#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
বন্যা আর তাহসান পাশাপাশি বসে আছে।আজকে আর কোনো লুকোচুরি নেই।আজকে প্রকাশ্যে দুজনে পাশাপাশি বসে আছে।বন্যা আড়চোখে তাহসানের দিকে তাকায়,সাদা পাঞ্জাবীতে ছেলেটাকে কি সুন্দর লাগছে!বন্যার চোখ মুখ মুগ্ধতায় ছেয়ে যায়।এই পুরুষটা তার; একান্তই তার।এই যে কিছুক্ষণ আগে সে তার নামের আংটি পড়িয়ে দিয়েছে।বন্যার চারপাশে কে আছে কিংবা কে কি বলছে এসব কথায় তার মনোযোগ নেই তার সম্পূর্ণ মনোযোগ তাহসানের গা থেকে ভুরভুর করে ভেসে আসা পারফিউমের ঘ্রানে।সে নিঃশব্দে শ্বাস টেনে ফুসফুস ভর্তি করায় ব্যস্ত।বন্যার মনে হলো সে খুব ভাগ্যবতী।ভাগ্যবতী না হলে তাহসানের মতো এমন লক্ষী ছেলে সে পাবে কেনো?লাজ লজ্জা ভুলে বন্যা তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
তাহসান সারাদিন ছটফট করে কাটিয়েছে।বন্যা ফোনে কথা বলেনি,বলেছে ভিষণ কাজ;কথা বলা যাবে না।তাহসান বন্যার কথায় সায় দিলেও মনে মনে খুব চাইছিলো বন্যা কথা বলুক কিন্তু তার তৃষ্ণার্থ মন উপোস জেনেও বন্যা সারাদিন ফোন দেয়নি।সন্ধ্যা আটটায় তারা সবাই বন্যাদের বাসায় যায়।তাহসান উত্তেজনায় ছটফট করছে।বাবা মা যে এতো সহযে মেনে নেবে তা সে কল্পনাও করেনি।বন্যাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার খুশীতে মনটা ফুরফুরে লাগছে।বন্যাকে যখন সে আংটি পড়িয়ে দিচ্ছিলো তখন তার মনে হচ্ছিলো বন্যা অর্ধেক তার হয়ে গেছে।হালকা হলুদ জামদানিতে বন্যাকে হলুদিয়া পাখির মতোই মিষ্টি দেখাচ্ছিলো।তাহসান ভদ্রতা বজায় রাখতে সবার সাথে কথা বললেও বারবার চোখের দৃষ্টি ঘুরেফিরে বন্যার মাঝে এসেই আটকাচ্ছে।বন্যাও যে তাকে দেখছে এটা বেশ বুঝতে পারছে।সবার অগোচরে তাহসান বন্যার হাত ধরে,বৃদ্ধাঙ্গুলি দ্বারা ঘষে চোখ টিপে ফিসফিস করে বললো,
“এতো সুন্দর লাগছে কেনো?মে.রে ফেলার পায়তারা করছো নাকি?”
বন্যা উত্তরে কিছু বলেনা শুধু মুচকি হাসে।আজকে আসলেই তাকে সুন্দর লাগছে।শাড়ি পড়তে না পারা বন্যাকে রেনু বেগম খুব পরিপাটি করে রেডি করিয়ে দিয়েছেন।বন্যাকে আজ খুব স্নিগ্ধ লাগছে,অপার সৌন্দর্যে যেনো চোখ ফেরানো যাচ্ছে না।আফিয়া বেগম নিজেও বন্যাকে এই রূপে দেখে অবাক।কখনো কল্পনাও করেনি ছেলেমি করা মেয়েটা এতো সুন্দর।সবার খাওয়া দাওয়া শেষ হলে আগামী শুক্রবার বিয়ের তারিখ ঠিক করে মোবারক সাহেব পরিবার সমেত বাসায় ফিরে আসে।ভালোবাসাগুলো পূর্ণতার পথে উল্কাপিন্ডের গতিতে ছুটে যাচ্ছে।
বন্যা তাহসানকে ফোন করেনি গায়ের শাড়িও পাল্টায়নি সবাই শুয়ে পড়লে আস্তে করে ছাদে উঠে আসে।প্রিয় পুরুষকে কাছে পাওয়ার আনন্দে মনটা নেচে নেচে নিজের উচ্ছাস জানাচ্ছে।এখন তাহসানকে ফোন করলে পাগলটা একছুটে ছাদে চলে আসবে কিন্তু বন্যা ফোন করেনি।থাক কিছুটা সময় একা।ছাদে উঠার সাথে সাথে নির্মল ঠান্ডা বাতাস বন্যার গা ছুঁয়ে যায়।জুতাজোড়া একপাশে খুলে রেখে খালি পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসে।হাসিটা ভালোবাসার পূর্নতার।জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওয়া হচ্ছে তাহসান।এই ছেলেটা তার জীবনে আসার পর জীবনের ছন্দ পাল্টে গেছে,রঙিন হয়ে ছাড়িয়ে গেছে চারপাশ।পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তাহসান তাকে চাঁদ বলে।তার মন বললো,তাহসানকে ছাড়া এই ভরা জ্যোৎস্না গায়ে মাখা অন্যায়।বন্যা এই অন্যায় করতেই পারবেনা।হঠাৎ করেই সে তাহসানকে ভিষণ মিস করছে।হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে রাখা মোবাইলের দিকে তাকায় উদ্যেশ্য তাহসানকে ফোন করে ছাদে আসতে বলা।কিন্তু ফোন হাতে নিয়েই ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়।তাহসানের নাম্বার থেকে পনেরোটা মিসড কল।ফোন সাইলেন্ট ছিলো বিধায় শুনতে পায়নি।বন্যা কল ব্যাক করার আগেই আবারো ফোন আসে।চিন্তিত্ব মুখে রিসিভ করার পরে তাহসানের কাতর গলার স্বর শুনতে পায়।
“আমার বউ কি খুব ব্যস্ত?একটু ছাদে আসা যাবে?আমি একটু মন ভরে দেখবো।”
বন্যা ফিক করে হেসে বললো,
“আমি ছাদেই।”
তাহসান কিছু না বলে ফট করে ফোন কেটে দেয়।মিনিট দুই পরে ছাদের সিড়িতে ধুপধাপ শব্দ শোনা যায়।বন্যার মুখে সুখের হাসির রেশ উঠে।মাথা ঘুরিয়ে তাকানোর আগে তাহসান পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তাহসানের গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণে বন্যার গা শিরশির করে উঠে।মাথাটা তাহসানের বুকে ঠেকিয়ে বললো,
“আপনাকে খুব ভালোবাসি।”
তাহসান বন্যার গালে গাল ছুঁয়িয়ে বললো,
“আমিও আমার চাঁদকে ভিষণ ভালোবাসি।”
থেমে তাহসান জিজ্ঞেস করলো,
“একা একা ছাদে চলে এলে আমাকে ডাকলে না কেনো?”
“ডাকতাম কিন্তু এর আগেই আপনি ফোন দিয়ে দিলেন।”
তাহসান আর বন্যা পাশাপাশি বসে।বন্যা যেনো আজকে কিশোরী মেয়ে হয়ে গেছে।প্রেমিকের গা ঘেষে বসতে,তার কাধে মাথা রেখে আঙ্গুলের ভাজে আঙ্গুল রেখে ফিসফিস করে কথা বলতে একটুও সংকুচবোধ হচ্ছে না।বন্যার এই পরিবর্তনে তাহসান অবাক হলেও মনে মনে খুশী।খোলা ছাদের ফ্লোরে প্রিয় পুরুষের হাত ধরে কাধে মাথা রেখে বন্যা বললো,
“সবাই এতো সহযে মেনে নেবে ভাবতেও পারিনি। ”
তাহসান বন্যার কথায় সায় দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ আমিও অবাক।”
“আমি ভেবেছি আরো কতো ঝড় না আসে।”
“আসলে আসতো আমি ঠিক সামলে নিতাম।”
বন্যা তাহসানের গালে হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
“আমি জানি।”
“প্রেমের তান্ডব শুরু হওয়ার আগেই আমরা এক হতে পেরেছি,শুকরিয়া।”
তারপর আবার তাহসান উচ্ছ্বাসিত গলায় বললো,
“আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে তুমি আমার হতে যাচ্ছ।”
বন্যা কথা না বলে হাসে।তাহসান বললো,
“তোমাকে আজকে এতো সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরাতে পারছিনা।”
বন্যা মাথা নেড়ে সায় জানায়।মুখে ফুটে উঠে লাজুক হাসি।
“আপনাকেও সুন্দর লাগছে।রাজকুমারের মতো।”
তাহসান বললো,
“রাজকুমার!হ্যাঁ তোমার রাজকুমার।”
বন্যা তাহসানের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আজকে কেউ দেখে ফেললেও কোনো ভ,য় নেই।”
তাহসান ঠাট্টা করে বললো,
“হ্যাঁ আজকে তো অর্ধেক বউ হয়ে গেছো।”
বন্যা মিহিয়ে যায়।হাত দিয়ে তাহসানের বুকের শার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,
“ভালোবাসি।”
তাহসান বন্যার কাতর গলার স্বর শুনে বললো,
“আজকে কি হয়েছে এতো ভালোবাসি ভালোবাসি করছো কেনো?অন্যদিন তো আবদার করেও শুনতে পারি না।”
বন্যা কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললো,
“ভালো লাগছে বলতে।তাছাড়া আর যদি বলার সুযোগ না পাই।”
“সুযোগ পাবে না কেনো?”
“যদি ম,রে যাই।”
তাহসান কেমন চুপসে যায়।মন খারাপের শতো শতো নৌকা এসে তার মনের আঙ্গিনায় ভীড় জমায়।
“এসব বলো না তো।আমি তোমায় নিয়ে বাঁচতে চাই হাজার বছর।”
বন্যা তাহসানের মন খারাপ লক্ষ করে বললো,
“শোনেন.”
“বলো।”
“বলেছিলাম না বিয়ের রাতে সারাটা রাত আপনার বুকে জড়িয়ে রাখবো।”
“হ্যাঁ।”
“মনে রাখবেন কিন্তু।”
তাহসান হেসে বন্যাকে বুকে জড়িয়ে বললো,
“তোমার আবদার আবার মনে থাকবেনা?সব ইচ্ছা পূরন করবো।”
বন্যা বললো,
“আমায় ভিষণ ভালোবাসবেন।সারাক্ষণ আদরে আদরে রাখবেন।”
তাহসানের শ্বাস ঘন হয়।বন্যার গালে ছোট করে চুমু দিয়ে বললো,
“খুব আদর করবো।”
“আমরা বিয়ের পরে অনেক ঘুরতে যাবো।”
“আচ্ছা।”
বন্যা তাহসানের বুকে নাক ঘষে বললো,
“আপনার গায়ের ঘ্রাণ এতো মিষ্টি কেনো? ”
“তোমার ভালো লাগছে?”
“সারাক্ষণ শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।”
তাহসান আদুর গলায় বললো,
“বন্যা আজকে এতো ভালোবেসে কথা বলছো যে আমার ইচ্ছে করছে এখনি বিয়ে করে ফেলি।”
বন্যা তাহসানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।তাহসানকে জড়িয়ে ধরলে বন্যার এক অন্যরকম শান্তি অনুভব হয়।ভিষণ আদরমাখা গলায় ফিসফিস করে বললো,
“আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন না।আপনাকে জরিয়ে ধরেও যে আমার মন ভরে না।”
তাহসান আলতো হাতে বন্যাকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে।বন্যা হঠাৎ কেঁদে দেয়।তাহসানের বুকে ঢুকে যাওয়ার মিথ্যা চেষ্টা করে বললো,
“আপনার সাথে আমি আরো অনেক বছর বাঁচতে চাই।”
তাহসান বন্যাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
“আল্লাহ চাইলে বাঁচবো।”
“তাহসান..”
“হুম.”
“বউ বলে ডাকেন না একবার….”
তাহসান বন্যার চোখে চোখ রেখে বললো,
“আমার বউ,আমার মিষ্টি বউ,আমার আদুরে বউ।আমার বউটাকে এত্তোগুলা ভালোবাসি।”
তাহসানের এতো আদুরে কথা শুনেও বন্যা কাঁদে।তার কেনো জানি খুব সুখ সুখ যন্ত্রণা হচ্ছে।
চলবে……