#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_৯
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
রেনু বেগম পানি খেতে উঠেছে।যথারীতি ডাইনিং রুমে এসে পানি খেয়ে রুমে ফিরে যাবেন কিন্তু মেইন দরজা খুলার শব্দ শুনে ফিরে তাকায় দেখে বন্যা দরজা আটকাচ্ছে।বন্যাও তার মা কে এই সময় এখানে আশা করেনি তাইতো মায়ের সাথে চোখাচোখি হতেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় হন্তদন্ত পায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।বন্যার কান্নাভেজা চোখ আর ফ্যাকাশে চেহারা রেনু বেগমের দৃষ্টি এড়ায় না।তার মেয়েটা কাঁদছে!বন্যা তো কান্না করার মতো মেয়ে না তাহলে! বন্যার রুমে যাবেনা যাবেনা করেও নিজের মনের প্রশ্নের ছুটোছুটিতে আর নিজেকে আটকাতে পারে না বন্যার পিছুপিছু উনি নিজেও যায়।বন্যা দরজা আটকানোর আগেই রেনু বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে।বন্যা তার আম্মাকে দেখে হাসে,কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া কাহিনীটা মায়ের দৃষ্টি আড়াল করতেই এই হাসির আগমন।সে আলতো গলায় বললো
“এখনো ঘুমাওনি আম্মা?”
রেনু বেগম সন্ধানী চোখে তাকিয়ে বললো,
“এতো রাতে কোথায় গিয়েছিলি?”
বন্যা সহয গলায় বললো,
“ছাদে।”
রেনু তির্যক দৃষ্টি নিয়েই তাকিয়ে থাকে।
“এতো রাতে ছাদে!”
বন্যা মায়ের চোখের দৃষ্টি বুঝে যায়।মাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“গরম লাগছিলো তাই গিয়েছিলাম।”
“গরম লাগলে কাঁদতে হবে কেনো?”
বন্যা মায়ের কাধে মুখ গুজে বললো,
“কাঁদিনি তো।”
“আমি দেখেছি।”
বন্যা মাকে রুম থেকে ঠেলে বের করতে করতে বললো,
“ভুল দেখেছো।তোমার মেয়ে কাঁদেনা।এখন যাও ঘুমাও,আমিও ঘুমাবো।”
রেনু বেগম উনার প্রশ্নের সঠিক উত্তর পায়নি কিন্তু তারপরও এতো রাতে আর কথা বাড়ায় না চুপচাপ নিজের রুমে চলে যায়।বন্যা লাইট বন্ধ করে বিছানায় বসে পড়ে।বুকের ভেতরটায় এতো তোলপাড় হচ্ছে, মনে হচ্ছে বুকে হাতুড়ি দিয়ে পেটানো হচ্ছে।তারও ইচ্ছে করে স্বাভাবিক হতে কিন্তু সে যে কঠিন অতীতটাই ভুলতে পারে না,পুরুষ দেখলেই যে হিং/স্র মনে হয়।কিন্তু তাহসানকে দেখে আজকাল হিং/স্রতা না এসে কেমন ঠান্ডা বাতাস বুকের মাঝে প্রভাবিত হয়।আজকেও তাহসানের কথাগুলো তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু সে যে লোকটাকে ঠকাতে পারবেনা,আর যাই হোক সত্য মিথ্যা সামনে এসেই হবে তাইতো কালো অতীত রাবার দিয়ে মোছার চেষ্টা না করে তাহসানের সামনে পেশ করে দিয়েছে।বন্যা সোজা বিছানায় শুয়ে পড়ে।চোখ বন্ধ অথচ চোখের কোল বেয়ে নেমে যাচ্ছে নোনতা পানির স্রোত।তার কেমন পা/গল পা/গল লাগছে ইচ্ছে করছে এক সেকেন্ডের জন্য হলেও তাহসানের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে নিজেকে শান্ত করতে।সে নিজের উপর নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেছে,কোনো ছেলে তাকে আজ পর্যন্ত আকর্ষিত করতে পারেনি সেখানে কয়েকদিনের পরিচয়ের এই তাহসান কিভাবে মনের শক্ত করে খিল দেয়া বন্ধ ঘরে ঢুকে গেলো!ঢুকলো তো ঢুকলোই তার উপরে মন জুড়ে রাজ্যের কল্পনায় নিজের বিস্তার প্রসারিত করছে।এই আধার রাতের নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে বন্যা আবিষ্কার করলো শুধু তাহসানের তরফ থেকে না তার তরফ থেকেও ভালোবাসার নিরব আলোর বিচ্ছুরণ হচ্ছে,যা এতোদিন সে টের পায়নি।বন্যা নিরবে কাঁদে,তার জীবনের যেই ক/লঙ্ক তা কখনো মুছার না আর না তাহসানের মতো এমন একটা ভালো ছেলেকে নিজের সাথে জড়ানো।আজকে তাহসান মোহে,আবেগে তাজা ভালোবাসার তাড়নায় বন্যাকে পাবার জন্য গোপন ইচ্ছা তার সামনে ব্যক্ত করলেও ভবিষ্যতে মানুষ যখন বলবে বন্যা ন/ষ্ট,ধর্ষিতা তখন!তখন তাহসান আর ঠিক থাকবেনা বদলে যাবে,সমাজ সংসার ধর্ষিতাদের স্বাভাবিক ভাবে মানতে পারেনা তাদের কাছে ধর্ষিতা মানেই পাপী,বাঁচার চেয়ে ম/রে যাওয়াই সবাই বেশী কামনা করে।নিস্তব্ধ নিঝুম রাতেই বন্যা সিন্ধান্ত নিয়ে নিলো,আর যাইহোক সে তার এই সিদ্ধান্তে অটল থাকার চেষ্টা করবে।
তাহসান তার রুমে পায়চারী করছে চিন্তায় বুকের খাঁচা বেশামালভাবে স্পন্দিত হচ্ছে।বন্যার শেষ কথাটা এখনো যেনো কানে শিশার মতো গলছে।তার মনে ভিষণ য/ন্ত্রণার পাহাড় ধ্বসে পড়ছে একি কথা বললো বন্যা!বুকে যে আ/গুন জ্বলছে সীমাহীন।আ/গুনটা এতোটাও জ্বলতো না যদি বন্যা স্বাভাবিক আচরন করতো।রাতে কান্নারত বন্যা আগুনের ফুলকির মতো কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায়নি তাহসানের দিকে ভেজা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছুটে ছাদ থেকে চলে গেছে।তাহসানকে কিছু বলার সুযোগ দেয়নি।কিন্তু তাহসান যে কিছু বলতে চায়,অশ্রুসিক্ত চেহারায় হাসি ফুটাতে চায় অথচ বন্যা নিরুত্তাপ,ভাবলেশহীন।সে রাত থেকে ক্রমাগত ফোন দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কোনো উত্তর নেই।প্রেমে পাগল মনটা হাহাকার করে উঠে।আনচান করে জানান দেয় দম আটকে আসছে।দুপুরের দিকে তাহিয়া বই খাতা নিয়ে তাহসানের রুমে আসে।ধুপ করে বই টেবিলে রেখে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
এমনি দহনে হৃদয় ভঙ্গুর হয়ে আছে হঠাৎ তাহিয়ার আগমনে যেনো আগুনে ঘি পড়লো।কেমন অজানা য/ন্ত্রণায় সারা শরীর জ্বলে উঠলো কিন্তু সে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখার চেষ্টা করে গম্ভীর গলায় বললো,
“এখানে কি?”
তাহিয়া মাথা দুলিয়ে বললো,
“পড়বো।”
তাহসান বুঝতে পারে না বিধায় চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“কি?”
“কি আবার!পড়া পড়বো কিছুদিন পরে আমার পরিক্ষা না?”
“তো!আমার কাছে কেনো?”
তাহিয়া মন খারাপ করে বললো,
“বন্যা আপু নাকি আর আমাকে পড়াবেনা তাই আম্মু বলেছে নতুন টিউটর না পাওয়া অব্দি তুমিই আমাকে পড়াবে।”
পড়াতেও আসবে না!তাহসান নিজের উত্তেজিতভাব লুকানোর যথাযথ চেষ্টা করে বললো,
“কেনো পড়াবেনা?”
“আপুর নাকি প্রচুর পড়তে হয় আমাকে পড়ালে চাপ পড়ে যায় তাই।”
“আচ্ছা।”
তাহিয়া ব্যস্ত গলায় বললো,
“এখন আসো আমাকে পড়াও।”
তাহসান খিটখিটে গলায় বললো,
“বেরিয়ে যা।”
তাহিয়া অবাক হয়ে বললো,
“কেনো?”
“তোর মতো বলদকে আমি পড়াই না।”
তাহিয়া চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যায়।
“আমি বলদ!”
“হ্যাঁ।”
“এমনটা কেনো মনে হলো?”
তাহসান গম্ভীর গলায় বললো,
“যে তোকে অনেকদিন ধরেই পড়াচ্ছে তার সব ফাইনাল পরিক্ষার সময়ও পড়িয়েছে তাহলে এখন কেনো পড়ানো বন্ধ করবে?নিশ্চয়ই তুই এমন কিছু করেছিস যার কারনে তোর বন্যা আপু কষ্ট পেয়েছে তাই তোকে আর পড়াবেনা আর এই সামান্য লজিকটা তুই বুঝতে পারছিস না তাহলে তুই তো বলদই।”
তাহিয়া তাহসানের দাবার চাল বুঝতে পারে না।সেদিন যে প্রেমের প্রসঙ্গ এনে বন্যার সাথে আলাপ জমানোর চেষ্টা করেছিলো তার কারনেই কি রাগ করে পড়ানো বন্ধ করে দিলো?তাহিয়া ছুটে গেলো বন্যাদের বাসায়।সাথে তাহসানও গেলো বোনের ছুতো দিয়ে যদি একটু কথা বলা যায় এতে মন্দ কি!
তাহিয়া আর তাহসানকে দেখে রেনু বেগম খুশী হয়।কিন্তু হঠাৎ করেই বন্যা তাহিয়াকে পড়াবেনা তাহসানের হুটহাট বাসায় আসা বন্যার কান্না সব কেমন এলোমেলো লাগছে।তাহিয়া আর তাহসানকে সোফায় বসিয়ে রেখে উনি বন্যাকে ডাকতে যায়।বন্যা তখন গম্ভীর মুখে বসে আছে তাহিয়া আর তাহসানের কন্ঠস্বর তার কর্ণগোচর হয়েছে।তাদের সামনে যেতে একদম ইচ্ছে করছেনা কিন্তু না গেলেও মায়ের হাজারো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।কোনো উপায়ন্তর না দেখে রেনু বেগম কিছু বলার আগেই বন্যা উঠে দাঁড়ায় হনহন করে হেটে ড্রয়িংরুমে যায়।তাহিয়ার কাছে বসে বললো,
“কি ব্যাপার তাহিয়া?”
তাহিয়া বন্যার হাত ধরে বললো,
“আপু প্লিজ আমাকে পড়াও,আমার কোনো কথায় কষ্ট পেলে মাফ করে দাও।তারপরেও পড়াও প্লিজ।”
নাটের গুরু যে তাহসান তা বুঝতে বন্যার কষ্ট করতে হয় না।সে আলতো করে হেসে বললো,
“আরে না,আমার পড়া বেশী তাই পড়াতে পারবোনা।তোমার বেশী সমস্যা হলে মাঝে মাঝে বাসায় এসো আমি বুঝিয়ে দেবো।”
তাহসান বন্যাকে লক্ষ করে কান্নার ফলেই কিনা দুই চোখ ফুলে গেছে।আসার পর থেকে তাহিয়ার দিকে তাকিয়ে তার সাথেই কথা বলছে তাহসানের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না।বন্যার চোখের দৃষ্টি পাওয়ার জন্য তার অশান্তি লাগছে।সে বন্যার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করে কিন্তু বন্যা ভুল করেও তাকায় না।তাহিয়া হার মেনে নেয় বন্যা তাকে এটা বলে স্বান্তনা দেয় যে মাঝে মধ্যে তার কাছে পড়তে আসতে।তাহিয়া উঠে দরজার কাছে চলে যায় বন্যাও তাহিয়ার সাথে সাথে যায় অগ্যতা তাহসানেরও যেতে হয়।তাহিয়া বেরিয়ে গেলে তাহসান যায় না।নিচু হয়ে বন্যার ফ্যাকাসে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বললো,
“নিজেকে এতো কষ্ট দিচ্ছো কেনো?”
বন্যা দরজার হাতলে হাত রেখে বললো,
“দরজা লাগাবো।”
“ঘরের দরজা লাগাও সমস্যা নেই কিন্তু মনের দরজা লাগিও না।”
বন্যা শান্ত চোখে তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“আপনি ভুল করছেন।প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়েও টিনেজারের মতো আচরণ করছেন।”
“মানুষ প্রেমে পড়লে নিজের সর্বস্ব ভুলে পাগলাটে আচরণ করে।এটাই নিয়ম আমি নিয়মের বাহিরে যাচ্ছিনা।”
“যেতে হবে,আর আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করবেন না।”
তাহসান বন্যার হাত ধরে বললো,
“একবার আমার….”
তাহসান কথা শেষ করার আগেই বন্যা উঁচু গলায় চেচিয়ে বললো,
“একদম গায়ে হাত দেবেন না।আর এমন ছ্যাছরামি করছেন কেনো শুনি।আর কখনো আমার সাথে কথা বলতে আসবেন না,বেশী বাড়াবাড়ি করলে বাসা ছেড়ে দেবো।”
বন্যার উঁচু গলা শুনে রেনু বেগম এগিয়ে আসে।উনাকে দেখে তাহসান থমথমে মুখে মাথা নিচু করে নেয়।বন্যার হঠাৎ এমন চিৎকার করাটা ঠিক হজম হচ্ছেনা।তার জোড়ে কথা বলার কারণেই তো রেনু বেগমও এখানে চলে এসেছে,যা তাহসানের জন্য অসস্থি।তার কেমন লাগলো।সে বিবস মুখে বন্যার রাগী মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কথা না হলে কি তুমি খুশী?”
“হ্যাঁ।”
তাহসান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আচ্ছা!তাই হবে।”
চলবে…..