তারা রাতের সন্তান ৩য় পর্ব

0
4374

তারা রাতের সন্তান ৩য় পর্ব
.: #Masud_Rana

.
মিলি যেই খাটের নিচে উকি দিবে হঠাৎ মিলিকে হতভম্ব করে দিয়ে খাটের নিচ হতে অবিকল মিথিলার কন্ঠে ভেসে আসল:
-খাটের নিচে উকি দিস নে মিলি। আমি মারা গেছি অনেক্ষণ আগে। আমার ভয়ংকর কুৎসিত চেহারা দেখে তুই ভয় পাবি।
.
মিলির মেরুদন্ড বেয়ে যেন ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। মিলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল:
– এসব কী আবল-তাবল কথা বলছিস মিথিলা। তোরতো এখন তোর বাড়িতে থাকার কথা। খাটের নিচে কী করছিস?
-মরে গেলে মানুষতো লুকিয়েই থাকে। আমার আর যাওয়ার জায়গা নেই রে। আমার আত্মাটা তোদের বাড়িতেই আটকে পড়ে রয়েছে।
-মিথিলা তুই আমার সাথে মজা করিস না। আমার প্রচুর ভয় করছে। তুই খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আয় বলছি!
.
মিথিলা এবার কথা থামিয়ে আবার সেই ভয়ংকর চাপা কান্না শুরু করল। মিলি ভয়ে অস্থির হয়ে যাচ্ছিল। তবুও মিথিলার কথা কেন জানি তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। মিলি ভয়ে ভয়েই মাথাটা ঝুকিয়ে খাটের নিচে তাকাল। মিলি যা দেখল তা দেখে সে কয়েক মুহুর্ত বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল। খাটের নিচে মিথিলার মাথা কাটা শরীর পড়ে রয়েছে। তার রক্ত যেন খাটের নিচের অনেকটা জায়গা জুড়ে জমে রয়েছে। ভয়াবহ দৃশ্য হলো মাথা ছাড়া শরীরটা নড়ছে, কাঁপছে। শরীরটা যেন হাত দিয়ে মিলিকে খাটের নিচে যেতে ডাকছে। লাশটার মাথা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে লাশের পেছন থেকে মিথিলার কাটা মাথাটা দ্রুত গতিতে মিলির মুখ বরাবর এসে থমকে দাঁড়ায়। ভয়ংকর দৃষ্টিতে মিলির চোখের দিকে তাকায় আর কুৎসিত একটা হাসি দিয়ে বলে, কিরে বললাম না খাটের নিচে তাকাস না। আমি মরে গেছি। তুই ভয় পাবি!


.
মিলি ভয়ে সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পড়ে যায়। যখন তার জ্ঞান ফিরে তখন মিলি বুঝতে পারে এখনও ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। তার শরীরের সব শক্তি যেন কেউ চুষে নিয়ে গেছে। মিলি কাঁপা কাঁপা কন্ঠ বলে:
-মিথিলা, তুই কী এখনও খাটের নিচে আছিস?
-হুম।
-আমার সাথে এমন হলো কেন বলতো? এইতো কিছুদিন আগেই সব ঠিক ছিল। হঠাৎ জীবনটা বদলে গেল। বাবা-মা প্যারালাইসড হয়ে গেছেন। আর এখন তুই কী আবল-তাবল কথা বলছিস খাটের নিচ হতে। কি ভয়ঙ্কর তোর চেহারা! আমি বোধ হয় পাগল হয়ে গেছি। তুই আমার অবচেতন মনের কল্পনা।
-তোর একাধিক সমস্যা কিন্তু একটা সুতাতেই বাধা রয়েছে মিলি। যা দেখে তোর বাবা-মা ভয় পেয়েছে। সেই আবার আমাকে খুন করেছে। তার জন্যই তোর জীবনের এই অবস্থা।
– তোকে কে খুন করেছে?
-তোর ভাই। অনিক।
-এসব কী যা-তা বকছিস! অনিক তোকে খুন করবে কেন? আর বাবা-মা কেই বা ভয় দেখাবে কেন?
-হ্যাঁ যা-তাই তো বলছি। তোর ভাই অবশ্য এই কাজগুলো করেনি। সেতো মারা গেছে। তার শরীর ব্যবহার করে অন্য কেউ কাজটা করেছে।
-অনিক মারা গেছে মানে?
-অনিকের আত্মা আর তার শরীরে নেই। সে তার আত্মা শয়তানকে নিজের অজান্তেই উৎসর্গ করেছে। শয়তান তার দেহ ব্যবহার করে পৃথিবীতে এসেছে।
-মিথিলা! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার তোর কথা কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। অনিকের দেহে শয়তানের আত্মা কিভাবে এলো? আর সে তোকে কেন খুন করবে?
-শোন তাহলে পুরো ঘটনা। তোকে বলেছিলাম না শয়তানের উপাসনা করার কথা? একদল যাদুকর শয়তানকে পৃথিবীতে আনার জন্য অনেক ধরণের কৌশল করছেন। এর জন্য তারা কুমার ছেলেদের খুঁজে থাকেন। এ ধরণের শরীর ছাড়া অন্য শরীরে শয়তান আশ্রয় নিতে পারে না। কেউ যদি জোর করে কোনো কুমার ছেলের শরীরে শয়তানকে আনতে চায় তবে সে পারবে না। কুমার ছেলেটার শয়তানকে ভালোবেসে তার দেহ এবং আত্মা শয়তানকে উৎসর্গ করতে হবে। এর জন্য সেই কালো যাদুকরেরা শয়তানী মায়ার সাহায্য নিয়ে কিছু বই রচনা করে বিভিন্ন ছলনায় বইগুলো কুমার ছেলেদের কাছে পৌছে দেয়। বইটা এমন যে, যে কেউ বইটা পড়ে ঈশ্বর ভক্তি বাদ দিয়ে শয়তানের উপাসনা করতে থাকে। শয়তানই হয়ে উঠে তাদের ঈশ্বর। সেই বইটাতেই লেখা থাকে কী করে নিজের আত্মাকে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করে শয়তানকে নিজের দেহ দান করা যায়। কিছু উপকরণ আর মন্ত্র পাঠের পর তিন রাত নগ্ন হয়ে দরজা খোলা রেখে ঘুমাতে হয়। ঘরে কোনো পবিত্র গ্রন্থ থাকতে পারবে না। এই সময় ঘর হতে নানান অদ্ভুত ভয়ংকর শব্দও আসতে থাকবে। তোর ভাইও সেই ছলনার ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই তার শরীর এখন শয়তানের নিয়ন্ত্রনে। এতে অবশ্য তোর ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। তোর ভাই সেই বইয়ের মায়ায় বশ হয়ে গিয়েছিল। শয়তান যখন তোর ভাইয়ের শরীরে প্রবেশ করল তখন তোর সম্পর্কে সে সব তথ্য জানতে পেল। তিনি বুঝতে পারলেন তুই সেই ৩ রাতের ঘটনা কিছুটা জেনে গেছিস। তাই তোকে বিভ্রান্ত করতে বলল, আমিও রোজ রাতে হাড় কামড়ে খাওয়ার শব্দ শুনি তোমার ঘর হতে। তুইও বিভ্রান্ত হলি। এবং উল্টো চিন্তায় ডুবে গেলি। অবশ্য শয়তান তোকে আগে থেকেই বিভ্রান্ত করা শুরু করেছিল। মাঝরাতে তুই যখন হাড় কামড়ে খাওয়ার কটমট শব্দ শুনে তোর ভাইয়ের ঘরে গিয়ে তোর ভাইয়ের নগ্ন দেহ দেখতি তখন শয়তান তোকে মায়ায় আচ্ছন্ন করে রাখত। তাই তুই পাপ ও লজ্জাবোধ অনুভব করে নিজের ঘরে ফিরে আসতি। তুই যে হাড় কামড়ে খাওয়ার শব্দ শুনে সেই ঘরে যেতি এটাই তোকে ভূলিয়ে দেওয়া হতো। কিন্তু সকাল বেলা এই ঘটনাটা তোর আবার মনে পড়তো। কারণ তোর ভাইয়ের উপর দিনের বেলা তখনও তার ( শয়তানের) নিয়ন্ত্রন আসেনি। তাই দিনে তার শক্তি কাজ করত না। তাই হাড় কামড়ে খাওয়ার শব্দের