ডুমুরের ফুল
৭.
হেমলতা বিষন্ন হাসি হেসে বলল
– তোমার তো মা জীবিত আছেন আর আমার তো….
হেমলতার হঠাৎ তার মৃতা মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। মনে পড়ে যাওয়াতে সে আর কথা বলতে পারলো না। মনে হচ্ছে কে যেন তার গলায় অনেক ভার চাপিয়ে দিয়েছে।
জাদিদ বুঝতে পারছে যে মায়ের কথা হেমলতার খুব মনে পড়েছে। হেমলতাকে কখনো সে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেনি। জুবায়ের এর কাছ থেকে হেমলতার সম্পর্কিত সকল বিষয় জাদিদ জেনে নিয়েছিলো। জাদিদ এমন একজন ফ্রেন্ড চেয়েছিলো – যে ওর কষ্ট গুলো খুব সহজে বুঝতে পারবে। মুখ ফুটে তাকে কিছুই বলতে হবে না। যেমন আজকে জাদিদ শুধু ওর মা বাবার ডিভোর্স এর কথা বলেছে তাতেই হেমলতা বুঝতে পেরেছে জাদিদের ভিতরের কষ্টটা।
ওর মতোই মা – বাবা ছাড়া একজনকে ফ্রেন্ড হিসাবে চেয়েছে এবং পেয়েছোও। কারণ জাদিদ নিজেও মা – বাবা ছাড়া। মা – বাবা থাকতেও নেই।
হেমলতারও তাই। মা তো মারাই গেছেন আর বাবা তো ছোট মার জন্য পারেন না।
একজন মা ছাড়া সন্তানই বুঝতে পারে মা না থাকার কষ্টটা। আর কেউই পারে না।
জাদিদ পরিস্থিতি হালকা করার জন্য বলল
– আচ্ছা তুমি চুল বেণী ছাড়া কিছুই কি করতে পারো না?
– নাহ। নানী বেণী ছাড়া কোনো স্টাইলের চুল বাঁধতে পারেন না। আর মা তো নেই।
মা মারার যাবার পর থেকে নানী তার জগত। মা মরা মেয়েটাকে মিসেস জয়নব আগলে রেখেছেন। মেয়ে যদি বখে না যায় তাই সহজে কারো সাথে মিশতে দেন না। এমনকি কোনো প্রকার ফ্যাশন করতে দেন না। আর হেমলতাও সব কিছু মেনে নিয়েছে। হয়তোবা নানী কষ্ট পাবে সেই কারণে।
জাদিদ বলল
– আরে ইউটিউব এ তো কতো প্রকার চুল বাধার ভিডিও পাওয়া যায়। তোমার একমাত্র ফ্রেন্ড মিম্মার কাছ থেকে তো শিখতে পারো।
– আসলে জাদিদ আমার না ভালো লাগেনা।
– চুল খোলা তো রাখতে পারো?
– লম্বা চুল তো নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হয়ে যায়।
জাদিদের মা মাইমুনা ইফতি। ছেলেকে সে অনেক ভালবাসেন।
কিন্তু স্বামীর সাথে বনিবনা না হওয়াতে তার ডিভোর্স টা নিতে হলো। আজকে তার একমাত্র ছেলে তার হাতের রান্না খেতে চেয়েছে তাই সে অনেক কষ্টে রান্না করেছে। গ্রীসে তো সে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে খায়। একা মানুষের জন্য রান্না করাটা তার কাছে সময় নষ্ট বলে গণ্য।
ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করে গোসল করে কেবল একটু শুয়েছিলো আর জাদিদ হাজির।
প্রায় ৫ বছর পর ছেলেকে দেখে সে আনন্দিত যেমন হয়েছেন ঠিক তেমনি কষ্টও পেয়েছেন।
ছেলেটাকে নিজের কাছে রাখতে পারলে ভালো হতো।
দুটো রুম, একটা বাথরুম, একটা বেলকুনি আর একটা কিচেন সহ এই ফ্ল্যাট টা সে ৩ দিনের জন্য বুকিং করেছেন। ছেলেটার সাথে অনেক সময় কাটাবে সে।
টেবিলে খাবার গোছাতে গোছাতে জাদিদের মা এগুলো ভাবছিলেন।
গোছানো শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ছেলেকে ডাকলেন
– জাদিদ বাবা আয়। তোর ফ্রেন্ড কেও আসতে বল।
– আসছি মা।
জাদিদ আর হেমলতা টেবিলের পাশে এসে চেয়ার টেনে বসলো।
জাদিদ টেবিলের খাবার দেখে মার দিকে তাকিয়ে বলল
– তোমার মনে আছে? আমার পছন্দের খাবারের কথা?
মাইমুনা ইফতি ছেলের পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল
– মা কখনো ভুলতে পারে?
জাদিদ আবদার করে বসলো
– মা তুমি খাইয়ে দাও।
– আচ্ছা, দিচ্ছি।
মাইমুনা ইফতি হেমলতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল
– মা তুই হাত দিয়ে নিয়ে খা। যা যা লাগবে নিজের হাতে বেড়ে খা।
– জি।
হেমলতা একটা কাচের প্লেট নিলো।
টেবিলের খাবার দেখে নিলো এক পলকে। পোলাও চালের ভাত রান্না করেছে। ঘ্রাণ নাকে আসছে তাতেই সে বুঝতে পারছে। ঝোল তরকারীর অভাব। ইলিশ মাছ ভাজা, চিংড়িমাছ ভাজা, রুই মাছ ভাজা, পুটি মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা। জাদিদ মাছ ভাজা পছন্দ করে। আর মুরগির মাংস পাতলা ঝোল করেছে। আরেকটা যে কী রান্না করেছে সেটা হেমলতা বুঝতে পারেনি।
পোলাও চালের ভাত হেমলতা কোনোদিন খায়নি । তার খেতে কেমন যেন লাগছে।
হেমলতার অবস্থা দেখে মাইমুনা ইফতি নিজেই খাবার বেড়ে দিলেন। সব মাছ ভাজা প্লেটে তুলে দিলেন।
হেমলতার থুঁতনি ধরে বলল
– আমি খাইয়ে দেই?
হেমলতা মাথা নিচু করলো। সেই ৫ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছে। মায়ের হাতে খাবার খেতে কেমন লাগে সেটা তার মনে নেই। মাঝেমাঝে মার কথা খুব মনে পড়ে। তখন মায়ের কাপড় জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকে। মায়ের জামা কাপড় নানী না ধুয়ে রেখে দিয়েছেন তার জন্য। যাতে মায়ের জামা কাপড় থেকে গায়ের গন্ধটা তাকে মায়ের অভাব পূরণ করে।
মায়ের স্পর্শও তার মনে নেই।
চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।
সবার সামনে এভাবে কেঁদে ফেলাতে হেমলতা একটু লজ্জা পেল।
মাইমুনা ইফতি দুজনকে খাইয়ে দিলেন।
তারপর তিনি খেতে বসলেন।
খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর জাদিদ তার ব্যাগ মায়ের হাতে দিয়ে বলল
– আমার পুরাতন কাপড় চোপড় সব এখানে আছেন।
ব্যাগ হাতে নিয়ে মাইমুনা ইফতি বললেন
– আধোয়া তো?
– হুম।
আমি তোর জন্য অনেক সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় এনেছি।
তারপর একটা কালো রঙের লাগেজ পাশের রুম থেকে নিয়ে আসলেন।
হেমলতা সোফায় চুপচাপ বসে ছিলো।
হেমলতাকে বললেন
– তোর জন্য আমি কিছু এনেছি। তবে বাসায় গিয়ে দেখবি। ওকে?
হেমলতা শুষ্ক হাসি ঠোঁটের এক কোণায় এনে বলল
– জি।
তারপর মা ছেলে গল্প জুড়ে দিলেন। ছবি তুলল সবাই।
কয়েকটা ছবি খুব ভালো হয়েছে।
হেমলতার বেণী খুলে খুব সুন্দর করে বেধে দিলেন।
স্বন্ধ্যা হবে হবে এমন সময় জাদিদ ব্যস্ত হয়ে উঠলো বাসায় যাওয়ার জন্য। হেমলতারো আর থাকা সম্ভব না।
মাইমুনা ইফতি তাদের রিক্সায় উঠিয়ে দিলেন। আগামীকাল আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা আসলো।
এই প্রথম ওরা রিক্সায় এক সাথে উঠলো। হেমলতার অস্বস্তি লাগছিলো।
চুল কীভাবে যেন বেধে দিছে ও বুঝতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে খুলে যাবে যেকোনো সময়।
হেমলতা কাপড় চোপড় ওড়ণা ঠিক করতে গিয়েই চুল খুলে গেলো। এতো লম্বা চুল সে কীভাবে কী করবে বুঝতে পারছিলো। এর উপর আবার জোড়ে বাতাস শুরু হলো।
চুল এলোমেলো ভাবে উড়তে শুরু করলো। কপালে ছোট ছোট চুল গুলো উড়ছিলো। তাতে ওর সুড়সুড়ি লাগছিলো।
মনের অজান্তেই হেমলতা হাসতে শুরু করলো। অট্টহাসিতে সে মগ্ন।
জাদিদ এতক্ষণ ধরে রাস্তার লোকজন, গাড়ি দেখছিলো।
অট্টহাসির আওয়াজে সে হেমলতার দিকে তাকালো।
হেমলতার মুখের উপরে, কপালে চুল গুলো এলোমেলো ভাবে খেলে যাচ্ছে।
বাতাসের গতি বৃদ্ধিতে চুলগুলো উড়ে জাদিদের মুখের উপর এসে খুব মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
তার সাথের এই মেয়েটি যে এতো সুন্দর করে হাসতে পারে তার জানা ছিলো না।
হাসির শব্দে, চুলের মিষ্টি গন্ধে চিরচেনা হেমলতাকে তার অচেনা লাগছে।
গোধূলি লগ্নের রক্তিম আভায় এই হেমলতাকে খুব রহস্যময়ী লাগছে।
চলবে….!