খারাপ হয়ে যায়।তনু মাথায় হাত দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে রাস্তায়।এখন কি হবে?
কি করে যাবে সে।রাস্তায় তো আর কোনো গাড়িও নেই।তনু ফোন বার করে রূপকে ফোন দেয়…যাতে সে দ্রুত গাড়ি নিয়ে এসে তনুকে ভার্সিটিতে পৌছে দেয় নয়তো বেশ দেরী হয়ে যাবে।
রূপ কল রিসিভ করে তনু রূপকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে খেয়াল করে তার পাশে এসে দাঁড়ায় একটা কালো গাড়ি।জ্বানালার গ্লাস নামাতেই তনু বলে উঠে
-আরে অন্তর ভাইয়া তুমি এখানে?
অন্তর রূপের ছোট বেলার বন্ধু সেই সুবাদে সে বেশ কয়েকবার রূপের বাড়িতেও এসেছে।তাই সে তনুকে খুব ভালো করেই চেনে।

-কি ব্যাপ্যার তনয়া তুমি রাস্তায় একা দাড়িয়ে আছো কেন?ক্যাম্পাস যাবে না? ৯ টা তো বেজে গেলো!
তনু মুখ কালো করে উওর দেয়
-একেই তো বের হতে দেরী হয়েছে তার উপর দেখো না গাড়িটাও মাঝ রাস্তায় খারাপ হয়ে গেলো।

অন্তর একগাল হেসে গাড়ির দরজাটা খুলে দেয়
-এসো তোমায় পৌছে দেই।
তনু একটু ইতস্তত বোধ করে।
-থাক তোমায় কষ্ট করতে হবে একটু পরই কোনো না কোনো সি এনজি চলেই আসবে।
-আরে থাকবে কেন? ভয় পেয়োনা তনয়া আমিও তো তোমার ক্যাম্পাসেই যাবো।দুইজনের গন্তব্য যখন একই তখন বাকিটা পথ না হয় একসাথেই চললাম….
তনু আর কিছু বলেনা।গাড়িতে উঠে পড়ে।

এদিকে গোটা সময় যে রূপ লাইনে ছিলো তা তনু খেয়ালই করেনি।ফোনের দিকে চোখ পড়তেই।তনুর মুখটা কালো হয়ে যায় তারপর দুম করে তনু লাইনটা কেটে দেয়।রূপ ফোনটা নামিয়ে গাড়ির চাবিটা নিয়ে বেরিয়ে পরে…..

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে