ডুমুরের ফুল ৩৫.
বাসায় এসে লাঈলী বানুর হাতে বাজারের ব্যাগ দিয়ে নানীর রুমে গেলো হেম। মিসেস জয়নাব তেমন একটা চলাফেরা করতে পারেননা। মেজর ব্রেইন স্ট্রোক করার পর এক সাইড প্যারালাইজড হয়ে গেছিলো। অনেক ট্রিটমেন্ট এর পরে কিছুটা ঠিক হয়েছে। একজনের সাহায্য ছাড়া বিছানায় উঠে বসতেও কষ্ট হয় তার।
মিসেস জয়নাব বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় তছবী পড়তেছিলেন। হেমলতাকে দেখে বললেন
– এক কাপ চা খাওয়াইতে পারবি?
হেম মাথা নাড়িয়ে হা জানিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল এক্সামটা তার দেয়া হয়নি। অনেক জোরাজোরি করে মনিরের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ফর্ম ফিলাপ করেছিল কিন্তু এক্সামটা আর দেয়া হয়নি। ওর সাথের সবাই থার্ড ইয়ারের ক্লাস করছে এখন।
চায়ের কাপে এক চামচ চিনি দিয়ে আরেক চামচ দেয়ার আগেই কলিং বেল বাজলো। লাঈলী বানু মুখ বেজার করে বললেন
– এই অসময়ে কে এলো?
হেমলতা দরজা খুলে অবাক হলো। মিম্মার সাথে অনেক দিন কথা হয়না। মনির মিম্মার সাথে কথা বলা পছন্দ করতোনা। কারণ হিসেবে বলেছিল, মিম্মা নাকি তাকে খারাপ বুদ্ধি দেয়।
মিম্মা বিরক্ত হয়ে বলল
– কীরে এভাবে দাড় করায় রাখবি নাকি?
হেমলতা সড়ে দাঁড়াতেই মিম্মা ভেতরে ঢুকলো। হেমলতা দরজা আটকে দিতে দিতে বলল
– কেমন আছিস?
মিম্মা সোফায় ধুপ করে বসে বলল
– এইতো আছি। তোর খবর কী?
– এইতো আছি।
হেমলতার হাত টেনে ধরে পাশে বসিয়ে মিম্মা বলল
– এতোদিন হয়ে গেছে এসেছিস একটাবার কি আমাকে ডেকে পাঠাতে পারলিনা?
– নিশ্চুপ
লাঈলী বানু রান্নাঘর থেকে চেচিয়ে বললেন
-বলি চা’টা যে ঠান্ডা হচ্ছে। বুড়ো মানুষকে ঠান্ডা চা খাওয়াবা নাকি?
হেমলতা উঠতে যাচ্ছিল মিম্মা হাত ধরে টেনে বলল
– ওনাকে ঠান্ডা চা খাওয়ানোই দরকার। তুই এখানে বস।
হেমলতা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল তখন মিম্মা আবার প্রশ্ন করল
– ডিভোর্স দিল ক্যান তোরে? কী এমন করছিলি?
হেমলতা মাথা নিচু করে বলল
– চরিত্রহীনা, অকর্মা বউ কে চায় বল?
মিম্মা রাগ কন্ট্রোল করে বলল
– ফাজলামি মার্কা কথা বলবি না। যা হইছে সেটাই বলবি।
হেমলতা ধীর স্বরে বলল
– তোর মনে আছে জাদিদের বাসায় আমরা তিনজন বেড়াতে গেছিলাম ঢাবির এডমিশন টেস্ট দিয়ে?
– হ্যাঁ, কেনো?
– ওর পাশের ফ্ল্যাটে আমার দূর সম্পর্কের মামা শ্বশুর থাকতেন। তিনি আমাকে জাদিদের সাথে ছাদে দেখেছিলেন। জাদিদের হাত ধরে আমি দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামা দেখছিলাম। আমার তখন আশেপাশের কোনো খেয়াল ছিলোনা।
আমার বিয়েতে উনি আসতে পারেননি ব্যস্ততার কারণে। ছয় থেকে সাত মাস আগে ফরিদপুরে একটা কাজে আসেন। এসে আমার শ্বশুর বাড়িতে উঠেন। তখন আমাকে দেখেন। তখন অবশ্য উনি তেমন কিছু বলেননি। পরে আমার শ্বাশুড়ির কাছে উনি জানান। শ্বাশুড়ি আম্মা মনিরকে জানায়। তারপর মনির আমাকে অনেক টর্চার করতে শুরু করে। আগে তো মানসিকভাবে টর্চার করতো তখন গায়ে হাত দেয়া শুরু করলো। আমি নাকি বিয়ের আগে অনেক ছেলেদের সাথে শুয়েছি। জাদিদকে নিয়েও আজেবাজে কথা বলতে শুরু করলো। জাদিদ আর যাই করুক কখনো শারীরিক সম্পর্কে যাবার কথা ভুলেও বলে নাই। আমি মনিরকে অনেক বুঝালাম।
মিম্মা বলল
– তোর জাদিদের সাথে প্রেম ছিলো বলেছিলি মনির ভাইকে?
– হ্যাঁ। আমি সবকিছু ক্লিয়ার করেছিলাম ওর মামার কথার প্রেক্ষিতে। কিন্তু হলো উল্টোটা। শ্বাশুড়ি আম্মা, ননদ আর মনির মিলে শুরু করলো আরেক ধরনের অত্যাচার। ননদ উঠতে বসতে খোঁচা দিয়ে বলে, বিয়ের আগে নোংরামি করে বেড়িয়েছে আর এখানে এসে ভালোগীরি করে।
শ্বাশুড়ি আম্মার তো মুখে খই ফুটতে শুরু করলো। আমার সেকেন্ড ইয়ার এক্সাম দিতে দিলোনা। কারণ ছিল, আমি নাকি পড়াশোনা করে তার ছেলেকেই পল্টি দিবো।
হেমলতা ডানপাশের কামিজের ঘাড়ের দিক থেকে একটু সড়িয়ে মিম্মাকে দেখিয়ে বলল
– দ্যাখ এখানে একবার। মনির এখানে জ্বলন্ত মশার কয়েল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ আমি জাদিদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, জাদিদ ওই টাইপের ছেলে না যে বিয়ের আগে শুবে মেয়েদের সাথে।
মিম্মা চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ঘাড়ের থেকে একটু নিচে খানিকটা জায়গায় বিশ্রী ক্ষত।
হেমলতা কান্না আটকে রাখতে না পেরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলতে লাগলো
– যে জাদিদ একটা ধমক দিয়ে হাজারবার সরি বলতো সেই জাদিদ আমাকে জীবনে একটা ফুলের টোকাও দেয়নি। সেই জাদিদের পক্ষ আমি নিবো না তো কে নিবে?
বিশ্বাস কর মিম্মা আমি চলে আসতাম না। আমার ছোট ননদটার বার্থডে পার্টি ছিলো। সবাই সাজগোজ করে এসেছে তাই আমিও ভাবলাম একটু সাজগোজ করি। শাড়ী পড়লাম সাজগোজ করলাম। পার্টিতে ননদের ছেলে ফ্রেন্ড আমাকে সুন্দর লাগছে বলেছিল। সেই রেশ ধরে কথা কাটাকাটি হলো। স্টোর রুমে রডের দুই হাত সমান টুকরা ছিলো। সেই রডের টুকরা দিয়ে এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। আমার ননদ এসে মনিরকে জাপটে ধরে থামানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য কোনোমতে মেইন দরজা খুলে দৌঁড়াতে লাগলাম। আমার তখন মাথায় কিছুই কাজ করতে ছিলনা। আমার মাথায় শুধু ঘুরছিল বায়তুলামান পৌঁছাতে হবে। এখানে মেইন গেটে পা দিয়ে আমার আর কিছু মনে নেই৷ জ্ঞান যখন হলো তখন নানীর কাছে জানতে পারলাম। আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন এসেছিল। তারা বলে গেছে, আমার নাকি জাদিদের সাথে মাখামাখি সম্পর্ক। যেই জাদিদের চেহারা পর্যন্ত ভুলে গেছি, যার সাথে লাস্ট কবে দেখা হয়েছিল ভুলে গেছি তাকে নিয়ে আজেবাজে কথা কীভাবে এরা বলে?
আমিই ডিভোর্স পেপার পাঠালাম। আমি আর দ্বিতীয় বার ভাবিনি। দিলাম ডিভোর্স পেপারে সাইন করে। কীসের মায়ায় আমি ওই সংসারে যাবো? বিয়ে হবার পর থেকে ইনিয়েবিনিয়ে শ্বশুর, শ্বাশুড়ির অনেক কথা শুনতে হয়েছে। মা ছাড়া বড় হওয়া মেয়ের সাংসারিক কাজ না জানারই কথা। আমি প্রথমদিকে মেনে নিতে পারিনি কিন্তু আস্তে আস্তে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু মনির তার মায়ের, বোনের কথায় আমার কথা না শুনে অনেক টর্চার করেছে। আমি সেটাও মুখ বুজে সহ্য করেছি। কিন্তু আমার চরিত্র নিয়ে, জাদিদকে নিয়ে বলেও তারা……
মিম্মা কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। হেমলতার সাথে এতো বাজে কিছু ঘটতে পারে সে কল্পনাও করেনি।
জাদিদের সাথে ওর সম্পর্ক আবার হবে কীভাবে? জাদিদ তো হেমলতার বিয়ের পরে আর ফরিদপুরেই পা রাখেনি।
জাদিদ কমলাপুর রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে ট্রেনে যাত্রীদের ওঠানামা দেখছিল। পেছন থেকে শাহীন বলল
– কীরে কোথাও যাবি টাবি নাকি?
জাদিদ শুকনো হাসি ফিরিয়ে দিয়ে বলল
– না।
– তাহলে এখানে কী করিস? কেউ আসবে নাকি?
– না। এমনি দাড়িয়ে আছি।
– তাহলে চল টিএসসিতে একটু ঢু মেরে আসি।
– নারে বাসায় যাবো। অনেক খুদা লাগছে।
– চল আজকে তোকে ট্রিট দেই আমি।
জাদিদ বলল
– আমার বাসায় চল একসাথে রাতে খাওয়া দাওয়াও হবে আর পড়াশোনা নিয়েও আলোচনা হবে।
শাহীন এক গাল হেসে বলল
– চল।
চলবে……
” লেখিকা মারিয়া কবির এর সকল লেখা দ্রুত পেতে অবশ্যই এ্যাড হোন তার ফেসবুক পেইজ ‘Maria Kabir -মারিয়া কবির’(এখানে পেইজ লিংক) এর সাথে।