#তনয়া
#পর্ব-১৬
সিফাতী সাদিকা সিতু
আরাফের রাগী মুখটা দেখে মিশকাত মনে মনে একচোট হেসে নিলো।বেচারা রাগে টগবগিয়ে ফুটছে!বেলা এগারোটা বাজে।সকালের নাস্তা শেষ করে সবাই রাফাতের ঘরে জড়ো হয়েছে আরাফের জন্য।সকলে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে আরামে।কারও মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। আরাফের সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করছে।
অবশ্য তনু লজ্জা পাচ্ছে সেই সাথে বিরক্ত হচ্ছে। মিশকাত এবং আরাফ দুজনেই চরম অসভ্য।তনুর ভালো লাগছে না এত সুন্দর জায়গায় এসে দুটো ফাজিলের সাথে সারাক্ষণ থাকতে। সত্যি দুটোই অসহ্যকর!কিন্তু কিছুই করার নেই।একটু পরেই ওরা বের হবে ঘুরতে।অথচ আরাফ সেই পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে বসেছে।যা খুব বিরক্তিকর! আজ নিশ্চয়ই এসব কথার মাধ্যমে মিশকাত ভাই সবটা জেনেই যাবে?সুইমিংপুলের ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই লজ্জায় কাবু হয়ে আছে সে।তখন যেন ঘোরের ভেতর ছিল।মিশকাতকে ছেড়ে উঠে আসতে পারছিল না।
“প্লিজ তোমরা সবাই একটু বলবে আমায়?”
“কি বলব আমরা? বলার মতন কি আছে সবটাই তো সবার জানা।”রাফাত অলস ভঙ্গিতে জবাব দিলো।
” আমাকেও জানতে হবে?তনয়া তো নিজে বলবে না, তাহলে তোমরা কেউ বলো?”
“তনু না বলুক আমি তো বলতে পারি?তুমি আমায় জিজ্ঞেস করে দ্যাখ?”মিশকাত সোজা কথা বলে বসলো।
আরাফ রাগটা সামলে নিয়ে বলল,
“তাহলে বলো?”
“অবশ্যই বলব। তবে এখানে নয় বাইরে এসো আমার সাথে।সবাই সবটা জানলেও এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যায় না এমন খোলামেলা ভাবে।”
“বাইরে কোথায় যাব?এখানে কেন বলা যাবে না?আমি তো তনয়ারর থেকেও সবটা শুনতে চাই।আমায় ওর দুর্বলতার দোহাই দিয়ে সরিয়ে রেখেছে অথচ ঠিকি তোমার সাথে..!”
তনু শিউরে উঠল।আরাফ কেমন ভাবে কথাটা বলল?পুরোপুরি শেষ করল না কেন?কি বোঝাতে চাইছে আরাফ?
“রাফাত ভাই তোমার ভাইকে চুপচাপ আমার সাথে বাইরে আসতে বলো।শুধু শুধু তনুকে যেন এসবের মধ্যে টেনে না আনে?”মিশকাতের কথায় রাগের বহিঃপ্রকাশ স্পষ্ট। তাই রাফাত দ্রুত বলল,
“আরাফ তোর সবটা জানা দরকার তাই তো, তাহলে এতো ঝামেলা কেন করছিস?মিশকাতের কাছেই সবটা জানতে পারবি।আমিও বলছি এসবের মাঝে তনুর কোনো ভূমিকা নেই। তাই, প্লিজ তুই তনুকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবি না।”
আরাফ চোয়াল শক্ত করে দাঁড়াল। হিসহিসিয়ে বলল,
“কোথায় যাব?”
“সেই সুইমিংপুলের কাছেই চলো!”
মিশকাতের এমন কথায় বাকিরা মুখ টিপে হাসলেও আরাফ হনহনিয়ে চলে গেল।মিশকাত একবার তনুর দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সেও চলে গেল ঠোঁটের কোণে ফিঁচেল হাসি নিয়ে।
ওদের যাওয়ার পর সবাই জোরে হেঁসে উঠল।তনুর তো অবস্থা খারাপ লজ্জায়।আসলে ভোরবেলা আরাফ ওদের দুজনকে সুইমিংপুলের ধারে দেখেছিল এসে।মিশকাত তখন তনুর হাত চেপে ধরে ছিল।খুব কাছাকাছি দুজনে থাকায় আরাফ উল্টো পাল্টা ভেবে বসেছে।
রাফাত সবাইকে তাড়া দিলো জলদি তৈরী হয়ে নিতে।আজ ওরা অনেক জায়গায় ঘুরবে।রাফাত একটা ব্যাগে সবার এক্সট্রা জামাকাপড় নিতে বলেছে।সেই সাথে শুকনো খাবার, পানি তো আছেই।ঘুরতে গেলে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাথে রাখলে ভালো হয়।অচেনা জায়গায় কোনো বিড়ম্বনায় পরতে হয় না।
সবাই দ্রুত তৈরী হয়ে এসে দেখল,আরাফ ব্যাগ নিয়ে রেগে বেরিয়ে গেল।রাফাত দুএকবার আটকানোর চেষ্টা করলেও তেমন জোর করলো না।যা হবার হবে, ঢাকায় ফিরে সবটা সামলে নেয়া যাবে।মিশকাত নিশ্চয়ই সব বলেছে। আরাফ রাগের মাথায় সবকিছু নিয়ে আবার বাড়াবাড়ি না করে বসে?রাগের সময় তো মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না।অথচ এই ট্যুরটা নষ্ট করতে ইচ্ছে করছে না।আরাফের এমন হুট করে আসা আবার হুট করে চলে যাওয়ায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে সেই সাথে তনুর মন খারাপ হয়ে গেছে।পরিস্থিতিটাই পুরো অন্যরকম এখন।তবু সবাই গাড়িতে বসলো জাফলং এর উদ্দেশ্যে।যাওয়ার পথেই সবার মন ফুরফুরে হয়ে গেল।যখন ওরা প্রকৃতি কন্যার কাছে পৌঁছুলো তখন কেউই আর সকালের ব্যাপারটা মনে রাখলো না।অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে ব্যস্ত হয়ে পরলো। স্বচ্ছ পানির ধারা পাহাড় আর নদীর কি অপূর্ব সংযোগ। পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানিতে পা ভেজাতে তনুর মনটা ছটফট করছিল।সে শান্তা আয়রাকে ডেকে এনে পানিতে নামলো।রাফাত মারুফ এসে ওদের কাছে পাথরের ওপর বসলো।
মিশকাত শুধু দূরে ওদের থেকে।ও নিজের মতন ঘুরছে।আসলে ঘোরাঘুরির ফাঁকে তার দুঃচিন্তাও হচ্ছে অনেকটা।তাই একটু ভাবছে।আরাফ কেমন রেগে মেগে চলে গেল, ছেলেটা নিশ্চয়ই চুপ করে বসে থাকবে না?ওর মাথায় এখন তনু চেপে বসেছে এত সহজে তা নামবে বলে মনে হয় না।আরাফকেই বা কি দোষ দেবে তার নিজেরই তো একি অবস্থা। এত বছরেও তনুকে তো ভুলতে পারে নি।এমনকি তনুর সত্যিটা জানার পরে আরও বেশি ভালবাসা বেড়ে গেছে।তনুদের বাড়ি থেকে চলে আসার আগের রাতে তনু যখন ছাঁদে জ্বরের চোটে জ্ঞান হারিয়েছিল তখন তনুকে নিচে নিয়ে এসেছিল মিশকাত।অচেতন তনুকে ঘরে শুয়ে দিতে এসে বালিশের নিচে লেখা খাতাটা পেয়েছিল সে।তনুর পাশে বসে সবটা পড়েছিল।সেদিন যেন জীবনের মানেটাই অন্য হয়ে গিয়েছিল।সেদিনের কথা ভাবলে এখনও তার চোখের কোণে জল আসে।সবথেকে বেশি কষ্ট হয়েছিল তনুর কথা ভেবে।একজন নারী মা হতে পারবে না এটা খুব একটা সাধারণ ব্যাপার নয়।সবকিছু নীরবে সয়ে এসেছে মেয়েটা। তনয়া নামের অর্থই তো নারী।সেই নারীর স্বার্থকতা থেকে বঞ্চিত! অথচ এখানে কিছুই করার নেই।সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কখনও এই স্বার্থকতা সম্ভবও নয় কিন্তু সে জন্য তনু তো অপরাধী হতে পারে না?তাছাড়া এসবে যে নিজের মায়ের একটা ভূমিকা আছে তা জেনে সত্যি অবাক হয়েছিল।অথচ ছোট থেকে দেখে আসছে তার মা তনুকে খুব আদর করতো।আয়রা আপা খুব বেশি আসত না তাদের বাড়িতে ফুপিকে ছাড়া।তনুই তন্ময়কে নিয়ে প্রায় আসতো।কিছুদিন থেকে যেত।তখন তনুর সাথে ওর মায়ের বন্ধন টা কত সুন্দর ছিল!অথচ শুধুমাত্র মা হতে পারবে না জন্য তনু নিজের ছেলের ভালোবাসা জেনেও এভাবে দূরে সরিয়ে রেখেছে।অবশ্য মায়ের এতে দোষ নেই।শুধু তার মা কেন সমাজের সবাই একি কাজ করবে।সমস্যাটা তো আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির।একটা প্রকৃতিগত সমস্যা বড় হয়ে যায় বাকি সব চোখে পড়ে না।তখন রূপ গুন কিছুই কাজে আসে না।এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।মিশকাত তারই চেষ্টা করে চলছে।সবটা ধীরে ধীরে গুছিয়ে আনছে।কিন্তু তার আগেই যদি আরাফ বাড়াবাড়ি করে তাহলে একটু ঝামেলা তৈরী হবে।ঝামেলা মুলত দুজন করবে।মা এবং তনু!এনারা কেউ সমঝোতা করবে না।তনু এই দোহাই দিয়ে সবসময় দূরে ছিল এবং থাকছে।কারণ বড়মামি কখনও মেনে নেবে না কথা টা সে খুব ভালো ভাবে মাথায় গেথে নিয়েছে।অন্যদিকে নিজের মা ছেলের জন্য তনুকে বউ করবে না।এই দুজনকে অন্যরকম ভাবে সামলাতে হবে!মাঝখান থেকে আরাফ নামের উৎপাত।সব হয়েছ ওই তনুর জন্য। যেমন হেসে হেসে কথা বলেছে এখন বুঝুক মজা!সে তো ঝামেলা পাকিয়ে ঠিকি ভাব দেখিয়ে চুপচাপ আছে।সব এখন তাকে সামলাতে হবে!
“তুমি আরাফের কথা ভাবছো?”রাফাত এসে পাশে দাঁড়াল।
“হুম,ভাবছি ফিরে গিয়ে কি করবে?আমি সত্যি সুন্দর ভাবে সবটা বুঝিয়ে বলেছি। তনুর যদি ওই সমস্যা টা না থাকত তবে এতদিন আমাদের সম্পর্কের বয়স পাঁচ বছর হতো।আরাফ বুঝতে চাইলো না তনু আমায় ভালোবাসে।”
“রাগের সময় মানুষ ভুল করে বসে।পরে ঠিকি বুঝতে পারে।যা করে করুক না।আরাফ যখন বুঝতে পারবে তখন দেখবে লজ্জিত হবে।”
“সেটাই আমিও জানি রাফাত ভাই।কিন্তু কিছু সমস্যা তো তৈরী হবেই।”
“তা ঠিক।তবে সমস্যা থাকলে সমাধানও থাকবে।আয়রার বাবা তো জানেন।অনেক কিছু উনি সামলে নিতে পারবেন।”
“হুম,আচ্ছা চলো ওদের কাছে যাই। এরপর লালাখাল যাব।ওদের জিজ্ঞেস করিও ঝুলন্ত ব্রিজে যাবে কিনা?”
***
আরাফ বিকেলে ঢাকায় পৌঁছে মায়ের কাছে এসে বলল,
“তনয়ারা মিথ্যা বলেছে আমাদের মা।ওর হয়ত কোনো সমস্যাই নাই।”
“চুপ কর।আবার তুই আজে বাজে কথা শুরু করলি?কেউ ওরকম একটা ব্যাপার নিয়ে মিথ্যা বলে কখনও?”
“তনয়ার যদি সমস্যাই থাকে তাহলে ও প্রেম করে কিভাবে?তখন কি ওই সমস্যার কথা মাথায় থাকে না?”
“কি বলছিস, তুই? ”
“ঠিক বলতেছি।তনয়ার মামাতো ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে।ওদের অনেক দিনের সম্পর্ক। তনয়া যদি কোনো সমস্যা থাকত তাহলে কি ছেলে সম্পর্ক রাখতো?ওরা দুজনে মিলেই এমন গল্প ফাঁদছে।”
“আমি তো কিছুই বুঝতেছিনা।ওনারা আমাদের এতবড় মিথ্যা কেন বলবে?”
“এইজন্যই তোমায় বলেছিলাম ওসব কোনো সমস্যা নয়।বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“চুপ কর আরাফ! মানলাম ওরা মিথ্যা বলেছে মেয়েটার অন্য ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ওরা খারাপ এসবে তোর মাথাব্যাথা কেন?যা খুশি করুক ওরা।”
“নাহ্ ওরা আমাদের এভাবে মিথ্যা বলবে আর আমরা কিছুই করবো না?তুমি এখনই তনয়ার মাকে ফোন করবে জানতে চাইবে নিজের মেয়ের সম্পর্কের কথা গোপন করে মিথ্যা কেন বলেছে?”
“না, আমি ফোন করবো না।তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে।গতরাতে বেরিয়ে গেলি আবার আজকেই ফিরে আসলি।রাফাতের সাথে নিশ্চয়ই খুব চোটপাট করেছিস?”
“তুমি ফোন করবে এরপর আমি যাব।” আরাফ বজ্রকন্ঠে বলে মায়ের ফোনটা হাতে তুলে নিলো।
***
সারাদিন অনেক জায়গায় ঘুরে ঘুরে সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে ফিরলো।খিদেয় নাজেহাল অবস্থা।জাফলং মায়বী ঝর্নায় সবাই গোসল করেছে।শরীর না চললেও মনটা ভিষণ ফুরফুরে হয়ে আছে তনুর।শান্তাকে বলল,
“কিছু না খেয়েই শুয়ে পরলি কেন?
“তুই ঘরেই খাবার নিয়ে আসতে বলে দে।আমার শক্তি নেই নিচে নামার।”
“এত দেখি করুণ অবস্থা তোর?”
“তবে যাইহোক এতদিনে সিলেটে আসার ইচ্ছে টা পূর্ণ হয়েছে।অসম্ভব সুন্দর জায়গা।আমার তো ঢাকায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না।”
তনু কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর ফোনটা বেজে উঠল।মায়ের নম্বর দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করল।তবে শায়লা বেগমের কথা শুনে মুখটা শুকিয়ে গেল।যা ভেবেছে তাই হলো।তনুর চোখজোড়া ছলছল করছে। খুব চেষ্টা করছে কান্না আটকাতে। এখন সে মাকে কিভাবে বোঝাবে সত্যি টা?
চলবে…