#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_১৭
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
তাহসান ছুটে গিয়ে দেখে বন্যা ইতোমধ্যে তিনতলায় চলে গেছে।সে পিছন থেকে কয়েকবার ডাকে বন্যা শুনেও দাঁড়ায় না।তাহসান গিয়ে বন্যার পথ আগলে দাঁড়ায়।বন্যার চোখে তখন পানির স্রোত।তার জন্য বাবা মা অনেক কথা শুনেছে,শুনেছে বললে ভুল হবে প্রতিনিয়ত শুনে আসছে;এখন আবার এই নতুন গল্পের কটু কথাগুলোও শুনতে হচ্ছে।বন্যার নিজের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে;সে কিভাবে পারলো বাবা মা কে আবারো নতুন কথা শুনানোর রাস্তা বানিয়ে দিতে,সে তো জানতো তার অতীত কি তারপরও কেনো পা বাড়ালো এই ভ,য়াবহ কঠিন রাস্তায়!মায়ের ছলছল চোখ বন্যার বুকে বর্শার মতো বিধে আছে।তাহসানের ডাক শুনেও তাকানোর ইচ্ছে হয় না।সব নষ্টের মূল এই ছেলে।আঠার মতো গায়ের সাথে লেগে প্রেম করেছে।বন্যা তো প্রেম করতে চায়নি তাহলে তার কেনো সবটা দোষ হবে?তার বাবা মা কেনো কথা শুনবে?তাহসান পথ আগলে দাঁড়ালে বন্যা চাপা গলায় হিসহিসিয়ে বললো,
“সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।”
তাহসান আকুল আবেদন করে বললো,
“আমার কথাটা শোনো প্লিজ।”
“কোনো কথা শুনতে চাই না।”
“এভাবে সমাধান হবে না।প্রেমে ঝড় আসবেই তাই বলে সরে যাওয়া তো বুদ্ধিমানের কাজ না।”
বন্যা ফুসে উঠে বললো,
“আমার বাবা মা কি আপনার সাথে প্রেম করেছে?প্রেম করেছি আমি কথা শুনালে আমাকে শুনাবে কিন্তু আপনার আম্মা আমার বাবা মা কে অপমান করে গেছে।প্রেম কি একা একা করা যায়?প্রেম করতে ছেলে লাগে না?আমি তো আপনার সাথে প্রেম করেছি তাহলে আমি কেনো একা কথা শুনবো?আমার বাবা মা কেনো মিথ্যা অপবাদ নিবে?মগের মুল্লুক পেয়েছেন নাকি?”
তাহসান ক্ষিপ্ত বন্যার দিকে তাকিয়ে থাকে।রাগে মুখ লাল আভা ছড়াচ্ছে।সে অনুনয় করে বললো,
“আমি আম্মুর সাথে কথা বলে সব সমস্যা সমাধান করে নেবো।তুমি প্লিজ উল্টাপাল্টা কিছু বলো না।”
“বলবো না মানে!একশো বার বলবো।আজকে থেকে আমাদের…”
বন্যা কথা শেষ করার আগে তাহসান তাকে থামিয়ে দেয়।
“তুমি আমার হৃদয় বন্যা।আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলো না।”
বন্যার বুকে শীতল বাতাস বয়।এই ছেলেটার কাছে শক্ত আবরণ মেখে থাকা বড়োই দুষ্কর।সে বললো,
“ভালোবাসলে তাকে প্রাপ্য সম্মান দিয়ে রাখতে শিখুন।আমাকে যদি ভালোই বাসেন তো মর্যাদা দিয়ে নিজের করে নিন।আমি এমন ভাবে আপনার হতে চাই যেনো কেউ অপবাদ দিতে না পারে।”
বন্যার কথা শুনে তাহসান মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।মুখে বললো,
“হাত ধরেছি এতো সহযে ছেড়ে দেয়ার জন্য নাকি?তুমি শুধু শক্ত থেকো আমি বাকিটা সামলে নেবো।”
বন্যা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।তাহসান সাথে হাটতে হাটতে বললো,
“আরেকটু থাকো।”
বন্যা তাহসানের শান্ত চোখ দু’টোর দিকে তাকায়।
“মা জানতে পারলে আরো খারাপ হবে।”
তাহসান বন্যার হাত ধরে হাটা থামায়।গালের দাগে হাত ছুঁয়িয়ে বললো,
“সব আ,ঘাত আমার হোক।”
বন্যা গাল থেকে হাত সরিয়ে দেয়।মুখে বললো,
“ছেলেদের আ ঘাত করা হয় না আ,ঘাত করা হয় মেয়েদের।”
তাহসান আলতো করে হাত ধরে বললো,
“ভালোবাসি।”
বন্যা আর তর্ক করেনা।সইচ্ছায় তাহসানের ডাকে সাড়া দেয়।ঠোঁট অল্প নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো,
“আমিও ভালোবাসি।”
“এই কথায়ই থেকো।আমার হাত ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও অন্যদিকে যাবে না।তাহলে আমি তান্ডব বয়িয়ে দেবো।”
তারপর বন্যা চুপচাপ বাসায় চলে যায়।সবাই তখন খাবার খাওয়া প্রায় শেষ।বন্যা গিয়ে খেতে বসলো।রেনু বেগম মেয়ের দিকে তাকায়।তখন থাপ্পড় মে,রে উনি নিজেই কষ্ট পেয়েছেন।বাবা হায়ায়া মেয়েকে আ,ঘাত দিতে দশবার ভাবেন।এখন তাহসানের সাথে দেখা করে এসেছে বুঝতে পেরেও চুপ থাকলেন।উনি কড়া গলায় বললেন,
“কালকেই এই বাসা ছেড়ে দেবো।বাসা ছাড়ার আগে আর কোনো অঘটন ঘটিও না।”
বন্যা মাথা নাড়ে।রেনু ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলো,
“তাহসানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি?”
“হ্যাঁ। ”
“তাহসানের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেবে।আতোটাও ফালানো হও নি যে কোনো ছেলের পিছনে ঘুরে বিয়ে করতে হবে।”
বন্যা তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,
“তাহসান মানিয়ে ফেলবে সবাইকে।”
ইতোমধ্যেই সবার খাওয়া শেষ।রেনু বেগম সবার প্লেট একসাথে করতে করতে বললো,
“মানালেও কি!ওর মা তোকে একটুও পছন্দ করে না,আর শাশুড়ীর অপছন্দে বিয়ে হলে সংসার কখনো সুখের হয় না।”
বলতে বলতে রেনু বেগমের গলা কেঁপে ওঠে।বন্যা মায়ের সব খেয়াল করছে।মা নিঃসন্দেহে তার ভালো চায়।কিন্তু সেও তো জানে তাহসান তাকে কতোটা চায়।সে তাহসানের পক্ষ নিয়ে বললো,
“মা!তাহসান আমাকে বিয়ে করবে,আর কাউকে খারাপ কথা বলার সুযোগ দেবে না।”
রেনু বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।
“ছেলেরা বিয়ের আগে এসব বলেই কিন্তু বিয়ের পর দেখা যায় কাহীনি উল্টে গেছে।”
বন্যা প্রতিবাদ করে বললো,
“তাহসান এমন না। সে আমাকে ভালোবাসে।”
রেনু বেগম মেয়ের মুখের দিকে তাকায়।এই কি সেই বন্যা যে ছেলেদের সহ্য করতে পারতো না!ভালোবাসা বিয়ে এসবের কথা শুনলে রেগে যেতো?বন্যার বিস্তর পরিবর্তনে উনি অবাক হয়।
তাহসান বাসায় গিয়ে দেখে তার আব্বু আম্মু ড্রয়িং রুমে চুপচাপ বসে কিসের যেনো অপেক্ষায় আছ।সে কাছে যাওয়াতে সবাই নড়েচড়ে বসে যেনো তার জন্যই এই দীর্ঘ অপেক্ষা।আফিয়া বেগম তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সে লজ্জা পেলোনা বরং মায়ের সামনের সোফায় বসে বললো,
“কি? ”
আফিয়া বেগম ছেলের প্রশ্নে থমথম খেয়ে যায়।
“কি?”
“বন্যার বাসায় গিয়ে কি বলেছো?শুনি বলো।”
“যা বলার বলেছি তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে না। ”
“আম্মু শোনো বন্যাকে আমি ভালোবাসি।বিয়ে করলে বন্যাকেই করবো।”
আফিয়া বেগম উনার স্বামী মোবারক সাহেবের দিকে তাকালেন।মোবারক সাহেব স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।আফিয়া বেগম বললো,
“বাবা মায়ের অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন মনে করিস না?”
তাহসান মায়ের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,
“অনুমতির প্রয়োজন মনে করছি বলেই তো জিজ্ঞেস করছি।”
আফিয়া বেগম চিৎকার করে বললো,
“ওই নষ্ট মেয়েকে আমি মানি না।সমাজ কি বলবে?তুই কি এই সামান্য ব্যাপারগুলোও বুঝিস না?”
“থুরাই কেয়ার সমাজের।আমি খুশী থাকলেই হলো,সমাজ দিয়ে কি করবো?”
আফিয়া বেগম চিৎকার বন্ধ করে না।গলা বাড়িয়ে সমানতালে বললো,
“তোমার সমাজ না লাগলেও আমাদের লাগবে।একটা ধর্ষিতাকে বউ হিসেবে মানা যায় না।”
“বারবার ধর্ষিতা বলবে না।বন্যা খুব ভালো মেয়ে।”
“কতো ভালো মেয়ে তা এই পাড়ার
সবাই জানে।ছেলেদের মতো চলাফেরা,মুখে অকথ্য ভাষা,দেখতেও কি বিশ্রী।”
বন্যার নামে এই কটু কথাগুলো শুনতে তাহসানের ভালো লাগে না।সে বললো,
“তোমার চোখে ভালো না লাগলেও আমার চোখে ভালো লাগে।”
আফিয়া বেগম অনুরোধ করে বললো,
“তোকে এরচেয়ে ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো।এসব পাগলামি বন্ধ কর।কয়দিনেই ভুলে যেতে পারবি।”
তাহসান হেসে বললো,
“এরচেয়ে ভালো মেয়ে চাই না আম্মু আমার বন্যাকেই চাই।”
আফিয়া বেগম স্বামীর দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তুমি কিছু বলছো না কেনো?”
তাহিয়া ভয়ে ভয়ে বললো,
“আম্মু বন্যা আপু তো ভালো মেয়ে মানতে সমস্যা কি?”
মেয়ের কথায় আফিয়া বেগম আরো রেগে যায়,
“ছোট মানুষ ছোট মানুষের মতো থাকো।বেশী পাকনামি করতে যেও না।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো,
“শান্ত হও আফিয়া।ছেলে মেয়েদের পছন্দও তো ভাবতে হবে।”
স্বামীর কথায় আফিয়া বেগমের মুখ আরো অন্ধকার হয়ে যায়।
“কোনো ভাবা ভাবি নেই।কালকেই ওরা বাসা ছেড়ে দেবে।”
তাহসান চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“বাসা ছেড়ে দেবে কেনো?ওরা যদি এই বাসা ছেড়ে দেয় তাহলে আমিও আর এই অহংকারী বাসায় থাকবো না।”
“তাহসান বেশী বাড়াবাড়ি করছিস না?”
তাহসানের রাগে শরীর কাঁপছে।চোখে পানি টলমল।কথা বলতে গিয়ে খেয়াল হলো গলা শুকিয়ে গেছে।
“বাড়াবাড়ি করলে বাড়াবাড়িই। আব্বু কেনো বুঝেননা বন্যা আমার শান্তি।আমি বিয়ে করলে বন্যাকেই করবো।ভুল করেও ওদের বাসা থেকে বের করতে যাবেন না এতে বিপরীত হবে।”
তাহসানের শেষের কথাগুলো জড়ানো শোনা গেলো।কথাগুলো বলেই সে রুমে চলে যায়।ভাইয়ের চোখে পানি দেখে তাহিয়া নিজেও কেঁদে দেয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললো,
“এক ছেলে নিয়ে তোমার খুব অহংকার তাই না?যা শুরু করেছো এই ছেলে হারালে বুঝবে।”
আফিয়া বেগম ফ্যাচফ্যাচ করে কেঁদে বললো,
“তুমিও কি চুপ করে থাকবে?আমি এই মেয়েকে মেনে নিতে পারবোনা।”
মোবারক সাহেব স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বললো,
“মহিলা মানুষের এই এক ঝামেলা।বুঝে কম লাফায় বেশী।ছেলে মেয়ে ছোট নেই যে তোমার কথা শুনবে।”
আফিয়া বেগম থামে না।
“না শুনলে না শুনবে।তোমার ছেলে ম,রে গেলেও আমি রাজী হবো না।”
চলবে……