কথা মনে থাকতো। কিন্তু রাতে তোর ভাইয়ের ঘরে যেয়ে যে তুই তোর ভাইয়ের নগ্ন দেহ দেখতি এটা মনে থাকতো না। রাতের ওইসময় টায় তোর উপর মায়া আচ্ছন্ন করে থাকত বলে সেই কথা তোর দিনে মনে থাকত না। এই মায়া শুধু তোর উপর সে খাটায়নি। তোর বাবা-মাও একরাতে এই শব্দশুনে ছুটে আসে তোর ভাইয়ের ঘরে। তোর মতো তাদেরও মায়া দিয়ে সব ভূলিয়ে দেওয়া হতো। গতদিন সকাল হতেই শয়তান তোর ভাইয়ের শরীরের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়। সে বুঝতে পারে এই পৃথিবীতে তার প্রভাব বিস্তার করতে হলে প্রথমে বেশ কিছুদিন তোদের পরিবারের সাথেই থাকতে হবে। তবে তার দিনের কর্মকান্ড দেখে তোর বাবা-মা তাকে বেশ সন্দেহ করছিল। শয়তান ভাবল তোর বাবা আর মা এই বাড়িতে থাকলে তার কাজকর্মে তার বেশ ব্যঘাত ঘটবে। তাই সে তার আসল রুপ দেখাল তাতেই তোর বাবা-মা ভয় পেয়ে প্যারালাইসড হয়ে গেল। শয়তান ভাবল এবার তুইও তোর বাবা আর মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বি। তার কাজ কর্মে আর কেউ বাঁধা দিবে না। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে আমি এই বাড়িতে চলে এলাম। যাদু বিদ্যা সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি। তোদের বাড়ি ঢুকেই আমি বুঝতে পারলাম এ বাড়িতে শয়তানের পুজা হয়। তবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি শত শত বছর ধরেও চেষ্টা করে যেই শয়তানকে আহ্বান করে পৃথিবীতে আনা যায়নি সে তোর ভাইয়ের শরীরে আশ্রয় নিয়েছে। এটাই আমার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। আমি তোর ভাইকে সামান্য একটা শয়তান পুজারী ভেবেছিলামা মাত্র। তাই গতরাতে সে যখন খাবার নিয়ে বাড়িতে ঢুকল তখন থেকে আমি তাকে ভয় দেখাতে শুরু করি। শয়তানী শক্তির বিপরীতে যে আমি একটা বইও লিখেছি এটাও বললাম। বললাম সে যদি শয়তানের এই মায়া থেকে বাঁচতে চায় তবে আমি তাকে সাহায্য করব। কিন্তু কে জানতো সে নিজেই স্বয়ং শয়তান। সেই উল্টো আমায় মায়া করে ফেলল। মায়া করে যাদুবিদ্যা সম্পর্কে আমার সব জ্ঞান স্মৃতীশক্তি থেকে মুছে দিল। সেই বইটা , “তারা রাতের সন্তান” আগুন দিয়ে সে পুড়িয়ে দিল। একটা ধারালো ছুরি চালিয়ে দিল গলায়। আমার লাশটা এই বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছে সে। তোকে আমার সম্পর্কে মিথ্যা কথা বলেছে সেই। সেই আবার আমার মোবাইল থেকে আমার মতো কন্ঠ করে তোকে কল দিয়েছে।
-ওহ মাই গড! আমার মাথায় তোর কোনো কথাই ঢুকছে না। আচ্ছা তুই এত ঘটনা জানলি কী করে?
-শয়তান আমাকে খুন করার আগে সব কথা বলেছে। সে ভেবেছে আমি আর কখনও ফিরে আসব না। অবশ্য আমিও ভেবেছিলাম ফিরে আসব না। কিন্তু আমার আত্মাটা কেন মুক্তি পেল না! বুঝতে পারছি না। হয়তো কালো যাদু বিদ্যা চর্চা করার জন্য আমার আত্মাটাও অভিশপ্ত হয়ে গেছে।
-মিথিলা, আমাকে কিছু একটা বল। আমার এখন কী করা উচিত?
-সে তোর বাবা-মায়ের আর কোনো ক্ষতি করবে না। তোর ভাইয়ের আত্মাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা আমি জানি না! এখন শুধু তোকে নিরাপদ থাকতে হবে। আমি সঙ্গে করে যে ব্যাগটা এনেছিলাম সেটা তোর ভাইয়ের ঘরের বড় আলমারিটার ভেতর রয়েছে। সেই ব্যাগটাতে একটা মালা রয়েছে। মালাটা যদি তোর গলায় থাকে তাহলে শয়তান তোর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আফসোস তোর ভাইয়ের সাথে দেখা করার সময় আমি মালাটা পড়িনি। তুই কোনোমতে শয়তানটার অনুপস্থিতিতে সেই ব্যাগটা থেকে মালাটা নিয়ে পড়ে নে।
.
.
মিলি এইসব কথাশুনে তার বাক শক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলল। মিলির ওয়াশরুমে যেয়ে একটু ফেশ হওয়া দরকার। কিন্তু সে মেঝেতে পা রাখতে সাহস পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে সে মেঝেতে পা রাখা মাত্র একটা রক্তাক্ত হাত খাটের নিচ থেকে এসে তার পা চেপে ধরবে। এরপর একটানে তাকে খাটের নিচে নিয়ে যাবে। মাথা কাটা সেই লাশটা মিলিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। মিলি কিছুতেই ছুটতে পারবে না। মিলি ভয়ে ভয়ে খাট থেকে মেঝেতে পা রাখল। সে যা ভেবেছিল তেমন কিছুই হলো না। মিলি স্বাভাবিক ভাবেই হেটে ওয়াশরুমে গেল। ওয়াশরুমে ঢুকেই ভেসিং থেকে মুখে পানি ছিটাতে লাগল। ঘরের আলো যেন এখন তাকে বেশ স্বস্তি দিচ্ছে। মিলি মুখ ধুয়ে যেই ভেসিং এর আয়নার দিকে তাকাল হঠাৎ করে নিজের প্রতিচ্ছবীর জায়গায় মিথিলার রক্তাক্ত মাথাটা ভেসে উঠল। সাথে সাথেই ঘরের সব আলো নিভে গেল। অন্ধকারেও আয়নার ভেতরে মিথিলার রক্তাক্ত মাথা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চোখ গুলো কেউ যেন উপরে নিয়েছে। মুখে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। মিলিকে অবাক করে দিয়ে মিথিলার ভয়ংকর মাথাটা আয়না ভেদ করে মিলির মুখোমুখি এসে ভয়ংকর ভাবে হাসতে শুরু করল। কী ভয়ংকর আর কুৎসিত সেই হাসি! মিলি সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে বাথরুমেই পড়ে গেল।
.

.
মিলি যখন চোখ খুলল তখন সূর্যের আলো তার ঘরে পৌছে গেছে। তার মাথায় অসম্ভব রকমের যন্ত্রনা করছে। তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। তার মাথার পাশে অনিক গোমড়া মুখ করে বসে ছিল। মিলিকে চোখ খুলতে দেখেই অনিক বলে উঠল:
– রাতে তোমার কী হয়েছিল আপু? আমি ঘরে শুয়ে ছিলাম হঠাৎ তোমার বিকট চিৎকার শুনলাম। তোমার ঘরে আসতেই দেখি তুমি বাথরুমে অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছ। মাথা বেয়ে রক্ত পড়ছে। পরে আমিই ব্যান্ডেজ করে এখানে শুইয়ে দিলাম। আর সকাল বেলাই মিথিলা আপু চলে এসেছে। তোমার এই অবস্থা দেখে বেশ অবাক হলো। এখন রান্নাঘরে আছে। পরোটা বাজছে।
.
সাথে সাথেই মিলির কানে ভেসে আসলো রান্নাঘর থেকে মিথিলার কন্ঠের আওয়াজ:
– কার সাথে কথা বলছ অনিক! মিলির জ্ঞান ফিরেছে নাকি? …………………..
…………………………………………………………………………………………………
.
.
. . . . . . . . . চলবে . . . . . . . . .
.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে