#তান্ডবে_ছাড়খার
#পর্ব_৩
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
তাহসান বাসায় এসে তার মাকে সামনে পায়।সে বললো,
“আম্মু আমি যে ভার্সিটিতে জয়েন হয়েছি এই মেয়েও সেখানে পড়ে।আমার ছাত্রী অথচ এমব ভাব করলো যেনো আমাকে চিনেই না।মেয়েটা আমাকে সালাম অবধি দেয়নি।”
আফিয়া চোখ মুখ কুঁচকে বললো,
“বলিস কি?”
তাহসান মন খারাপ করে।বন্যা সালাম না দেয়াতে যেনো তার বড়ো রকমের ক্ষতি হয়ে গেছে।মায়ের কথায় মাথা নেড়ে বললো,
“এই বেয়াদবটা কি পড়ায় তোমার মেয়েকে?”
আফিয়া মুখ কালো করে বললো,
“আমি কি জানি তোর আব্বু এই মেয়ের মাঝে নাকি সম্ভাবনার আলো দেখতে পায়,বন্যার কাছে পড়লেই নাকি ভালো ছাত্রী হওয়া যাবে।অথচ দেখ কেমন ছেলেদের মতো চলাচল,ছিহ!”
তাহসান কিছু না বলে সোফায় গিয়ে বসে।আফিয়া ছেলের পাশে বসতে বসতে বললো,
“চাল-চলন,কথা বার্তা কিছুরই ঠিক নেই এর কাছে মেয়ে পড়াতে আমারো ইচ্ছে করেনা,কিন্তু তোর আব্বু ওর কাছেই পড়াবে।”
“না করে দাও।”
আফিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি না করলে হবে?তোর আব্বু আর তাহিয়া তো বন্যার সেই রকম ভক্ত।”
তাহসান উঠে দাঁড়ায়।রুমে গিয়ে আনমনে ভাবে আচ্ছা বন্যা নামটা তো শান্ত মনে হয় কিন্তু এই মেয়ে তো উড়নচণ্ডী।এই মেয়েটা কেনো অতল জলের মতো শান্ত হলোনা?নামের মতই কেনো নয়?
পরের সাপ্তাহ খানেক তাহসান আর বন্যার তেমন কোনো কথা হলোনা।বন্যা তার মতো ক্লাস করে তাহসান তার মতো ক্লাস করায়।কিন্তু দুজনের চোখের দৃষ্টি দুজনের দিকেই কঠোর যেনো তাদের মাঝে বড়ো রকমের শ,ত্রুতা আছে।তন্নীর চোখে ব্যাপারটা পড়ে।ব্যগ্র কণ্ঠে বললো,
“এই!তোর দিকে স্যার এমন রাগী লুক দেয় কেনো?”
বন্যা বই থেকে মাথা তুলে তাহসানের দিকে তাকায়।দুজনের চোখের দৃষ্টি এক হলে বন্যা মাথা নিচু করে বললো,
“তুই কি স্যারের চোখের দৃষ্টি মাপছিস নাকি?”
“না কিন্তু স্যার তোর দিকেই বেশী তাকাচ্ছে।”
বন্যা ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“বেডা মানুষ এমনি;লু,চ্চা।”
রাতুল আস্তে করে বললো,
“তুইও তো পুরুষই।”
বন্যা রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
“তন্নী ও কি বলে রে?ছাগল নাক!”
তন্নী আস্তে করে বললো,
“খারাপ কি বলেছে!তুই কি মেয়েদের মতো চলিস নাকি?না চাল চলনে বুঝা যায়।”
বন্যার চোখ মুহূর্তেই রাগে জ্বলে উঠে।কাটাকাটা গলায় বললো,
“মেয়েদের মতো থাকবো কেনো?আশে পাশে হাজারো কুত্তা জিব্বা বের করে তাকাই থাকে।নিজেকে মেয়ে সাজিয়ে কি কুত্তার নাস্তা হবো নাকি?”
রাতুল ফুস করে শ্বাস ফেলে বললো,
“ছেলেদের কুত্তা বলার স্বভাব বাদ দে।সবাই এক নাকি?”
বন্যা রাতুলের দিকে তাকায়।মনের গহীনে বেজে যায় বিষাদের করুণ সুর।য,ন্ত্রণায় হাফসাফ করে উঠে বুকটা।নাকের পাটাতন ফুলে উঠে তার।জোরে দম ফেলে বললো,
“সব পুরুষ খারাপ।আর কোনো কথা হবেনা রাতুল।তুই আমার বন্ধু আছিস তাই থাক।”
রাতুল হার মানেনা।
“তা থাকলাম কিন্তু স্যার তোর দিকে তাকায় মানে তো সে লু,চ্চা হতে পারেনা।স্যার যখন পড়া বুঝায় তখন ছাত্রীদের দিকে তাকাতেই পারে।চোখে চোখ রাখলে সব ব্যাপার খুবই সহযে হয়।জানিস না!”
বন্যা মাথা তুলে তাহসানের দিকে তাকায়।তাহসান বোর্ডে কিছু লিখছে।সাদা শার্ট বলিষ্ঠ দেহ আড়াল করতে অক্ষম।বন্যা সেদিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।রাতুলের হাতে জোরে চিমটি কেটে বললো,
“স্যারদের চোখের দৃষ্টি নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছে নেই,আপাতত জার্নালিস্ট হতে পারলেই হলো।”
রাতুলের হাতে তন্নী ফু দিচ্ছে রাতুল মুখ চোখ কুঁচকে বললো,
“তুই জার্নালিস্ট হবি!দেখা যাবে রি/পোর্ট করতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে সালা টালা বলে টাল হয়ে চলে আসবি।তোর দ্বারা হবেনা মাম্মাহ!”
বন্যা পড়ায় মনোযোগ দেয়।জার্নালিস্ট হওয়ার অনেক ইচ্ছে।সমাজের যে অন্যায়গুলো কেউ দেখেনা কিংবা দেখেও প্রতিবাদ করেনা সেই অন্যায়গুলো সে তুলে ধরবে।রাতুলের কথায় কিছু না বললেও চুপ থাকতে পারলোনা।
“হবে হবে সব হবে।”
তাহসান সন্ধ্যায় ছাদে যায়।বনে বাদারে ঘুরে বেড়ানো মানুষের কি বন্ধ করা ঢাকা শহর ভালো লাগে?কেমন দম আটকে আসে।বাসার মধ্যে তার সবচেয়ে বেশী ছাদটাই ভালো লাগে,হাজারো গাছের সমারোহ আর ঠান্ডা নিবিড় পরিবেশ।চুপচাপ বেঞ্চে বসে রাতের পরিবেশ উপভোগ করে।একটা চাঁদকে ঘিরে হাজারো তারার ঝলমলানি চোখে লাগছে।কেনো জানি এই নিস্তব্ধ রাত দেখলে তাহসানের বুকটা চিনচিন করে ব্যাথা করে।অনেকেই নাকি রাতের আকাশে প্রিয়তমাকে নিয়ে ভালোবাসার মহল সাজায় অথচ সে ঠিকঠাক প্রেমই করতে পারলো না মহল সাজাবে কি!তার প্রাক্তন বলতো সে নাকি রোবট মানব।তার ভালোবাসায় কোনো অনুভূতি নেই;আর না কোনো আকর্ষণ আছে।আসলে তাহসানের কেনো জানি কাউকে নিয়ে তেমন অনুভূতি হয়না,বুকের খাচায় তীব্র কম্পন টের পায়না।কাউকে দেখলে গলা শুকিয়ে কথার বাধা হয় না কিংবা মনের অজানা ইচ্ছাগুলোও মাথানাড়া দিয়ে উঠে না।সে এমন একজনের অপেক্ষায় আছে যাকে না দেখলে তার দম আটকে আসবে,যার সানিধ্য পাওয়ার জন্য মনটা তৃষ্ণার্থ হয়ে থাকবে,যার কাছে থাকলে নিজেকে সুখী লাগবে।সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে মানুষটা একান্ত তার এটা ভেবেই মানুষিক শান্তি লাগবে।তাহসান চোখ বন্ধ করে দুই হাতের তালুতে মাথা ঠেকিয়ে বসে থাকে।
বন্যা পায়ে পায়ে ছাদে আসে।ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,রাত তার খুব প্রিয়,রাতের নিস্তব্ধতা বড়োই আপন মনে হয়।রাতের মিহি ঠান্ডা বাতাসে নিজেকে খুব হালকা লাগে।বন্যার অতি শাসনে ঢেকে রাখা নারী সত্ত্বা জেগে উঠে।রগচটা ক্যাটকেটে গলা হয়ে যায় মধুর।সে ডানা মেলে রাখা পাখির মতো দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে দেয়।মিষ্টি কন্ঠে ফিসফিস করে বললো,
“বাতাস এতো মিষ্টি কেনো?রাতের নিস্তব্ধতা এতো আপন কেনো?আমি পাখির মতো উড়তে পারি না কেনো?এই এতো কেনো’র উত্তর কে দেবে আমায়!”
বন্যা তখনো তাহসানকে খেয়াল করেনি।তাহসান কিন্তু ঠিকি বন্যাকে খেয়াল করেছে।নিঃশব্দে বন্যার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়।বন্যা তখন পাখির মতো ডানা মেলেছে।তাহসানের মনে হচ্ছে বন্যা উড়বে; বন্যা উড়লো না বরং ফিসফিস করে হাওয়ায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।তখনি তাহসান বললো,
“আমি দেই?”
হঠাৎ পুরুষের গলা শুনে বন্যা চমকে যায়।দুই পা পিছিয়ে তাহসানের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই লোক কখন এসেছে?তার আগে নাকি পরে?তারই ছাদে আসার আগে কেউ আছে কিনা দেখে আসা উচিত ছিলো।সে কি বন্যার কথাগুলো শুনেছে?বন্যার মিষ্টি গলা মূহুর্তেই কঠিন হয়ে যায়।
“কি দিবেন?আমি কি চেয়েছি আপনার কাছে?”
তাহসান এগিয়ে আসে।রেললিংয়ে হাত রেখে বললো,
“একটু আগে যা বললে।”
বন্যা বুঝতে পারে তাহসান তার কথাগুলো শুনে ফেলেছে।মাথা ঘুরিয়ে আস্তে করে বললো,
“আপনাকে বলিনি।”
“তাতে কি!আমি উত্তর গুলো জানি।বলবো?”
বন্যা মাথা নেড়ে না করে।
“যেখানে সেখানে নাক গলাবেন না।আমার সাথে তো একদমই না।”
তাহসান ফোস করে শ্বাস ফেলে বললো,
“এভাবে কথা বলো কেনো?জন্মের পরে মধু খাওয়ায়নি?”
তাহসানের কথায় বন্যা রেগে যায়।চোখ কটমট করে বললো,
“আপনি এতো কথা বলছেন কেনো?শিক্ষকদের এমন ছ্যাছরামিতে মানায় না।”
তাহসান মনে মনে ধাক্কা খায়।ঠিকি তো সে কেনো এই বেয়াদবটার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে?আস্ত বেয়াদব;কোনো আদব কায়দা তো জানেই না জানে খালি চটাং-চটাং কথা।রাগে তার গলার স্বর কেঁপে ওঠে।
“বন্যা;তুমি কি জানো তুমি চরম পর্যায়ের বেয়াদব।”
বন্যা সম্মতির চোখে তার দিকে তাকালো।
“আমি জানি।”
এতো নিরুতাপ কেনো মেয়েটা?তাহসানের আরো রাগ হয়।কেটে কেটে বলল,
“আমাকে সম্মান দিচ্ছো না কেনো তুমি?স্যারকে কেউ ছ্যাছড়া বলে?ইডিয়ট।”
বন্যার চোখেও তখন রাগ।হিংস্র বাগীনির মতো তাহসানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“পুরুষ মানুষে আমার এলার্জি আছে স্যার,যার তার প্রতি সম্মান আসে না।”
তাহসান ফোস করে নিভে যায়।বন্যা যে খারাপ পুরুষকে ঈঙ্গিত করেছে এটা বুঝতে পেরেই তার মুখটা থমথমে হয়ে যায়।
“আমাকে তোমার ওইরকম পুরুষ মনে হয়?”
“হ্যাঁ।সবাই এক।”
তাহসান এক পা এগিয়ে আসে।🤭
“সবাইকে এক ভাবার কারণ?”
“আপনাকে বলবো কেনো?”
এতো অবজ্ঞা!তাহসানের সহ্য হয় না।
“নিজের দিকে একবার তাকিয়েছো? এই চলনে কোনো পুরুষ আটকাবে?আর আমি ইম্পসিবল!রাসকেল।”
বন্যা কিছু বলেনা।চুপচাপ তাহসানের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।তারপর কিছু না বলে নিঃশব্দে পা ফেলে নিচে নেমে যায়।তাহসান অবাক হয়ে বন্যার প্রস্থান দেখে।তার কেনো মনে হচ্ছে বন্যার চোখের দৃষ্টিতে কষ্ট আছে?কেনো?সে কি ভুল কিছু বলেছে?
চলবে…