ডুমুরের ফুল ৫.

0
3470

ডুমুরের ফুল
৫.
হেমলতা ক্যালকুলেটর আবার ব্যাগে রেখে দিলো।
বিকালবেলা কী করবে ভাবছিলো হেমলতা। মিম্মাকে জানানো দরকার। তবে মেসেজ বা সামনাসামনি জানাতে হবে। ফোনে বলতে গেলে নানী জেনে যাবেন।
ফেসবুকে মেসেজ করে দিয়ে চা বানানোর জন্য রান্নাঘরে গেলো।
চা নিজ হাতে বানিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ছাদে গেলো।
খোলা চুলে হালকা বাতাসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বেশ ভালোই লাগছে।
রাতে পড়তে বসলো। ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। অচেনা নাম্বার। রিসিভ করে হ্যালো বলতেই হেমলতা অবাক। আরে এতো জাদিদের কণ্ঠ মনে হচ্ছে।
– আচ্ছা। তোমার নামটা এতো সেকেলে টাইপের ক্যান?
– আপনার কোনো সমস্যা?
– অবশ্যই। এতো বড় নাম। ছোট কোনো নাম নাই?
– না।
– তুমি তো হিন্দু। তাই না?
– না।
– হেমলতা চৌধুরী। হিন্দু নামই তো।
– নাম হলেই কি সে হিন্দু হবে?
– না। সেটা না।
– আমার নাম্বার কোথায় পাইলেন?
– মিম্মার কাছ থেকে। রাগ কইরো না। আমি লাইন মারার জন্য তোমার পিছুপিছু ঘুরছি না। তুমি মেয়েটা অনেক ভালো। এমন একজন মেয়েকে আমি ফ্রেন্ড হিসেবে চাই।
-সত্যি তো?
– হ্যা ১০০% সত্যি।
– কিন্তু আমি কেন? মেয়ের কি অভাব?অনেক ভালো ভালো স্টুডেন্ট আছে। আমার মতো মেয়েকে কেন ফ্রেন্ড হিসাবে লাগবে?
– আসলেই মেয়েরা না সোজাসুজি কোনো কিছু বুঝতে চায় না। খালি সাত পাঁচ ভাবে।
– বিশ্বাস করো আমি ফ্রেন্ড ছাড়া কোনো কিছুই চাই না।
– করলাম। এখন ফোন রাখেন।
– আমরা সেম এজের।তাই তুমি করে বলাই বেটার।
– রাখি।
হেমলতা ফোন কেটে দিয়ে ভাবলো তার নিজেরো কোনো ছেলে ফ্রেন্ড নাই। পড়াশোনার ব্যাপারে তো ও অনেক সাহায্য করতে পারবে।
বাংলা বই নিয়ে বসলো। আগামীকাল বাংলা পরীক্ষা। খালি পরীক্ষা আর পরীক্ষা।
জাদিদ ফোন রেখে দিয়ে ভাবতে লাগলো জুবায়েরকে ধন্যবাদ দেয়া দরকার। জুবায়ের কে ফোন করলো। রিসিভ করলো
– হ্যালো
– হ্যালো। কি কথা হয়েছে?
– হুম। একসেপ্ট করছে!
– লাভ রিকুয়েস্ট?
– নাহ নাহ পাগল নাকি? ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট।
– তুই না আজব পাব্লিক। মানুষ এই বয়সে করে লাভ রিকুয়েস্ট আর তুই করলি ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট।
– আমার জিএফ এর দরকার নাই। একজন ভালো মেয়ে ফ্রেন্ড এর দরকার।
– তা বুঝলাম। তুই আর মেয়ে পাইলি না? ভালো স্টুডেন্ট ছিলো তো। তাহলে পড়াশোনায় সাহায্য পাইতি।
তোর সম পর্যায়ের কাউকে….
-তুই বুঝবি না।
– এইসব মেয়ে ঘাড়ে চাইপা বসবে তখন বুঝবি।
– ও ঘাড়ে চাপার মেয়ে না। উল্টা আমি ওর ঘাড়ে চাপবো।
কথাটা বলেই হাসতে শুরু করলো। হাসতে হাসতে বলল
– একটা চরিত্রবান, ভালো স্বভাবের মেয়ে হাজারটা ব্রিলিয়ান্ট মেয়ের থেকে ভালো।
– কিন্তু…!
– আচ্ছা রাখি।
– ওকে।
ফোন রেখে দিয়ে জাদিদ ভাবতে লাগলো পড়তে হবে। পড়তে হবে।
দরজা কে যেন নক করছে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা খুলে দেখে তার দাদী হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
খাবারের প্লেট হাতে করে দাদী এসেছে। এর মানে বাবার বিয়ে মনে হয় ঠিক করে ফেলেছে। আমাকে পটানোর জন্য দাদী আমার পছন্দের খাবার এনেছে। এগুলো ভাবতে ভাবতে জাদিদ হেসে ফেলল তারপর বলল
– ভিতরে আসো দাদী।
বৃদ্ধা রুমে ঢুকে বিছানায় বসলেন। তারপর প্লেট রাখলেন।
প্লেটের উপরকার ঢাকনা সরিয়ে বলল
– দাদাভাই আয়। তোর পছন্দের সব পিঠা বানিয়েছি।
জাদিদ চুপচাপ বিছানায় বসে পিঠা খেতে শুরু করলো।
বৃদ্ধা বলতে শুরু করলেন
– তোর বাপের জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। মানে সব ঠিকঠাক। তোর বাপ আসলেই হুজুর ডেকে নিকা করায় দিবো।
জাদিদ মাথা নেড়ে বলল
– হুম।
জাদিদ ভালোভাবেই জানে তার বাবা আর বিয়ে করবে না। বাবা এমন ভাবে বিয়ে ভাঙবে যে দাদী বুঝতেও পারবেনা।
প্লেট খালি হয়ে গেলো। প্লেট খালি দেখে বৃদ্ধা বললেন
– আরো পিঠা লাগবে?
– হুম
– বয়। আমি নিয়ে আসি।
জাদিদ আজকে বেশ আনন্দিত। পিঠা তার পছন্দের। বিশেষ করে পাটিসাপটা, আন্দোসা আর বড়া পিঠা। আজকে সবই দাদী করেছে।
প্রতিবছর বাবার বিয়ে উপলক্ষে অনেক খাওয়া দাওয়া তার হয়। এর মধ্যে পিঠা তার পছন্দ।
বাবা না আসা পর্যন্ত এভাবেই প্রতিদিন ভালো ভালো খাবার খাওয়া হবে জাদিদের।
এমনি দিনেও খাওয়া হয় কিন্তু সেগুলো বুয়ার হাতের তৈরি। স্বাদ না ছাই। দাদীর হাতের রান্নাকরা খাবার খুব স্বাদের।
হেমলতা পড়তে পড়তে আবারো টেবিলে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নানী অবশ্য দেখেছে যে সে ঘুমুচ্ছে টেবিলে কিন্তু ডাকেনি। কারণ একবার ঘুম ভাঙলে সারারাত আর ঘুমাতে পারবে না।
জাদিদের পড়ার নির্দিষ্ট কোনো টাইম টেবিল নাই। মন চাইলে সারারাত পড়লো আবার মন চাইলে সারারাত নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবে। ঘুমের ঘোরে ওর নাক আটকে যায়। বহুত ডাক্তার, কবিরাজ দেখানো হয়েছে কোনো লাভ হয়নি। বরংচ তিতা, বিচ্ছিরী স্বাদের ঔষধ খেয়ে পেটের বারোটা বাজাইছে।
ওর বাবা মোল্লা সাহেব একদিন ছেলের এতো কষ্ট দেখে কী মনে করে যেন নাকে সরিষার তেল দিয়ে দিলেন। সারারাত মোল্লা সাহেব ছেলের পাশে না ঘুমিয়ে জেগে ছিলেন। যদি সরিষার তেলের নেগেটিভ ইফেক্ট হয়ে জাদিদের কিছু হয়ে যায়!
কিন্তু কিছুই হয়নি। সারারাত শান্তিতে ঘুমিয়েছে। তখন থেকে জাদিদ নাকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়ে ঘুমায়।
রাত দুটোর সময় জাদিদের পড়তে পড়তে বোরিং লাগছিলো। হেমলতাকে ফোন দিলে কেমন হয়?
যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন বাজছেই তো বাজছে।
হেমলতা ফোনের রিংটোন এ ঘুম ভাঙলো। ফোন রিসিভ করলো
– এতো রাতে কেউ ফোন দেয়?
– আমি দিলাম তো।
– কেন ফোন দিছো?
– এমনি ভাল লাগছিলো না তাই ।
– এখন পুরো রাত আর ঘুম আসবে না।
– কেন?
– আমার ঘুম ভাংলে আর ঘুম আসে না।
– তাহলে তো ভালো।
– এখন পড়তে বসো।
– নাহ।
– সেদিন দেখলাম একটা মাত্র গণিত পারছো। তাও ভাগ করতে পারছিলা না।
– আরে স্যার যেসব প্রশ্ন, গাণিতিক সমস্যা দেয় সেগুলা খুইজা পাইতেই তো ১ দিন চলে যায়। তার উপর আবার ১ টা তো সাবজেক্ট না। বাংলা আছে, ইংলিশ আছে, রসায়ন আছে, উদ্ভিদবিজ্ঞান….
– ফাঁকিবাজি কথাবার্তা!
– শুনো আমি তোমার মতো ভালো স্টুডেন্ট না। আমি কমার্স নিতে চাইছিলাম।
– নিলা না ক্যান?
– আরে জেএসসি এক্সাম দিয়ে বেড়াতে গেছিলাম। বেড়ানো থেকে আসতে দেরি হয়ে গেলো। এইদিকে বাবা আমার অনুপস্থিতিতে ভর্তি কমপ্লিট করে রেখেছিলেন। তিনিই আমাকে সাইন্স নিতে বাধ্য করলেন।
– ইন্টারে তো চেঞ্জ করতে পারতে?
– বাবা বুঝছো।
জাদিদ হাসতে শুরু করলো।
– হাসো হাসো। ফেল করলে তখন আরো হাসবা।
– ফেল করবা ক্যান?
– কিছুই তো কমপ্লিট করতে পারছিনা। ফিজিক্সের প্রশ্ন সমাধান করতে যেয়ে তো অন্যান্য সাবজেক্ট গোল্লায় যাইতেছে। আসলে এতো চাপ আমি সহ্য করতে পারছিনা।
– একটা উপায় আছে। বলবো?
– ফিজিক্সের এমনকি যেকোনো সাবজেক্ট এর প্রশ্ন আমি সলভ করে ছবি তুলে ফেসবুকের ইনবক্সে দিয়ে দিবো। তারপর তুমি পড়বা। তাহলে তোমার অনেক সময় বেঁচে যাচ্ছে।
– তোমার নিজের পড়া বাদ দিয়ে?
– আরে এতে তো আমারি বেশি উপকার।
— তুমি কী চাও বলোতো?
– আচ্ছা একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে কি শুধুই প্রেম হয়? বন্ধুত্ব কি হতে পারেনা?
– হতে পারে।
– এখন তো আর ঘুমাবা না?
– না।
– আমি কিছু গণিতের সমাধান দিচ্ছি। প্রাকটিস করো।
– হুম।
– নেট কানেকশন অন করো। আমি ছবি তুলে পাঠাচ্ছি।
– আচ্ছা।
নেট কানেকশন অন করে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো।
জাদিদকে ফোন দিলো হেমলতা। রিসিভ করলো
– হ্যালো
– আচ্ছা ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট তো একসেপ্ট করো।
– দাড়াও।
ফোন কেটে দিয়ে। ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট করলো। তারপর মেসেঞ্জার এ টুংটাং শব্দ করে জাদিদের আইডি থেকে মেসেজ আসলো।
– ছবি গুলো সেভ করো।
– ওকে।
– তাহলে আমি যাই। পড়তে বসবো।
– হুম। টাটা।
হেমলতা নতুন খাতা বের করলো। খাতার উপরে সাবজেক্ট এর নাম লিখে। ছবি গুলো থেকে অংক গুলো প্রাকটিস করতে শুরু করলো।
হঠাৎ করে হেমলতা বেশ মনোযোগী হয়ে উঠলো।
ফজরের সময় মিসেস জয়নব নাত্মীর রুমে এসে অবাক। একি নাত্মী না ঘুমিয়ে পড়ছে। রাতে ঘুম না আসলে ও তো টেলিভিশন দ্যাখে। কিন্তু আজকে কী হলো?
মনে প্রশ্ন চেপে রাখতে না পেরে নাত্মীকে প্রশ্ন করেই বসলো
– কিরে পড়ছিস?
নানী যে অবাক হয়েছে সেটা হেমলতা বুঝতে পেরেছে। তাই সে খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
– পরীক্ষা সামনে। ভালো রেজাল্ট করা দরকার।
– খুবই ভালো।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
– চল নামাজ পড়ে নেই। তারপর হেঁটে আসি।
– চলো।
হেমলতা বই খাতা গুছিয়ে রেখে, ফোন চার্জ দিয়ে নামাজ পড়তে গেলো।
পড়াশোনা নিয়ে হেমলতা বেশ ব্যস্ত হয়ে পরলো।মিসেস জয়নব বিবি আর মনোজ হেমলতার পড়াশোনা দেখে খুব অবাকও হলেন। খুশিও হলেন।
হেমলতার উন্নতির কথা জাদিদ জুবায়ের কে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে। জুবায়ের কিছু বলেনা। হুম, হ্যা বলে কাটিয়ে দেয়।
ওর ধারনা যে ভুল সেটা প্রমাণিত হওয়াতে একটু লজ্জায় পড়েছে।
পরীক্ষা শুরু হতে ১ সপ্তাহ বাকি।
প্রত্যেক স্যার তাদের কোর্স কমপ্লিট করে দিয়েছেন। তাই বাইরে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসেনা। আজকাল নানীর সাথে সকালে হাঁটতে যাওয়া হয়না।
এতো পরিমাণ ফাকি দিয়েছে যে এখন সারা দিন রাত পড়েও শেষ করতে পারছে না হেমলতা।
জাদিদ এই কথা শুনে হাসতে হাসতে বলেছে
– এই ভাবে পড়তে পড়তে ইনশাআল্লাহ রেজাল্ট ভালো হবে।
– হু। পাবনায় একটা সিট বুকিং দিয়ে রেখো।
এই কথা শুনে জাদিদ হাসতে হাসতে অস্থির। তুমি পাগলের মতো কথা বলো না ক্যান?
– পাগল হয়েই তো গেছি।
সকালে পড়ছিলো জাদিদ এর ফোন আসলো। রিসিভ করে হেমলতা বলল
– কী সমাচার?
– একটু বের হতে পারবা?
– কখন?
– দুপুরবেলা।
– কয়টায়?
– ৩ টায়।
– আচ্ছা। কিন্তু কোথায় আসতে হবে?
– র‍্যাফেলস এ
– আচ্ছা।

চলবে…..!

#Maria_kabir