ডুমুরের ফুল  ৪৪.

1
2688
ডুমুরের ফুল  ৪৪.
শেষ পর্ব
মিম্মার সাথে হেম আর কথা বলার সাহস পায়নি। জীবনটা যেন কেমন হয়ে গেলো আবার। একটা ভুল তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। মিম্মার প্রেগন্যান্ট হবার কথা শোনার পর থেকে সবসময়ই হেম অন্যমনস্ক হয়ে থাকে৷ ক্লাসের টাইম আর টিউশনির সময়টা বাদে কোনো কিছুই তার ভালো লাগেনা। জাদিদের ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছা করেনা। মাঝেমধ্যে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে রিসিভ করে। জাদিদ অনর্গল কথা বলতেই থাকে হেম হু হ্যাঁ বলেই কাটিয়ে দেয়। জাদিদকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয় তার
– আচ্ছা জাদিদ আমি যদি প্রেগন্যান্ট হয়ে যাই আমাকে বিয়ে করবে তো? নাকি…
আর ভাবতে পারেনা। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মানুষটা তো তার জীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছিল আবার ফিরে আসার কি খুব দরকার ছিলো?
জাদিদ আগের মতোই তার সাথে কথা বলে। কোনো পরিবর্তন পায়নি সে। ফোন রাখার আগে নিয়ম করে বলবে
– হেম
– হু
– অনেক ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে অনেক মিস করি আমি।
– হু
মিসেস জয়নাবের শরীরের আর উন্নতি হয়নি। মিসেস জয়নাব সারাদিনই বিছানায় শুয়ে বসে কাটান৷ জানালার দিকে তাকিয়ে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকাল, বিকাল থেকে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা থেকে রাত হওয়া দেখেন। আর ভাবেন সময় গড়িয়ে আসছে চলে যাবার। হেমলতার সাথে কথা হয়। তবে আগের মতো না। হেমলতার জীবনটা যে এমন হবে ভাবতেই পারেননি সে। বেশ খোঁজ খবর নিয়েই একমাত্র সম্বলকে তাদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন জয়নাব। কিন্তু পরে বের হলো অন্যকিছু।
সেদিন হুট করে বিয়ে দিয়ে দিবে সিদ্ধান্তটা না নিলেও হতো। প্রেম করছিলো সেটাকে অন্য কোনোভাবে আটকানো যেতো। তাই বলে বিয়ে দেয়াটা সমাধান ছিলোনা। তার একটা ভুলে মেয়েটার কপালে ডিভোর্সি, চরিত্রহীনা তকমা লেগে গেলো। হেমলতা যথাসাধ্য চেষ্টা করছে তাকে সুস্থ করে তোলার কিন্তু কোনো কাজে দিবেনা। স্বপ্নে কয়েকদিন ধরে দোলাকে দেখছেন সে।
সে পুকুরের পাশে চুপচাপ বসে থাকেন। কিছু সময় পর দোলা আসে হেলে দুলে হাঁটতে হাঁটতে। গল্প শুরু করার কিছু সময় পরে দোলা থমথমে গলায় বলে
– মা, আমার ওখানে একা থাকতে ভয় লাগে। তুমি আমার সাথে থাকবে?
মেয়ের দুখী দুখী চেহারা দেখে মিসেস জয়নাব মমতা মাখা কণ্ঠে বলেন
– হ্যাঁ, আমি এখন থেকে তোর সাথে থাকবো।
তারপর মা মেয়ে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে শুরু করার কিছু সময় পর জয়নাবের ঘুম ভেঙে যায়।
মিসেস জয়নাব তার মায়ের কাছে শুনেছিলেন, মরা মানুষ নিতে আসার অর্থ তার মরার সময় চলে এসেছে।
মরার পর দোলার কাছে তিনি কী জবাব দিবেন? যদি দোলা গাল ফুলিয়ে বলে
– মা তুমি আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট করে দিয়েছো কেনো?
তখন সে কী উত্তর দিবে?
সাজেক থেকে ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পর হেমলতার ভয়টা কেটে গেলো। পিরিয়ড এসেছে এর অর্থ সে প্রেগন্যান্ট না। প্রতি রাতে তাহাজ্জুদ নামাজে বসে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে সে তার মহাপাপের জন্য ক্ষমা চায়। জীবনেও আর এই ধরনের পাপ করবেনা সে।
বুধবার সকালে হেমলতা তার রুটিন অনুযায়ী দুই কাপ চা বানালো। এক কাপ নানীর জন্য আরেক কাপ তার জন্য।
বেশ হালকা লাগছে তাকে আজ। নানীর হাতে চায়ের কাপ দিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। মিসেস জয়নাব মমতা মাখা কণ্ঠে বললেন
– আমাকে মাফ করে দিস।
হেমলতা বেশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
– কেনো? তুমি আবার কবে কী করলে?
– আমার জন্য তোর জীবনের এই অবস্থা।
– আমার কপালে লেখা ছিলো। ওসব বাদ দাও তো নানী।
জয়নাব চা পুরোটা না খেয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিলেন।
উত্তরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকে হেমকে বললেন
– একটু আমার কাছে আয়। তোকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছে।
হেমলতা নানীকে জড়িয়ে ধরলো। মিসেস জয়নাব বিরবির করে কিছু বললেন। তারপর বেশ শব্দ করে কালেমা পড়লেন। হেমলতার মনে হলো মিসেস জয়নাব কিছুটা কেঁপে উঠলেন তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার শব্দ পেলো। হেমলতার মনে হলো ন্যানো সেকেন্ড আগেও হার্টবিট তার কানে আসছিলো আর এখন….
আছরের নামাজের পরে মিসেস জয়নাবের জানাযা নামাজ পড়ানো হলো। দাফন কাফন করে আত্মীয় স্বজন যারা এসেছিলো সবাই এক এক করে চলে যেতে লাগলেন। হেমলতার চোখে এক ফোটাও পানি নেই। শুকনো কটকটে অবস্থা। তার সামনে সবাই কান্নাকাটি করছে সে চুপচাপ দেখছে। নানীকে বিছানা থেকে নামিয়ে গোসল করানো হলো। কাফনের কাপড় পড়ানো হলো। চোখে সুরমা পরানো হলো। শেষ বার দেখানোর জন্য হেমকে টেনে আনা হলো। হেম একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো।
লাঈলী বানুও চলে গেছেন গ্রামের বাড়িতে। যাওয়ার সময় বলে গেলেন, আর ফিরবেন না। পুরো বাড়িতে হেম একা।
পুরো রাত ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কাটিয়ে দিলো হেম। বুদ্ধি হবার পর থেকে নানীকেই সে কাছে পেয়েছে। মা ছাড়া জীবনটা নানীর ছায়ায় অনেক ভালোই কাটিয়েছে। মাঝে কী যেন একটা হলো আর সবকিছু উল্টে গেলো। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়লো। ঘুম ভাঙলো জাদিদের ফোনে।
রিসিভ করে সালাম দিয়ে বলল
– কিছু বলবা জাদিদ?
জাদিদ বলল
– তোমার নানী মারা গেছেন মিম্মার কাছ থেকে শুনলাম।
– হ্যাঁ।
– বাসায় পুরো একা তুমি?
– হ্যাঁ। জাদিদ?
– বলো।
– আমাকে বিয়ে করবে জাদিদ? আমার একা এই বাসায় থাকার সাহস নাই। আমি পারছিনা জাদিদ… আমার যাওয়ার মতো জায়গাও নেই। বাবা আমার সাথে কথা বলেনা । একা থাকারও সাহস নেই আমার। বিয়ে ছাড়া তোমার সাথে থাকতেও পারবোনা। জাদিদ আমি কী করবো?
– হেম আমার কাছে তোমার আসতে কোনো বাঁধা নেই। চলে আসো। সকাল ৮ টার বাসে ঢাকায় চলে আসো। আমি বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবো।
– ঠিকাছে।
জাদিদ ফোন রেখে দিয়ে বুয়াকে পোলাও, মুরগির রোস্ট, গরুর গোস্ত, বুটের ডাল রান্না করতে বলল।
শাম্মীকে ফোন দিলো। শাম্মী বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করে বলল
– এখন ফোন দেয়ার খুব দরকার ছিলো?
– হ্যাঁ।
– তাহলে ৫ মিনিটে কথা শেষ করবা।
– শুনো তুমি আর রেহান মিলে একটা টকটকে লাল শাড়ী কিনবা সাথে কসমেটিকস। মানে বিয়েতে একটা মেয়ের জন্য নূন্যতম যে জিনিসপত্র লাগে সেরকম। আর আমার জন্য সাদা একটা পাঞ্জাবী আনবা।
– বিয়ে করবা নাকি?
– হ্যাঁ।
– আচ্ছা এখন তো নিউমার্কেট খোলে নি। খুললে আমি আর রেহান সবকিছু কিনে তোমার বাসায় আসবো। দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা হবে টবে নাকি?
– আলবৎ হবে।
– ঠিকাছে রাখলাম আর টাকা রেহানের বিকাশ একাউন্টে পাঠায় দিও।
– ওকে, বাই।
– বাই।
রেহানকে ফোন দিয়ে সব জানালো। রেহান কড়া মেজাজে বলল
– ব্যাটা আগে থেকে বলবি না? আমার টিউশনি আছে।
– আরে সকালেই প্ল্যান হলো। একদিন টিউশনে না গেলে কিছুই হবেনা।
– জীবনে টিউশন তো করিস নাই বুঝবি কী। যাইহোক এখন আপাতত রাখি।
শাহীনকেও জানালো, সে আকাশ থেকে পড়েছে। শেষ মেষ ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করবি? – প্রশ্নটা করেই বসলো৷ জাদিদ পানসে মুখে বলল
– হ, তোর সমস্যা?
– আমার তো বউ না।
জাদিদ বাবাকে ফোন দিলো। জাদিদের বাবা ফোন রিসিভ করে বললেন
– বাবা একটু ব্যস্ত আছি। পরে কথা বলি?
জাদিদ বলল
– আমি বেশি সময় লস করবোনা তোমার।
– তাহলে বলো।
– আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি।
– পাত্রী কে?
– হেমলতা।
– ওহ সেই হাবাগোবা মেয়েটা?
– হ্যাঁ।
– ওর তো বিয়ে হয়ে গেছিলো না?
– হ্যাঁ, ডিভোর্সও হয়ে গেছে।
– তুমি কি তাতে সুখী হবে?
– সুখী হবার জন্যই তো বিয়ে করতে চাচ্ছি।
– তাহলে সুখী হও, ভালো থেকো দোয়া করি। টাকাপয়সা যা লাগবে শরম লজ্জা ছেড়ে আমার কাছে চাইবে। ঠিকাছে বাবা?
– হ্যাঁ।
– গুড বাই।
– বাই।
ইমরান মোল্লা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বললেন, এখন যদি একটা গতি টতি হয়। আধা বখে যাওয়া ছেলে যদি এখন ভালো হয় তাহলে খারাপ কোথায় আর!
হেমলতা বাসের জানালার ধারের সিটে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। পনেরো মিনিট হবে বাস ছেড়েছে। মিম্মাকে ফোন করে সব জানিয়ে এসেছে। মাস গেলে নিচতলার ভাড়াটা সে উঠিয়ে বিকাশ করে দিবে। আর দোতালাটা আপাতত ফাঁকাই থাকুক৷ রওনা হয়েছে খবরটা জাদিদকে জানানোটা দরকার না?
ভাবতে ভাবতেই জাদিদের কাছ থেকেই ফোন আসলো।
– হেম, কোথায় এখন?
– বাসে।
– কটার বাসে উঠেছো?
– আটটার।
– সাবধানে এসো আর গাবতলীর আগে থাকতেই আমাকে ফোন দিয়ে জানাবে। আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
– আচ্ছা।
– কিছু খেয়েছো?
– হ্যাঁ।
– একটা কাজ করো। কন্ডাকটর এর নাম্বার টা আমাকে জোগাড় করে দাও।
হেমলতা কন্ডাকটরের নাম্বার জাদিদকে জোগাড় করে দিলো।
জাদিদ কন্ডাকটরের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
হেম বাসের জানালা দিয়ে তাকিয়ে সবকিছুর পেছন দিকে চলে যাওয়া দেখছে। কে জানতো কাউয়ার বাসার মতো চুলওয়ালা, অসম্ভব সুন্দর ছেলেটার কাছেই তাকে বাঁচার জন্য যেতে হবে?
যে ছেলেটাকে সে একবার হারিয়ে ফেলেছিলো আজ সেই ছেলেটাকেই সে বিয়ে করতে যাচ্ছে। সংসার করবে, বাচ্চা হবে তারপর….
জাদিদ বারান্দায় এক মগ কফি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে তার৷ এতোটা আনন্দ তার ফিজিক্সের ম্যাথ সলভ করেও হতো না। হেমলতাকে পেয়েও সে যেন হারিয়ে ফেলেছিলো। চিরদিনের জন্য হেম তার হয়ে যাবে । ভাবতেও পারেনি সে! হাবাগোবা নাক বোঁচা মেয়েটার সাথেই সংসার জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। জীবনের প্রথম প্রেম, ভালোবাসা নিয়েই সে তার জীবন কাটাবে। এটা কি কম?
জাদিদ তৃপ্তির হাসি মুখে এনে বিরবির করে বলল
– আমার লাজুকলতা আমারই। আর কারোরই না সে!
সমাপ্ত
~ Maria Kabir

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে