তনয়া পর্ব-১১

0
1016

#তনয়া
#পর্ব -১১
সিফাতী সাদিকা সিতু

তনয়া সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘরে চা বানাতে এলো।শায়লা বেগম আয়রা অবাক হয়ে তনুকে দেখছে।তনুকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে সেই বিকেল থেকে ওর মনে কি ঝড় বয়ে চলছে।

শায়লা ইশারা করায় আয়রা বলল,

তনু তোর খিদে লেগেছে? কিছু বানিয়ে দেব?

না আপা শুধু চা খাব।আমি বানাচ্ছি তুমি খাবে?মা তোমাকেও দেই?

শায়লা বেগম মাথা নাড়ালেন।কেউ বুঝে উঠছে না তনু কি চাইছে?

মাথা ব্যাথা করছে তোর?

হ্যাঁ রে আপা।মাথাটা খুব ধরেছে।একটু তেল লাগিয়ে দেবে?

আচ্ছা, চল ঘরে যাই।

দাঁড়াও বাবাকে চা দিয়ে আসি।

শায়লা যা বোঝার বুঝে গেলেন।তবে মনে মনে খুশিও হলেন।তনু নিজেই কথা গুলো বলতে পারবে এটাই তো আনন্দের। শুধু শুধু কেন গুটিয়ে রাখবে নিজেকে?বিষয়টা তনুর সমস্যা কোনো অপরাধ নয়!

বাবা একটু আগে চা খেয়েছে।তুই চল আমি তেল দিয়ে দেই।

তনু কিছু বলার আগে শায়লা বললেন,চা টা নিয়ে যা।তোর বানানো চা খুব পছন্দ করে।

তনু অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো। শায়লা বেগমের চোখের কোণ চিকচিক করছে।তনুর সস্তির শ্বাস ফেলে বাবার কাছে এলো।

তনুকে দেখে খুশি হলেন তানভীর সাহেব। ভেবেছেন মেয়েটা হয়ত মন খারাপ করেছে।হুট করেই এমন অভাবনীঅভাবনীয় প্রস্তাব পেয়ে তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করেই মোটামুটি মত দিয়েই ফেলেছেন।না করার তো কারণ নেই।রাফাতকে যদি পছন্দ হয় তাহলে আরাফ কে কেন অপছন্দ হবে?আরাফও ভালো ছেলে।তবু তিনি খোঁজ খবর না নিয়ে এগোবেন না।তাছাড়া রাফাত ভালো জন্য আরাফও ভালো হবে এমনটা নাও হতে পারে।কিন্ত আত্মীয়দের মুখের ওপর না করে দেয়াটা খুব খারাপ হয়ে যেত।

তানভীরের পাশে বসে তনুর নিরবে চায়ে চুমুক দিচ্ছে।

তুমি কি আমায় কিছু বলবে বাবা?

তানভীর এতক্ষণে সুযোগ পেলেন।বললেন,

তুই কি আমার ওপর রেগে আছিস?

উহু, আমি তো কখনো রাগী না।বলতে পারো আমার রাগ খুব কম।যেটুকু আছে তাও অপ্রকাশ্য।

তা অবশ্য ঠিক।তুই তো রেগে থাকিস নীরবে।কিন্তু জানিস কি তোর চাপা রাগটাকে আমি আর তোর মা খুব ভয় পাই।

তনুর মনটা আসলেই ভালো হয়ে গেল।বাবার কাছে কিছুক্ষণ থাকলেই মন ভালো হয় তার।এর আগেও এমন হয়েছে।একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল,

সবকিছু তো আমাদের হাতে থাকে না বাবা।তাহলে অপ্রত্যাশিত কিছু বিষয় নিয়ে রাগ অভিমান করার মতো বোকা আমি নই।তুমি তো জানতে না ওরা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে।

আয়রা তো আমাদের সেভাবে কিছু বলে নি।আমি সত্যিই কিছু জানতাম না।

তুমি আরও একটা সত্যি জানো না বাবা! তোমার মেয়ে কোনোদিন “মা” হতে পারবে এই কথাটা এখনও তোমার অজানা।তোমার মেয়ের রিপোর্টে Polycystic Ovarian Syndrome এ সমস্যা লেখা আছে।এটা শোনার পর কি তোমার খারাপ লাগবে বাবা?

তানভীর স্থীর হয়ে বসে আছে।বোঝার চেষ্টা করতে চাইছে তনু কি বলছে!সব কথা গুলো জট পাকিয়ে উঠছে।

তনু আবার বলল,

আমি জানি তোমার খারাপ লাগবে।রাগও হবে প্রচুর এতদিন এই বিষয়টা গোপন রাখার জন্য।সবথেকে যেটা বেশি হবে সেটা হলো কষ্ট!তোমার মনে আছে বাবা,অফিস থেকে ফিরে আগে আমার হাতে চকলেট তুলে দিতে এরপর আয়রা আপাকে দিতে।ছুটির দিন গুলোতে তুমি আমায় বেশি সময় দিতে।সবসময় ছায়ার মতোন ছিলে আমার পাশে।মা বাবার কাছে সব সন্তান এক হলেও আয়রা আপাকে যেভাবে মা আঁকড়ে রেখেছে তুমিও সে ভাবেই আমায় স্নেহের চাদরে জড়িয়ে রেখেছ।তুমি পারবে না বাবা তোমার তনয়াকে এভাবেই আগলে রাখতে?

তনু বাবাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু উত্তর শুনতে চাইলো।কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার প্রয়োজন হয় না।প্রশ্নটাই উত্তর হয়ে যায়।তনু উঠে দাঁড়াল। তানভীর সাহেবের সামন থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপটা নিয়ে চলে গেল।

***
মিশকাত ইন্টারভিউ শেষ করে বেরিয়ে এসে রাস্তার পাশে দাঁড়াল।প্রচন্ড গরমে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সে।আজ দুটো ইন্টারভিউ ছিল।একটা খুব খারাপ হয়েছে অন্যটা বেশ ভালো হয়েছে। ঠিক তনু যেরকম।বেশি খারাপ আবার খুব ভালো।টক ঝাল মিষ্টির সংমিশ্রণ। মিশকাতের ফাইনাল পরিক্ষার মাসখানেক বাকি।এরই মাঝে সে চাকরির পেছনে ছুটছে।পরিক্ষা নিয়ে ভাবছে না।তার এখন অন্যকিছু ভাবনা!শুধু ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ নয় সেটা বাস্তবায়নেও নেমে পরেছে।এখান থেকে সোজা সে বাস টার্মিনালে যাবে।দুদিনের জন্য বাড়ি যাবে সে।রাস্তায় দাঁড়িয়ে মারুফের অপেক্ষা করছে।মারুফ এইদিকেই কাজে এসেছিল।দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে।বাড়িতে থাকবে একদিন এরপর মারুফের কাছে যাবে।ওখানে সমস্ত কাজকর্ম সেরে আবার হলে ফিরবে।

পকেট থেকে টিস্যু বের করে গলায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘামগুলো মুছে নিলো।

কয়েক মিনিটের মধ্যে মারুফ এলো।দুজনেই রিকশা নিলো।

কিছু জানিস ওই দিকের খবর?

তুই বললেই জানতে পারব।

আরাফ বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে।ফুপা বোধহয় মত জানিয়ে দিয়েছে।

মিশকাত হাসলো দুপা ছাড়িয়ে আরাম করে বসলো।

এতসব কবে হলো?

গতকালই হয়েছে।আয়রার শ্বশুর বাড়ির কথা ভেবেই বোধহয় ফুপা এত দ্রুত রাজি হয়েছেন।তা না হলে দেখিস নি রাফাতের সময় কতদিন ধরে খোঁজ খবর চালিয়েছেন।

এবার খোঁজ নিয়ে কি করবে বিয়ে টাই তো হবে না!

কি বলছিস?কেন হবে না?তুই কি এখন বিয়ে ভেঙে দিবি তনুর?মারুফ অবাক হয়েছে ভীষণ।

মিশকাত এত সামান্য কিছু করে না।যা হবে তা এমনিই হয়ে যাবে।দুদিন পর শুনিস বিয়ের প্রস্তাব যেভাবে এসেছে সেভাবে ফিরে গেছে।

এত নিশ্চিত হচ্ছিস কিভাবে?তোর ধারনা তো ভুলও হতে পারে।

তনুর ব্যাপারে আমার কখনো ভুল হয়েছে?

মারুফ একটু ভেবে বলল,তা হয়নি।তুই বলেছিলি তনু তোর মাকে নালিশ করতেই পারে না!যদি করেও থাকে এর মধ্যে অন্য কোনো কারণ আছে।

আমার বিশ্বাসটা ঠিক মিলে গেছে।এখন দেখবি এটাও মিলে যাবে।কি বলতো,কাউকে ভালোবাসলে নিজের মাঝে সুপারন্যাচারাল পাওয়ার চলে আসে।তবে আমার দেরিতে এসেছে।তা না হলে অনেক আগেই বুঝে যেতাম তনু সেদিন রাতে দেখা করতে আসবে না!

তুই যে পথে হাঁটছিস তাতে কি মনে হয়?

মিশকাত সে কথা জবাব না দিয়ে বলল,

খোঁজ নে তো।তনু এ দুদিন ভার্সিটিতে আসবে কিনা?

তনুর সাথে দেখা করবি?

নাহ।ঠিক দেখা করবো না অন্যকিছু করবো!

ভালোভাবে বলতো কি চাইছিস তুই?

বলব,আগে কিছু খেয়ে নেই।বাসে উঠে তোকে সবটা বলছি।সকালে কিছু খেয়ে বেরোই নি আজ।

মারুফ রিকশাওয়ালা কে বলল,মামা সামনে কোনো ভালো রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ায়েন তো।

আইচ্ছা মামা।

আরাফ মায়ের ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে।তার মা সমানে বকাঝকা করে চলেছে।কারণ,একটু আগেই তনুর বাবা জানিয়েছেন সবকিছু।তানভীর সাহেবে বলেছেন,

ওনার মেয়ের এই সমস্যাটা মানতে রাজি হলে হলে তবেই ওরা বিয়ের বিষয়ে ভাববে।তনুর সবটা ওনারা খোলামেলাই জানিয়েছেন।আরাফকেও বলে দিয়েছিলেন, তুমি বাবা বিয়ে করতে না চাইলে আমরা কিছু মনে করবো না।তবুও আগেই সব ভেবে চিন্তে নিও।বিয়ের পর আমার মেয়েকে অসুখী দেখতে পারব না।

তনুর বাবার এমন ব্যবহার ভালো লেগেছে আরাফের মায়ের।সত্যি লুকোনো হয় তাদের কাছে।আয়ারার পরিবার যে সত্যি ভালো পরিবার তা বুঝতে পেরেছেন।কিন্তু ছেলের কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেছেন।

আরাফ বলছে,সে তনয়াকেই বিয়ে করবে।বাচ্চা লাগবে না তার।যদি প্রয়োজন হয় দত্তক দেবে।কত নিষ্পাপ শিশু এতিমখানায় বড় হচ্ছে। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন আনা দরকার।নিজের ঔরসজাত সন্তান হতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই।এরকম সমস্যা তো তার নিজেরও হতে পারতো।

ছেলের এমন আবেগী ভাষণে গলে না গিয়ে বরং রেগেমেগে চড় বসিয়ে দিয়েছেন।একমাত্র ছেলের গায়ে হাত তুলেছেন অনেকদিন পর।এই যে এতবড় কথা বলছে ঠিক একদিন বলবে তার নিজের সন্তান চাই।তনুর সমস্যাকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে দেবে।যতই হোক তিনি একজন নারী।নিজেকে দিয়েই তো বোঝেন।আরাফ তার বিয়ের পাঁচ বছর পর এসেছে।এরপর তো অপারেশন করতে হলো।আরাফের বাবা প্রথম প্রথম ঠিক এমন কথাই বলেছিল।অথচ পাঁচটা বছরে কতশত ডাক্তার দেখিয়েছেন,কত মান অভিমান,অপমানের পালা চলেছে সেটা শুধু তিনিই জানেন।আরাফ একমাত্র ছেলে এখন যদি ছেলের বউও সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয় তাহলে কি করে হবে?

***
তনু ভার্সিটির থেকে বেরিয়ে মারুফকে দেখতে পেল।হেসে এগিয়ে এসে বলল,

কেমন আছো ভাইয়া?

ভালো আছি, তোর খবর কি?

এইতো ভালোই।কাজে আসছিলে?

উহু,তোর কাছে এসেছি?

তনু একটু অবাক হয়ে বলল,

আমার কাছে কেন?

প্রয়োজন আছে।চল আমার সাথে একটা জায়গায় তোকে নিয়ে যাব।

কোথায় যাবো?

গেলেই দেখতে পাবি।

তনুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেনে নিয়ে গেল মারুফ।

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে