#তনয়া
#পর্ব -৮
সিফাতী সাদিকা সিতু
“সেদিন রাতে তোমার সাথে দেখা করতে যাইনি আমি।জানতাম অপেক্ষায় ছিলে।নিশ্চয়ই ছটফট করেছিলে খুব!যাইহোক তোমার অনুভূতি গুলো তোমার মধ্যেই থাকুক। আমি চাইলেও সেই অনুভূতির যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারব না কখনো।তবে কি জানত,তোমার আমার মনের ভেতর কি চলছে সেটা বড়মামি খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।মায়েরা সবটা বুঝতে পারে! হয়ত তোমার আমার না হওয়া সম্পর্কের কারণ এটাই!কি ভাবছ, বড়মামিকে দোষারোপ করছি?উহু,মোটেও না।নিজের এত দোষের ভীড়ে অন্যকে কি দোষ দেব।ভুল বলো,অন্যায় বলো যদি কিছু হয়েই থাকে সেটা আমার হয়েছে।তুমি ঠিক বুঝতে পারছ না কি বলতে চাইছি, তাইনা?
আচ্ছা বলছি,
তুমি তো জানো বড়মামা বড়মামির কত আদরের ছিলাম আমি।সেদিন সন্ধ্যা বেলা বড়মামি আমায় ডেকে তার কাছে বসিয়ে বললেন,
“আয় তোর চুল গুলো ভালো ভাবে বেঁধে দেই।সারাদিন খুলে রেখেছিস জট লেগে গেছে।”
আমি খুশি মনে বসেছিলাম চুল বাঁধতে ।মামি প্রথমেই বললেন,
“এই যে এত সুন্দর চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াস আমার ছেলের মাথাটা নষ্ট করতে বুঝি?”কি সুন্দর ভাবে হেসে বলেছিল কথাটা!প্রথমে আমি সত্যি বুঝতে পারিনি মামির কথা।সদ্য কলেজে পা দেয়া আমি তখনও এই কথাটার গাম্ভীর্য বুঝে উঠেনি।
মামি আবার বললেন,”আমি জানি মিশকাতের মনে কি চলছে তোকে নিয়ে।তবে তোকে সাবধান করে দেই তনু, ভুলেও মিশকাতের দিকে পা বাড়াস না!এরবেশি কিছু আমি বলতে চাইনা।”
আমি অবাক হয়ে মামির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।ধীরে ধীরে সবটা বোঝার পর লজ্জা সেই সাথে ভয়ে আঁতকে উঠেছিলাম।আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মামি বলেছেন,
“খুব অবাক হচ্ছিস তাই না?ভাবছিস আমি কিভাবে জানলাম তোদের দুজনের মনের খবর?জেনেছি জন্যই চেপে যেতে বলছি তোকে।ভুলেও মিশকাতের কাছাকাছি যাবি না।যে সম্পর্কটা তোদের শুরু হবার কথা তা যেন কখনোই না হয়।”
আমার বুকের ভেতর তখন তোলপাড় চলছে। কি করবো ভেবে পাচ্ছি না।লজ্জা দূরে রেখে মামির পায়ের কাছে বসে বললাম,
“কেন এমন বলছ বড়মামি?মিশকাত ভাইয়ের কাছে যেতে কেন বাঁধা দিচ্ছো?মিশকাত ভাই আমায় পছন্দ করে!”
“পছন্দ যখন করে তখন একদিন অপছন্দও করবে।তোকে যেটা বলেছি সেটা মাথায় রাখিস।”
আমি মামির পা দুটো আঁকড়ে ধরে বলেছি,
“তোমার আদরের তনু তোমার ছেলের বউ হোক তা চাও না কেন?”
“কারণ,তুই কখনো আমার মিশকাতের জীবনে সুখ এনে দিতে পারবি না তাই।”
“কি বলছ,কেন পারব না?আমি মিশকাত ভাইকে ভালোবাসি। ”
“ভালোবাসা আর সুখের পার্থক্য বোঝার মতো বয়স,জ্ঞান তোর কোনটাই হয়নি তনু!জীবনে ভালোবাসা না থাকলেও চলে কিন্তু সুখ, সেটা লাগে রে।আমি আমার সংসারে সুখ চেয়ে এসেছি, আমার ছেলের জীবনেও তাই চাইবো।”
“কিসের সুখ আমায় বলো, দেখবে আমি ঠিক পারব।”
“পারবি না তুই?”
আমি নাছড়বান্দার মতোর বলেছিলাম,
“পারব,তুমি বলে দেখ আমি ঠিক পারব।”
মামি কিছুক্ষণ কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।এরপর বলেছিলেন,
“তুই কখনো মা হতে পারবি না তনু!তোর সাথে বিয়ে হলে আমাদের সংসারটা শেষ হয়ে যাবে।”
আমি তখন বজ্রাহত হয়ে বসেই রয়েছি।মামির কথা আসলেই কিছু বুঝতে পারছি না।”মা “হতে পারব না কেন?বিয়ের পর তো সব মেয়েরাই মা হয়।আমি তখন এতটাও ছোট নই যে বিয়ে, নারী পুরুষের সম্পর্ক, সন্তান এসব বিষয়ে বুঝবো না।
“কি বলছ মামি?”মা “কেন পারবো না?আমার বিয়ে হলেই তো মা হতে পারব।তুমি আগেই কেন এসব বলছ?
আমি জানি তাই বলছি।তোর আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোর মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। তোর মনে নেই কিছুদিন আগে পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালের ভর্তি ছিলি দুইদিন।আমিও তো ছিলাম।দুলাভাই বাইরে থাকায় তোর মামা তোকে নিয়ে হসপিটালে গিয়েছিল।তখন রিপোর্টে এসেছিল তুই কখনো মা হতে পারবি না।এ জন্যই তোর পিরিয়ডের সমস্যা হতো।আজ তোর মিশকাতের সাথে সম্পর্ক হলে কাল আমি ছেলের সুখের কথা ভেবে তোদের বিয়ে দিয়ে দিলাম। বিয়ের পর যখন তুই মা হতে পারবি না, তখন মিশকাতকে কি জবাব দিবি?”
মামির এই কথাটাই আমায় প্রবলভাবে নাড়িয়ে দিয়েছিল।সত্যি তো, কে না চায় নিজের সন্তান। তোমায় আমি কি জবাব দিতাম?এখন যতটা কষ্ট হচ্ছে তখন তো আরও বেশি কষ্ট হবে।সেই কষ্টের সীমানা থেকে বের হতে পারব না।
আমি ছুটে মায়ের কাছে গিয়েছিলাম।প্রশ্ন করেছিলাম আমায় এই কথা কেন জানানো হয়নি?পরে এই নিয়ে বড়মামির সাথে মায়ের কথা কাটাকাটি হয়। সেই থেকে বড়মামির সাথে মায়ের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে।তার পরেরদিন সকালেই মা আমায় নিয়ে চলে আসে।তোমায় কিছুই জানাতে পারিনি।তোমার সামনে দাঁড়ানোর সাহসটুকুও সেসময় আমার ছিল না।সদ্য পাওয়া আঘাতটা সামলিয়ে ওঠার মতো মানসিক দৃঢ়তা ছিল না।তবে একটা কাজ আমি করেছিলাম,
মামিকে বলে গিয়েছিলাম তোমায় এমন কিছু বলতে যাতে আমার মতো তুমিও নিরবে সরে যাও।না হওয়া সম্পর্কের রেশ টেনে নিয়ে না চলো।
আমি জানতাম না মামি তোমায় কি বলেছিল।নতুন বাড়িতে ওঠার সময় মারুফ ভাই এসেছিল।তার কাছ থেকেই জানতে পারি,
মামি তোমায় বলেছিল,আমি নাকি তার কাছে তোমার নামে নালিশ করেছি।তুমি আমায় বিরক্ত করো খুব,আমি তোমায় নিজের ভাইয়ের চোখে দেখি অথচ তুমি নাকি আমায় অন্য চোখে দেখ।এমন ধরনের অনেক কিছুই বলেছিল হয়ত।তুমি নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলে!কষ্ট পেয়েছিলে কিনা সেটা না হয় নাই বা জানতে চাইলাম।অবশ্য ভালোই হয়েছে তুমি অনেকটা সরে গেছ আমার কাছ থেকে।এরপর কোথাও দেখা হলেই আমি তোমায় এড়িয়ে চলেছি তোমার প্রশ্নবাণে জর্জড়িত হবার ভয়ে।
মারুফ ভাই বলেছিল,আমি নাকি ছোট ছিলাম তাই তুমি আমায় মাফ করে দিয়েছ?কেন দিয়েছ মিশকাত ভাই?তুমি বোধহয় বিশ্বাস করতে পারোনি আমি মামিকে তোমার নামে নালিশ করেছিলাম, তাই তো?
আমার বাবাও আজ পর্যন্ত জানে না এই ব্যাপারটা।হয়ত জানবে একদিন। আমার সবচেয়ে বড় দোষের কথা একদিন পুরো পৃথিবী জানবে।সবচেয়ে বড় দোষই তো,এই কারনেই তো ভালোবাসা হারাতে হয়েছে।সেদিনের পর অনেকটা সময় লেগেছিল নিজেকে স্বাভাবিক করতে।দুটো মাস ঘরবন্দী হয়েছিলাম।কলেজ যেতাম না,বাইরে বের হতাম না,পড়াশোনা করতে পারতাম না।শুধু মনে হত আমি “মা” নামক পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর অনুভূতির সাথে কখনো পরিচিত হতে পারব না।নারীর সার্থকতা যে অনুভূতিতে তা থেকে আমি বঞ্চিত।
তুমি বলতো আমায় মিশকাত ভাই,আমার কি করা উচিত?ভালোবাসলেই কি ঘর বাঁধতে হয়?তুমি হয়ত বলবে এটা কোনো সমস্যা নয়, ভালোবাসায় বাঁধা হতে পারে না। তোমার ভাবনায় সমাজ,পরিস্থিতি কখনো থেমে থাকবে না।কখনো না কখনো তুমি নিজের সন্তানের আশা করবে!হয়ত আমায় বুঝতে দেবে না কখনোই তবু দুজনের মধ্যে যোজন বিয়োজন থাকবে।প্লিজ মিশকাত ভাই আমি আর তোমায় ভাষায় বোঝাতে পারছি না।আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে।সম্পর্কের জটিলতা কেউ পছন্দ করে না। তোমার জীবন তুমি সুন্দর ভাবে সাজিয়ে তোলো।কেন পেছন ফিরে চাও বারবার?অতিত কখনো ভবিষ্যৎ হয়?সবটা জানার পর আশা করি তুমি নতুন কোনো ঝামেলা করবে না।সবার আগে তোমার মায়ের কথাটা ভেব।নিজের সুখের চিন্তা করার আগে সবার সুখের কথাটা একবার ভেবে নিও।”
তনু খাতাটা বন্ধ করে বুকে চেঁপে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো। বুকের ভেরতটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই আয়রাকে বিদায় দিয়ে পুরো পরিবারে বিষাদের ছায়া ভর করেছে।শায়লা বেগম নিজের ঘরে কাঁদছেন। চাচী ফুফু সবার মনই খারাপ।সবাই শায়লা বেগমকে সবাই শান্তনা দিচ্ছে। তনু আয়রাকে বিদায় দিয়ে এসে খাতাটা নিয়ে বসেছে লিখতে।তনুর কান্নার শব্দে শান্তা এসে জড়িয়ে ধরলো।সবাই ভাবছে বোনের জন্য কাঁদছে তনু।শুধু তনুই জানলো, সে কেন কাঁদছে! কোথায় তার কষ্ট হচ্ছে!
“আচ্ছা, তনুর মনের এই হাহাকার কি মিশকাত অব্দি পৌঁছেছে?”
***
রাত অনেকটাই গভীর।সবাই ক্লান্ত হওয়ার দরুন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ঘুম শুধু নেই তনুর চোখে।জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর।বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে।শুয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। বাধ্য হয়ে উঠে ওয়াশরুমে ঢুকলো।সময় নিয়ে মাথায় পানি ঢাললো।শরীর দূবল হয়ে গেছে।ঘুম আসবে না তাই সে পা বাড়ালো ছাঁদের উদ্দেশ্যে।ঘরের গুমোট ভাবে মাথা ধরে যাচ্ছে। ছাঁদের খোলা পরিবেশে এসে দাঁড়াল তনু।মৃদুমন্দ বাতাস বইছে।
মিশকাত আজ শুতে যায়নি।মায়ের সাথে রাগারাগি হয়েছে বেশ।আজ মাকে নিয়ে না যাওয়ায় অনেকটা ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। মা তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে।উপায় না পেয়ে মিশকাত বাধ্য হয়েছে আগামিকাল চলে যাওয়ার জন্য।মনটা প্রচন্ড ভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে।দুচোখে ঘুমের লেশমাত্র নেই। বিয়ে বিদায়ের পর সে আর ঘরে যায়নি।সোজা ছাঁদে উঠে এসেছিল।সেই থেকেই ছাঁদেই সময়টা পার করে দিচ্ছে আর তনুর কথাই ভাবছে।হঠাৎ ছাঁদের একপাশে ছায়ামূর্তি দেখে একটু অবাক হলো।উঠে দাঁড়াল সে।ধীরে ধীরে এগোতেই অবাক হলো।ছায়ামূর্তিকে চিনতে পরেছে।তনু দাঁড়িয়ে আছে! রাত দুটোর সময় তনুকে মোটেও ছাঁদে আশা করেনি সে।
আচ্ছা, তারই মতো কি তনুর চোখেও ঘুম নামেনি আজ?
“কি করছিস এখানে?তোর দেখছি ভুতের ভয় নেই?”
তনু কেঁপে উঠে।মিশকাতকে দেখে অবাক হয়।একটু এগিয়ে আসতে চাইলে মাথাটা ঘুরে যায়।তনু টলছে দেখে মিশকাত এগিয়ে আসে ধরতে।তনু হাত নেড়ে মানা করে।মিশকাত থমকে দাঁড়ায়।তনুকে দেখে মনে হচ্ছে অসুস্থ।
কাঁপা গলায় তনু বলে উঠে,
তুমি চলে যাও মিশকাত ভাই,যত তাড়াতাড়ি পারো আমার থেকে দ্রুত চলে যাও!
রাতের গাঢ় আধার ভেদ করে তনুর বলা কথা গুলো মিশকাতের কানে এসে ডানা ঝাপটায়।অভিমানে টলমল করে ওঠে চোখের কোণ।মিশকাত ঘুরে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য।তার আগেই তনুর শরীরটা লুটিয়ে পরে যায় নিচে।
চলবে…