#তনয়া
#পর্ব -৭
সিফাতী সাদিকা সিতু
বিয়ে বাড়ি জমে উঠেছে।কিছুক্ষণ আগেই বরপক্ষ এসেছে।তনু, আপার পাশেই বসে আছে।আয়রা কিছুতেই তার হাত ছাড়ছে না।আয়রা যে বেশ নার্ভাস হয়ে পরছে তা বুঝতে পেরে তনু সাথেই আছে।লাল শাড়িতে সোনার গয়নায় পুরো রাজকন্যার মতো লাগছে আয়রাকে।তনুর ইচ্ছে করছে না আয়রার থেকে দৃষ্টি সরাতে।বারবার মনে মনে বলছে,ইশ,আমার আপা কি সুন্দর!
সে নিজেও সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরেছে। গোলাপি রঙয়ের লেহেঙ্গায় উজ্জ্বল শ্যামলা তনুকে মিষ্টি দেখাচ্ছে। তনুর মাঝে সবসময় অন্যরকম স্নিগ্ধতা বিরাজ করে।পার্লারের মেয়েদের থেকে চুল গুলো আজ সুন্দর করে খোঁপা করে নিয়েছে।খোঁপায় কাঠগোলাপের গাজরা গেঁথে দিয়েছে।অনেকদিন পর সে বেশকিছু ছবিও তুলেছে।মনটা হঠাৎ ভালো হয়ে গেছে।আসলে সকালে মনের কথা গুলো লিখে প্রকাশ করায় নিজেকে একটু হালকা মনে হচ্ছে। যেন ভারী পাথর চেপে ছিলো মনে।তা একটু সরে গেছে।পুরোটা সরাতে পারলে খুব ভালো হতো।তনুর হঠাৎ খাতাটার কথা মনে পরলো।শান্তার থেকে বাঁচার জন্য খাতাটা মায়ের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে।একমাত্র মায়ের ঘরটাতে কোনো ঝামেলা নেই।বাবা আর মা ছাড়া কেউ থাকেও না।এত মেহমানদের মধ্যে কেউই বেশি মায়ের ঘরে যায় না।তনু সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে।বিয়ে বিদায় শেষে তবেই খাতাটা মায়ের ঘর থেকে নিয়ে আসবে।
কাজি যখন বিয়ে পরালো আয়রা তখন তনুর হাত জোড়ে আঁকড়ে ধরেছে।আয়রার নখের আঁচড়ে তনুর হাতে জ্বালাপোড়া করছে।তবু তনু মুখে কিছু বলেনি।তাকে সবাই আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় এই ভাবনায় বিভোর ছিল।মিশকাত ভাই ও তনু আঁকড়ে ধরতে চাইছে!কিন্ত সে কি করে বলবে,
তার মতো মেয়েকে আঁকড়ে ধরতে নেই।তনুর পাশে যেই থাকবে তার দিকেই সমাজ বাঁকা চোখে তাকবে।তনুকে ভালোবাসতে হলে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইলো ভেঙ্গে চুরে ভালোবাসতে হবে।নিয়মনীতি বিহীন ভালোবাসার প্রয়োজন।যা পৃথিবীতে অসম্ভব। আমাদের এই নিষ্ঠুর সমাজে ভালোবাসাটাও নিয়মের মধ্যে পরে।নিয়ম মেনে,পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে ভালোবাসতে হয়।তাহলেই ভালো ভাবে,সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকা যায়!নিয়মের বাইরে গেলেই সমাজ ছুঁড়ে ফেলবে।একা হয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
বিয়ে পরানো হলে সে আয়রাকে বলে একটু বের হলো।কারণ ইতিমধ্যে আয়রাকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন ঘিরে বসে পরেছে।সে বোন হয়ে এভাবে আপাকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে ব্যাপারটা সবাই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।এসব বাস্তবতা বোঝার মতো মন এখনো আপার তৈরী হয়নি।তনুকে বুঝতে হয়েছে, শিখতে হয়েছে অনেক কম বয়সে।যখন তার ডালা মেলা উড়ে বেড়ানোর সময় ঠিক তখনই ডানা দুটো ভেঙে গেছে।
অনেক সময় ধরে বসে থাকার জন্য বাম পা টনটন করছে।একবার বাবার কাছে যাওয়া দরকার।মায়ের কাছে যাওয়ার মতো সাহস পাচ্ছে না।মায়ের কাছে ফুফু,খালারা আছে।
আচ্ছা, মিশকাত ভাই কোথায়?একবারও তো দেখতে পায় রাগচটা টা কে।হওয়া হয়ে গেছে নাকি।তনু ভাবলো,একবার আশেপাশে কোথাও খুঁজে দেখবে তারপর আবার ভাবলো,কি দরকার?মিশকাত ভাইকে নিয়ে এত মাথা ঘামানোর দরকার কি?কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলো,মিশকাত ভাইকে তো বলতে হবে তার সাথে একফাঁকে দেখা করার জন্য, কিছু দেয়ার আছে!অবশ্য পুরোটা তো লিখতে পারেনি।তবু মনটা মিশকাতের দিকেই ধাবিত হতে চাইছে।তনু মিশকাতকে খুঁজতে পা বাড়ালো।
****
“কিরে বাবা,কাকে যেন দেখাবি বলেছিস?”
আরাফ মায়ের কথায় হেসে বলল,
“দেখাবো তো মা,কিন্তু তাকে তো খুঁজেই পাচ্ছি না।”
“কেন নাম ধাম জানিস না, নাকি?শোন, ভালো পরিবারের মেয়ে না হলে কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হবো না।”
“খুব ভালো পরিবার মা।তুমি আমার পছন্দের ওপর ভরসা রাখতে পারো নিশ্চিন্তে।ওকে দেখার পর তুমি নিজেও খুব পছন্দ করবে।”
“তা বিয়ে বিদায়ের সময় হয়ে আসলো এখনো তো মেয়েটাকে দেখাতে পারলি না।”
“আচ্ছা, তুমি এখানেই থাকো। আমি দেখছি তনয়া কোথায়।”
আরাফ তনয়ার খোঁজে পা বাড়ালো।
মিশকাত একটা ফাঁকা জায়গায় চেয়ার নিয়ে বসে আছে।চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। একটু পরেই চলে যেতে হবে।তনুর সাথে আবার কোথায়, কখন দেখা হবে জানা নেই তার।ভাগ্য তাকে সবসময় তনুর থেকে দূরে রাখছে।কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তার সেটা কি তনু জানে?সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো তনু তার দিকেই আসছে ধীর পায়ে হেটে।মিশকাত বুঝতে পারলো না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবেই তনুকে দেখতে পাচ্ছে!
তনু যখন সামনে এসে দাঁড়ালো মিশকাতের ঘোর লেগে গেল।তার হৃদয়রাজ্যের যার সবসময় বসবাস সেই তনু যেন সত্যি রানী সেজে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
তনুকে মিশকাত কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,
“তুমি এখানে কেন মিশকাত ভাই?”
মিশকাত জবাব দিচ্ছে না। তনু সহ্য করতে পাচ্ছে না মিশকাতের মুগ্ধ দৃষ্টি।এই দৃষ্টি যে তার বুকে কাঁপন ধরায়,ভেঙে গুড়িয়ে দেয় তার ভেতরের তনুকে।নিজেকে সামলাতে কষ্ট হয় খুব!সমস্ত কিছু ভুলে মিশকাতের অনুভূতির আকুতিকে সাদরে জড়িয়ে নিতে।তনু আবার বলল,
“তোমার কি হয়েছে, কথা বলছো না কেন?আর চোখ গুলো এমন লাল হয়ে আছে কেন?”
মিশকাত নিজেকে সামলে নেয়।তবে তনুর থেকে নজর সরায় না।বলে,
“আমার চোখ লাল না সাদা সেটা নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।কি বলতে এসেছিস বলে বিদায় হ।”
তনু বুঝলো মিশকাত তার সাথে কখনোই ভালো ভাবে কথা বলবে না।শুধু শুধু আশা করাই বৃথা। সে দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল,
“তুমি কাল একবার আমার সাথে আলাদা কোথাও দেখা করতে পারবে?আসলে তোমায় কিছু দেয়ার আছে!”
মিশকাত চমকে উঠলো। তিন বছরের বেশি সময় হয়ে গেল ঠিক একই কথা সে একদিন তনুকে বলেছিল!তনু তার কথা শোনে নি।সেদিনের পর থেকে দুরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।কিন্তু কি জানে মিশকাতও এবার তনুর কথা রাখতে পারবে না।তাকে চলে যেতে হবে।আচ্ছা, কি এমন দেবে তনু যা আজ দেয়া যায় না?
সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাফ এসে তনুর হাতে ধরে ফেললো। তনু চমকে উঠলো আরাফের এমন কান্ডে। আরাফ খুশে মনে বলল
“এতক্ষণ তোমায় পেলাম।কোথায় ছিলে বলোতো?ভাবীর কাছেও নেই তুমি?”
তনু অপ্রস্তুত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। বলল,
“আমায় খুঁজছিলেন কেন?”
“উমম,একটা প্রয়োজন। চল আমার সাথে তাহলেই বুঝতে পারবে।”
“কোথায় যাব? ”
“সেটা তে গেলেই দেখতে পারবে।” আরাফ দেরী করলো না সেটা তনু প্রায় টেনে নিয়ে গেল।
তনু যদি একবার পেছন ফিরে তাকাতো তাহলে আঁতকে উঠতো মিশকাতকে দেখে।
আরাফকে কিছুতেই আর সহ্য করতে পারছে না।তার কাছ থেকে তারই তনুকে টেনে নিয়ে গেল? কতবড় সাহস ছেলেটার ভাবা যায়?মিশকাতের মাথা কাজ করছে না।শুধু ইচ্ছে হচ্ছে শক্ত কিছু দিয়ে আরাফের মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।এই ছেলেটা তনুকে নিয়ে এত টানাটানি করার অধিকার টা পেল কি করে?রাগে মিশকাত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো সে যাবে না,কোথাও যাবে না।তার পক্ষে তনুকে ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়।আরাফের কিছু একটা ব্যবস্থা না করে তো আরও নয়।এই মুহূর্তে তার বাবাকে খুব প্রয়োজন। মাকে সামলাতে বাবাই তাকে সাহায্য করতে পারবে!মিশকাত ছুটলো বাবার কাছে।
আরাফের মায়ের প্রশ্নের জবাবে হাপিয়ে উঠেছে তনু।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে আছে। আরাফ তাকে হুড়মুড় করে টেনে এনে এই মহিলার সামনে কেন এনে বসিয়েছে বুঝতে পারছে না।ওইদিকে আপার কাছে যাওয়া প্রয়োজন।বাবার কাছেও যেতে হবে। কনের বোনকে এত প্রশ্ন করার কি আছে সে সত্যি বুঝতে পারছে না।
আরাফ ও কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।সে নিজেও বুঝতে পারেনি তার মা প্রথম দেখাতেই তনু এতসব প্রশ্ন করতে শুরু করে দেবে।সে তো শুধু এক নজর দেখাতে এনেছে।মায়ের কারনে না আবার তনু সবটা বুঝে যায়।তনুকে সে নিজে প্রপোজ করার কিছুই বুঝতে দেবে না।সারপ্রাইজ দিয়ে তনুকে চমকে দেবে।তনু না করতে পারবে না!সে তো না করার মতো ছেলে নয়।দেখতে সুন্দর, ভালো চাকরি করে,সমাজে একটা ভালো অবস্থানে আছে।তনুকে সে একদম বিয়ের প্রপোজাল দেবে।প্রেম করার মতো ইচ্ছে বয়স কোনোটাই নেই।সোজা বিয়ে করে ঘরে তুলবে।শুধু তনুর মত পেলেই হলো।
“আন্টি আপনার কথা শেষ হলে আমি একটু আপার কাছে যাই।বোঝেনিই তো বিয়ের বাড়ি অনেক ঝামেলা।”
“আচ্ছা মা, যাও।আগামিকাল তো আমাদের আবার দেখা হচ্ছে তখন না হয় জমিয়ে গল্প করা যাবে।আরাফের মা হেসে বলল।
তনু মনে মনে বলল,
“আপনার এসব গল্প না পুলিশি জেরা সে নিয়ে সন্দেহ আছে।” মুখে বলল,
“ঠিক আছে আন্টি। ভালো থাকবেন।”
তনু আর দাঁড়ালো না।দ্রুত আয়রার কাছে আসলো।রাফাত আয়রাকে এক সাথে বসানো হয়েছে।আয়না দেখার পালা চলছে।তনুকে দেখে শান্তা বলল,
“কিরে কোথায় ছিলি? ”
“পরে বলব।এখন আপার যাই চল।”
“ধুর যাব কিভাবে?দেখিস না ওরা কেমন আপাকে ঘিরে ধরে আছে।আমাদের তো কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না।কবুল পরানোর সাথে সাথেই আপাকে ওরা নিজেদের ভেবে নিয়েছে।মেয়ে গুলা এমন ভাব করছে ওরা যেন কতো আপন আর আমরাই পর,হু!”
তনু হেসে ফেললো। বলল,
“আস্তে কথা বল, কেউ শুনে ফেললে খুব খারাপ হবে।”
“শুনলে ভালোই হবে।”
“আয় তো আমার সাথে।আপা নিশ্চয়ই আমাদের কাছে না পেয়ে খুব নার্ভাস হয়ে পরেছে।”
তনু একটু একটু করে এগিয়ে এসে আপার পাশে দাঁড়াল। আয়রা তনুকে দেখে একটু সাহস পেল।সবাই বারবার বলছে,
“ভাবী আয়নায় কি দেখতে পাচ্ছেন, বলেন তো?উত্তর কিন্তু রোমান্টিক হওয়া চাই!”
আয়রা লজ্জায় কাবু হয়ে পরেছে।এভাবে কি বলা যায়! মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।আয়রার অবস্থা দেখে রাফাত মুচকি মুচকি হাসছে।এই লজ্জবতীকে নারীকে সে অন্তকাল ধরে পাশে চায় সবসময়ের জন্য!
চলবে..