#তবে_ভালোবাসো_কী
#Mehek_Enayya(লেখিকা)
#সূচনা_পর্ব
সামনে বসা নিজের হবুবরকে দেখে ভড়কে যায় মাহানুর। একবার তার বেস্টফ্রেন্ডের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার স্মুখীন বসা ছেলেটির দিকে। ফ্যামিলির পছন্দ করা ছেলের সাথে দেখা করতে এসেছিলো মাহানুর। আপাদত তার বিয়ে করার সখ নেই। কিন্তু পরিবারের বাধ্য মেয়ে! তাই বড়দের মুখের ওপরে না করতে পারলো না। ভেবেছিলো এখানে এসে উল্টাপাল্টা কথা বলে পাত্রকে বলবে বিয়ে ভেঙে দিতে। সঙ্গী হিসেবে নিজের বেস্টফ্রেন্ডকেও সাথে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এখন পাত্রকে দেখে মিনেশা পারে না হাত পা ছড়িয়ে এখানেই কান্না করে দেয়!
মাহানুরের বেস্টফ্রেন্ড তন্দ্রা মেকি হাসি দিয়ে সামনে বসা ছেলেটির দিকে তাকায়। ভোঁতা মুখে বলে,
-ভাইয়া ভালো আছেন?(তন্দ্রা)
-হ্যাঁ আপু। আপনি ভালো আছেন?
-জি ভাইয়া। আপনিই কী হামযা চাচ্চুর বন্ধুর ছেলে? আপনি দেখতে আসলেই অনেক হ্যান্ডসাম!(তন্দ্রা)
মাহানুর বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে তাকায় তন্দ্রার দিকে। মনে মনে বলে,”এই ছেরির মাথা আবার গেলো নাকি!” মাহানুর সম্পূর্ণ এটিটিউড নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-আপনিই তাহলে আরহাম চৌধুরী? আমার বাবা চাচারা আপনার কী যে তারিফ করলো আমার সামনে ভাই রে ভাই! কিন্তু এ তো দেখি মুলা!(মাহানুর)
-আমি আস,,,,,,,,,,,,
-ঐ মিয়া দাঁড়ান আমার কথা শেষ হয়নি। আপনিই কী আর্মি? সিরিয়াসলি ভাই এই হেংলা পাতলা শরীর নিয়ে যুদ্ধ কীভাবে করেন? আপনার জন্য তো দেখছি বাংলাদেশ যুদ্ধে হেরে যাবে! আপনার থেকে তো মনে হয় আমিও ভীষণ শক্তিশালী! (মাহানুর)
-,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,।
-কী হলো মিস্টার মুলা? আপনার কী আবার কথা কম বলারও অভ্যাস আছে নাকি? আচ্ছা ভাই আমরা যাই। সযত্নে আমার বাপ্ চাচাদের ফোন করে বলে দিয়েন মেয়ে আপনাকে রিজেক্ট করে গিয়েছে। লাগবো না আমার আর্মি। আমি রিকশালাকে বিয়ে করবো। (মাহানুর)
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহানুর ও তন্দ্রা। বসা ছেলেটি এখনও ভেবছেঁকা খেয়ে বসে আছে। মাহানুরের সব কথা তার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। দেখতে কত সংস্কারি লাগে অথচ মুখের ভাষা!
মাহানুর হিজাব ঠিক করতে করতে ক্যাফের দরজা দিয়ে বের হতে নেয় হঠাৎই কারো সাথে ভীষণ জোরে ধাক্কা খায়। তাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে যায়। তন্দ্রা নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। রেগে অগ্নিমূর্তি হয়ে মাহানুর সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে তাকায়। ছেলেটি গম্ভীর মুখে মাহানুরের দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মাহানুর হাত ধরলো না। নিজে নিজেই উঠে দাঁড়ায়। জামা ঠিক করে তেড়ে যায় ছেলেটির দিকে। আঙ্গুল দেখিয়ে বলে,
-ঐ বেডা চোখ কী পকেটে রাখিস হুম? নাকি সুন্দর মেয়ে দেখলেই শুধু ধাক্কাধাক্কি করতে মন চায়?
-এক্সকিউস মি? আমি নাহয় চোখ পকেটে রেখেছিলাম। আপনি আপনার চোখগুলো কী কাঁককে হাওলাদ দিয়ে এসেছেন?
-এক তো ধাক্কা দিয়েছিস আবার বড় বড় কথা বলছিস! তোকে তো আমি জিন্দা খেয়ে ফেলবো!
তন্দ্রা বিরক্ত হয় মাহানুরের কথা শুনে। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখে তার একটু ভয় লাগছে। কত লম্বা চওড়া ছেলেটি। মাহানুরকে এক লাত্থিতে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারবে বলে মনে হলো তন্দ্রার। তাই সে এগিয়ে যায় মাহানুরের কাছে। ভীত কণ্ঠে বলে,
-নুরি চল দোস্ত। শুধু শুধু ছেলেদের সাথে বাড়াবাড়ি না করাই ভালো। (মাহানুর)
-তুই চুপ। কত বড় সাহস এই ছেলের আমি আজ দেখে ছাড়বো। (মাহানুর)
-নির্বোধ।
সামনের ছেলেটির কথা শুনে মাহানুরের রাগ আরো বেড়ে যায়। মুখ ফুটে কিছু বলবে তার আগেই ছেলেটা তাকে সম্পূর্ণ এভোইড করে চলে যায়। হতবাক হয়ে যায় মাহানুর। তন্দ্রা সুযোগ বুঝে মাহানুরকে নিয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে পরে। বাহিরে এসে মাহানুর এক এক করে সবাইকে বকে যাচ্ছে।
-সব দোষ ঐ মুলার! সালা মুলার বাচ্চা মুলা আমার সম্পূর্ণ দিন টাই নষ্ট করলো।
-কিন্তু দেখতে খারাপ ছিল ছেলেটা!
-তুই বিয়া কর তাইলে। দাঁড়া আমি এখনই কথা বলছি।
-না না দোস্ত। আমি বলছি ছেলেটার গাঁয়ের রঙ তো অনেক ফর্সা।
-মুলা কী আমি শুধু শুধু বলছি! চল এখন বাসায়।
রিকশায় উঠে পরে মাহানুর আর তন্দ্রা। মাহানুর আশেপাশে চোখ বুলাচ্ছে আর তন্দ্রা চুপচাপ বসে আছে।
মাহানুরের সাথে ধাক্কা খাওয়া ছেলেটা এগিয়ে যায় একটি ছেলের কাছে। মাহানুর কিছুক্ষন আগে যাকে মুলা নাম দিয়ে গেলো সেই ছেলেটির পাশে বসে পরে ছেলেটি। গম্ভীর কণ্ঠস্বরে বলে,
-কিরে দোস্ত এখনও আসেনি সে?
-এসেছিলো। চলে গিয়েছে।
-মানে?
-মেয়ে না ঐটা অগ্নির গোলা! নাগা লাল মরিচ!বারুদ!
-আরেহ রিদ হয়েছেটা কী বল তো?
রিদ নামক ছেলেটা অসহায় ভঙ্গিতে আরহামের দিকে তাকায়। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলে,
-মেয়েটা আমাকে আরহাম চৌধুরী মনে করেছে। বিনা পয়সায় রোস্ট করে গেলো আমাকে নিয়ে! আমার নতুন নামও দিয়ে গেলো। মুলা!
আরহাম অবাক হয়েছিল রিদের কথা শুনে। কিন্তু শেষের কথায় শব্দ করে হেসে দেয়। পেট ধরে নিজের হাসি থামিয়ে বলে,
-কিন্তু মেয়ের চাচা যে বললো মেয়ে একদম সংস্কারি। এতো ভদ্র যে সবার কথায়ই উঠে বসে। এমন কী এই যুগের মেয়ে হয়েও নাকি তাঁদের মেয়ে ফোন উসড করে না।
-ওওও ভাই মুঝে মারো মুঝে মারো! ঐ মেয়েরে বিয়া করিস না দোস্ত তোর জীবন খতম হয়ে যাইবো। আমি তো এতক্ষন বসে বসে তোদের ফিউচার কল্পনা করছিলাম। বিশ্বাস কর ঐ নাগা মরিচ তোর নাকে দড়ি দিয়ে গরুর মতো ঘুরাবে মামাহ!
-আচ্ছা কুল ব্রো। আমাকে নিয়ে ভেবে এতো ডিপ্রেশনে যাওয়া লাগবে না! কুল।
___________________🖤
বাড়ির সামনে আসতেই ভেজা বিড়াল হয়ে যায় মাহানুর। হাতের দামি ফোনটা ব্যাগের ভিতরে লুকিয়ে ফেলে। তন্দ্রা হেসে বলে,
-নাটক শুরু! প্রতিবারের মতো এবারও নায়িকা মাহানুর খান। নায়ক এখনও অনিশ্চিত! ভিলেনের তো অভাব নেই। তো চলুন আমরা দেখতে থাকি সবসময়ের মতো এবারও মাহানুর খান কী পারবে ফ্যামিলির সবাইকে বেকুব বানাতে!
-ঐ শা*লী চুপ। বাসায় আয়।
-না অন্য একদিন আসুম।
-আচ্ছা টাটা তাইলে।
মুখ মলিন করে বাড়ির মেইন গেট খুলে ভিতরে ঢুকে মাহানুর। চোরের মতো আশেপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। সকালে ভীষণ বৃষ্টি হয়েছিল। যার জন্য এখনও পাকা করা উঠান ভিজে সেঁতসেঁতে। সাবধানতা অবলম্বন করে মাহানুর এগিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু আজ মাহানুরের ভাগ্য আসলেই খারাপ ছিল। উঠানের মধ্যখানি আসতেই পিছলিয়ে পরে যায় মাহানুর। জোরে একটা চিৎকার করে উঠে। পুরো দু’তালা বাড়িটা জানো কেঁপে উঠে মাহানুরের চিৎকারে। ছাদে নিজের লুঙ্গি শুকিয়ে দিচ্ছিলো হামযা খান মাহানুরের বড় চাচা। মাহানুরের চিৎকার শুনে কলিজা কেঁপে উঠে তার। ছাদ থেকে নিচের দিকে তাকাতেই দেখে মাহানুর নিচে পরে কাঁদছে। আর কী মাহানুরের চোখে পানি দেখে জ্ঞানশূন্য হয়ে পরে হামযা খান। সেও একটা চিৎকার করে নিজের পরিহিত লুঙ্গি হাঁটুর ওপরে তুলে দৌড় লাগায়। মাহানুরের ছোট চাচা করিম খান, তার স্ত্রী সহ বাড়ির সকলেই দৌড়ে উঠানে আসে। খান বাড়িতে জানো ভূমিকম্প শুরু হয়ে গিয়েছে।
মাহানুরের বড় চাচী হাজেরা খান মাহানুরকে গিয়ে ধরে। মেজো চাচী রামিশা ও ছোট চাচী লুৎফা মিলে মাহানুরকে দাঁড় করায়। মাহানুরের চোখের পানি দেখে হামযা খান নিজেও জানো কেঁদে দেবে এখনই। সবাই ধরে ড্রইংরুমে নিয়ে বসিয়ে দেয় মাহানুরকে।
-কোথায় ব্যাথা পেয়েছি মা? (করিম খান)
-পায়ে আর কোমরে ব্যাথা পেয়েছি ছোট চাচ্চু। (মাহানুর)
-করিম্মার তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? দ্রুত ডাক্তারকে ফোন দে। আমার মায়ের পায়ে ব্যাথা। (হামযা খান)
-ডাক্তার ডাকা লাগবে না বড় বাবা। (মাহানুর)
-দাঁড়াও আমি মলম নিয়ে আসছি। মালিশ করে দিলে আরাম লাগবে। (রামিশা)
-হ্যাঁ রামিশা দ্রুত যাও। (হাজেরা )
এলাকার অন্যতম নাম ডাকআলা পরিবার হলো খান পরিবার। অত্যাধিক কোটিপতি না হলেও মোটামুটি যা আছে ততোটুকুই এনাফ। যেখানে বর্তমান যুগে সব ভাইরা আলাদা আলাদা থাকতে পছন্দ করে। সেই যুগে এইরকম বড় ফ্যামিলি পাওয়া অনেক কঠিন বিষয়। মাহানুরের বাপ চাচারা চার ভাই এক বোন। বড় চাচা হামযা খান তিন ছেলে তার। বড় ছেলের বিয়ে হয়েছে ছোট দুইটার এখনও হয়নি। দ্বিতীয় মাহানুরের বাবা মেহরাব খান। শুধু এক মেয়েই তার। তৃতীয় মুশফিক খান দুই ছেলে তার। আর চতুর্থ করিম খান। এক ছেলে তার। মাহানুরের জন্মের সময়ই তার মা মারা গিয়েছে। এই বিশাল ফ্যামিলিই তাকে অত্যাধিক আদর ও ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। তিন চাচী জানো তার তিন মা! পরিবারের একটি মাত্র মেয়ে হওয়ায় ছোটকাল থেকেই সকলের চোখে মনি হয়ে থেকেছে মাহানুর। চাচাতো ভাইরা কত জ্বলে মাহানুরকে দেখে।
__________________🖤
রাতে খাওয়ার জন্য মাহানুর তার রুম থেকে বের হলো না। হাজেরা খান নিজেই মাহানুরের রুমে গিয়ে ওকে খাইয়ে দিয়ে আসে। দুইতালার সবচেয়ে বড় রুমটা তার। এটা নিয়ে একটু হিংসা করেছিল তার চাচাতো ভাইয়ের বউ। কিন্তু মাহানুর তাকে নিজের রুম দেয়নি। নিজের জিনিস অন্য কাউকে দেওয়া একদম অপছন্দ করে মাহানুর।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে উপন্যাসের বই পড়ছিলো মাহানুর তখনই তার রুমে ঢুকে হামযা খান, মেহরাব খান আর করিম খান। হঠাৎ বাপ চাচাদের আগমন মাহানুরের কাছে ভালো ঠেকালো। শান্ত ভঙ্গিতে উঠে বসে। হামযা মাহানুরের বিছানার কিনারে বসে মাহানুরের মাথা হাতিয়ে দেয়।
-আম্মা শরীর এখন কেমন লাগছে? (হামযা খান)
-জি বড় বাবা আগের থেকে একটু ভালো। (মাহানুর)
-উইযে, আসলে জানতে এসেছিলাম উইযে, (হামযা)
-বলে ফেলো বড় বাবা? (মাহানুর)
-মা আরহামকে কেমন লেগেছে তোর? (মেহরাব খান)
-একটুও ভালো লাগেনি বাবা। ছি তোমাদের চয়েস যে এতোটা খারাপ জানা ছিল আমার! ছেলেটাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো সে নেশাপানি করে কেমন হেংলা পাতলা! আমি তো ভাবছি তাকে আর্মিকে বানালো!(মাহানুর)
-কী বলিস মাহানুর? আরহাম হেংলা পাতলা! আমি তো সেদিন বড় ভাইয়ের সাথে দেখেছিলাম তাকে। কী সুন্দর উচা লম্বা বলিষ্ঠ দেহ ছেলেটির। ( করিম খান)
-তোমাদের বয়স হচ্ছে চাচ্চু তাই হয়তো তোমাদের চোখে ছানি পরে গিয়েছে!(মাহানুর)
-বুড়ো ওরা হচ্ছে আমি এখনও ইয়ং বুঝলি আম্মা। (হামযা খান)
-হ্যাঁ কে বুড়ো দেখাই যায়!(করিম খান)
-তুই বুড়ো! তোর বাপ বুড়ো!(হামযা)
-হ্যাঁ আমার বাপ আপনের চাচা লাগে বড় ভাই! (করিম)
-উফফ!তোমরাও না কী ছোটদের মতো ঝগড়া করো! আমার তো ঝগড়া একদমই সহ্য হয় না ভাই! আমি ঝগড়া করতেও পারি না দেখতেও পারি না। (মাহানুর)
-দেখতে হবে না কার মতো হয়েছে। (হামযা খান)
-হ্যাঁ আমার মতো। (করিম)
-উইযে আবারও!(মাহানুর)
-আচ্ছা আর না। আমি কালই আরহামের বাপকে কল করছি। নেশা খাইয়ে তার ছেলেকে পাঠায় নাকি আমাদের মেয়ের সাথে দেখা করতে! ওর একদিন কী আমার একদিন। (হামযা)
-ঠিক আছে। (মাহানুর)
-আচ্ছা আম্মা এখন ঘুমিয়ে পড়ো। আমরা চইলা যাইতেসি। (হামযা)
“ওকে। শুভরাত্রি বাবা চাচ্চু’স। (মাহানুর)
>>>চলবে?